সম্পাদকীয়
এনআরসি ডেকে আনছে সভ্যতার সংকট

মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাংলায়ও এনআরসি হবে। সেটা করতে বিজেপি-র ২০২১-এ ক্ষমতায় আসা প্রয়োজন। ওপর থেকে এই প্রচার যে কোনো উপলক্ষে শুরু করে দিয়েছে বিজেপি-র রাজ্য নেতৃত্ব। সঙ্গে চলছে নিচের তলায় আরএসএস-এর প্রচার। সঙ্ঘ পরিবার নামিয়েছে তার সমস্ত শাখা সংগঠনগুলোকে। এই প্রচার প্রধানত চালানো হচ্ছে প্রতিবেশী রাজ্য অসম এবং বাংলাদেশ লাগোয়া জেলাগুলোতে। বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে রয়েছে মুসলিম প্রধান জেলাগুলো । তবে নিশানা থেকে রাজ্যের কোনো জেলা বাদ নেই, কলকাতা শহরও রয়েছে। অসমে লক্ষ লক্ষ মানুষের এনআরসি-র কোপে পড়ার খবরে এরাজ্যের জনমানসে পড়েছে একটা ভীতিবহুল প্রভাব। ভয়ের শিকার হওয়া জনসংখ্যা কম নয়। নাগরিকের কোনো-না-কোনো প্রমাণপত্র জোগাড়ের তাড়নায় তাদের অবস্থা যেন ত্রাহি ত্রাহি। নথি খুঁজতে নাজেহাল হচ্ছেন। উপায়ন্তর না দেখে ঘটছে পরের পর অসুস্থ হয়ে মৃত্যু বা আত্মহত্যার ঘটনা।

২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রিজিজু শুনিয়েছিলেন ভারতে ‘বিদেশী অনুপ্রবেশকারী’র সংখ্যা নাকি ২ কোটি! তার মধ্যে অসমে ৫০ লক্ষ! তবে কোন গণনার ভিত্তিতে এই সংখ্যাগত দাবি, তার কোনো শ্বেতপত্র তখন কিন্তু মোদী সরকার প্রকাশ করেনি। শেষবার জনগণনা হয় ২০১১ সালে কেন্দ্রে কংগ্রেস আমলে। তখনও ‘বিদেশী অনুপ্রবেশকারী’র কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নিরূপিত হয়নি। এটা পরবর্তীতে মোদী জমানায় তৈরি করা আনুমানিক পরিসংখ্যান এবং এই পদ্ধতি ও সংখ্যাগত ধারণা করে নেওয়ার সাথে বিরোধী শক্তিগুলো সহমত থাকেনি। আসু, অগপ-র অবস্থান তো বরাবর আরও ভয়ানক সংকীর্ণ, বিজেপির হিসেবের চেয়ে আরও ব্যাপক অ-অসমীয়া ও বাংলাদেশী বিতাড়নের পক্ষে, এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। আসু-অগপ’র সাথে বিজেপি গোপন বোঝাপড়া করে নিয়েছে ব্যাপকতম মুসলিম বিতাড়ন নিশ্চিত করার শর্তে। যাই হোক, বিজেপি-র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রিজিজু বছর তিনেক আগে দাবি করেছিলেন গোটা দেশের ক্ষেত্রে বিদেশী ‘অনুপ্রবেশকারী’র অস্তিত্ব নাকি ২ কোটি! এখন বাংলার বিজেপি সভাপতি বলছেন এরাজ্যেই নাকি সংখ্যাটা ১-২ কোটি! দুটি দাবির মধ্যে জমিন-আসমান ফারাক। আর সবই ওপর থেকে একতরফা দাবি করা। এভাবে আগে থাকতে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রায় ২০ লক্ষ ৮০ হাজারের মতো গণস্বাক্ষর সম্বলিত আবেদপত্র জমা পড়েছিল, এনআরসি যদি একান্তই করতে হয় তাহলে যেন ত্রুটিমুক্তভাবে করা হয়। তবু প্রাথমিক তালিকায় বাদ পড়েছেন ১৯ লক্ষাধিক মানুষ। বাদ পড়াদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন ভাষাভাষী ও ধর্মের মানুষেরা। রয়েছেন ১ লক্ষের কম-বেশি গোর্খা জনতা। গোর্খা জনতার এক সমন্বয় সংস্থা জানিয়েছে তাদের কেউ ফরেইনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করবে না। তাদের লড়াই এরকম ব্যাপক বহিষ্কারের উদ্দেশ্যে এনআরসি লাগু করার বিরুদ্ধে, তারা যাবেন আদালতে, আইনি লড়াই লড়তে।

এনআরসি-র ফলশ্রুতিতে অসমে বিজেপিও পড়েছে সংকটে। উদ্দেশ্য ছিল ব্যাপকতম মুসলিম উচ্ছেদ, কিন্তু পঞ্জীতালিকা চূড়ান্তকরণের পর দেখা গেল ছেঁটে যাওয়া বৃহদাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের। বিশেষত এই বৈপরীত্যের সংঘাত থেকে নিষ্ক্রমণের ব্যাপারে তথা হিন্দুমুখী পঞ্জীকরণের ও বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে হিন্দুদের পুনর্বাসন প্রদানের সামগ্রিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য বিজেপি মুখিয়ে। তার জন্য তার ঝোলায় রয়েছে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব)’, যা সুবিধামতো কাজে লাগানোর অপেক্ষায় বিজেপি স্রেফ দিন গুণছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল, এনআরসি-র ফলাফল অসমের মানবজীবনে অস্থিরতা, নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা, অন্তরীণ হয়ে থাকা, পরিবার- ভিটেমাটি-জীবিকা হারানো এক মহাসংকট ডেকে এনেছে। এককথায় নজীরবিহীন চূড়ান্ত অমানবিক সংকটে দীর্ণ হচ্ছে অসম। পশ্চিমবঙ্গ থেকে অসমে স্থানান্তরিত হওয়া মানুষ, সে তো দেশের মধ্যেই এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাওয়ার মতোই। এর সাদৃশ্য তো বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সহাবস্থানের মধ্যেই রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার অসমে বিশাল সংখ্যায় ‘অনুপ্রবেশের’ অভিযোগ মানতে রাজি নয়। তবু এইসব খতিয়ে দেখার সমস্যা যদি মেটাতে হয় তবে সঙ্গত একমাত্র রাস্তা হল আলোচনার মাধ্যমে মেটানো। বহিষ্কার কোনো মানবিক সমাধান নয়। চার দশক আগে অসমীয়া জনতা আত্মপরিচয় সংকটে পীড়িত হোত ঠিকই। কিন্তু তারপর তো শক্তিশালী অসমিয়া জাতিসত্তার আন্দোলন থেকে শুরু করে আরও অনেক ছোট-মাঝারি জাতিসত্তার আন্দোলনের বহু ঝড়-জল বয়ে গেছে। তার ফলে বিভিন্ন জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের সামনে আজও ‘বিদেশী’ অনুপ্রবেশের’ সমস্যা আগের মতোই ব্যাপক বিতাড়নের সমস্যা হিসেবে একইভাবে অনুভূত থাকে কি করে? ভুললে চলে না অসমে নয়া আর্থিক নীতির চাপ তথা কর্পোরেট পুঁজি এবং সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ ও রাজনীতির অনুপ্রবেশও বেড়েছে। এইসমস্ত আক্রমণ তো কাউকে ছেড়ে রাখছে না। তাহলে নাগরিক পঞ্জীকরণের নামে ‘বিতাড়ন’ বিষয়টি আজও কেন অসমে অগ্রাধিকারে থাকবে?

আর, পশ্চিমবাংলায় এনআরসি-র প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? দেশভাগের পর ওপার বাংলা থেকে যাইই উদ্বাস্তু স্রোত এসেছে তা এ রাজ্যের অর্থনীতিতে প্রাথমিকভাবে কিছু চাপ সৃষ্টি করেছিল ঠিকই। কিন্তু দ্রুতই তা সম্পদে পরিবর্তিত হতে থাকে। বৃহত্তর বসত এলাকা নির্মাণ, অধিকার প্রতিষ্ঠা, আন্দোলন, আত্তিকরণ, মানবসম্পদ সৃষ্টি এরাজ্যের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে প্রভূত পরিবর্তন। বহতা নদীর মতোই চলছে এই সবকিছু। পক্ষান্তরে, ‘বাংলাদেশী মুসলিমদের ব্যাপক অনুপ্রবেশের তত্ত্ব ও রাজনীতি’ ছড়ানো হচ্ছে হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে। তার জন্য রসদ হিসেবে ব্যবহার করা হয় কখনও সীমান্তবর্তী কিছু কিছু মুসলিম ধরপাকড়ের ঘটনাকে। এরকম সমস্যা বিশ্বের যে কোনো গোলার্ধে হামেশা ঘটে থাকে, সদিচ্ছা থাকলে মীমাংসাও করা সম্ভব। সুতরাং বাংলায় এনআরসি নামানোর জুজু দেখানো মানে নজিরবিহীন এক বদ মতলব। বিতাড়নের ভয় দেখিয়ে রাজনীতির বাজারে কাঁপুনি ধরিয়ে রাখা।

উপসংহারের পরিবর্তেযে প্রশ্নটি না তুললেই নয় সেটি তোলা প্রয়োজন। সঠিক নাগরিকত্ব নির্ণয়ের জন্য ইতিপূর্বেই চালু হয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। যেমন, প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনা। তারপর শুরু হয়েছে সচিত্র ভোটারপত্র। এতেই নিঃসংশয় হওয়া যায়। তারপরেও মোদী সরকার ক্ষমতায় এসে নামিয়েছে আধার পঞ্জীকরণ। কোনো যুক্তি নেই। তবু গোঁ ধরে আছে। মামলা গড়িয়েছে আদালতে। সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছে এক মধ্যপন্থী রায়, ‘আধার’ আবশ্যিক নয়, ঐচ্ছিক! কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের নাকের ডগায় ‘আধার’কে করে তোলা হচ্ছে আবশ্যিক! তারপরেও প্রকৃত নাগরিকত্ব নির্ণয়ের অজুহাতে উপরন্তু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এনআরসি! কিন্তু বারবার এ জাতীয় হয়রানি, নির্যাতন, বে-নাগরিক করে দেওয়ার পরিণাম ভোগ করতে হবে কেন? নাগরিকত্বের অধিকার এক জন্মগত অধিকার। জীবন বেড়ে চলার সাথে সাথে নাগরিক মানুষ দেশের মধ্যে এখান থেকে সেখানে তো স্থানান্তরিত হওয়া তো বটেই, দেশকালের সীমানাও অতিক্রম করে যেতে পারে, গিয়েও থাকে, অবার ফিরেও আসতে পারে। সরকারপক্ষের দিক থেকে অবশ্যই ভারসাম্য রক্ষার দাবিও যুক্তিসঙ্গত, তবে মুক্ত থাকতে হয় পক্ষপাতদুষ্টতা থেকেও। আধুনিক সভ্যজগতে নাগরিকত্ব প্রদানের বহু রকমের রীতিনীতি চালু রয়েছে। কোনও অজুহাতে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া বা বে-নাগরিক করে দেওয়ার মধ্যে যুক্তিবাদের পরিচয় মেলেনা, তা তৈরি করে সভ্যতার সংকট।

খণ্ড-26
সংখ্যা-31