“সাভারকরকে নাকি মরণোত্তর ভারতরত্ন দেওয়া হচ্ছে? কিন্তু সেলুলার জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য উনি কি ব্রিটিশ গভমেন্টকে চার চার বার মুচলেকাপত্র লেখেননি? নাকি আমিই ইতিহাসের কিছু জানিনা! এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম...” টুইট করে একথা লেখেন অপর্ণা সেন। উত্তরে কেউ কেউ জানায় যে চার বার নয়, অন্তত ছয় বার ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেছিল এই সাভারকার মহাশয় এবং ছাড়া পেয়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ষাট টাকা মাসোহারা পেত। পৃথিবীর কোনও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ঔপনিবেশিক প্রভুদের কাছে এভাবে এ ভাষায় উপর্যুপরি ক্ষমাপ্রার্থনার নজিরও আর নাই বলে জানান অনেকে।
ইতিহাস উল্টে দিতে চাইছে ওরা। আধুনিক স্বাধীন ভারত গড়ার সংগ্রামে আরএসএস-এর গদ্দারি ও অন্তর্ঘাতের কলঙ্কজনক বাস্তবতা মুছে দিয়ে মিথ্যার স্বর্গরাজ্য বানাতে মরিয়া বিজেপি-আরএসএস। সম্প্রতি গুজরাটে স্কুলগুলির ইতিহাস পরীক্ষায় প্রশ্ন দেওয়া হয়েছিল : “গান্ধীজি আত্মহত্যা কেন করেছিলেন?” বস্তুত গান্ধী হত্যাকে আরএসএস-বিজেপি এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে সমর্থন করতে পারেনি। অন্যদিকে আবার গান্ধীকে যে হত্যা করেছিল সেই নাথুরাম গোডসে-কে মহিমান্বিত করা থেকেও সরে আসতে পারেনি। এবং ঘটনা হল গান্ধীহত্যা মামলায় নাথুরাম গোডসের সাথে সাভারকার মহাশয়ও ছিলেন অন্যতম আসামী, প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে যাকে শেষ পর্যন্ত রেহাই দেওয়া হয়েছিল।
কম বয়সে স্বদেশী বিপ্লবীদের দলে ভিড়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে চালান হয়েছিলেন সাভারকার। কেউ কেউ বলেন বাকি জীবন নির্বাসনে কাটানোর বদলে ব্রিটিশ সরকারের হাত-পা ধরে উনি যদি বেরিয়েও এসে থাকেন তাহলে তা এমন কি দোষের, উনি তো দেশের কাজ করতেই ছাড়া পেতে চেয়েছিলেন! কিন্তু উপুর্যপরি লেখা মুচলেকাপত্রগুলিতে উনি যে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আর কোনওরকম আন্দোলন না করার কথা, ব্রিটিশ সরকারকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করার কথা লিখেছিলেন সেগুলি নিছক সাময়িক কৌশল যে ছিলনা তা তার বাকি জীবনের প্রতিটি কাজের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ হয়। সেসবের মধ্যে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তাঁর ন্যক্বারজনক ভূমিকা বিশেষ সমালোচিত।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন, যা আগস্ট ক্রান্তি নামেও পরিচিত, ছিল দেশব্যাপী এক আইন অমান্য আন্দোলন। এম কে গান্ধী গোয়ালিয়া ট্যাংক ময়দানের ১৯৪২-এর ৮ আগস্ট “ভারত ছাড়ো” বক্তৃতায় “করব অথবা মরব” ডাক দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী ৯ আগস্ট থেকে এই আন্দোলন শুরু হওয়ার কথা ছিল (সেই সময় থেকেই ৯ আগস্ট দিনটি আগস্ট ক্রান্তি দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়)। ব্রিটিশরা এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ৮ তারিখেই গণআটক শুরু করে। ১০০,০০০ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়, এদের মধ্যে গান্ধী সহ কংগ্রেসের সব বড় নেতারা ছিলেন। গণ হারে জরিমানা চাপানো হয় এবং প্রতিবাদীদের প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। কয়েকশ মানুষ এই ঘটনায় মারা যান, পুলিশ এবং সেনা বহু লোককে গুলি করে। বহু রাষ্ট্রীয় নেতা আত্মগোপন করেন এবং চোরাগোপ্তা রেডিও স্টেশনে খবর সম্প্রচার করতে থাকেন। পুস্তিকা বিলি করে, সমান্তরাল সরকার বানিয়ে নিজেদের লড়াই চালাতে থাকেন। প্রকাশ্যে তেরঙা উত্তোলনের অপরাধে অসংখ্য দেশভক্ত ভারতবাসীকে গুলি করে মারা হয়। এর আগেও মাইসোরে আরো একটি জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল। তেরঙ্গা পতাকাকে সেলাম করার অপরাধে ২২ জন কংগ্রেস কর্মীকে গুলি করে মারে মাইসোর রাজার সশস্ত্র সেনা। মাইসোরের এই রাজা ছিলেন হিন্দুমহাসভা ও আরএসএস-এর খুব কাছের লোক।
সারা দেশের মানুষ যখন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে জানমাল কবুল করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন সাভারকারের বাহিনী কী করছিল?
লক্ষণীয়ভাবে, কংগ্রেসকে দেশদ্রোহী এবং বেআইনি সংগঠন ঘোষণা করার পর, ব্রিটিশ প্রভুরা শুধুমাত্র হিন্দুমহাসভা এবং মুসলিম লীগকে সামনে তুলে আনে। এরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা তো করেই ছিল, সেই সাথে ব্রিটিশ প্রভুদের বহুমুখী ও বহুমাত্রিক সহায়তা করেছিল। এই ঐতিহাসিক গণ-উত্থানকে দমন করার জন্য ব্রিটিশের সাথে হাত মিলিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি “রেসপন্সিভ কোঅপারেশন” বা “সক্রিয় সহযোগিতা” নীতি ঘোষণা করেছিলেন।
১৯৪২ সালে কানপুরে হিন্দুমহাসভার ২৪তম অধিবেশনে, সাভারকর হিন্দুমহাসভার পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি করেন নিম্নলিখিত শব্দে :
“হিন্দুমহাসভা মনে করে যে সমস্ত ব্যাবহারিক রাজনীতির মূল কথা হল সক্রিয় সহযোগিতা। এবং এই নীতির কারণে সভা এই বিশ্বাসও রাখে যে যেসব হিন্দু সংগঠনকর্মী কাউন্সিলর, মন্ত্রী বা বিধায়ক হিসেবে কাজ করছেন এবং সার্বজনীন অথবা পৌর কাজে নিযুক্ত আছেন এবং এই ক্ষমতা ব্যবহার করছেন হিন্দুদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে ও এগিয়ে নিয়ে যেতে, অবশ্য অন্যদের স্বার্থে অনধিকার প্রবেশ না করে, তারা দেশের উচ্চতম দেশভক্তির কাজে নিযুক্ত আছেন ....
“সক্রিয় সহযোগিতার নীতি, যাতে নিঃশর্ত সহযোগিতা থেকে শুরু করে সক্রিয় এবং সশস্ত্র প্রতিরোধে অংশগ্রহণ পর্যন্ত সবরকম কার্যই বোঝায়, তা সময়ের প্রয়োজনে আমাদের সংসাধনের নিরিখে বদলাবে এবং আমাদের জাতীয় প্রয়োজনে ও আমাদের ইচ্ছানুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে” (ভি ডি সারভারকর, ‘সমগ্র সারভারকর ওয়াংমায়া : হিন্দু রাষ্ট্র দর্শন’, ভল্যুম ৬, মহারাষ্ট্র প্রান্তিক হিন্দু সভা, পুনা, ১৯৬৩, পৃ ৪৭৪ এ উদ্ধৃত)।
হিন্দুত্বের আরেক প্রতীক, ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি তখন ছিলেন বেঙ্গগল মুসলিম লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে উপমুখ্যমন্ত্রী। সাভারকারের ঘোষিত পথে তিনি বাংলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন দমনের ভার নিয়েছিলেন। হিন্দুমহাসভার নির্দেশে ব্রিটিশ সরকারকে সহায়তা করে, ব্রিটিশ প্রভুদের আশ্বাস প্রদান করে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন : “আমি এই প্রদেশে সৃষ্টি হওয়া পরিস্থিতির বিবরণ দিচ্ছি, যা কংগ্রেসের ব্যাপক আন্দোলনের কারণে তৈরি হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালীন কেউ যদি গণ-অনুভূতি জাগিয়ে তোলার পরিকল্পনা করে এবং ফলস্বরূপ আভ্যন্তরীণ ঝামেলা অথবা নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়, তবে তাকে সরকারের দ্বারা প্রতিহত করতে হবে।” (মুখার্জি, শ্যামাপ্রসাদ, “Leaves from a Diary”, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, পৃ: ১৭৯)। ডাঃ মুখার্জি হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের তরফ থেকে ব্রিটিশ গভর্নরের প্রতি একটি চিঠিতে পরিষ্কার করে দেন যে এই দুই পক্ষই কংগ্রেসের দ্বারা পরিচালিত ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিপক্ষে ব্রিটিশ প্রভুকে বাংলার ত্রাতা হিসেবে দেখে। গভর্নরকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক চিঠিতে তিনি লেখেন : “ভারতীয়রা ব্রিটিশদের ওপর বিশ্বাস করে, ব্রিটেনের স্বার্থের প্রয়োজনে নয়, ব্রিটিশদের কোনো সুবিধা হবে এই কারণে নয়, কিন্তু এই প্রদেশের প্রতিরক্ষা বজায় রাখার জন্য ও স্বাধীনতার জন্য।” (A G Noorani, ‘‘The RSS and the BJP: A Division of Labour”, LeftWord Books, পৃ: ৫৬-৭৬-এ উদ্ধৃত)।
যুদ্ধ চলাকালীন কেউ গণ-অনুভূতি জাগিয়ে তুললে তাকে সায়েস্তা করার যে হুঙ্কার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী দিয়েছিলেন এবং সাভারকার যে সশস্ত্র অংশগ্রহণ পর্যন্ত সক্রিয় সহযোগিতার নীতি ঘোষণা করেছিলেন তা যুদ্ধের দিনগুলিতে সত্যিই বাস্তবায়িত করেছিল হিন্দুমহাসভা।
সাভারকার সরাসরি বলেছিলেন যে যুদ্ধ যখন দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছে তখন হিন্দুদের তাকে সুযোগ হিসেবে নিতে হবে, ব্রিটিশ বাহিনীতে সব বিভাগেই ব্যাপকভাবে নাম লেখাতে হবে। শুধু ভাষণ নয়, কাজেও ঝাঁপিয়ে পড়েন সাভারকার। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে রীতিমতো রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প সংগঠিত করে ব্রিটিশ বাহিনীতে ‘হিন্দু’-দের নিয়োগ করতে থাকেন। এই রিক্রুটমেন্টের জন্য এমনকি একটি কেন্দ্রীয় বোর্ডও গঠন করে ফেলে হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস, যে বোর্ড ব্রিটিশ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে কাজ করবে। সাভারকারের এই উদ্যোগ আজাদ হিন্দ বাহিনীকে বিধ্বস্ত করতে ব্রিটিশদের অত্যন্ত সহায়ক হয়।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ বাহিনী যে কেবল ভারতের হিন্দু-মুসলমান-শিখ সহ সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে দেশের মানুষের সামনে হাজির হচ্ছিল তাই নয়, সেই বাহিনীতে লক্ষ্মী শেহগলের নেতৃত্বে চালিত সম্পূর্ণত মহিলা যোদ্ধা ও মহিলা অফিসারদের ‘ঝাঁসির রাণী ব্যাটেলিয়ন’ ছিল নারী-পুরুষ সম-মর্যাদায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অঙ্গীকার। বলা বাহুল্য জাত-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সম মর্যাদায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এই জাতীয় মুখচ্ছবিটি আরএসএস-এর সবর্ণ-হিন্দুত্ববাদী-পৌরুষের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ মেরুর। আরএসএস নিযুক্ত সেনাদের তাই আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া সহজ ছিল। উত্তর পূর্বাঞ্চলে পরাজিত আজাদ হিন্দ বাহিনীর যোদ্ধাদের অনেককে তারা হত্যা করেছিল। “দ্যা ইন্ডিয়ান আর্মি অ্যান্ড এন্ড অব রাজ” গ্রন্থে ড্যানিয়েল মর্সটন লিখছেন যে ব্রিটিশ অফিসাররা যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না যে বন্দী ও জখম আইএনএ জওয়ানদের নিয়ে তাঁরা কী করবেন তখন সাভারকারের ওইসব রিক্রুটরা কাজে এসেছিল। সহজেই তাদের বোঝাতে পারা গেছিল যে সুভাষ চন্দ্রের আইএনএ আসলে দেশদ্রোহী এবং এইভাবে বন্দী ও জখম আইএনএ জওয়ানদের হত্যা করাতে পেরেছিল।
“বীর” সারভারকরের এইসব নথি হিন্দু মহাসভার সংরক্ষণাগারেই রয়েছে। সাভারকরকে ভারতরত্ন দেওয়া হলে সেই হাজার হাজার শহীদ এবং ব্রিটিশ সরকারের শিকার হওয়া ভারতীয়দের নির্লজ্জভাবে কালিমালিপ্ত করা হবে। কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি কি এরকমটা হতে দিতে পারে?