একই মঞ্চে মিলিত হলেন দুই ফ্যাসিস্ট, মোদী ও ট্রাম্প

প্রধানমন্ত্রী মোদীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় তাঁর জনসভায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের উপস্থিতি এই দুই চরম-দক্ষিণপন্থী, ফ্যাসিস্ট রাজনীতিবিদের মতাদর্শগত নৈকট্যকেই সামনে এনেছিল। হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদের প্রবক্তা আরএসএস-এর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের সদস্যরা যে ‘হাউডি মোদী’ জনসভার আয়োজন করে তা ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের সভাও হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত, ট্রাম্প ২০২০ সালে আবার নির্বাচনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। মোদী ট্রাম্পকে “প্রার্থী ট্রাম্প” বলে সম্বোধন করেন এবং ট্রাম্পের প্রচারের সমর্থনে শ্লোগান দেন “আবকি বার ট্রাম্প সরকার”। এই শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে তিনি কার্যত আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের কাছে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। এইভাবে তিনিই হয়ে উঠলেন কোন দেশের নির্বাচিত নেতা যিনি সর্বপ্রথম বিদেশের নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর সমর্থনে প্রচার চালালেন।

সেদিনের সভায়মোদী তাঁর ভাষণে ভারতের ভাষা, ধর্মীয়, খাদ্য বৈচিত্র্যের কথা বলেন যা এক পরিহাস হয়ে ওঠে, কেননা এই বৈচিত্র্যের বিরুদ্ধে নিজের দেশে ভারতে তিনি, তাঁর সরকার ও সংঘ পরিবার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে! তিনি দাবি করলেন, “কাশ্মীরের জনগণ যাতে অবশিষ্ট ভারতের জনগণের মতো সমান অধিকার পায়” তা সুনিশ্চিত করার জন্যই তাঁর সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করেছে। কাশ্মীর এখন যে একটা কারাগার, সমস্ত ধরনের সংযোগ, সচলতা, রাজনৈতিক কার্যকলাপ, প্রতিবাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং সেখানকার জনগণকে বেআইনি গ্ৰেপ্তারি ও অত্যাচার ভোগ করতে হচ্ছে, সে কথা মাথায়রাখলে এই দাবি আমাদের বিস্ময়বিমূঢ় করে।

গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র্য নিয়ে মোদীর দাবির কপটতা সেদিনের অনুষ্ঠানেই উন্মোচিত হয়ে যায়। অনুষ্ঠানের সংগঠকরা ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান কৌতুকাভিনেতা হাসান মিনহাজকে এই যুক্তিতে ঐ সভায় অংশ নিতে দেননি যে, তাঁর উপস্থাপিত অনুষ্ঠানগুলো মোদীর সমালোচনা করে থাকে। কিন্তু মিনহাজকে সভাকক্ষে প্রবেশ করতে না দেওয়া হলেও ঐ কক্ষেরই এক বড় পর্দায় প্রদর্শিত বেশ কয়েকজন সফল ভারতীয় আমেরিকানের মধ্যে মিনহাজের ছবিও শোভা পাচ্ছিল! বৈচিত্র্যের প্রতীক হিসাবে মিনহাজের ছবি প্রদর্শিত হলেও মোদী এবং বিজেপির সমালোচনার কারণে মিনহাজ নিজেই সভাকক্ষে ঢুকতে বাধাপ্রাপ্ত হন। একইভাবে মোদী বিদেশে দায়সারা ভাবে ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র্যের উল্লেখ করলেও দেশে সেগুলোর উপর আক্রমণ চালান।

সেদিনের অনুষ্ঠানে ট্রাম্প তাঁর ভাষণে “সীমান্ত নিরাপত্তা” নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন – ভারত এবং আমেরিকা উভয়েই যে উদ্বেগের শরিক। ঐ উদ্বেগ প্রকাশে তিনি ব্যবহার করেন “অবৈধ অভিবাসীদের” বিরুদ্ধে “সীমান্ত প্রাচীর” গড়া নিয়ে তাঁর নিজস্ব নির্বাচনী ঘৃণার বুলি যা বিদেশী ভীতি থেকে উদ্ভূত। এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে বিজেপির দুরভিসন্ধিমূলক এনআরসি প্রকল্পের প্রতি অনুমোদন যা ভারতে লক্ষ – লক্ষ মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে তোলার উপক্রম করছে।

মোদী হাউস্টনে ভারতে “সবকিছুই ভালো চলছে” বলে যে দাবি করেন তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ভারতে অর্থনীতি গভীর সংকটে নিমজ্জিত, যার জন্য সম্পূর্ণতই দায়ী মোদী অনুসৃত নীতিসমূহ।

হাউস্টনে এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায়তাঁর ভাষণে মোদী প্রকাশ্যে মলত্যাগের বিরুদ্ধে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের তথাকথিত সাফল্য নিয়ে বড়াই করেন। এই প্রকল্পের তথাকথিত সাফল্যের জন্য গেটস ফাউণ্ডেশন তাঁকে একটি পুরস্কারও দেয়। এই প্রকল্প নিয়ে যে বাড়াবাড়ি হচ্ছে তার পিছনে ভয়াবহ বাস্তবতাটা হল এই প্রকল্পকে অছিলা করে উচ্ছৃঙ্খল জনতা সংখ্যালঘু এবং দলিতদের গণপ্রহার দিতে প্ররোচিত হচ্ছে, আর ভূগর্ভস্থ নর্দমা পরিস্কার করতে গিয়ে দলিত সাফাই কর্মীরা মারা যাচ্ছে। এই সেদিনই প্রকাশ্য স্থানে মলত্যাগকে ছুতো করে মধ্যপ্রদেশে এক জনতা দুই দলিত শিশুকে হত্যা করে।

এক তাঁবেদার ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের সহায়তায় মোদী ও বিজেপি এই দাবিকে চালানোর চেষ্টা করে যে, মোদীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং জনসভায়তাঁর প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন মোদীকে এক বিশিষ্ট রাষ্ট্রনায়ক রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কাশ্মীর এবং পাকিস্তান নিয়ে ভারত সরকারের অবস্থানও সমর্থন লাভ করেছে। ট্রাম্প কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সঙ্গে নিয়েও একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন, যাতে তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার আবেদন জানান, কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন এবং পাকিস্তানই সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় উৎস বলে ভারত যে দাবি করে থাকে তাকে অনুমোদন করতে দ্ব্যর্থহীন ভাবে অস্বীকার করেন। অন্যভাবে বললে, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে পাকিস্তানের সংযোগ এবং কাশ্মীর ভারতের “অভ্যন্তরীণ বিষয়” সম্পর্কে মোদী ও ভারত সরকার বিবৃতি আখ্যান থেকে তিনি নিজেকে সুস্পষ্ট রূপে দূরে রাখেন।

মোদী এবং খানকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করার সময় ট্রাম্প ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই ধামাধরা সাংবাদিকদের প্রশংসা করেন। আমেরিকার যে সমস্ত সাংবাদিক ট্রাম্পের নীতিগুলো নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন তুলে তাঁদের কর্তব্য করে যান, তাঁদের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক বৈরিমূলক বলেই সবাই জানে। কাজেই ভারতীয় ও পাকিস্তানি সাংবাদিকদের প্রতি ট্রাম্পের প্রশস্তি বোঝাচ্ছে যে ঐ সমস্ত সাংবাদিক নিজেদের পেশার কলঙ্ক।

রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় মোদী কাশ্মীরের বন্দিত্ব নিয়ে লজ্জাজনকভাবে নীবর থাকেন। তবে তিনি যদি এই আশা করে থাকেন যে তাঁর নীরবতা কাশ্মীর নিয়ে বিশ্বের জনগণের আলোচনাকে থামিয়ে দিতে পারবে, সেই আশা অবশ্যই ভুল ছিল। বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দই শুধু (চীন, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, তুরস্কের) কাশ্মীর নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। রাষ্ট্রপুঞ্জ ভবনের বাইরে কাশ্মীরের প্রতি সংহতি জানিয়ে এক বিশাল প্রতিবাদ বিক্ষোব সংগঠিত হয়। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাউস্টন এবং অন্যান্য স্থানেও কাশ্মীরের প্রতি সংহতি জানিয়ে জোরালো বিক্ষোভ সংগঠিত হয় যা মোদী এবং ট্রাম্পের রাজনীতির মধ্যে মিলকে সামনে নিয়ে আসে : সংঘের হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদের চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতি এবং ট্রাম্প যে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন তার মধ্যে মিল।

মোদীর মার্কিন সফল তাঁকে “বিশিষ্ট বিশ্ব নেতা” রূপে প্রতিষ্ঠিত করেনি, এই সফর বিশ্বের একনায়ক, স্বেচ্ছাচারী ও ফ্যাসিস্ট শাসকদের মধ্যেই তাঁর স্থানকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ অক্টোবর ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-32