মধ্যরাতে বাড়িতে হানা দিয়ে সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা রাজ্যের গণতন্ত্রের পক্ষে এক বিপদ সংকেত। দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষকে যখন বিজেপির ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে পদে পদে লড়তে হচ্ছে তখন পশ্চিমবঙ্গের একটি অ-বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে এই স্বৈরতান্ত্রিক অসহিষ্ণু হামলা নেমে এল। মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে বিজেপি বিরোধী লড়ায়ের মুখ হিসেবে তুলে ধরতে চাইলেও আসলে যে তিনি বিজেপির পদাঙ্ক অনুসরণ করে যে কোনও বিরোধী কণ্ঠস্বরকে পুলিশ দিয়ে দমন করার স্বৈরাচারী পথেই চলছেন, তা এই ঘটনা থেকে প্রকাশ হয়।
গ্রেপ্তার ও তৎপরবর্তী আচরণে ফ্যাসিস্ট সুলভ প্রতিহিংসাপরায়ণতা খুব স্পষ্ট। সাদা পোশাকের পুলিশ(?) সন্ময়বাবুকে তুলে নিয়ে যায়, ঘরের দরজা ভেঙ্গে টেনে হিঁচড়ে, জামা ছিঁড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বলে খবর। বাড়ি তল্লাশি ও পরিবারের মেয়েরাও ধস্তাধস্তি থেকে রেহাই পাননি। কলকাতা থেকে অনেক দূরে পুরুলিয়াতে নিয়ে গিয়ে আদালতে তোলা হয় এবং ছাড়া পাওয়ার পর এই প্রৌঢ় ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন যে তাঁকে অর্ধনগ্ন করে নিম্নাঙ্গে অত্যাচার করেছে পুলিশ। এসবই করা হয়েছে শাসক দলের বিরুদ্ধে কুৎসামূলক প্রচার করার অভিযোগে!
সামাজিক মাধ্যমে ও সংবাদ মাধ্যমে যে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক জিঘাংসামূলক উস্কানি জিয়াগঞ্জের হত্যাকাণ্ডের পর বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষ থেকে চালানো হল, তার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিতে তো দেখা গেল না রাজ্য সরকারকে! যুগশঙ্খ পত্রিকায় যেভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হল সম্পূর্ণ মিথ্যা শ্লোগান তুলে তা কি রাজ্যের কোনও আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য নয়? অথচ এক একক ব্যক্তি যখন সরকারী নীতির বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করলেন, তখন তার ওপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে অত্যাচার চালানো হল।
পাশের রাজ্য ঝাড়খন্ডে বিজেপির শাসন। সেখানে স্ট্যান স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা সাজানো হয়েছে। এই সপ্তাহে ৩০ জনের পুলিশবাহিনী তাঁর সম্পত্তি সীজ করতে গিয়ে কেবল দু-চারটি চেয়ার টেবিল পেয়েছেন, আর কোনও সম্পত্তি তাঁর নাই, খবরে আসে একথা। তাঁর অপরাধ তিনি ফেসবুকে আদিবাসীদের “সারনা” ধর্মের স্বীকৃতির সাংবিধানিক অধিকারের কথা বলেছিলেন। বিজেপি-আরএসএস যখন আদিবাসীদের “হিন্দু” এক্তিয়ারে আনতে মরিয়া তখন স্ট্যান স্বামী তথা আদিবাসীদের “সারনা আন্দোলন” যে আরএসএস-কে আশঙ্কিত করে তা বোঝা যায়। সে কারণেই সমগ্র পুলিশ প্রশাসন নিয়ে স্ট্যান স্বামীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজেপির সরকার। অভিযোগ সেই “কুৎসা ও উস্কানি ছড়ানো”।
এ রাজ্যের মমতা সরকারও যে কোনওরকম বিরোধী কণ্ঠস্বরেই আতঙ্কিত বোধ করছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি সভাপতির সাথে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পর তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্যেও ফ্যাসিস্টদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার ইঙ্গিত ধরা পড়ছে।
অম্বিকেশ মহাপাত্র বা শিলাদিত্য চৌধুরীদের গ্রেপ্তারির ঘটনায় এর আগে রাজ্য সরকারকে ধিক্কৃত হতে হয়েছিল। শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে পুলিশ-প্রশাসনের নির্লজ্জ খোলাখুলি মদতে শাসক দলের চালনো স্বৈরতন্ত্র পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে প্রবল প্রভাব ফেলেছিল বলে মানুষ মনে করে। দেখা যাচ্ছে এইসব ঘটনা থেকে শাসক দল বা প্রশাসনিক প্রধান কোনো শিক্ষাই নিতে রাজি নন। বিজেপি-আরএসএসের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই যেমন চলবে, তেমনি রাজ্যের শাসক দলের সমস্ত গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধেও মানুষ রুখে দাঁড়াবেন।