অর্থনৈতিক মন্দার ফাঁদ থেকে ভারতকে উদ্ধার করুন

২০১৬-র নভেম্বরে নামানো বিমুদ্রাকরণ এবং তারপর হঠকারী ভাবে তাড়াহুড়ো করে চালু করা জিএসটি জমানা যে অর্থনৈতিক বিশ্বৃঙ্খলার জন্ম দেয় তা এখন আবার আতঙ্কজনক অর্থনৈতিক মন্থরতায় পরিণতি লাভ করেছে। জিডিপি বৃদ্ধির হার সরকারি ভাবেই নেমে এসেছে ৫ শতাংশে এবং এর সাথে যদি মূল্যস্ফীতিকে হিসাবে নেওয়া হয় তবে বৃদ্ধির ঐ হার কার্যত নেমে দাঁড়াবে শূন্যতে। উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, দেশের মধ্যে বিক্রি এবং রপ্তানি কমে যাচ্ছে; আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের মুদ্রার মান দুর্বল হচ্ছে; একমাত্র অত্যাবশ্যকীয় পণ্য এবং পরিষেবার দাম এবং বেকারি ও ছাঁটাই-এর পরিসংখ্যান বেড়ে চলেছে।

ব্যবসার খবরাখবর দেওয়া সংবাদপত্রগুলিতে মোটর গাড়ির বিক্রিতে ধস নামাটাই চর্চার সবচেয়ে বড় বিষয় হয়ে উঠেছে। বিক্রি কমতে থাকায় মোটর যান তৈরির বড় বড় সংস্থাগুলি উৎপাদন হ্রাস করতে শুরু করেছে। সহায়ক শিল্পের সুবিশাল শৃঙ্খলে এই মন্থরতার প্রভাব কতটা ব্যাপক হয়ে দেখা দিচ্ছে তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হওয়ার নয়। ভারতের জিডিপিতে মোটরগাড়ি শিল্পের অবদান হল ৭ শতাংশ এবং এই ক্ষেত্র প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ ভাবে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করে থাকে। তবে মোটর গাড়ির মত দামি জিনিস এবং শীততাপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ও ঠাণ্ডা মেশিন অথবা টিভি ও ওয়াশি্ং মেশিনের মত ব্যয়বহুল ভোগ্যপণ্যের বিক্রি যথেষ্ট কমেছে বলেই শুধু খবর পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি ৫ টাকা দামের বিস্কুটের প্যাকেটের বিক্রিও কমে গেছে এবং পারলে ও ব্রিটানিয়ার মত বিস্কুট কোম্পানিও শ্রমিক ছাঁটাই করছে।

এই মন্দা প্রকৃত অর্থেই ব্যাপক। আমাদের এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, এই মন্দা প্রধানত ‘ভারতে তৈরি’: এটা বিশ্বে চলা আর্থিক অথবা অর্থনৈতিক সংকটের ভারতে সম্প্রসারণ নয়। বস্তুত, ১৯৯০-এর দশকে ঘটা এশীয় মন্দা অথবা এক দশক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উদ্ভুত হওয়া বিশ্ব আর্থিক সংকট থেকে ভারত নিজেকে মোটামুটি সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিল। ভারতে যে মন্দার মুখোমুখি আজ আমরা হচ্ছি তা ব্যাপক সংখ্যাধিক গ্ৰামীণ জনগণের আয় ও ক্রয় ক্ষমতায় ধস নামানো কৃষি সংকট এবং অর্থনৈতিক নীতি সমূহ আর বিমুদ্রাকরণ ও হঠকারী ভাবে চাপিয়ে দেওয়া উদ্ভট জিএসটি জমানার বিপর্যয়কর পদক্ষেপের সম্মিলিত ফল।

তথ্য প্রযুক্তির উথ্থান এবং তার পরিণামে উদ্ভুত উপরমুখী সঞ্চরণশীল এক মধ্যবিত্ত শ্রেণী কিছুকাল সুপ্ত অর্থনৈতিক সংকটকে আড়াল করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু উপভোক্তার ঐ ফাঁপা রমরমা ভারতের মতো বিশাল দেশের অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারে না। ব্যাপক সংখ্যাধিক ভারতবাসীর ক্রয় ক্ষমতার অভাব আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের বৃদ্ধিকে গণ্ডিবদ্ধ করে তোলে। আর নিশ্চল এবং মন্দীভূত চাহিদার এই সমস্যাই এখন আমাদের এমন এক মন্দার মধ্যে এনে ফেলেছে যা অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্র এবং বাজারের সব অংশকেই গ্ৰাস করেছে।

মোদী সরকার দীর্ঘদিন ধরেই মন্দাকে পুরোপুরি অস্বীকার করার ভাব করে থেকেছে। আজ কিন্তু ঐ বিলাসিতা দেখানোর সাধ্য সরকারের আর নেই, কিন্তু সরকারের দেখানো প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি অপাত্রে ন্যস্ত হয়েছে। সরকার কর্পোরেট ক্ষেত্রের জন্য ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার বিপুল পরিমাণ কর ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছে; এরই সাথে ঘোষণা করেছে এর আগে বাজেটে চাপানো অতি ধনীদের উপর থেকে সারচার্জ প্রত্যাহার এবং শেয়ার বিক্রি থেকে দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদি মূলধনী লাভের উপর দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উপর চাপানো সারচার্জ প্রত্যাহারের কথা। অন্য কথায়, সরকার আরবিআই-এর উদ্বৃত্ত থেকে যে ১.৭০ লক্ষ কোটি টাকা অধিকার করেছে তার পুরোটাই করপোররেট ক্ষেত্রকে ভেট দেওয়া হয়েছে। অপরিশোধিত ঋণ শোধের ব্যাপারে কোন তোয়াক্কা না করে করপোরেট ঋণ গ্ৰহীতাদের আরও টাকা ধার দেওয়ার জন্য সরকার ব্যাঙ্কগুলোকে চাপ দিচ্ছে। বিলাস দ্রব্যগুলির জিএসটি হারের হ্রাসও হতে চলেছে।

শেয়ার বাজারের যে সূচক পতনের পথে চলেছিল, বিপুল পরিমাণ করপোরেট কর ছাড়ের ঘোষণায় তা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে গেছে। শেয়ার বাজারের একযোগে ফেটে পড়া এই উচ্ছ্বাস কিন্তু সংখ্যাধিক কোটি-কোটি ভারতবাসীকে গ্ৰাস করা হতাশার নিরসন করতে পারবে না। এই সরকার দু দিক থেকে সাধারণ জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে — প্রথমে অসহনীয় মন্দার চাপে তাদের পিষ্ট করার পর সরকার বিপর্যয়ের মধ্যে পড়া জনগণের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। ভারতকে উঠে দাঁড়িয়ে এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মোদী সরকারকে দায়বদ্ধ করতে হবে। ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে, গ্ৰামীণ এবং শহরাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকরী কর্মনিশ্চ্য়তার ব্যবস্থা করে, কৃষি সংকটে জর্জরিত কৃষকদের ঋণ মুকুব করে এবং ত্রাণ দিয়ে এবং প্রবীণ ও দারিদ্রপীড়িতদের জন্য ন্যূনতম ৩০০০ টাকা মাসিক পেনশনের ব্যবস্থা করে সরকারকে জনগণের সুরাহা করতে হবে।

(লিবারেশন সম্পাদকীয়, অক্টোবর ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-31