গত ১৪ সেপ্টেম্বর (যে দিনটাকে ভারত সরকার হিন্দি দিবস হিসেবে পালন করে) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বললেন, “ভাষার বৈচিত্র্য এবং আঞ্চলিক ভাষাসমূহ আমাদের জাতির শক্তি। কিন্তু আমাদের দেশের কাছে একটা মাত্র ভাষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যাতে বিদেশী ভাষার কোনো ঠাঁই না হয়।” এর দু-এক দিন পর অমিত শাহ আবার বললেন “বহু দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেশের নাগরিকদের আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে” আর এই কারণেই নির্বাচক মণ্ডলী মোদী সরকারকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে।
এই মন্তব্যগুলো আমাদের মনে পড়িয়ে দিচ্ছে যে, বিজেপি এবং আরএসএস ভারতের বৈচিত্র্যকে, তার বহুবিধ ভাষা, সংস্কৃতি, রন্ধন প্রণালী, ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রচণ্ড ঘৃণা ও ভয় করে। প্রকৃত, অপরূপ এই বৈচিত্র্যকে (এবং যে যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র এই বৈচিত্র্যকে সম্মান জানায় তাকে) অপসারিত করে তার স্থানে ওরা অলীক “এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক দল, এক নেতা”র ব্যবস্থা আনতে চায়।
গত মাসে মোদী সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করে বলে যে, এই পদক্ষেপ তাদের “এক জাতি, এক সংবিধান, এক আইনের” নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এই দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন আর কেউ নন, স্বয়ং অমিত শাহ। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক সমাবেশে তিনি তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর বিশিষ্ট পরিচিতির সুরক্ষায় ৩৭১ ধারা অব্যাহত রাখা হবে।
শাহ যদি স্বীকার করেন যে, “ভাষার বৈচিত্র্য এবং আঞ্চলিক ভাষাগুলো জাতি শক্তি”, তাহলে অন্য সব ভাষার উপরে একটা ভাষাকে “জাতীয় ভাষা” রূপে ঘোষণা করে এই শক্তিকে দুর্বল এবং ধ্বংস করতে চাওয়া হচ্ছে কেন? ভারতীয়তার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য সমরূপতার মধ্যে নেই। সমস্ত ভারতীয় একে অপরের ভিন্ন-ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য, ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমান রূপে সম্মান করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হলে তবেই ভারতের “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য” থাকতে পারে।
শুধুমাত্র হিন্দিকেই ভারতের সমতূল্য বলে গণ্য করা এবং সমস্ত ভারতবাসীর উপর তাকে চাপিয়ে দেওয়ার বিজেপির চেষ্টা স্পষ্টতই সেই সমস্ত মানুষের কাছে অপমান যাঁরা অসমিয়া, বাংলা, বোড়ো, ডোগরি, গুজরাটি, কন্নড় কাশ্মরী, কোঙ্কানি, মৈথিলি, মণিপুর, মারাঠি, নেপালি, উড়িয়া, পাঞ্জাবি, সাঁওতালি, সিন্ধি, তামিল, তেলেগু ও উর্দু ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষাগুলোক ভারত “সরকারী” ভাষা রূপে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তপশিলে হিন্দির সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এগুলো ছাড়াও ভারতে আরও ১৭০০টির বেশি ভাষা আছে যেগুলোতে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ কথা বলেন।
ভারতের স্বাধীনতার আগেই সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোই প্রথম “হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানী” শ্লোগান আমদানি করার চেষ্টা করে। তারপর থেকে এই শক্তিগুলোই এক তথাকথিত “হিন্দি বলয়কে” ভারতের রাজনীতির আধার বলে তুলে ধরে এসেছে, এবং দাবি করেছে যে ব্যাপক সংখ্যাধিক ভারতবাসী একমাত্র হিন্দি ভাষাতেই কথা বলে থাকে। এই দাবির কোনো বস্তুগত ভিত্তি নেই।
একটা ব্যাপার হল, উত্তর ভারতের রাজ্যগুলো যদি যথার্থই এক “হিন্দি বলয়” হয় থাকে, তাহলে এই রাজ্যগুলোর ব্যাপক সংখ্যক স্কুল ছাত্রই প্রতি বছর হিন্দি পরীক্ষায় ফেল করে কেন? উত্তরপ্রদেশ বোর্ড পরিচালিত ২০১৯ সালের দশম ও বারো ক্লাসের পরীক্ষায় ১০ লক্ষেরও বেশি ছাত্র হিন্দি পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি। এর কারণ হল, রাজনৈতিক প্রচারের বিপরীতে হিন্দি এই ছাত্রদের মাতৃভাষা নয়, তারা অন্যান্য হরেক ভাষাতেই কথা বলতে পারে (যথা, অওধি, ব্রজ ভাষা, ভোজপুরি)। এগুলো এমন আঞ্চলিক ভাষা নয় যেগুলো হিন্দির চেয়ে কোনো অংশে “কম” : এই ভাষাগুলো স্কুলে শেখানোর সমজাতীয় করে তোলা, সরকারী, সংস্কৃতর আদল দেওয়া “হিন্দির” চেয়ে ভাবকে আরও ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারে।
এর পরিণাম হল, হিন্দি চাপিয়ে দেওয়াটা শুধু ভারতের অন্যান্য ভাষার প্রতি অপমানই নয় : তা হিন্দির প্রতি এবং তার সাথে উত্তর ভারতের সমৃদ্ধ ভাষাগত বৈচিত্র্যের প্রতিও অবমাননা।
১৯১৪ সালে তাঁর একটি লেখায় লেনিন রাশিয়ায় বাধ্যতামূলকভাবে একটি সরকারী ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে অভিমত পোষণ করেন। তাঁর লেখায় তিনি পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, “বাধ্যতামূলকভাবে এক সরকারী ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে “রাশিয়ার সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে” জবরদস্তি, লাঠির ব্যবহার জড়িয়ে রয়েছে।”
এ কথাটা গ্রাহ্য করলে ভারত ভালো করবে। একটি একক জাতীয় অথবা “সরকারী” ভাষাকে জোরজবরদস্তি মদত দিলে বা সবার উপর চাপিয়ে দিলে তা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার বিপরীতে বিভাজিতই করবে। ভারতের বহুবিধ ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রাজ্যগুলোর যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকারকে দমন করলে তা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করবে না, বিভাজিতই করবে।
ভারতের ঐক্য ও বৈচিত্র্যের উদযাপনের স্বার্থে “হিন্দি দিবসকে” অপসারিত করে তার স্থানে “মাতৃভাষা দিবস” চালু করলে তাতে ফল আরও হবে, যে দিন সমস্ত ভারতবাসীকেই নিজেদের মাতৃভাষা এবং তার সাথে ভারতের ভাষাগত বৈচিত্র্যের উদযাপনে উৎসাহিত করা হবে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯)