মোদি-২-এর প্রথম ১০০ দিন সমাপ্ত হল। প্রচারকরা মোদি-শাহ জমানার অত্যাশ্চর্য সাফল্য — তিন তালাক, কাশ্মীর ও চন্দ্রাভিযানের তালিকা তৈরিতে ব্যস্ত। সারা দেশ যে বিষয়টি – অর্থনৈতিক মন্দা – নিয়ে আলোচনা করছে সেটি ব্যতীত অন্য সব ব্যাপারের আলোচনাতে তারা মগ্ন। তাদের মতে মন্দাকে সাময়িক, বাণিজ্যিক চক্রের বিষয় বলে এড়িয়ে যাওযা যাবে, কিন্তু এখন প্রত্যেক ত্রৈমাসিকের তুলনামূলক সংখ্যা ও প্রত্যেক সূচক এক পরিষ্কার ও বিপজ্জনক পতনের ইঙ্গিত করছে। জিডিপি বৃদ্ধির হার সরকারিভাবেই ৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যদি আমরা বাস্তবিকভাবে দেখি তাহলে এটি শূন্যে পৌঁছেছে। উংপাদন কমছে, দেশজ বিক্রি ও রফতানি কমছে; আমাদের টাকার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে; কেবল বেকারি ও ছাঁটাইয়ের সংখ্যার পাশাপাশি অত্যাবশ্যক পণ্য ও পরিষেবার দাম বাড়ছে।
মোটরগাড়ির বিক্রিতে ভাটা বাণিজ্যিক প্রচার মাধ্যমে সব থেকে বেশি আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় সমস্ত মোটর গাড়ির উৎপাদকেরা উৎপাদন কমাতে শুরু করেছে। সহযোগী শিল্পের বিপুল সারিতে এই মন্দার প্রভাব আন্দাজ করা কঠিন নয়। বাস্তবে, মানেসারের মারুতি কারখানার আশেপাশের সমস্ত অর্থনৈতিক কাজকর্ম, সব্জি বিক্রেতা ও পথসংলগ্ন খাবার দোকান থেকে মুদির দোকান বা পোশাকের বিক্রেতা ব্যবসায় মন্দার কথা জানাচ্ছে। বিজেপি আইটি সেলের প্রচারে যা মন্দাকে ব্যবসায়িক মডেলের পরিবর্তনশীল ধরনের ফল বলে ব্যাখ্যা করতে চায়। উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থমন্ত্রী গাড়ির বিক্রি কমাকে সহস্রাব্দের যুব মননের পরিবর্তনশীলতাকে দায়ী করছেন। মন্ত্রী মহোদয়ার মতে তরুণ পেশাদারদের মেট্রো বা ওলা ও উবের-এর মতো ভাড়া গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতাই গাড়ি বিক্রি কমার জন্য দায়ী। সুবিধেজনকভাবে তিনি ট্রাক ও ট্রাক্টরের বিক্রির হ্রাসকে ভুলে গিয়েছেন কারণ ট্রাক ও ট্রাক্টরের পরিসেবার জন্য কোনো ওলা বা উবের নেই।
কেবলমাত্র গাড়ি, এয়ার কন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন অথবা ওয়াশিং মেশিনের মতো ব্যয়বহুল ভোগ্যপণ্যই নয়, পাঁচ টাকার বিস্কুটের প্যাকেটের বিক্রিও কমেছে, এবং পার্লে ও ব্রিটানিয়ার মতো বিস্কুট কোম্পানিগুলিও কর্মী ছাটাই করছে। অর্থনৈতিক মন্দা সত্যিই সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে। এই মন্দা মূলত ‘ভারতে তৈরি’, ভারতে বিশ্বের আর্থিক বা অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রসারের কারণে ঘটেনি। বাস্তবে, ১৯৯০-এর দশক বা বছর দশেক আগের আমেরিকায় তৈরি বিশ্ব মন্দার থেকে ভারত যথেষ্ট সুরক্ষিত ছিল। ভারত এখন যে মন্দার মুখে দাঁড়িয়েছে তা দেশের বিপুল সংখ্যার গ্রামীণ জনতার আয় ও ক্রয় ক্ষমতা হ্রাসকারী কৃষি সঙ্কট ও বিমুদ্রাকরণের মতো সর্বনাশা অর্থনৈতিক নীতি ও পদ্ধতি এবং তাড়াহুড়ো করে চালু করা স্বেচ্ছাচারী জিএসটির পুঞ্জিত ফল।
তথ্য প্রযুক্তিও তার ফলে এক ঊর্ধ্বগামী মধ্যবিত্তের উত্থান কিছুদিনের জন্য অন্দরস্থ অর্থনৈতিক সঙ্কট ঢাকা দিতে কার্যকরী হতে পারে, কিন্তু সেই কৃত্রিম ভোগ বিস্তার কিছুতেই ভারতের মতো এক বিপুল দেশের অর্থনীতিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সামাল দিতে পারে না। আমাদের বিপুল সংখ্যাধিক ভারতীয়ের ক্রয় ক্ষমতার অভাব আভ্যন্তরীণ বাজারের বৃদ্ধিকে সীমিত রেখেছে, এখন আমরা এক মন্দার সম্মুখীন যা বাজারের সমস্ত ক্ষেত্র ও বর্গতে বিস্তৃত হয়েছে। দীর্ঘকাল মোদি সরকার মন্দাকে অস্বীকার করেছে। এখন সরকার আংশিক ভাবে হলেও তা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে, কিন্তু সে বিষয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত অপর্যাপ্ত ও অপাত্রে ন্যস্ত। মূলত, সরকার বৃহৎ কোম্পানিগুলিকে দেয় ব্যাঙ্ক ঋণকে বাড়াতে সচেষ্ট হয়েছে, যখন ওই কোম্পানিগুলির অশোধিত ঋণের পরিমাণ বিপুল। সাবধানতাজনিত কারণে যে সমস্ত ব্যাঙ্কগুলির ঋণদানের উপর প্রতিবন্ধকতা ছিল সেই বাধাকে এড়ানোর জন্য সেগুলিকে শক্তিশালী ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকার ব্যাঙ্কে টাকা সরবরাহের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্তেও হস্তক্ষেপ করছে। জিএসটি পরিষদও বাহ্যিকভাবে ভোগ চাহিদাকে বাড়ানোর জন্য গাড়ি ও দামি ভোগ্যপণ্যের উপরে জিএসটি হারকে কমানোর কথা বিবেচনা করছে।
সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিটাই কর্পোরেট ঋণখেলাপিদের অধিক ঋণদান ও বিলাসদ্রব্যের ভোগকে প্রসারিত করার চারপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘরের কাছেই চীনের দৃষ্টান্ত রয়েছে যারা শ্রমিক কর্মচারীদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মজুরি বৃদ্ধি করে ও তার মাধ্যমে চাহিদা বাড়িয়ে বিশ্ব আর্থিক সঙ্কট ও রফতানির হ্রাসকে মোকাবিলা করেছে। মোদি সরকার বিপরীত রাস্তায় হাঁটছে এবং দেশকে দীর্ঘকালিন ও সার্বিক মন্দার গভীরে ঠেলে দিচ্ছে। সঙ্কট থেকে নিষ্কৃতির একমাত্র রাস্তা হল সরকারকে নীতি পরিবর্তন করে মজুরি বৃদ্ধি ও জনকল্যাণ এবং শ্রম নিবিড় ক্ষেত্র ও কাজে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিতে বাধ্য করা। তবে সাধারণ মানুষের অর্থনীতির উপরে পুনর্নবীকৃত মনোযোগের জন্য প্রয়োজন বর্তমান সর্বনাশা ঘৃণার রাজনীতি এবং জনগণের বুনিয়াদি প্রয়োজন এবং স্বার্থ ধ্বংসকারী রাজনৈতিক পরিবেশের আদর্শগত পরিবর্তন। অন্য কথায়, ভারতের জন্য অর্থনীতি ও রাজনীতি, উভয় ক্ষেত্রেই পথ পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)