মোদী জমানায় চাকরির বাজার সংকোচনের ব্যর্থতা ঢাকতে আরও কত যে যুক্তিজাল শুনতে হবে কে জানে। জানেন একমাত্র তারা, যারা আছেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় এবং তার দম্ভে মানুষকে মানুষ মনে করেন না, যা খুশী তাই বলে দিতে পারেন, অহরহ বুনে চলেন মিথ্যাচারের জাল, অবলম্বন করেন অর্ধসত্যকে। এ লক্ষণ ফ্যাসিবাদেরই। বারেবারে এই ধূর্তামির আশ্রয় নেওয়ার উদ্দেশ্য হল মানুষের মগজ ধোলাই করা। শুধু তাই নয়, মানুষের যুক্তি-বুদ্ধির ভাবনার জগতে, বিচারবোধে আধিপত্য বিস্তার করা।
এমনই এক ভাবপ্রকাশ লক্ষ করা গেল ‘শূন্যপদে নিয়োগ’ প্রশ্নে কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান দপ্তরের স্বাধীন প্রতিমন্ত্রীর গলায়। উপলক্ষ ছিল উত্তর ভারতের পরিপ্রেক্ষিত। মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘চাকরির সুযোগের অভাব নেই’, ‘ঘাটতি আছে যোগ্যতার’! দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাবের কারণেই চাকরি অনেক কম হচ্ছে ! এটাই নাকি মূল কারণ! অদ্ভুত সাফাই গাওয়ার অপচেষ্টা। গোটা দেশ ডুবে রয়েছে অভূতপূর্ব বেকারির জনস্রোতে। ভীড় লেগে রয়েছে অদক্ষ-আধা দক্ষ-দক্ষ— সবরকমের বেকারবাহিনীর। গত সাড়ে চার দশকের তুলনায় বেকারি বৃদ্ধি পেয়েছে নজিরবিহীন মাত্রায়। ২০১৯ সালে পৌঁছে গেছে ৬.১ শতাংশে। এই বিপুল বেকারির মধ্যে শূন্যপদের সংখ্যা অনুপাতে দক্ষ কর্মী মিলছে না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে? মন্ত্রীবাবু খোলসা করেননি সরকারি না বেসরকারি, কোন ক্ষেত্রের প্রসঙ্গ তুলেছেন। ধরেই যদি নেওয়া যায় উভয় ক্ষেত্রের, এই অপবাদ মেনে নেওয়া যায় না। প্রত্যেক বছর শিক্ষা শেষে কাজের সন্ধানে নাম লেখাচ্ছে প্রায় আড়াই কোটি নতুন বেকার। এছাড়া রয়েছে বছরের পর বছর কাজ না পাওয়া, কাজ চলে যাওয়া মজুদ বেকার বাহিনী। মোদী জমানার প্রথম পর্বে প্রতিশ্রুতি ছিল বছরপ্রতি দু’কোটি হাতে কাজ দেওয়ার । সেসব কিছুই করা হয়নি। সে না হলেও তার জন্য ‘যোগ্যতার অভাব’কে কখনও কারণ হিসাবে দেখানো হয়নি, অথচ এখন দেখানো হচ্ছে সেই অজুহাত।
কাজ না দিতে পারার পেছনে আসল কথা স্বীকার করার নৈতিকতা মোদী মন্ত্রীসভার নেই। বিগত পর্বে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার প্রশ্নে অমিত শাহ বলেছিলেন, ওসব ‘জুমলা’, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিতে হয় তাই দেওয়া, কিন্তু বারেবারে তো ‘জুমলা’ বলে চললে তো আর বলায় চমক থাকে না, তাই জমানার দ্বিতীয় পর্বে কাজ না দিতে পারার অপদার্থতা ঢাকতে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে ‘যোগ্য কর্মী’র নাকি আকাল! বঞ্চনার কারণ ধামাচাপা দিতে নেওয়া হচ্ছে নতুন নতুন ছলনার আশ্রয়।
আসল কারণ হল, কেন্দ্রীয় সরকার পলিসি কার্যকর করছে কাজের সুযোগ গোটানোরই। প্রথম পর্ব থেকেই বড় মাত্রায় হামলা শুরু করা হয়েছিল বিলগ্নীকরণ-বেসরকারিকরণের, তার সাথে কাজের বাজারে প্রচুর কাজ খেয়ে নিয়েছে বিমুদ্রাকরণের আর জিএসটি-র সাঁড়াসি আক্রমণ। আর, শাসনের দ্বিতীয় পর্বে ছ’মাস না যেতেই বৃদ্ধি ঠেকেছে তলানিতে, পাঁচ শতাংশেরও নিচে, গেঁড়ে বসছে উৎপাদন সংকট, ফলে কাজের ব্যাপারে না দেওয়া যাচ্ছে সুরাহা, না যাচ্ছে শোচনীয় অপদার্থতার সত্যটা স্বীকার করা। এমনকি সেনা অত্যাচারিত, অবরুদ্ধ কাশ্মীরে খোদ সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে হামলে পড়া কাশ্মীরী যুবদের যে আলোকচিত্র সংবাদমাধ্যমে ছাপানো হচ্ছে তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। হয় তা বহু পুরানো, নয়ত ভূয়ো। ‘যোগ্যতা’র কথা তুলে যারা কাজের দাবি ছেঁটে দিচ্ছেন তাদের কাজ ছাঁটাইয়ের সরকার চালানো ছাড়া আর কোন যোগ্যতা আছে? থুড়ি, হ্যাঁ, কিছু ‘যোগ্যতা’ আছে বৈকি! এরা আবার অমর্ত্য সেন, রোমিলা থাপার প্রমুখদের চিন্তা-মেধা-কাজের ‘যোগ্যতা’ নিয়েও প্রশ্ন তোলার ব্যবস্থা নেন। কাজের দাবিতে বেকারকণ্ঠ সোচ্চার হলে ‘বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী’ ‘ষড়যন্ত্রী’-‘দেশদ্রোহী’ ইত্যাদি তকমা দাগিয়ে দেওয়া হয়, ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানাতে গেলে লাঠিসোটা কালা কানুনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
কাজের সুযোগ অনুপাতে ‘যোগ্য কর্মী নেই’ তাই তত কাজ দেওয়া যাচ্ছে না — এহেন বজ্জাতি করছে কেন্দ্রীয় সরকার শুধু নয়, একই দোষে দুষ্ট পশ্চিমবাংলার রাজ্য সরকারও। হালেই মিলল তার আরও একবার জ্বলন্ত নজির। কর্মসংস্থানের উনিশটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কর্মীমেলার আয়োজন করেছিল দক্ষিণবঙ্গের এক জেলা প্রশাসন। পদের সংখ্যা সাড়ে চারশোর কাছাকাছি, কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা ছয় সহস্রাধিক, কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্তর সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র একশ ঊনিশ। নিয়োগ এত কম কেন? জেলা কর্তৃপক্ষের জবাব হল, ‘যোগ্য কর্মীর অভাব’। পদ লুকানোর, পদ গোটানোর সেই একই ছল চলছে। সরকারপক্ষের ‘যোগ্যতা’য় বেকারের কাজের সংস্থান হয় না, উপরন্তু কাজের দাবিতে রাস্তায় নামলে উল্টে নামানো হয় বর্বর পুলিশী দমন।