আজকের দেশব্রতী : ২১ এপ্রিল ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati 21 april 2022

Oath of April 22

২২ এপ্রিল ২০২২ সিপিআই(এমএল) প্রতিষ্ঠার ৫৩তম বার্ষিকী। এই উপলক্ষে, কেন্দ্রীয় কমিটি সিপিআই(এমএল)-এর সমস্ত সদস্য ও সমর্থকদের উষ্ণ বিপ্লবী অভিনন্দন জানাচ্ছে এবং যাবতীয় প্রতিকূলতার মধ্যেও গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের জন্য সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পার্টির অঙ্গীকারকে পুনর্ঘোষণা করছে। এবছর লেনিনের ১৫২তম জন্ম বার্ষিকী। আমরা কমরেড লেনিন এবং আমাদের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত নেতা এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি। এবছরের পরের দিকে, ২৮ জুলাই আমরা কমরেড চারু মজুমদারের ৫০তম শহীদ দিবস পালন করব এবং ১০ ডিসেম্বর কমরেড জগদীশ মাস্টার ও কমরেড রামায়ণ রামের ৫০তম শহীদ বার্ষিকী উদযাপন করব। গত দু’বছর কোভিড-১৯ অতিমারী ও তার মোকাবিলার নামে রাষ্ট্র কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া নিষ্ঠুর লকডাউনে আচ্ছন্ন থেকেছে। তৎসত্ত্বেও, ভারতের জনগণ ও আমাদের পার্টি জনগণের বিভিন্ন বুনিয়াদী দাবি এবং অধিকারের প্রশ্নে সফলতার সঙ্গে ধারাবাহিক সংগ্রাম গড়ে তুলেছে। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন মোদী সরকারকে কর্পোরেটমুখী কৃষি-আইনগুলি প্রত্যাহারে বাধ্য করেছে। ভাগচাষি সমেত কৃষকদের সকল অংশের জন্য সমস্ত ফসলের উপযুক্ত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আদায় ও শ্রমজীবী জনগণের সমস্ত ধরনের ঋণমুক্তি, নিশ্চিত কর্মসংস্থান ও সমস্ত শ্রমিক এবং কর্মপ্রার্থীদের জীবন ধারনের উপযোগী মজুরি আদায় ও মুষ্টিমেয় কর্পোরেশনগুলির হাতে সরকারি সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তর রোধে এখন লড়াই জারি রয়েছে। নির্বাচনে প্রতিটি বিজয় বিজেপি ও সঙ্ঘ বাহিনীকে তাদের ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে তীব্র করতে সাহস জুগিয়েছে।

২০১৯’র জয়ের পর, মোদী দ্রুত ৩৭০ ধারার বিলোপ ঘটান ও জম্মু-কাশ্মীরকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নামিয়ে আনা হয় এবং নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এবার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, গোয়া ও মণিপুরে বিজেপি’র জয়লাভের পর তারা অ-বিজেপি রাজ্যগুলিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি ও এতাবৎকাল বিজেপি যেখানে তাদের মুখ কিম্বা মুখোশ হিসেবে নীতীশ কুমারকে ব্যবহার করে এসেছে সেই বিহারেও তারা তাদের নিয়ন্ত্রণকে আঁটোসাঁটো করতে সচেষ্ট। জ্বালানি, খাদ্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও পরিষেবার বিপুল মূল্যবৃদ্ধি ঘটানোর সাথে সাথে তারা জনগণকে সাম্প্রদায়িকভাবে মেরুকৃত করে তোলার জন্য ঘৃণা ও ত্রাস সৃষ্টি ও হিংসায় প্ররোচনা দিয়ে চলেছে। এমনকি সঙ্কট যখন তীব্রতর হচ্ছে, তখনও জনগণের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া এবং বিজেপি শাসন ও আরএসএস’এর মতাদর্শ মেনে নেওয়ার জন্য ত্রাসের আবহ সৃষ্টিই যেন ভারতের অনিবার্য নিয়তি। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের ৭৫তম বার্ষিকী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শক্তিশালী, বিপ্লবী ঐতিহ্য এবং এক মুক্ত, প্রগতিশীল ও সমানতাবাদী ভারতের যে স্বপ্ন ভগৎসিং, আম্বেদকার ও পেরিয়ার এবং আরও পূর্ববর্তীতে উপনিবেশবাদ বিরোধী, জাতপাত বিরোধী যোদ্ধারা প্রজ্বলিত করেন তার ঊজ্জ্বল স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনে। সেই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা এবং স্বাধীনতা, ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকে তীব্র করার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে ভারতকে মুক্ত করার দায়িত্ব এখন আমাদের কাঁধে। এই ঐতিহাসিক কর্তব্য পালনের জন্য আমাদের প্রয়োজন পার্টির আরও বিস্তার ঘটানো ও শক্তি বৃদ্ধি করা। আগামী বছরের শুরুতে পাটনায় আমরা পার্টির ১১তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করতে চলেছি আর ২০২৪-এর গোড়ায় আমরা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছি। সত্যিকারের নিষ্ঠা নিয়ে সমগ্র পার্টিকে এই কর্তব্যগুলি পালনের জন্য অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে। নতুন নতুন এলাকায় ও জনগণের নতুন নতুন অংশের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যায় প্রার্থী সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে পার্টির বিস্তার ঘটানো, পার্টি কমিটি ও ব্রাঞ্চসমূহের উন্নততর অনুশীলনের মাধ্যমে পার্টির ঐক্য ও সংগ্রামী শক্তির বৃদ্ধি করা এবং পার্টি শৃঙ্খলাকে কঠোরভাবে মেনে চলা ও পার্টি মুখপত্রগুলি ও মার্কসীয় সাহিত্যের সযত্ন অধ্যয়নের মাধ্যমে পার্টির মতাদর্শগত রাজনৈতিক উৎকর্ষসাধনের মধ্য দিয়েই গণসংযোগ ও গণসংগ্রামের দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করেও এই অভিমুখে আমাদের অবশ্যই অগ্রসর হতে হবে।

আমাদের সমস্ত প্রিয় নেতা ও শহীদদের প্রতি বিপ্লবী অভিবাদন। ভারতজুড়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধের এক প্রাণবন্ত, দায়বদ্ধ ও শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে সিপিআই(এমএল)-কে প্রতিষ্ঠিত করুন।

- কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই(এমএল)

maintaining peace and harmony

এই আবেদনপত্রে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃবর্গ জনগণের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত আবেদন জানাতে সমবেত হয়েছেন।

আমাদের সমাজে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য শাসকগোষ্ঠীর একাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য, পোশাক, আস্থা, উৎসব এবং ভাষা সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে নির্লজ্জের মতো ব্যবহার করে চলেছে, এই আচরণ অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক।

ঘৃণা প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক মঞ্চ হতে বক্তব্য প্রকাশের ক্রমবর্ধমান ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভের সুযোগ নিয়েই এমনটা করা হচ্ছে বলে প্রতিভাত হচ্ছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কোনোরকম শক্তিশালী ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা সম্প্রতি তীব্র আকার নিয়েছে, আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, কারণ সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনসমূহ এই ইঙ্গিতই করছে যে এই ঘটনাগুলি সব জায়গাতেই এক অভিন্ন কায়দায় সংগঠিত করা হয়েছে৷ প্রতিটি ঘটনায় সশস্ত্র ধর্মীয় মিছিল সহ আক্রমণের ঘটনার ঠিক পূর্বেই সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে দিতে উস্কানিমূলক ঘৃণাভরা বক্তৃতা আয়োজিত হয়েছে।

দুঃখের কারণ হিসাবে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য হল ঘৃণা ও অন্ধবিশ্বাস প্রচারের উদ্দেশ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সোশ্যাল মিডিয়া এবং অডিও-ভিস্যুয়াল প্ল্যাটফর্মগুলির যথেচ্ছ অপব্যবহার করা চলছেই, এই পরিবেশ অসহনীয়।

এই সকল ঘটনায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর নীরবতায় সকলেই মর্মাহত, যারা ধর্মান্ধতা প্রচার করছে এবং যারা তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে জনসমাজে উসকানি দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর এহেন নিরবতা কার্যত তার ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আক্রমণকারী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করছে, এই নীরবতাই তার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দেয়।

বহু শতাব্দী ব্যাপী বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ভারতকে সংজ্ঞায়িত ও সমৃদ্ধ করেছে, সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধনকে শক্তিশালী করে সকলে একসঙ্গে কাজ করার উদ্দেশ্যে আমাদের সম্মিলিত সংকল্পকে আমরা তাই আরও একবার স্পষ্ট করছি।

আমাদের সমাজে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছে এমন বিষাক্ত মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো এবং তার মোকাবিলা করার লক্ষ্যে আমাদের পূর্ব-প্রতিশ্রুতিকে আমরা আরও একবার স্পষ্ট করছি।

আমরা আরও একবার নিজেদের এই দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করছি যে আমাদের দেশ তখনই সমৃদ্ধ হবে যদি এটি তার বহু বৈচিত্র্যকে পূর্ণ মাত্রায় সম্মান জানায়, নিজের অন্তরে স্থান দেয় এবং সমবেত অস্তিত্বকে উদযাপন করে।

শান্তি বজায় রাখতে এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীক্ষ্ণ করতে চায় যারা, তাদের অশুভ উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করার লক্ষ্যে আমরা দেশের জনগণের সকল অংশের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। সারাদেশে আমাদের দলের সকল ইউনিটকে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য স্বাধীন ও যৌথভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধী —ভারতের জাতীয় কংগ্রেস,
শ্রী শরদ পাওয়ার —এনসিপি,
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় —পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ারপার্সন,
শ্রী এম কে স্তালিন —তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এবং ডিএমকে’র সভাপতি,
শ্রী সীতারাম ইয়েচুরি — সাধারণ সম্পাদক, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী),
শ্রী হেমন্ত সোরেন — ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ও জেএমএম’র কার্যকরি সভাপতি,
ডঃ ফারুক আব্দুল্লাহ —জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের সভাপতি,
শ্রী তেজস্বী যাদব —বিহার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা, আরজেডি,
শ্রী ডি রাজা —সাধারণ সম্পাদক, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি,
শ্রী দেবব্রত বিশ্বাস —সাধারণ সম্পাদক, সারা ভারত ফরোয়ার্ড ব্লক,
শ্রী মনোজ ভট্টাচার্য —সাধারণ সম্পাদক, আরএসপি,
শ্রী পি কে কুনহালিকুট্টি —সাধারণ সম্পাদক, আইইউএমএল
শ্রী দীপঙ্কর ভট্টাচার্য —সাধারণ সম্পাদক, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী–লেনিনবাদী)

decree of the center

কেন্দ্রের মোদী সরকার ‘দুয়ারে রেশন’ নিয়ে আইনগত পরিপন্থীর অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে। ‘দুয়ারে’ প্রকল্প প্রথমে চালু করে দিল্লীর আপ সরকার, তারপরে চালু হয় অন্ধ্রপ্রদেশে, আর সেই ধারায় ‘পিকে’-র ভাবনাগত কৌশলগত প্রয়োগে চালু করেছে এরাজ্যের মমতা সরকার। কারণ দুর্নীতি-দলতন্ত্র-সন্ত্রাসের কলঙ্ক থেকে গণদেবতার মনোভাব ঘুরিয়ে কিভাবে ক্ষমতায় ফিরে আসার রাস্তা করা যায় সেটা ছিল তৃণমূলের কাছে এক কঠিন প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তৃণমূল বাজি ধরে ‘দুয়ারে সরকার’ থেকে ‘দুয়ারে রেশন’। এই পলিসি ও কৌশলের চাপের মুখে বিজেপিকে ‘জনপ্রিয়তাবাদে’ পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে — এটাই হল মোদীবাবুদের গাত্রদাহের আসল কারণ। সেটা আড়ালে রেখে কেন্দ্র আইনি আপত্তি তুলছে। এজন্য কেন্দ্র ইতিমধ্যে একটা ক্যাবিনেট নোট তৈরি করেছে। নোটটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে নীতি আয়োগ, অর্থমন্ত্রক, আইন মন্ত্রক, নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক, শিক্ষা মন্ত্রক সামাজিক ন্যায় বিচার মন্ত্রকের কাছে। গরিষ্ঠতার জোরে চাপিয়ে দেওয়াই মতলব। বলছে, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের ১২ ও ২৪ নম্বর ধারা মোতাবেক রেশন দোকান থেকে খাদ্যশস্য বাইরে বের করা যায় না, করলে সেটা নাকি হবে আইনত দন্ডনীয় অপরাধ! সত্যিই কি ওই আইনের মর্মার্থ তাই! নাকি তার অন্তর্নিহিত অর্থ হল, যাতে দ্রব্যাদি হিসাব বহির্ভূত অসুরক্ষিত হয়ে না থাকে। দুয়ারে রেশন বলতে পাড়ায়-পল্লীতে বণ্টনের আরও কেন্দ্র খুলে উপভোক্তাদের সরবরাহ করা হলে তার তো হিসাব থাকে, শুধু তাই নয়, এখন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে চেক করে প্রাপ্য মেটানো হয়। কোনও লুঠ-পাট-ডাকাতির তো খবর নেই। তাহলে আইনত নিষেধাজ্ঞার কথা আসছে কেন? যুক্তিতে এঁটে উঠতে না পেরে কেন্দ্র ঢাল করছে রেশন ডিলারদেরকে। ‘দুয়ারে’ পৌঁছে দেওয়ার পরিকাঠামোগত খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে ডিলারদের ক্ষোভ রয়েছে। সেটা যুক্তিসঙ্গত। এই খরচ পুষিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দুই স্তরের সরকারপক্ষের, কেন্দ্র-রাজ্য মিলে বোঝাবুঝি করে সেই দায়ভাগ মেটাক। তা না করে কেন্দ্রের অভিলাষে ধরা পড়ছে ডিলারদের বোড়ে বানানোর উদ্দেশ্য। কেন্দ্রের আরেকটি কূটযুক্তি হল, রাজ্যগুলির যদিও অধিকার আছে কেন্দ্রের কোটার চেয়ে বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য দেওয়ার, কিন্তু সেটা দিলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের যে নির্যাস ‘এক দেশ, এক দাম, এক রেশন’ ভাবমূর্তি মার খায়। রাজ্য ভিত্তিতে একেক জায়গায় দাম দাঁড়াবে একেকরকম, প্রকৃত মূল্যমান নিয়ে বিভ্রান্তি বৈষম্য ছড়াবে। এহেন যুক্তি তুলে কেন্দ্র বলছে রাজ্য সরকারের তরফে অতিরিক্ত রেশন যদি দেওয়ার থাকে, তবে কেন্দ্রের কোটার সঙ্গে জুড়ে না দিয়ে উপভোক্তাদের ব্যাঙ্কে একাউন্টে জমা করে দেওয়া হোক। কিন্তু এভাবে একটা চালাকির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে, তা হল ওই ভর্তুকির টাকায় বাজার থেকে খাদ্যশস্য কেনার দিকে ঠেলে দেওয়া — যা কিছুতেই রেশনের মতো সুলভে মেলার নয়। খুব ‘এক দেশ এক রেশন’, ‘মেলাবে মিলিবে’ বড় বড় কথা বলা হয়, কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্যের কোটার রেশন একসাথে বিলি করা সহ্য হচ্ছে না।

২০১৩ সালে প্রণীত জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুসারে গ্রামীণ ৭৫ শতাংশ ও শহুরে ৫০ শতাংশ মানুষকে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় সুলভে রেশন দেওয়ার প্রচলন হয়। তারপরে ২০১৯-২১ অতিমারীতে রুজি-রোজগারের সমস্ত দিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনামূল্যে সর্বজনীন রেশন ও নগদ অর্থ দেওয়ার দাবি জ্বলন্ত হয়ে ওঠে। মোদী সরকার বাধ্য হয় রেশন দেওয়া শুরু করতে এবং সেটা ২০২১-২২-এ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের চাপ সামলানো পর্যন্ত বজায় রাখতে। এর মাঝে উত্তর-পশ্চিম ভারতের দীর্ঘস্থায়ী কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি মোদী সরকারের দরদ কেমন! দেখেছি কী মারাত্মক শয়তানি, বেইমানি। আর, অতিমারীর ক্ষত উপশমে নগদ অর্থ দেওয়ার দাবি আজ অবধি কানে তোলা হয়নি। পরে নির্বাচনী চাপ পর্ব মিটে যেতে মোদী সরকার ঘোষণা করে বসে বিনামূল্যে রেশনের ঝাঁপ ২০২২-এর মার্চের শেষে বন্ধ করে দেওয়া হবে। তারপর পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনের মোট ফলাফল হিসাবে রেখে কী ভেবে বিনামূল্যে রেশন সরবরাহের সময় আরও ছয়মাস বাড়িয়ে দিল। আসলে বিরোধী শাসিত সরকারগুলির এই বণ্টন প্রকল্প বজায় রাখা কেন্দ্রের ঘাড়ের ওপর গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রের সুযোগ এখনও প্রাক অতিমারী পরিস্থিতির মতো পুনরুদ্ধার হয়নি, মূল্যবৃদ্ধির বাজার আগুন। এসব দেখে আর ২০২৩-এর পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ভোট, ২০২৪-এর লোকসভা ভোট মাথায় রেখে বিনামূল্যে রেশন চালু রাখছে মোদী সরকার। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে একই প্রকল্প আরও তিন মাস বাড়িয়েছে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার। একইসাথে সাম্প্রদায়িক ও জাতিবাদী ঘৃণার-বিদ্বেষ-বিভাজনের আগুন এবং বিনামূল্যের রেশনের যুগল হাতিয়ারে ফ্যাসিবাদী মেরুকরণ চালিয়ে যাওয়াই উদ্দেশ্য।

‘দুয়ারে রেশন’ সংস্কার প্রকল্পটির বাস্তবোচিত গণদাবির ভিত্তি হল, কেন্দ্র-রাজ্যের যুগ্ম দায় পালনের দায়িত্ব থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও বিনামূল্যে বণ্টন প্রণালীর যতবেশি বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতান্ত্রিকীকরণ করা যায় সেটাই। এপ্রশ্নে পরিকাঠামোগত ব্যবস্থাপনায় এরাজ্যের মমতা সরকারের যে কোনও ত্রুটি থাকছে না তা নয়। কিন্তু কেন্দ্রের ফরমান কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না।

 BJP's intention is to impose Hindi

বিজেপি সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবার উদ্দেশ্যপূর্ণ মন্তব্য করে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। সরকারের সংসদীয় ভাষা কমিটির সদস্যদের সম্বোধন করে, যার সভাপতি স্বয়ং তিনি, শাহ বলেন যে হিন্দি দেশের ‘ঐক্যের’ জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং তাই অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির সাথে যোগাযোগের ভাষা হিসাবে ইংরেজিকে প্রতিস্থাপন করে হিন্দি আনা উচিত। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ৭০ শতাংশ যোগাযোগ এখন হিন্দিতে হয়।

সংস্কৃত করা হিন্দিকে সকলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার এই অভিসন্ধি আরএসএস-বিজেপি’র ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’এর বৃহত্তর মনুবাদী এজেন্ডার অংশ, যা মোদী সরকার ২০১৪ সাল থেকে চাপিয়ে দিতে শুরু করেছে। অথচ সারা ভারত জুড়ে বিরোধী দলগুলি এবং বিরোধী নেতৃত্বাধীন সরকারগুলি হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার এই দুরভিসন্ধিকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রক, বিভিন্ন দপ্তর, কর্পোরেশন এবং ব্যাংকগুলিকে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে হিন্দিকে অগ্রাধিকার দিতে বলছে মোদী সরকার; বিজেপি নেতাদের হিন্দিতে বক্তৃতা দিতে বলছে; জাতিসংঘে হিন্দির ‘সরকারি মর্যাদা’ পাওয়ার চেষ্টা করছে। এসবের মাধ্যমে এমনটাই বোঝান হচ্ছে যে, হিন্দি ভারতের একমাত্র জাতীয় ভাষা। দক্ষিণের রাজ্যগুলির মহাসড়কের মাইলস্টোনগুলিতে হিন্দি দিয়ে ইংরেজিকে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা হচ্ছে এবং সারা ভারতের স্কুলগুলিতে বর্তমান দ্বি-ভাষা সূত্র সরিয়ে দিয়ে তিন-ভাষা চালু করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হচ্ছে। যদিও মোদী সরকারকে বারবার এই পদক্ষেপগুলি থেকে পিছু হটতে হয়েছে, তবু তারা সারা দেশের উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের প্রচেষ্টার পুনরাবৃত্তি করার উপর জোর দেয় কারণ এটি আরএসএস’এর মূল এজেন্ডার অংশ।

এ’কথা অবশ্যই উল্লেখ করা উচিত যে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে ২২টি ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া আছে এবং সংবিধানে ইংরেজি ও হিন্দি উভয়ই দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে সমান মর্যাদা ভোগ করে। হিন্দিকে সরকারি যোগাযোগের একমাত্র ও কার্যকর ভাষা হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী।

এটাও জোর দিয়ে বলা উচিত যে ‘হিন্দি’ আসলে চলতি হিন্দির একরকম সংস্কৃত সংস্করণ যা সরকারিভাবে ব্যবহৃত হয়। ‘হিন্দি’ মোটেই তথাকথিত ‘হিন্দি বলয়ের’ সাধারণ বুলি বা ‘মাতৃভাষা’ নয়। পরিবর্তে এক ধরণের ‘লিঙ্ক ভাষা’, ঠিক যেভাবে ইংরেজি দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে, বাংলায়, আসামে বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে লিঙ্ক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অলোক রাই বলেছেন, “হিন্দি বলয়ে হিন্দিতে ফেল করা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এই সত্যের মারাত্মক সাক্ষ্য দেয় যে ‘হিন্দি’ তাদের মাতৃভাষা কেড়ে নিয়েছে”। উত্তরের এই রাজ্যগুলিতে, রাই যুক্তি দেন, “হিন্দি দরিদ্র মানুষের কাছে এক ধরণের ইংরেজিতে পরিণত হয়েছে”, অর্থাৎ ক্ষমতার এবং ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতার ভাষা।

যে ভাষায় তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সেই ভাষাতেই সমস্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্র পাওয়া প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের অধিকার। বাস্তবে, কেন্দ্র হিন্দি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই নথিকরণ, ফর্ম, আইন ইত্যাদি তৈরি করে; এবং রাজ্য সরকারগুলি তখন এগুলিকে ইংরেজি থেকে রাজ্যে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট ভাষাগুলিতে অনুবাদ করে নেয়। জোর করে অ-হিন্দিভাষী জনতাকে হিন্দি গিলিয়ে দেওয়া বৈষম্যকে উৎসাহিত করে, একতাকে নয়।

একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে হবে যে, হিন্দি আধিপত্য এবং হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামে কেবল তামিলনাড়ু, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির জনগণই অন্তর্ভুক্ত নন। বরং ভোজপুরি, মৈথিলি, মাগহি, আওয়াধি এবং উত্তরের রাজ্যগুলির আরও অনেক ভাষাভাষিরাও এই সংগ্রামে আছেন। এই চেতনা নিয়েই হিন্দি কবি ধুমিল ১৯৬৫ সালে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে লিখেছিলেন, “তোমার তামিল ব্যথা/ আমার ভোজপুরি ব্যথার ভাই”।

সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে ‘রাশিয়ান’কে বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে লেনিনের মন্তব্য মনে রাখা দরকার : “মানুষকে মেরেধরে স্বর্গে পাঠাতে চাই না আমরা। ‘সংস্কৃতি’ সম্পর্কে আপনি যতই সুললিত বাক্য উচ্চারণ করুন না কেন, বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষা আসলে জোর জবরদস্তি, যারসাথে সবসময় জড়িত থাকবে ডান্ডার ব্যবহার”। গোটা দেশের উপর সংস্কৃত হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে বিজেপি’র একগুঁয়েমির পিছনে এই ‘জবরদস্তির উপাদান’ই আসল চালিকাশক্তি।

কেবল ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, খাদ্যাভ্যাস, বিশ্বাস, রাজনীতি এবং মতাদর্শের ক্ষেত্রেও বিজেপি ভারতীয়ত্ব ও একতাকে সমরূপতার সাথে একাকার করে দিতে চায়। ভারতের জনগণকে অবশ্যই ভারতের বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য, বিশ্বাস এবং ভাবধারা রক্ষা করার জন্য লড়াই করতে হবে, বিজেপি’র ‘এক জাতি, এক ভাষা, এক বিশ্বাস, এক মতাদর্শের’ ফ্যাসিস্ট প্রকল্পের বিরোধিতা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই প্রতিটি শিশুর নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষিত হওয়ার অধিকার দাবি করতে হবে। দাবি তুলতে হবে যে, উত্তর ভারতের স্কুলগুলি ইংরেজি, তামিল, কন্নড়, মালায়ালাম, তেলুগু ও উর্দু সহ অন্যান্য ভাষাগুলিকে মাধ্যমিক ও উচ্চতর বিদ্যালয়ে ঐচ্ছিক ভাষা হিসাবে সুযোগ দেবে। এবং ইংরেজিকে হিন্দির চেয়ে ন্যূনতম খাটো না করে সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৮ এপ্রিল ২০২২)

against price rise

পেট্রোল-ডিজেল, রান্নার গ্যাস সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, নদীয়ার হাঁসখালিতে নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে ও উচ্চপর্যায়ের তদন্ত ও হাঁসখালির ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর অবমাননাকর উক্তি প্রত্যাহারের দাবিতে ১৪ এপ্রিল শিলিগুড়ি শহরে বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয়। মিছিল হিলকার্ট রোড পরিক্রমা করে হাসমি চকে এসে শেষ হয়। মিছিলের সমাপ্তিতে বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য বাসুদেব বসু। মিছিলে নেতৃত্ব দেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, জেলা কমিটি সদস্য শরৎ সিংহ, মোজাম্মেল হক, মীরা চতুর্বেদী, শ্বাশ্বতী সেনগুপ্ত, কৃষ্ণপদ সিংহ প্রমুখ। সভার শেষে মোদীর কুশপুত্তলিকা দাহ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। বাধা অতিক্রম করে মিছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের সামনে রাস্তায় বসে পড়ে। পুলিশের নিষেধ অস্বীকার করে কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।

পেট্রোল-ডিজেল-রান্নার গ্যাস সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানে ৭-১৩ এপ্রিল প্রচারাভিযানের অংশ হিসাবে জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলা মোড়ে পার্টির জেলা কমিটির পক্ষ থেকে কেন্দ্রের মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়। নেৃতৃত্ব দেন জেলা কমিটির সদস্য প্রদীপ গোস্বামী, শ্যামল ভৌমিক, সুভাষ দত্ত, গোপাল রায়, তপন সেন, ছত্রপতি দাস, প্রশান্ত ভৌমিক, ও লুনা রায় লস্কর; বক্তব্য রাখেন মুকুল চক্রবর্তী।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানে ৭-১৩ এপ্রিল দেশজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসেবে পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা ২নং ব্লকের কালনা-বৈঁচি রোডে শিরিষতলা বাসস্ট্যান্ডে কালনা লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে রাস্তা অবরোধ করা হয় ১ ঘন্টা। অবরোধের পর নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়। বক্তব্য রাখেন লোকাল কমিটির সম্পাদক  রফিকুল ইসলাম। সদর ১নং ব্লকের বন্ডুল বাজারে লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে বিক্ষোভসভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিল শেষে নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়। এই কর্মসুচির নেতৃত্ব দেন জেলা কমিটির সদস্য সমীর হাজরা ও বাপন বক্সী।

anti-people activities of the central and state governments

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানে দেশব‍্যাপী পেট্রোপণ্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূলবৃদ্ধির প্রতিবাদের অংশ হিসাবে, হাঁসখালি-সহ দিকে দিকে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে, দেশজুড়ে দাঙ্গা বাঁধানোর চক্রান্তের বিরুদ্ধে এবং বেকার যুবকদের চাকরির দাবিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বজবজ বিধানসভা পশ্চিম এরিয়া কমিটির পক্ষ ‍থেকে গত ১২ এপ্রিল চড়িয়াল মোড়ে পথসভা করা হয়। এই সভায় বক্তব‍্য রাখেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা কাজল দত্ত, সারা ভারত কিষাণ মহাসভার জেলা সম্পাদক দিলীপ পাল, বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশনের রাজ‍্যনেতা শুভদীপ পাল, পার্টির জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার। সমগ্র সভা পরিচালনা করেন সাবির (রাজা)। সভাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ‍্যে উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। এই একই দাবিতে ১৪ এপ্রিল বজবজে কালুপুর থেকে চড়িয়াল পর্যন্ত এবং জেলা সদর বারুইপুরের মল্লিকপুরের বেশ কিছু জায়গায় পোস্টারিং করেন পার্টি কমরেডরা। ঐদিন বাখরাহাটে বুড়িরপোল নতুন রাস্তার মোড়ে পথসভা আয়োজিত হয়। বক্তব্য রাখেন সারাভারত কিষাণ মহাসভার জেলা সম্পাদক দিলীপ পাল, পার্টির জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য নেতা শুভদীপ পাল। সভা পরিচালনা করেন পার্টির বিষ্ণুপুর-সাতগাছিয়া লোকাল কমিটির সম্পাদক নিখিলেশ পাল। সভাস্থল হাতে লেখা পোষ্টার চাইনিজ রক্তপতাকা দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। আশেপাশের শ্রমজীবী জনতা ও বাজারের দোকান কর্মচারীবৃন্দ মনোযোগ দিয়ে বক্তাদের বক্তব্য শোনেন যা সভাস্থল থেকে পরিলক্ষিত হয়।

Tea workers are on the move

দেশ পদার্পণ করল স্বাধীনতার ৭৫তম বছরে।

আইন অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি শ্রমিকদের নায্য অধিকার। বর্তমান মালিকপক্ষ চা শ্রমিকদের এক্ষেত্রে বঞ্চনা করে যাচ্ছে। রাজ্য সরকার মালিকপক্ষের চাপের কাছে এই বঞ্চনার মোকাবিলা করার প্রশ্নে অপদার্থতা দেখিয়ে চলছে।

গত ১৪ এপ্রিল বাবা সাহেব আম্বেদকরের জন্মদিনে চা শ্রমিক সংগঠনগুলির যুক্তমঞ্চ জয়েন্ট ফোরামের আহ্বানে শিলিগুড়িতে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠক থেকে নায্য প্রাপ্য আদায়ে বৃহত্তর আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

২ এপ্রিল শিলিগুড়িতে দাগাপুরে শ্রমিক ভবনে মন্ত্রী বেচারাম মান্নার উপস্থিতিতে বহু প্রতিক্ষিত ত্রিপাক্ষিক আলোচনাতেও চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির বিষয়ে কোন সমাধান হয়নি। এরআগে ন্যূনতম মজুরির পরামর্শদাতা কমিটির ১৭তম বৈঠকে মালিকপক্ষ রাজ্য সরকারের কাছে ২১২ টাকা মজুরির প্রস্তাব জমা দেয়। প্রস্তাবটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে সরকারীভাবে জানানো হলে প্রতিনিধিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। ২০১৭ সালে চুক্তি শেষ হয়ে গেলেও ন্যূনতম মজুরির এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। এপর্যন্ত ৫ দফায় রাজ্য সরকার মেমো জারী করে মজুরি বৃদ্ধি করেছে, যা নগণ্য। এরআগে শ্রমিক, মালিক, রাজ্য সরকার তিন পক্ষকে নিয়ে গঠিত ৩০ সদস্যের ন্যূনতম মজুরি পরামর্শদাতা কমিটির ১৭টি বৈঠক হয়েছে। ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি মেলেনি।

গত ২ এপ্রিলের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে মালিকপক্ষ ১৭.৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। স্বাভাবিকভাবেই চা শ্রমিক সংগঠনগুলি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। সেদিনই সমস্ত সংগঠন জরুরি ভিত্তিতে ১৪ এপ্রিল বসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

তরাই-ডুয়ার্স পাহাড়ের প্রায় সমস্ত ইউনিয়ন শিলিগুড়ির মিত্র সম্মিলনী হলে মিলিত হয়। এআইসিসিটিইউ’র অন্তর্ভুক্ত তরাই সংগ্রামী চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অভিজিৎ মজুমদার ও বাসুদেব বসু প্রতিনিধিত্ব করেন। সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের চা শ্রমিক সংগঠনগুলির নেতৃত্ব অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে মালিকপক্ষের অনমনীয় মনোভাবের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক মজুরির দাবিতে পাহাড় থেকে তরাই ডুয়ার্স বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল সমস্ত এরিয়া পর্যায়ে সর্বস্তরের নেতৃত্বের যৌথসভা অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ২৪ এপ্রিল দার্জিলিং পাহাড়ে যৌথসভা অনুষ্ঠিত হবে। মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে দার্জিলিং পাহাড়ের বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী ২৯-৩০ এপ্রিল পাহাড় থেকে সমতল সকালে কাজে যাবার আগে সমস্ত বাগানের গেটে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ১ মে ঐতিহাসিক মে দিবসে বাগানে বাগানে যৌথ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। ৪ মে থেকে ১৫ মে সর্বস্তরে জোনাল কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ৬ জুন শিলিগুড়িতে তরাই-পাহাড়-ডুয়ার্স মিলিয়ে মহামিছিল উত্তরকন্যা অভিযান সংগঠিত হবে। সমস্ত চা শ্রমিকদের একটাই কথা

ন্যূনতম মজুরি দেনা হোগা,

জমিন কো পাট্টা দেনা হোগা!!”

Resistance against Deucha-Panchami coal mine

দেউচা-পাঁচামী দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙার গ্রামবাসীরা খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, যে কোন মূল‍্যে এই প্রকল্পকে রুখতে চান তাঁরা। সরকারের উচিত মানুষের এই বার্তা শোনা এবং প্রকল্প প্রত‍্যাহার করে নেওয়া। গত ১৩ এপ্রিল মুখ‍্যমন্ত্রী নবান্নে গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনায় বসেছিলেন। বীরভূম জমি-জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা এই বৈঠককে সদর্থকভাবে গ্রহণ করেছিল বিভিন্ন গ্রাম থেকে ৩১ জন প্রতিনিধি নবান্নে হাজির হয়েছিলেন যার মধ‍্যে ৯ জন বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে মুখ‍্যমন্ত্রী এই প্রকল্পের উজ্জ্বল দিকগুলি সবিস্তারে তুলে ধরে জানতে চেয়েছিলেন কেন গ্রামবাসীরা প্রকল্পটির বিরোধ করছে। মহাসভার প্রতিনিধিরা নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতির কথা তুলে ধরেছিলেন। মুখ‍্যমন্ত্রী বলেছিলেন, গ্রামবাসীরা না চাইলে জোর করে কয়লাখনি করা হবে না। প্রতিনিধিরা দুটি আশু দাবি তুলেছিলেন, আন্দোলনকারীদের ওপর থেকে মামলাগুলি প্রত‍্যাহার করে নেওয়া এবং মহিলাদের ওপর পুলিশ ও টিএমসির হামলার বিচার। এবিষয়েও মুখ‍্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা মুখ‍্যমন্ত্রীর কথাকে সদর্থক ভাবে নিয়েছিলেন এবং তাঁরা প্রত‍্যাশা করেছিলেন যে মুখ‍্যমন্ত্রী এই বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে বিবৃতি দেবেন। এই প্রত‍্যাশা নিয়ে বৈঠক থেকে ফিরে গিয়ে গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনার পর মুখ‍্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে মহাসভার পক্ষ থেকে ধরণা মঞ্চ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়াও হয়েছিল। কিন্তু মুখ‍্যমন্ত্রীর তরফে কোনোরকম বিবৃতি আসেনি। উল্টে নবান্নের বৈঠক ও ধর্ণা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে প্রকল্পের জয় তথা আন্দোলনের সমাপ্তি হিসেবে দেখিয়ে ব‍্যাপক প্রচার চালায় সংবাদ মাধ‍্যমের একাংশ। এই পরিস্থিতিতে মহাসভার নেতৃত্ব দ্রুত সাধারণ সভা ডেকে ১৬ এপ্রিল নতুন করে কর্মসূচি ঘোষণা করে। ইতিমধ‍্যেই জানা যায় যে জেলাশাসক দেওয়ানগঞ্জে জনসভা করে জমিদাতাদের ক্ষতিপূরণের চেক ও চাকরির কাগজ বিলি করবেন। এই খবরে গ্রামবাসীরা প্রতারিত বোধ করেন। ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তাঁরা। এবং শেষ পর্যন্ত ১৮ এপ্রিল ব‍্যাপক জনরোষের মুখে পড়ে প্রশাসনকে কর্মসূচি বাতিল করে পালিয়ে আসতে হয়। গ্রামবাসীরা অত‍্যন্ত স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন যে, কয়লাখনি যে কোনও মূল‍্যে রুখে দিতে চান তাঁরা।

১৮ এপ্রিল দেওয়ানগঞ্জের মাঠে জেলাশাসকের সমাবেশ কর্মসূচিটি ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। এই কর্মসূচির মাধ‍্যমে রাজ‍্যবাসীকে বার্তা দিতে চাওয়া হচ্ছিল যে গ্রামবাসীরা জমি দিতে ইচ্ছুক। বিশাল আয়োজন করা হয়েছিল। বিশাল পুলিশ বাহিনীর সাথে বীরভূম জেলার বিভিন্ন ব্লক থেকে আদিবাসীদের আনা হয়েছিল অনেকগুলি বাসে ভর্তি করে। কিন্তু গ্রামবাসীরা এই ষড়যন্ত্রের রাস্তা আটকে দেয়। বিপুল সংখ‍্যক মানুষ লাঠিঝাঁটা ও তীরধনুক নিয়ে পথ আটকে দাঁড়ায়। শান্তিপূর্ণভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, কোন রকম প‍্যাকেজ বা চাকরি নয়, প্রকল্প বাতিল করাই একমাত্র চাইছে গ্রামবাসীরা। জেলা শাসক ও পুলিশ বাহিনীকে শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে হয়। বাইরে থেকে যে আদিবাসীদের ভুল বুঝিয়ে আনা হয়েছিল তারাও সত‍্যিটা জেনে যায়। অনেকেই গ্রামবাসীদের সাথে যোগ দিয়েছে।

এই এলাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর মল্লারপুর। এখানে আছে রাজ‍্যের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘদিনের পুরনো “আদিবাসী কল‍্যাণ আশ্রম”, আদিবাসীদের মধ‍্যে হিন্দুত্বকরণের লক্ষ‍্যে আরএসএসের অন‍্যতম প্রতিষ্ঠান। এই সূত্রে বিজেপি আন্দোলনের মধ‍্যে ঢুকে বিভাজন ঘটাতে চাইছে। কিন্তু বিজেপি যে দেশ জুড়ে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করছে, অধিকার কেড়ে নিচ্ছে এবং প্রতিবাদ করলেই মাওবাদী তকমা দিয়ে গণহত‍্যা চালাচ্ছে এ বিষয়েও এলাকার মানুষের মধ‍্যে সচেতনতা বাড়ছে। “বীরভূম জমি-জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা” গঠনের সময় গৃহীত রেজলিউশনগুলির মধ‍্যে অন‍্যতম ছিল এ বিষয়ক একটি নিষেধাজ্ঞা, যেখানে বলা হয়েছিল, যেসব দল ক্ষমতায় থেকে একইরকম কাজ করেছে বা করছে তাদের মহাসভায় আসতে দেওয়া হবে না। রাজ‍্যের বিজেপি দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দেওচার আন্দোলনকারীদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন বলে ঘোষণা করার পর তাই মহাসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বিজেপি নেতাদের কোনোভাবেই বরদাস্ত করবেন না তাঁরা।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জে মহাসভার পর থেকে অনেক প্রতিকুলতা মোকাবিলা করে লাগাতার ধর্ণা আন্দোলন চলেছে। নবান্নে বৈঠক ও দেওয়ানগঞ্জের প্রতিরোধের পর দেওচার আন্দোলন নতুন পর্বে প্রবেশ করল। সমস্ত বিভ্রান্তি পেরিয়ে আন্দোলনের শক্তি আরও বেড়েছে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ‍্য কমিটির পক্ষ থেকে কমরেড পার্থ ঘোষ একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন যে, পার্টি গ্রামবাসীদের আন্দোলনকে পূর্ণ সংহতি জানায় এবং এই বিপর্যয়কর প্রকল্প বাতিল করার জন‍্য পার্টি তার ঘোষিত অবস্থান থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।

people do not agree

দেউচা-পাঁচামী-হরিণশিঙা-দেওয়ানগঞ্জে কয়লা শিল্প স্থাপনে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান সমস্যা হল — তাঁর সিংহাসন লাভ হয়েছিল জমি অধিগ্রহণ বিরোধী, উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। জমির সাথে গ্রামের মানুষের নিবিড় সম্পর্কের বিষয়টি তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী হিসেবে। তাঁর দল ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট, ১৮৯৪’র ঘোর বিরোধিতা করেছিল সিঙ্গুরের সময়। পরবর্তীতে ১৮৯৪’র ঔপনিবেশিক আইনের কিছু পরিবর্তন করে পার্লামেন্টে আইন পাস হয় রাইট টু ফেয়ার কমপেনশেসন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি ইন ল্যান্ড অ্যাকুইজেশন, রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসেটেলমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৩ — তৃণমূল মুখপাত্র সেই আইনেরও বিরোধিতা করেন, আইনটি কৃষক স্বার্থের বিরোধী বলে। গত দশবছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শিল্প’-বিরোধী, চপ ও মেলা শিল্পের ধারক বাহক রূপে অভিযুক্ত হয়েছেন বিরোধীদের দ্বারা। হঠাৎ শিল্প-বান্ধব হয়ে দেউচা-পাঁচামী অঞ্চলে কয়লাখনি কেন্দ্রিক শিল্প করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্ছেদ, জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সংঘর্ষের পরিস্থিতি আহ্বান করছেন, যা তার রাজত্বে নতুন ঘটনা।

দেউচা-পাঁচামীতে ভূগর্ভস্থ কয়লা উত্তোলনের ফলে হাজার বিশেক মানুষের (সংখ্যাগুরু আদিবাসী, এছাড়া তফসিলি জাতি ও মুসলিম) উচ্ছেদ ও সেই মানুষদের সম্ভব্য প্রতিরোধের সম্ভাবনা মাথায় রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতবর্ষের ‘সেরা পুনর্বাসন প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছেন। সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি জানিয়েছেন দশহাজার কোটি টাকার পুনর্বাসন প্রকল্পের কথা — প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেউচা-পাঁচামীর ভূমিপুত্রদের প্রায় সকলের চাকরি হবে, দেউচা-পাঁচামীর কয়লা শিল্পকে কেন্দ্র করে মোট একলক্ষ চাকরি, এলাকার পাথরখাদান মালিকের জন্য ত্রাণ, ওখানকার পাথর খাদানে কাজ করা আদিবাসী শ্রমিকের জন্য আর্থিক ত্রাণ, কৃষি মজুরের জন্য আর্থিক প্যাকেজ, নতুন কলোনী তৈরি করে সেখানে আদিবাসীদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে — যা যা ‘ভালো ভালো’ মানবিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া যায়, তার ম্যানেজারেরা খুঁজে পেতে সবকটাই ঢুকিয়ে রেখেছিলেন প্রেস নোটে। বেশিরভাগই অবাস্তব, অতিরঞ্জিত কথাবার্তা, নেতা মন্ত্রীরা যা বলেই থাকেন — সেসব নিয়ে কাটাছেঁড়া এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। প্রশ্নটি হল, কয়লাখনির জন্য যে জমি নেওয়া হবে সেটা কোন পদ্ধতিতে নেওয়া হবে — জমি অধিগ্রহণ হবে নাকি জমি কিনে নেওয়া হবে? বিষয়টি ধোঁয়াশায়।

বিবিধ প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্যও লাভজনক নয় বলে দেউচা-পাঁচামীতে কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড দীর্ঘদিন আগেই পরিত্যাগ করেছিল। নানান পরিকল্পনা ও সেগুলি ভেস্তে যাওয়ার পর ২০১৮’র সেপ্টেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে আসে দেউচা-পাঁচামীর কোল ব্লক, ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (ডাবলুবিপিডিসিএল) এই ব্লকের মালিকানা পায়। আবার জানা যাচ্ছে ‘বেঙ্গল বীরভূম কোল কোম্পানি লিমিটেড’ নামক রাজ্য সরকারের অধীনস্থ সংস্থা এই কয়লাখনির নির্মাণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকবে। ‘বেঙ্গল বীরভূম কোল কোম্পানি লিমিটেড’এর রেজিস্টার্ড অফিস ঠিকানা বিদ্যুৎ উন্নয়ন ভবন, বিধাননগর, কলকাতা। এবং এই কোম্পানির যাবতীয় টেন্ডার, কাগজপত্র ইত্যাদি ডাবলুবিপিডিসিএল’এর ওয়েবসাইট থেকেই প্রকাশিত হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ডাবলুবিপিডিসিএল’এর কয়লা উৎপাদনের প্রযুক্তি ও উপকরণ কিছু নেই, তাদের ওয়েবসাইটে স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে তাদের অধীনে থাকা পাঁচটি খোলামুখ খাদানে (বড়জোড়া, বড়জোড়া নর্থ, গঙ্গারামচক, তারা, পাচড়া) কয়লা উৎপাদনের দায়িত্বে আছে বিভিন্ন প্রাইভেট মাইনিং কোম্পানি। এটা স্পষ্টভাবে জেনে নেওয়া দরকার, ডাবলুবিপিডিসিএল তাদের চালু পাঁচটি খনির কোথাও জমি অধিগ্রহণ করেনি, জমি মালিকের কাছ থেকে জমি কিনেছে। অর্থাৎ ১৮৯৪ সালে জমি অধিগ্রহণ আইন বা ২০১৩ সালের পরিবর্তিত আইনের পরিধির বাইরে, বাজারদরে জমির কেনাবেচা, হস্তান্তর হয়েছে। দেউচা-পাঁচামীতেও জমি অধিগ্রহণ না হবারই কথা, জমি কিনে নেবার পরিকল্পনা করছে রাজ্য সরকার, ‘বেঙ্গল বীরভূম কোল কোম্পানি লিমিটেড’এর নামে।

কতকগুলি মনে রাখার বিষয় হল

১) ১৯৭৩ সালে কোল মাইনস ন্যাশানালাইজেশন অ্যাক্ট (সিএমএন) অনুসারে কয়লা শিল্পের জাতীয়করণ করা হয়েছিল। তারআগে কয়লা শিল্প ব্যক্তিমালিকানাধীন ছিল। ১৯৯১ সালে নিও-লিবারাল অর্থনীতির সূচনার পরে ধাপে ধাপে ফের বেসরকারিকরণের সূচনা হয়।

২) ১৯৯২ সালে রাজ্যগুলোকে ১৪৩টি কয়লা ব্লক ও সিঙ্গারেনি খনি থেকে কয়লা উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আবার ১৯৯৩ (জুন) সালে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি, ১৯৯৬ (মার্চ) সিমেন্ট কোম্পানি ও ২০০৭ সালে বেসরকারি কোল গ্যাসিফিকেশন ও লিকুইডিফিকেশন সংস্থাকে ক্যাপটিভ কয়লা খনি করার অনুমতি দেওয়া হল। ক্যাপটিভ মাইনস’এর কয়লা বাজারে বিক্রির জন্য নয় — ওই কয়লা ক্যাপটিভ মাইন’এর মালিক সংস্থাই ব্যবহার করবে শুধু, সংস্থার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলে সেখানে বা স্টিল প্ল্যান্ট থাকলে কোক-ওভেন বা ব্লাস্ট ফার্নেসে। পরবর্তীতে মাইনস অ্যান্ড মিনারেল (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন) অ্যাক্ট (২০০০) সংশোধনী অনুসারে সমস্ত রাজ্যগুলোকে কয়লাখনি চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে একথাও বলা হয় যেহেতু রাজ্য সরকারগুলোর কয়লা উৎপাদনের অভিজ্ঞতা নেই, তাই রাজ্যগুলো অভিজ্ঞতা আছে এমন বেসরকারি কোম্পানিকে দিয়ে আউটসোর্সিং করতে পারবে। ২০০৬ সালে ক্যাপটিভ মাইনসে ১০০ শতাংশ বিদেশী পুঁজি আসার ছাড়পত্র পায়।

৩) ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মোদী সরকারের মন্ত্রীসভা কয়লা শিল্পে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও বেসরকারি কয়লাখনির মালিকদের বাজারে কয়লা বিক্রিতে অনুমতি দিয়েছে।

৪) রানীগঞ্জ অঞ্চলে কয়লাখনির জন্য এতকাল তিনটি পদ্ধতিতে জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। (ক) ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইনে, রাজ্য সরকারের মাধ্যমে, (খ) কোল বেয়ারিং অ্যাক্টে, (গ) ডাইরেক্ট পারচেজ (জমি মালিকের কাছ থেকে কোল কোম্পানি সরাসরি জমি কিনে নিয়ে)। ২০১৩ সালে কোল বেয়ারিং অ্যাক্টটি পরিমার্জনা করা হয় যেখানে কয়লার জন্য অধিগৃহীত জমি অন্যান্য ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কাজেও ব্যবহার করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটি কংগ্রেস আমলে বেসরকারিকরণের একটি পদক্ষেপ।

পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ক্যাপটিভ মাইনসের ইতিহাসটিও খানিক স্মরণ করা জরুরি — যেহেতু ডাবলুবিপিডিসিএল দেউচা-পাঁচামীর দায়িত্ব পেয়েছে।

১) ১৯৯৬ সালে ডাবলুবিপিডিসিএল ও ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড (ডাবলুবিএসইবি) তারা (ইস্ট) ও তারা (ওয়েস্ট) কোল ব্লকের অনুমোদন পায় কয়লামন্ত্রকের থেকে, তাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চাহিদা মেটাতে। নজরুলের গ্রাম চুরুলিয়ায় এই খোলামুখ খনি অবস্থিত। ডাবলুবিপিডিসিএল’এর প্রথম ক্যাপটিভ মাইন এই তারা (ইস্ট) ও তারা (ওয়েস্ট)।

২) সেসময় ডাবলুবিপিডিসিএল ও ডাবলুবিএসইবি তারা (ইস্ট) ও তারা (ওয়েস্ট) কোল ব্লকের অপারেশন ও প্রোডাকশনের জন্য ইস্টার্ন মিনারেলস অ্যান্ড ট্রেডিং এজেন্সি (এমটা) কোম্পানির সাথে একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি গঠন করে, বেঙ্গল এমটা কোল মাইনস লিমিডেট। এমটার মালিক উজ্জ্বল উপাধ্যায় ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পুত্র চন্দন বসুর ঘনিষ্ঠ, ক্যাগের রিপোর্টে অভিযোগ ছিল এই জয়েন্ট ভেঞ্চারে কোনো টেন্ডার ডাকা হয়নি।

৩) তারা (ইস্ট) ও তারা (ওয়েস্ট) সহ পরবর্তী প্রতিটি ক্যাপটিভ মাইনিং প্রোজেক্ট এরিয়ায় ডাইরেক্ট পারচেজ অর্থাৎ মালিকের কাছ থেকে সরাসরি জমি কিনে মাইনগুলি চালাচ্ছিল ডাবলুবিপিডিসিএল। ২০১৯ সালে প্রকাশিত তারা (ইস্ট) ও তারা (ওয়েস্ট) কোল মাইনিং প্রোজেক্ট এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ও এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান রিপোর্টে পরিষ্কার লেখা আছে WBPDCL has decided to acquire the land as per the provisions of the National R&R Policy (whichever is more beneficial to the people) for which necessary budgetary provision has been made. The purchase of agriculture land will be made by paying appropriate mutually and voluntarily compensation agreed between agriculturist landowner and applicant— সরাসরি জমি কেনার কথা। বর্গাদার ও খেতমজুররা এক্ষেত্রে কোথাও জমির দাম বা ক্ষতিপূরণ পাননি। অন্যান্য চারটি খনি এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ও এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান খুঁটিয়ে পড়লেও দেখা যাবে জমি পারচেজ করা হয়েছে প্রোজেক্টের জন্য।

৪) তারা (ইস্ট) ও তারা (ওয়েস্ট) কোলিয়ারিতে বেঙ্গল-এমটা স্থানীয় জমিদাতাদের মধ্যে ১২০ জনকে চাকরি দিয়েছিল, বাকি শ্রমিক ঠিকাদারের মাধ্যমে বাইরে থেকে নিয়োগ করা হয়েছিল। খোলামুখ খনিতে প্রাইভেট কোম্পানি ঠিকাদারদের মাধ্যমেই শ্রমিক নিয়োগ করে।

৫) জমিদাতারা বাজার দরের চেয়ে বেশি মূল্য পাবার আশায় ছোটখাটো আন্দোলন ইত্যাদি করে থাকেন, কিছুদিন আগেই বীরভূমের গঙ্গারামচকের ডাবলুবিপিডিসিএল খোলামুখ খনির সম্প্রসারণের জন্যে নতুন করে জমির প্রয়োজন হয়েছিল, এবং জমিদাতারা দর বাড়ানোর দাবিতে ক্ষীণ প্রতিবাদের চেষ্টা করেছিলেন।

এখন প্রশ্ন হল, কোন অংশের জমি মালিক জমি দিতে আগ্রহী হচ্ছে এবং কেন? দেউচা নিকটবর্তী রানীগঞ্জ কয়লাঞ্চলের কথা ধরা যাক, যেহেতু সেটি পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন ও বিরাট কয়লার ব্লক, সেখানে একের পর এক খোলামুখ খনির সম্প্রসারণ হয়ে চলেছে। জমির মালিক যাদের স্থানীয় ভাবে ‘চাষি’ বলে, মধ্য জাতির (কাস্টের) অংশ অর্থাৎ পাল, ঘোষ, দাস, জমি বেচে দিতে উৎসাহী। কারণ হিসেবে বলা যায়, প্রথমত, গত দু’দশকে খোলামুখ খনির আশেপাশের কৃষিজমি ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, জলস্তর নেমে যাওয়া ও দূষণের কারণে — জমি টিকিয়ে রাখা যাচ্ছেনা। দ্বিতীয়ত, রানীগঞ্জ কয়লা অঞ্চলটি ইস্টার্ন কোলফিল্ড লিমিটেডের আওতায় যাদের পুনর্বাসন প্যাকেজ মধ্য ও বড় কৃষকদের কাছে আকর্ষণীয় — দুই একর জমির বিনিময়ে একটি চাকরি মেলে, এবং টাকাও। রানীগঞ্জের একটি কোলিয়ারির নিকটবর্তী গ্রামে শুনছিলাম অঞ্চলের কৃষক সম্প্রদায়ের দ্রুত বদলে যাওয়া মানসিকতার কথা। কয়েক দশক আগে এখানে কয়লাখনিতে, বিশেষত আন্ডারগ্রাউন্ডে চাকরি করা বিষয়ে এই মধ্য-জাতির কৃষকদের ঘোর অনীহা ছিল — মাইগ্র্যান্ট বিহারী, ওড়িয়া, ছত্তিশগড়ি, সাঁওতাল, স্থানীয় বাউরি, ডোম, মাল; এরাই খালি খনির গহ্বরে নামত। এখন মধ্য, বড় ও সম্পন্ন কৃষকরা জমি দিয়ে দিতে আগ্রহী, পরিবারের কয়েকটি মাথা ইসিএলে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি পেলে সেটাই লাভজনক মনে করছেন তারা। জমির মালিকানার দখল উচ্চবর্ণের, এবং এই দখলদারি বংশানুক্রমে সামাজিক-অর্থনৈতিক লভ্যাংশ তৈরি করে। আরেকটি কোলিয়ারিতে পরিচয় হয়েছিল এক ব্রাহ্মণ সন্তানের সাথে, ইস্টার্ন কোলফিল্ড লিমিটেডের মধ্যপদে চাকরি করছেন। তার শ্বশুরের প্রায় তিরিশ বিঘা জমি ছিল, খোলা মুখ খনিতে সেই জমি ঢুকে গিয়ে আটটি চাকুরির জন্ম দিয়েছিল। শ্বশুর মশাই তিন ছেলে, দুই জামাইকে ইসিএলে চাকরিতে ঢোকানোর পরও তিনটি চাকরি বেঁচে ছিল, সেই চাকরিগুলি বিক্রি করে দেওয়া হয়। জমি ইসিএলের হাতে যাওয়ার আগে জমির দলিল লিখে দেওয়া হয় অন্য চাকরি প্রার্থীদের নামে। বছর কুড়ি আগে প্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছিল এক-একটি চাকরি। নিচু জাতের লোকগুলি যারা কৃষি জমিতে মুনিষ খাটত, খেতমজুর ছিল অথবা দীর্ঘদিন জমিতে চাষ করেছে কিন্তু পাট্টা পায়নি, তাদের অবস্থা সমীক্ষা করে দেখুন, সাঁওতালদের অবস্থা সমীক্ষা করে দেখুন — তারা কয়লা চুরি করে, অজয়ের বালি ঘাটে লেবারের কাজ করে, ঠিকা শ্রমের কাজ করে, লটারি বেচে আর কেনে, চোলাই গিলে লুটোপুটি খায়। মাত্র দু’দশকে কৃষি অর্থনীতিকে ধ্বংস করে একটি ক্রিমিনাল ইকোনমি, ক্রিমিনাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছে খোলামুখ খনির সম্প্রসারণ, নয়া উদারীকরণের হাত ধরে। লাভবান হয়েছে উচ্চবর্ণ, বড় কৃষকের অংশ — তারা অধিকাংশই সটকে গেছে দুর্গাপুর, আসানসোলের দিকে, বাড়ি জমি কিনে। জমির উপর দখলদারি সামাজিক উত্তরণের, ক্ষমতায়নের সোপান; কোল বেল্টেও। খোলামুখ খনি ভগ্নস্তূপে পরিণত করছে রানিগঞ্জ কোল বেল্টের গ্রামগুলিকে, সেখানে পড়ে আছে নিচু জাত আর সাঁওতাল। সোশ্যাল আপওয়ার্ড মোবিলিটি, আর্বান শিফট সবই হয়েছে আপার কাস্টের।

Indigenous people do not agree

খোট্টাডি খোলামুখ খনির সম্প্রসারণে বিলপাহাড়ি গ্রামটি খনির গর্ভে যাবে তাই সেই গ্রামের পুনর্বাসন হয়েছে সিউড়ি হাইওয়ের ধারে। নতুন পত্তন হওয়া গ্রামে চাষিদের বাড়ি দেখলে মাথা ঘুরে যাবে, পেল্লায় তিনতলা আধুনিক প্রাসাদ। বাউরিপাড়া আলাদা গড়ে উঠেছে, একতলা বিহার-ইউপি’র ধাঁচে জানালা বিহীন দালান, আর মাঝিপাড়ায় (সাঁওতাল) পলেস্তারাহীন দু’কামরার ঘুপচি ঘর। উচ্ছেদ সবার হয়েছিল, পুনর্বাসন হয়েছে শ্রেণি ও জাতি বিভাগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। সাঁওতালদের চাষের জমি ছিলনা, বাস্তু-জমি চলে যাওয়ায় জন্য তারা ঘর পেয়েছে ওই দু’কামরার আর পাঁচলক্ষ টাকা। সেই কাঁচা টাকা খুব উদ্বায়ী — বাইক কিনে, মদে, জুয়ায় ফুস করে হাওয়া হয়ে গেছে। হাইওয়ের ঠিক উল্টোদিকে মহালক্ষ্মী ও সোনপুর বাজারি খোলামুখ খনি, বিরাট আকারের, সেই গ্রামগুলির আদিবাসী ও ভূমিপুত্ররা এখনও লড়ে যাচ্ছেন পুনর্বাসনের দাবিতে।

দেউচা-পাঁচামী’তে জমির বিনিময়ে চাকরি ঘোষণা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কিন্তু সেটা কী ধরনের চাকরি তাই নিয়ে প্রবল অস্বচ্ছতা রয়েছে। তবে এটা পরিষ্কার যে সেই চাকরি ইসিএল’এর প্রদান করা জমির বিনিময়ে স্থায়ী চাকরির বন্দোবস্ত নয়, যেখানে ডি গ্রেড কর্মীর বেতন হয় মাসিক পঞ্চাশ হাজার টাকার কাছাকাছি। আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২’র সংবাদে জানা যাচ্ছে বীরভূমের দেউচা-পাঁচামীতে প্রস্তাবিত কয়লাখনির পক্ষে-বিপক্ষে নানা দাবির সংঘাত চলার মধ্যেই সরকারি প্যাকেজ অনুযায়ী জমি দিতে সম্মত হয়ে অঙ্গীকারপত্রে সই করেছেন ওই এলাকার বেশ কয়েকজন জমি মালিক। অঙ্গীকারপত্রে সই করা জমি মালিকদের তিনজনের নাম বুদ্ধদেব গড়াই, সনৎকুমার গড়াই, দিব্যেন্দু ঘোষাল। ঘোষালরা রাঢ়ী বামুন। এই অঞ্চলের গড়াইরা ‘হাঁড়ি’ সম্প্রদায়ের নয়, তেলি ও ওবিসি। ধরে নেওয়া যায় এনারা কিছু জমির মালিক, নিও-লিবারাল যুগে বাংলার মধ্য কৃষক, গত কয়েক দশকে যাদের কৃষির পাশাপাশি পরিবারের অন্তত একজন সদস্যের স্কুলের চাকরি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, উচ্চশিক্ষার সংস্পর্শে উচ্চ অভিলাষ রয়েছে, বাজারের পণ্য-রতির সংস্কৃতি এদের ছুঁয়েছে। তাদের ‘কৃষক-চৈতন্য’র অভিমুখ শহরের দিকে হওয়াটা অর্থনৈতিক নিয়মেই স্বাভাবিক, জমি দিতে রাজি হওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব নেই। লক্ষ্য করার বিষয় হল একজনও গ্রামের আদিবাসীর নাম সংবাদপত্রের রিপোর্টে নেই, মুসলিমেরও। নাগরিক মঞ্চের রিপোর্ট বলছে, দেউচায় প্রস্তাবিত খনির জন্য ১১,২২২ একর জমির প্রয়োজন যার মধ্যে ৮১ শতাংশ, ৯,১০০ একর আদিবাসীদের জমি। দেওয়ানগঞ্জ হরিনশিঙার ভূমিহীন বা ছোট জমির মালিক আদিবাসীরা মরে গেলেও জমি দেবেনা এই বয়ান রাখছেন। তারা নিও-লিবারাল উন্নয়নের প্যারাডাইমের বাইরে, নিও-লিবারাল উন্নয়নের শিকার, সেই কাঠামোয় তাদের জীবন-জীবিকা-সংস্কৃতি ধ্বংস হয়।

কিছু মানুষ জমি দিচ্ছেন, সরকার সেটা বড় করে প্রচার করবে খুব স্বাভাবিক। সিঙ্গুরেও কয়েকশো একর জমি সরকারকে হস্তান্তর করেছিলেন ইচ্ছুক জমি মালিকরা। বামফ্রন্ট সেই অংশকে প্রগতিশীল বলে দাবি করেছিল, আজ তারাই দেউচার অনিচ্ছুক আদিবাসী মুসলিম অংশকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। ক্ষমতার স্বার্থে এসব করতেই হয়। আবার তৃণমূল কিছু আদিবাসী নেতাকে দালালির কাজে নামিয়েছে, বীরভূম আদিবাসী গাঁওতার দুই নেতা প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছেন কয়লাখনি হবেই। এমনও হতে পারে তাদের সাহায্যে, তাদের নামে জমির কাগজপত্র তৈরি করে আদিবাসীরা জমি দিতে প্রস্তুত এরকম বয়ান খাড়া করা হবে। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে জমিদাতারা ক্ষতিপূরণের চেক নেবেন বলেও প্রশাসন সূত্রের খবর। বীরভূমের জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, ‘‘প্রথম তালিকা থেকে ৪০ জন এবং দ্বিতীয় তালিকা থেকে ১০ জনকে বুধবার কলকাতায় পাঠানো হচ্ছে। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে চেক নেবেন। বুধবারই জেলায় কোথাও অনুষ্ঠান করে প্রশাসনের তরফে বাকিদের সেটা দেওয়া হবে। প্রশাসন সূত্রে খবর, লক্ষ্য রাখা হচ্ছে, যারা কলকাতা যাচ্ছেন তাঁদের অর্ধেক যাতে আদিবাসী মহিলা হন। যদিও এই ফটোসেশনটি মার্চের ১৩ তারিখ অবধি হয়নি, আদিবাসী জোগাড় হয়নি হয়তো।

দেউচা-পাঁচামী (এবং হরিণশিঙা দেওয়ানগঞ্জ)-তে প্রস্তাবিত কয়লাখনি ও শিল্পস্থাপনের বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি বিষয়কে পুনরায় উত্থাপন করেছে যা মূলধারার রাজনীতিতে, বিশেষত নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রায় অনুল্লেখিত থাকে। সারদা-নারদা, হিন্দু-মুসলমান, তোষণ-দুর্নীতি, অনুদান, মেরুকরণ-হিংসা ইত্যাদি নিয়ে চিল-চিৎকারের আবহে সামাজিক উন্নয়নের মডেল ও পরিকল্পনা, জমির মালিকানার প্রশ্ন, পরিবেশ, প্রকৃত কর্মসংস্থান ও উচ্ছেদের প্রসঙ্গগুলি প্রায় অনুচ্চারিত — ইচ্ছাকৃতভাবেই মূলধারার রাজনৈতিক দলেরা উক্ত প্রসঙ্গগুলি গুরুত্ব দেয় না। শাসকদলগুলির উন্নয়নের মডেলটি খুব চেনা; নির্বাচিত সরকার জমি, খনি, সরকারি সম্পদ, সরকারি ক্ষেত্রকে প্রাইভেট সেক্টরের (মাল্টিন্যাশানাল বা দেশীয় কর্পোরেট) জন্য তুলে দেবে, কখনো প্রকাশ্যে (যেমন নির্মলা সীতারমন কেন্দ্রে করছেন) কখনো ঘুরপথে — যেমন শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করছেন দেউচায়, যেমনটি শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চেষ্টা করেছিলেন সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে। এগুলিকেই উন্নয়নের দিশা, কর্মসংস্থানের পথ বলে সাধুবাদ দেবে বাণিজ্য সংস্থাগুলি, সাধুবাদ দেবে কর্পোরেট মিডিয়া — সপক্ষে হাজির করবে মুক্ত বাজারের, উন্মুক্ত বিনিয়োগের, ঊর্ধ্বমুখী জিডিপির যুক্তি। নিও-লিবারাল পুঁজিবাদ (যাকে অতীতে বামপন্থীরা সাম্রাজ্যবাদ বলত) বর্তমানে পৃথিবীর অর্থনৈতিক কাঠামো, সেই কাঠামো মেনে ভারতীয় শাসকশ্রেণী প্রতিটি প্রকল্প পরিকল্পনা করছে গত তিনদশক ধরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যত্যয় নন। আবার তিনি আঞ্চলিক শাসক থেকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হতে চান, কর্পোরেট প্রিয় হতে চান, তার হাতে খালি সঞ্জীব গোয়েঙ্কার মতো ছোট শিল্পপতি রয়েছে, বড় মাছ ধরতে তাকে দেউচা-পাঁচামীতে কয়লা শিল্প, তাজপুরে জাহাজ শিল্পের জন্য বেসরকারি বিনিয়োগের পথ মসৃণ করতে হবে। আপাতত তার প্রধান মাথাব্যথা, অঙ্গীকারপত্রে সই করতে অসম্মত, কয়লাখনি বিরোধী, জল-জঙ্গল-জমিনের আদিবাসী মানুষ।

- অভিজ্ঞান সরকার

how are sharecroppers

এদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই, বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা যেমন মনস্যান্টো, মিত্তাল-ভারতী, পেপসিকো ইত্যাদি কোম্পানি একলপ্তে একরের পর একর জমিতে কৃষকদের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে আধুনিক পদ্ধতিতে রকমারি চাষাবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। এরাজ্যেও এই ধরনের চুক্তি চাষের, বিশেষত পেপসিকোর হাত ধরে আলু চাষের ভালই প্রসার ঘটেছে। পেপসিকোর উদ্যোগে আলু চাষে ধনীচাষিদের সঙ্গে যেমন চুক্তি হচ্ছে তেমনই দু’এক বিঘে জমির মালিক — এমন গরিব চাষিও পেপসি কোম্পানির চুক্তিতে সই করে আলু চাষ করছেন। কর্পোরেট উদ্যোগে এই যে চুক্তি চাষ তাকে ঘিরে আমরা এখানে আলোচনা করছিনা। গ্রাম বাংলার সর্বত্রই জমির মালিক তথা সম্পন্ন কৃষকরা নিঃস্ব, ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকদের বা নিতান্ত গরিব কৃষকদের (অর্থাৎ যারা মাত্র এক-আধ বিঘে জমির মালিক) মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে জমি ঠিকা দিচ্ছেন। গরিব এই ঠিকা চাষিদের এধরনের চাষে লাভ-লোকসান কেমন হচ্ছে তা নিয়েই বর্তমান নিবন্ধের অবতারণা। এই জাতীয় ঠিকা চাষের গতি-প্রকৃতি জানার জন্য হুগলী জেলার পান্ডুয়া ব্লকের দু’টি গ্রামের চাষিদের মধ্যে অনুসন্ধান চালানো হয়। তারই ভিত্তিতে এই নিবন্ধটি রচিত। আশা করা যায়, অনুসন্ধানে উঠে আসা বৈশিষ্ট্যগুলো রাজ্যের অন্যান্য অংশের জন্যও প্রযোজ্য। ঠিকা-চাষিদের সঙ্গে ভাগচাষিদের কথাও এখানে আলোচিত হয়েছে।

ঠিকা-চাষ আর ভাগচাষের মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে। ভাগচাষের ক্ষেত্রে মালিক সার, কীটনাশক ও সেচের জলের খরচের অর্ধেক বহন করে। আর ট্রাক্টর, বীজ ও শ্রমিকের মজুরির খরচ পুরোটাই ভাগচাষিকে বহন করতে হয়। ঠিকাচাষে মালিক জমির ভাড়া বাবদ টাকা বা ফসলের অংশ পায়। চাষের যাবতীয় খরচ ঠিকা-চাষির।

ঠিকা-চাষ আগের তুলনায় বেড়ে যাওয়ার একাধিক কারণ লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, চাষের খরচ দিন দিন বাড়তে থাকায় এক শ্রেণীর জমির মালিক ঝুঁকিপূর্ণ চাষে না গিয়ে জমি ঠিকায় দিয়ে মরশুমের শেষে নিশ্চিত কিছু নগদ অর্থ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল আদায় করে নিতে পারছেন। অনুপস্থিত জমি মালিক, বিধবা বা মহিলা প্রধান পরিবার, চাষ ভিন্ন অন্য পেশাই যাঁদের রোজগারের মূল উৎস তাঁরাই প্রধাণত জমি ঠিকায় দিতে বেশি আগ্রহী। দ্বিতীয়ত, ব্যয়বহুল কোনো কোনো চাষে জোতদার ও ধনী চাষিরাও পুঁজি না ঢেলে গরিব ভূমিহীনদের জমি ঠিকাতে দিয়ে দেন। যেমন বোরো ধান ধনীচাষিরা আর চাষ করেন না। বোরো ধান ওঠার সময় একদিকে যেমন ঝড়-বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, অন্যদিকে যথেষ্ট সংখ্যক মজুর না পাওয়ার বিপদ। ঠিকা বা ভাগচাষ বৃদ্ধির অপর আরেকটি কারণ রাজনৈতিক। আমন চাষ না করলে অথবা কেবল এক মরশুম চাষ করলে ঠিকা বা ভাগচাষি বর্গা রেকর্ড করার সুযোগ পাবেনা। সুতরাং ঠিকা প্রথায় চাষ বা ভাগচাষ মালিকের পক্ষে নিরাপদ। মালিক ফসলের ভাগ বা টাকাও পেলেন, চাষ না করেও কেসিসি ঋণ পেলেন, কৃষক বন্ধু প্রকল্পের টাকা পেলেন আর আলেকালে বাংলা শস্য বীমার আওতায় ফসলের ক্ষতিপূরণও পেলেন। কিন্তু ভাগচাষিরা কী পেলেন?

দেখা যাচ্ছে, একজন ভূমিহীন ভাগচাষি ২ বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করে ১৬ বস্তা ধান ফলিয়েছেন। মালিক পেলেন ৮ বস্তা ধান। বীজ, লাঙ্গল (ট্রাক্টর) ও শ্রমিকের মজুরি পুরোটা নিজে মেটানো এবং বাকি খরচের অর্ধেক বহন করার পর দেখা যাচ্ছে, তাঁর ওই দুʼবিঘে আমন চাষ করে মাত্র দুʼহাজার টাকা লাভ হয়েছে। হ্যাঁ, খড় বিক্রি করে তিনি আরও আটশো টাকা পেয়েছেন।

আবার একজন ভূমিহীন ভাগচাষি ২২ কাঠা জমিতে বোরো ধান চাষ করে ১০ বস্তা ধান ফলিয়েছেন। মালিককে অর্ধেক ধান দেওয়ার পর তাঁর ঘরে ঢুকেছে ১,৭৫০ টাকা মাত্র। খড় বেচে যে তিনি আরও কিছু টাকা পাবেন সে উপায়ও নেই। কারণ বোরোতে ধানকাটা মেশিনে ধান কাটা হয়। ফলে খড় সব খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়। এই দুই ভাগচাষির চাষ করার জন্য সমবায় সমিতি থেকে কোন ঋণ পাওয়ার সুযোগ নেই। বছরের পর বছর মাটির বাড়িতেই রয়েছেন, সরকারি প্রকল্পে এক কুঠুরি ঘরও তাঁরা পাননি।

একজন ভূমিহীন কৃষক (কৃষিমজুর) ২ বিঘে জমিতে চুক্তি ভিত্তিতে (ঠিকায়) বোরো ধান চাষ করে ১৮ বস্তা ধান ফলিয়েছিলেন। মালিককে চুক্তি অনুযায়ী দিতে হল ৪ বস্তা ধান। বাকি যে ধান রইল তারমধ্যে ৫ বস্তা ধান চাষের খরচ মেটাতেই চলে গেল। বাকি ধান যা রইল তা ওই চাষির কথায়, “মাস চারেক ঘরের চালে খেয়ে মেখে, আর কিছু ধান দু’মাস পরে বেচে হাজার পাঁচেক টাকা হাতে পেলাম।” কয়েক মাসের খোরাকি আর পাঁচহাজার টাকার জন্য এত প্রাণপাত পরিশ্রম! এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার, সেটা হল সব মালিক সমান নয়। বিঘেয় তিন বস্তা ধান দেওয়ার শর্তেও গরিব চাষিকে রাজি হয়ে যেতে হয়। সে যাক। যাঁরা একটু বেশি জমিতে আবাদ করেন, তাদের অবস্থা? একটু যাচাই করা যাক। নিজের সামান্য একটু জমি থাকলে তবেই তো বেশি জমি ‘ঠিকে’ করার জন্য পাওয়া যাবে। এই গরিব চাষিটির নিজস্ব জমি দশ কাঠার সামান্য বেশি। তিনি ঠিকাতে এবছর প্রায় ৯ বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছিলেন। মালিককে বিঘে পিছু ২,৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। তিনি ৮২ বস্তা ধান ফলিয়েছেন। সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে তিনি সাকুল্যে লাভ করেছেন মাত্র ২,৫৭০ টাকা। অন্য বছর অবশ্য এত খারাপ পরিস্থিতি হয় না। এবার দুʼবিঘে ধান জলের তলায় চলে গিয়েছিল। অন্যবারে তা হয়নি; এমনকি গতবছর তিনি মোট ১১৫ বস্তা ধান ফলিয়েছিলেন এবং ৫৭ বস্তা বেঁধে রাখতে পেরেছিলেন। গড় হিসেব করলে বলা যায়, বেশি জমি চাষ করার ফলে কিছু আয়ের মুখ তিনি দেখেছেন। পাকা বাড়িও করেছেন। তবে ঠিকা-চাষের যদি সামগ্রিক ছবি বিচার করা যায় তাহলে ওই পর্যন্ত। অর্থাৎ “ক’মাস ঘরের চালেই রান্না বাদেও দু’চার হাজার টাকা লাভ”। আর হুড়মুড়িয়ে সব গরিবই যে ঠিকা-চাষ করেন, তথ্য তা বলে না। ২৭৫টি গরিব পরিবারের মধ্যে সর্বাধিক ৭৬টি পরিবার বোরো চাষ করেন (প্রায় ২৮ শতাংশ)। এবছর ডিভিসি জল না দেওয়ায় পরিমাণটা আরও কমে গেছে।

বোরো ধান ছাড়া অনেক গরিব আলু চাষও ঠিকা প্রথায় করে থাকেন। অবশ্যই নিজের জমানো টাকায় বা কারো কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে এই যে চাষ, তাতে এবছর গরিব ঠিকা চাষিদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। অসময়ের বৃষ্টিতে দু’বার করে চাষ করতে গিয়ে দেখা গেছে, চড়া দামে নিম্নমানের বীজ ব্যবহারের ফলে ও সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় বিঘা পিছু মাত্র ৩০-৩২ বস্তা (৫০ কেজি বস্তা) ফলন হয়েছে (হওয়ার কথা ৮০ থেকে ৯০ বস্তা)। অর্ধেকেরও বেশি গরিব চাষির সমূহ লোকসান হয়েছে। আলুচাষে গরিব চাষিরা আড়তদারের (মহাজন) কাছ থেকে দাদন নিয়েও অনেকে চাষ করেন। মহাজন বেশি দামে সার ও বীজ গছিয়ে পরে কম দামে আলুটা কিনে নেয়। এতে লোকসান হলেও আবার মহাজনের থেকে ঋণ করে ক’মাস চালিয়ে পরের বছরের জন্য ভাগ্য পরীক্ষা করতে হয়। অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। ‘উদার’ মালিকের কাছে বিঘে পিছু তিন বস্তা আলু দেওয়ার শর্তে (কোন কোন মালিক বিঘেয় ১০ বস্তা পর্যন্ত নেয়) কঠোর পরিশ্রমী এক আদিবাসী কৃষক দু’বিঘে জমিতে ১১০ বস্তা আলু ফলিয়ে মহাজনের ঋণ মিটিয়েও ৫০ বস্তা আলু হিমঘরে মজুত করেছেন। তবে এমন চাষির সংখ্যা খুবই কম।

গরিব চাষিরা লিজ নিয়ে সবজি চাষও করেন। সেক্ষেত্রে ভালো লাভের মুখও দেখেন অনেকে। অনেক মধ্যচাষিও সবজি চাষে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু আমরা বলছি গরিব লিজ চাষিদের কথা। কখনোই গরিব ভূমিহীনদের বড় অংশ এই ব্যয়সাধ্য চাষ করতে পারেন না। ওই ২৬৫টি পরিবারের মধ্যে সবজি চাষ করেন মাত্র ২০টি পরিবার। ঘটনাক্রমে সুনা জমি (আউশের জমি) যারা পেয়ে যান, সেখানে সারা বছরই পালা করে বিভিন্ন সবজি (কপি, টম্যাটো, ভেন্ডি, শসা ও করলা) চাষ করে ভালো লাভ করেন। আর যে ব্যক্তি কয়েক মাসের জন্য শুধু আমন জমিতে একটি মাত্র সবজি ফলান তাঁর সংসারে কোন শ্রীবৃদ্ধি হয় না।

অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ঠিকা বা ভাগচাষিদের আর্থিক অবস্থার কোন উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। পরিশ্রমী এই কৃষকরা যদি ‘কৃষকের’ স্বীকৃতি পান তাহলেই কেবল এঁদের সংসারের হতশ্রী চেহারাটা বদলাতে পারে। জমির কাগজ নেই, সুতরাং তাদের কিছুই নেই। এই নীতির বদল ঘটাতে হবে। জমির মালিকানার প্রশ্ন আপাতত নাহয় দূরে রাখা যাক। কিন্তু সরকার প্রকৃত এই কৃষকদের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখিয়ে গ্রামে গ্রামে সমীক্ষা চালাক। কারা কোন জমি একটি শস্য-মরশুমে চাষ করলেন — তার পূর্ণ পরিসংখ্যান তৈরি করে ঠিকা ও ভাগচাষিদের শংসাপত্র দেওয়া হোক। এই শংসাপত্রের ভিত্তিতেই তাঁরা সমবায় ঋণ, শস্যহানির ক্ষতিপূরণ, সুলভে সার-বীজ-ডিজেলের মতো উপকরণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। আর এ মুহূর্তে কৃষি দপ্তরের কাজ হওয়া উচিত, পাম্পসেট, থ্রেশার, স্প্রে মেশিন ইত্যাদি কৃষি সরঞ্জাম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গরিব ঠিকা ও ভাগচাষিদেরই সরবরাহ করা।

- মুকুল কুমার

next coriander poddari

আম জনতার পকেট মেরে মোদী সরকার সেই ‘লুঠের’ টাকা দিয়ে তাঁর বহু বিজ্ঞাপিত কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো রূপায়িত করছে গত কয়েক বছর ধরে! ২০২০-২১ সালে দেশের কোটি কোটি নাগরিক কেন্দ্রীয় কোষাগারে শুধুমাত্র জ্বালানি খাতে কর বাবদ ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার ৬৯ কোটি টাকা (এরসাথে যুক্ত হবে বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলোকে দেওয়া ওই একই খাতে ২ লক্ষ ১৭ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা) দিতে বাধ্য হয়েছে। আর, ওই একই সময়কালে ভারতের ১৪২ অর্বুদপতির সম্পত্তির পরিমান ২৩ লক্ষ ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫৩ লক্ষ ১৬ হাজার কোটি টাকা! অর্থাৎ, ওই স্বল্প সময়ে তাঁরা তাঁদের সম্পত্তির পরিমান বাড়িয়েছে ৩০ লক্ষ কোটি টাকা!

নানান ধরনের কল্যাণমূলক প্রকল্প চলুক আম জনতার পকেটের টাকায়। আর, অতি ধনীদের জন্য যেমন ঢালাও আর্থিক ছাড় ছিল, তা বজায় থাকুক — এই হল মোদী সরকারের আর্থিক দর্শন। তাই, কর্পোরেটদের স্বার্থে প্রথমেই কর্পোরেট কর ২২-২৫ শতাংশ হারে ছেঁটে দেওয়া হল, নতুন বিনিয়োগগুলোর ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে চালু করা হল এক উদার কর ব্যবস্থা। ৩০ শতাংশ হারে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত আয়কর আর তার সাথে ওই করের উপর ৪ শতাংশ হারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সারচার্জ বজায় রাখা হল। সম্পত্তি কর বাতিল করা হল, উত্তরাধিকার কর বসানোর চিন্তা মাথায় রাখাই হল না।

জিএসটি ও জ্বালানির উপর কর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যেন আলিবাবার সেই আশ্চর্য গুপ্তধন। আর, সেই গুপ্তধন থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে তাকে বিন্দুমাত্র মেহনত করতে হল না। আম জনতা প্রতিদিন প্রতি মিনিটে সেই বিপুল ধন তুলে দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। শুধু একবার চোখ বোলানো যাক পেট্রোল-ডিজেলের উপর আবগারি শুল্কের হারের ওপর, ক্ষমতায় আসার পর মোদী সরকার যা প্রবর্তন করে।

মে ২০১৪ — পেট্রোল-ডিজেলের উপর আবগারি শুল্ক ছিল লিটার পিছু যথাক্রমে ৯.২০ টাকা এবং ৩.৪৬ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ২৬.৯০ টাকা এবং ২১.৮০ টাকা।

মে ২০১৪ — পেট্রোল-ডিজেলের উপর দাম ছিল লিটার পিছু যথাক্রমে ৭১.৪১ টাকা এবং ৫৫.৪৯ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০১.৮১-১১৬.৭২ টাকা এবং ৯৬.০৭-১০০.১০ টাকা। কপালে চোখ তুলে দেওয়া মতো বেড়েছে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম — ৪১০ টাকা (মে ২০১৪ সালের দাম) থেকে এখন প্রায় ৯৪৯.৫০-১০০০.০০ টাকায়!

পকেটে ছুরি চালিয়ে মোদী সরকার এই টাকা আম নাগরিকের কাছ থেকে আদায় করেছে যখন কিনা অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল পিছু ১০৮ ডলার, আর এই দামটাই বজায় ছিল মে ২০১৪ সাল থেকে। ২০১৯-২০২১ ব্যারেল পিছু গড় দাম ঘোরাফেরা করেছিল ৬০ ডলার।

পেট্রলিয়ামখাতে জমা পড়া কেন্দ্রীয় রাজস্বের হার যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, তা দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

২০১৪-১৫ সালে এই খাতে জমা রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৭২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা।

২০১৫-১৬তে — ২লক্ষ ৫৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা।
২০১৬-১৭তে — ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।
২০১৭-১৮তে — ৩ লক্ষ ৩৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।
২০১৮-১৯তে — ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার ৪১ কোটি টাকা
২০১৯-২০তে — ৩ লক্ষ ৩৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
২০২০-২১তে — ৪ লক্ষ ৫৫ হাজার ৬৯ কোটি টাকা।
২০২১-২২তে — (আনুমানিক) ৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা।

মোট — ২৬ লক্ষ ৫১ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা!

কারা দিয়েছেন এই টাকা?

দেশে আনুমানিক ২৬ কোটি পরিবার রয়েছে। অর্থাৎ, পরিবার পিছু ১ লক্ষ টাকা মোদী সরকার এই বাবদ রাজস্ব আদায় করেছে।

যে চাষিরা ডিজেল চালিত পাম্প সেট চালায়, দু’চাকা-চার চাকা গাড়ির মালিক, অটো-ট্যাক্সি চালক, নিত্যযাত্রী, গৃহিনী, তাঁরাই এই টাকা ভরেছেন মোদীর সিন্দুকে। এই রাজস্ব আদায় করে এবার কোভিডকালীন ‘কল্যাণমূলক প্যাকেজ’ বাজারে ছেড়েছে মোদী সরকার। দেখা যাক, ২০২০ সাল থেকে সরাসরি কী কী বাড়তি সুযোগ সুবিধা হস্তান্তর করা হয়েছে?

দু’বছর নিখরচায় খাদ্যদ্রব্য সামগ্রী বিতরণ খাতে খরচ হয়েছে ২ লক্ষ ৬৮ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। মহিলাদের ব্যাঙ্কে সরাসরি নগদ হস্তান্তর বাবদ ৩০ হাজার কোটি টাকা, বছরে কৃষকদের ৬,০০০ টাকা প্রদান বাবদ বাৎসরিক খরচ ৫০,০০০ কোটি টাকা, আর এছাড়াও ছোটখাটো কিছু অনুদান রয়েছে। সব মিলিয়ে এই খাতে বাৎসরিক খরচ ২ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি নয়। আর, যা কেন্দ্র কর্তৃক আদায় করা শুধুমাত্র বাৎসরিক জ্বালানি বাবদ রাজস্ব থেকে বেশ খানিকটা কম!

কিছুদিন আগে, সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) এক সমীক্ষা প্রকাশ করে। তাতে জানানো হয়েছে, গত পাঁচ বছরে ভারতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা বেশ অনেকটাই কমেছে — জানুয়ারি ২০১৭-তে যা ছিল ৪০.১ কোটি তা মার্চ ২০২২এ এসে দাঁড়িয়েছে ৩৯.৬ কোটি। যদিও ওই একই সময়ে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ১৩০.৫ কোটি থেকে ১৩৭.৪ কোটি পর্যন্ত। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হল, পরিবারগুলোর আর্থিক সঙ্গতি ক্রমেই নিম্নমুখী। প্রায় ৫৭ শতাংশ পরিবার, এই সমীক্ষা অনুযায়ী, মাসে মাত্র ১৬,৬৬৬ টাকা উপার্জন করে। আবার ১৭ শতাংশ পরিবারকে মাসে মাত্র ৮,৩৩৩ টাকা উপার্জন করেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। গড়পড়তা মজুরি হল মাসে প্রায় ১৪,০০০ টাকা। দীর্ঘ সময় ধরে, অনেক কম মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন শুধু গরিব খেটে খাওয়া মানুষেরাই নন, বরং বিরাট সংখ্যক মধ্যবর্গের মানুষও। কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা জানুয়ারির ২০১৭ সালে ছিল ৪৫ শতাংশ, যা মার্চ ২০২২এ হয়েছে ৪০ শতাংশ। আকস্মিকভাবে এটা কমে যাওয়া গুরুতর যে সমস্যাকে চিহ্নিত করে তা হল, কাজ না পেয়ে বা হন্যে হয়ে ঘুরেও মনমতো কাজের সন্ধান না পেয়ে অনেকেই কাজের বাজার থেকে সরে আসছেন হতাশায়, অন্য কিছু করার কথা ভাবতে শুরু করেছেন।

আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির কোপে সাধারণ মানুষ বেসামাল। চার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে জেতার পর মোদী সরকার আরও বেপরোয়া। গভীর সংকটের আবর্তে দেশ, দেশবাসী। প্রতিরোধ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

- অতনু চক্রবর্তী

Moradabad in Uttar Pradesh

বিশ্বের বাছাই কিছু শহরের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ শহর। তবে, তার নেপথ্যে উল্লাস করার মতো কোনও কারণ নেই। বরং, এমন তালিকায় নাম ওঠায় লজ্জিত হতে হবে গোটা দেশকেই।

তথ্য বলছে, বিশ্বের মধ্যে যে শহরগুলিতে শব্দদূষণ মাত্রা ছাড়িয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ। তালিকায় তার স্থান দ্বিতীয়! রাষ্ট্রসংঘের (United Nations Environment Programme) তরফ থেকে প্রকাশ করা সমীক্ষা রিপোর্টেই এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তার ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছে তালিকা।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই তালিকায় প্রথম তিনে যে তিনটি শহরের নাম রয়েছে, তারা পরস্পরের প্রতিবেশি রাষ্ট্রে অবস্থিত! যেমন, এক নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, দুইয়ে ভারতের মোরাদাবাদ এবং তৃতীয় স্থান দখল করেছে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ। পিছিয়ে নেই ভারতের রাজধানী দিল্লীও। শব্দদূষণে জর্জরিত শহরগুলির তালিকায় নাম উঠেছে তারও। সঙ্গী কলকাতা, আসানসোল এবং জয়পুর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী, বসত এলাকায় বাড়ির বাইরে যে কোনও জায়গায় শব্দের উচ্চসীমা ৫৫ ডেসিবেলের মধ্যে থাকা উচিত। বাণিজ্যিক ও আর্থিক অঞ্চলগুলিতে তা বেড়ে ৭০ ডেসিবেল পর্যন্ত হতে পারে। যেখানে প্রচুর গাড়ি যাতায়াত করে, সেখানেও শব্দের সর্বোচ্চ সীমা ৭০ ডেসিবেলের মধ্যেই থাকা উচিত। কিন্তু, বিশ্বের বহু জনবহুল শহরেই এই ঊর্ধ্বসীমা মেনে চলা হয় না। এমনকী, বহুক্ষেত্রেই পরিস্থিতি সামলাতে প্রশাসনের তরফে তেমন কোনও উদ্যোগও চোখে পড়ে না।

উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ শহরটি ভারতের অন্যতম ব্যস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ রফতানি কেন্দ্র। সমীক্ষা বলছে, এই শহরে শব্দের ঊর্ধ্বসীমা ১১৪ ডেসিবেলে পৌঁছে গিয়েছে! অন্যদিকে, বাংলাদেশের রাজধানী সেদেশের বস্ত্রশিল্পের প্রধান কেন্দ্র। তাই সেখানেও শব্দের দাপাদাপি মারাত্মক।

ওাকিবহাল মহলের বক্তব্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবসায়িক লাভকে সবথেকে বড় করে দেখা হয়। সেখানে মানুষের স্বাস্থ্য কলকে পায় না। আর তা যদি হয় জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত, তাহলে তো কথাই নেই। তৃতীয় বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আমজনতার স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশাসনকে খুব একটা মাথা ঘামাতে দেখা যায় না। ফলে শব্দদূষণের মতো একটি গুরুতর সমস্যা চিরকালই অবহেলিত থেকে যায়। তবে এরফলে গণহারে শ্রবণ ক্ষমতা লোপ পেতে পারে।

গোটা বিশ্বের নিরিখে দক্ষিণ এশিয়ায় শব্দদূষণের মাত্রা সবথেকে বেশি। অন্যদিকে, ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকায় শব্দ দূষণের হার সবথেকে কম। দিল্লী ও কলকাতায় শব্দ দূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৮৩ এবং ৮৯ ডেসিবেল। কলকাতা শব্দদূষণ তালিকার ১৪ নম্বরে রয়েছে।

- এই সময়, ২৭ মার্চ ২০২২

many school problems

নিয়ম অনুযায়ী ফি’বছর যত টাকা পাওয়ার কথা, চলতি অর্থবর্ষে বিভিন্ন স্কুল পেয়েছে তার অর্ধেক। অথচ করোনার জেরে নিত্য জীবাণুমুক্তি-সহ নানান কাজ যেমন বেড়েছে, তারজন্য বেড়েছে অর্থের প্রয়োজনও। অথচ স্কুলের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার জন্য শিক্ষা দফতর যে অর্থ স্কুলকে দেয়, সেই কম্পোজিট গ্র্যান্টের টাকা স্কুল পুরো পাচ্ছে না বলে অভিযোগ প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।

স্কুল প্রধানেরা জানান, অতিমারীর জন্য প্রায় দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকলেও স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের খরচ কিছুমাত্র কমেনি, বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে তা বেড়ে গিয়েছে। কম্পোজিট গ্র্যান্টের টাকা তাই কোনওভাবেই কমানো যায় না। আবার কিছু প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকার অভিযোগ, ২০২১-২২ আর্থিক বছরে কম্পোজিট গ্র্যান্টের যত টাকা পাওয়ার কথা ছিল, মিলেছে তার অর্ধেক। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও এই অভিযোগ করছেন।

উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কিছু স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা জানান, যেসব স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা এক হাজারের বেশি, কম্পোজিট গ্র্যান্টে প্রতিবছর তাদের এক লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা। পাঁচশো থেকে এক হাজার পড়ুয়ার স্কুলের বছরে পাওয়ার কথা ৫০ হাজার টাকা। অভিযোগ, চলতি অর্থবর্ষে (২০২১-২২) এই ধরনের স্কুলে কম্পোজিট গ্র্যান্টে টাকার পরিমাণ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বক্তব্য, গতবছর করোনার জন্য স্কুল বন্ধ থাকলেও ‘অ্যাক্টিভিটি টাস্ক’ বা গৃহপাঠের প্রশ্ন ফোটোকপি করা থেকে শুরু করে স্যানিটাইজেশন বা জীবাণুনাশ-সহ অন্যান্য খরচ বেড়ে গিয়েছে। এখনও স্কুল চালাতে হচ্ছে করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনেই।

দক্ষিণ চাতরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, তাঁর স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ১,৮০০। তাঁদের বছরে এক লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু পেয়েছেন তার অর্ধেক। তিনি জানান, প্রতি মাসে গৃহপাঠের প্রশ্ন ফোটোকপি করা, জীবাণুমুক্তি তো রয়েছেই। এছাড়াও স্কুলে একটি শিক্ষা সংক্রান্ত সরকারি অনুষ্ঠানে ২৮টি ফ্লেক্স বানাতে হয়েছে তাঁদের। ওই প্রধান শিক্ষক বলেন, শিক্ষা দফতর থেকে কোনও নির্দেশ এলেই বলে দেওয়া হয়, কম্পোজিট গ্র্যান্ট থেকে টাকা খরচ করুন।

একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক তথা ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রাইমারি ট্রেন্ড টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সভাপতি জানান, যেসব স্কুলে একশো জনের মতো পড়ুয়া আছে, কম্পোজিট গ্র্যান্ট বাবদ তাদের সেখানে ২৫ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু চলতি অর্থিক বছরে মিলেছে সেই টাকার অর্ধেক। স্কুল বন্ধ থাকায় বিদ্যুতের খরচ ও চক-ডাস্টার কেনার খরচ শুধু কিছুটা বেঁচেছে ছিকই। কিন্তু বাকি সব খরচ প্রায় একই রয়েছে।

উপরন্তু করোনার জেরে স্কুলে জীবাণুনাশ-সহ নানা খাতে খরচ বেড়েছে অনেক। আগামী শিক্ষাবর্ষে কম্পোজিট গ্র্যান্টে বরাদ্দ পুরো অর্থ না-পেলে স্কুলের পরিকাঠামোগত সমস্যা দেখা দেবে।

- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ মার্চ ২০২২

the unemployed is burning

(এখানে দুই কিস্তি একত্রে দেওয়া হল)

আজ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে দুর্নীতি কোনো পৃথক শব্দ নয়। এ যেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটা প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সংবাদ শিরোনামে দুর্নীতি শব্দটা এতটাই প্রতিফলিত যে শিক্ষিত বেকাররা সরকারের বিশেষ প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে বলছে – “দুয়ারে দুর্নীতি”। কিন্তু প্রশ্ন হল এই দুর্নীতির জয়যাত্রার শুরু কবে থেকে? এর শিকড়ের সন্ধান অবশ্য পুরোপুরি পাওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা যারা চাকরির দাবিতে বছরের-পর-বছর রাস্তায় পড়ে ছিলাম এবং আছি নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে। তাদের কাছে এই ব্যাপারটা অনেকটাই স্পষ্ট।

পূর্বতন সরকারের আমল থেকেই এ রাজ্য শিল্প শ্রীহীন, কর্মসংস্থানহীন। তাই সরকারি চাকরি বলতে এ রাজ্যের শিক্ষিত বেকাররা বুঝতো এসএসসি (শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষা)। বাম আমলে একটা সময় ছিল যখন ম্যানেজিং কমিটির হাত ধরে, নেতা মন্ত্রীর সংস্পর্শ প্রাপ্ত ব্যক্তিদেরই মিলতো নিয়োগপত্র। এই বিষয়ে জনরোষ বাড়তে থাকলে সরকারি উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল স্ব-শাসিত সংস্থা — এসএসসি ( স্কুল সার্ভিস কমিশন)। ধারাবাহিকভাবে নিয়মমাফিক প্রতিবছর সংঘটিত এই পরীক্ষা ছিলো পশ্চিমবাংলার গরিব মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বেকারদের স্বপ্ন সাফল্যের সোপান। তারপর একদিন পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হল। দীর্ঘ এক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে শিক্ষিত কর্মপ্রার্থীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তারা বুঝতে পেরেছিল অবস্থা আরো ভয়ানক হতে চলেছে। হলোও তাই। ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকা স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের যে পরীক্ষা তা অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২ সালে যে পরীক্ষা হয়েছিল সেই পরীক্ষার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির বড়োসড়ো অভিযোগ ওঠে। তৈরি হয় সিএমপি কেস (কম্বাইনড মেরিট প্যানেল) প্রাইমারির ক্ষেত্রেও উঠে একই অভিযোগ। টেট কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসলেও তার সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি। কোনো নেতা, মন্ত্রী, আমলাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এই সময়ের দুর্নীতি প্রসঙ্গে সাম্প্রতিককালে একটি সংবাদ মাধ্যমের সাক্ষাত্কার দিতে গিয়ে সেই সময়কার স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মাননীয় চিত্তরঞ্জন মণ্ডল মহাশয়ের বক্তব্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার বিভিন্ন বক্তব্যের পাশাপাশি — পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে কি হয়েছিল আপনি কি জানেন না? তার এই ইঙ্গিত যে বিশেষ এক অধ্যায়কে নির্দেশ করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কে ছিলো সেই সময়কার প্রভাবশালী তা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মধু শেষ হলে মৌমাছিরা ফুল বদলাতে পারে কিন্তু নিজেদের স্বভাব পরিবর্তন সম্ভব নয়।

২০১২ সালের এই অমীমাংসিত দুর্নীতির উপরে আছড়ে পড়ল নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি (২০১৪-১৫ সাল নাগাদ) সে বিজ্ঞপ্তিও সহজভাবে আসেনি। চাকরি প্রার্থীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ শহর কলকাতার বুকে আছড়ে পড়েছিল একটার পর একটা আন্দোলন। তার ফলে নতুন বিজ্ঞপ্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। এবার পরীক্ষা পদ্ধতিতেও একটা আমুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। আগে এসএসসি শিক্ষক নিয়োগের যে পরীক্ষা নিতো তা ছিল আরএলএসটি (অর্থাৎ রিজিওনাল লেভেল সিলেকশন টেস্ট) এইবার সেই নিয়ম পরিবর্তন করে বানানো হলো এসএলএসটি (স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্ট)। বর্তমানে এই এসএলএসটি-র মাধ্যমে তৈরি হওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের যে প্যানেল তা বিশেষভাবে চর্চিত এবং কাঠ গড়ায় দণ্ডায়মান।

এসএলএসটি-র নিয়োগ দুর্নীতি সম্পর্কে আলোচনার আগে এসএসসি — গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়টা সামনে আসা দরকার। এসএলএসটি-র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ফল প্রকাশ এর পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল গ্রুপ-ডি এবং গ্রুপ-সি কর্মচারী নিয়োগ সংক্রান্ত মেধা তালিকা। প্রথম থেকেই চাকরিপ্রার্থীরা নানা অভিযোগ নিয়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য তাদের অভিযোগগুলিকে মধুমাখা বাক্যলাপে খন্ডন করে, প্যানেলের স্বচ্ছতার পক্ষেই সওয়াল করেছিলেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে তারা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলো। তারপর বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের বুকের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকটা পাথরের মতো কঠিন বছর। সাম্প্রতিককালে আদালতের রায়ে তাদের উপর নেমে এসেছে স্বস্তির বৃষ্টি। কিন্তু বৃষ্টি হলেও যে মাটি ভিজছে না সে বিষয়ে পরে আলোচনা করছি। আপাতত বলি গ্ৰুপ-সি এবং গ্ৰুপ-ডি এর দুর্নীতি ও কোর্টের রায় প্রসঙ্গ।

সম্প্রীতি কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বেশ কয়েকটা যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম গ্ৰুপ-ডি ও গ্ৰুপ-সি-এর নিয়োগ দুর্নীতি যাচাই করতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দান। প্রাথমিক তথ্যর উপর ভিত্তি করে অভিজিৎ বাবু গ্ৰুপ-ডি এবং গ্ৰুপ-সি-এর যথাক্রমে — ৫৭৩ এবং ৩৫০ জনের চাকরি বরখাস্ত ও বেতন বন্ধের নির্দেশ দান করেন। যদিও পরবর্তী কালে ডিভিশন বেঞ্চে সেই রায়ের উপরে স্থগিতদেশ দেওয়া হয়। ডিভিশন বেঞ্চের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিবিআই-এর পরিবর্তে গ্ৰুপ-ডি মামলার তদন্ত ভার নস্ত্য হয় একটা কমিটির উপরে। এই কমিটি ছিল প্রাক্তন বিচারপতি ও শিক্ষা দিপ্তেরের কয়েকজন আধিকারিকদের নিয়ে তৈরি, যার নেতৃত্বে ছিলেন আর কে বাগ। আর কে বাগের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী গ্ৰুপ-ডি-তে প্যানেল বহির্ভূত নিয়োগ হয়েছে ৬০৯ জন। সমান্তরালে চলতে থাকা আরও দুটি মামলা তথা গ্ৰুপ-সি এবং এসএলএসটি-র চূড়ান্ত রায় এখনো আসেনি। তবে এসএলএসটি-র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের যে মামলা চলছিল সেই মামলা এবং এই গ্রুপ-ডি মামলা উভয় মামলার প্রাথমিক তদন্তে এক চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট উঠে আসে। এই নিয়োগ দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড একটা কমিটি। এই কমিটি গঠিত হয়েছিল তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নেতৃত্বে। এই কমিটিতে ছিলেন পাঁচ জন ব্যক্তি — শান্তি প্রসাদ সিনহা (এ্যাডভাইসর, স্কুল সার্ভিস কমিশন), অলোক সরকার (ডেপুটি ডাইরেক্টর), সুকান্ত আচার্য (পার্সোনাল সেক্রেটারী অফ মিনিস্টার), প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায় (ওএসডি) ও তাপস পাঁজা (বিকাশ ভবন ল সেকশন)। আর এই কমিটির কূট বুদ্ধিতেই তৈরি হয়েছিল অবৈধ নিয়োগের কলাকৌশল। তারপর যখন আদালতে এই বিষয় নিয়ে জলঘোলা হতে শুরু হয়, ঠিক তখন কম্পিউটারের উপর সামগ্রিক দোষ চাপিয়ে বিষয়টা থেকে পরিত্রান পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন শান্তি প্রসাদ। পরে অবশ্য সত্যতা জানা যায়। তাদের সূক্ষ্ম হাতের নিপুণতায় জাল হয়েছে রিকমেন্ডেশন লেটারের সই, পোড়ানো হয়েছে ওএমআর শিট, ডিলিট করা হয়েছে কম্পিউটারের সমস্ত ডেটা। কিন্তু তাতেও পরিত্রাণ নেই। একটা দুটো কান টানতে টানতে মাথা পর্যন্ত পৌঁছাতে চলেছে দুর্নীতির মামলা। এই অবৈধ নিয়োগের গল্প থেকে বাদ যায়নি স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তনদের নাম — সুবীরেশ ভট্টাচার্য (চেয়ারম্যান স্কুল সার্ভিস কমিশন), শর্মিলা মিত্র (অস্থায়ী সময়ের চেয়ারম্যান স্কুল সার্ভিস কমিশন ও রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান), মহুয়া বিশ্বাস (রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান), শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায় (রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান), শেখ সিরাজউদ্দিন (রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান)। এই দুর্নীতির নিয়োগ কান্ডারীদের তালিকায় নাম রয়েছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলীর। রিপোর্ট অনুযায়ী ভুয়ো সুপারিশপত্রগুলি শান্তিপ্রসাদ সিনহা নিজে কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়েছিলেন। কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় নিয়োগপত্র ছাপার জন্য রাজেশ লায়েক বলে একজন কর্মীকে নির্দেশ দিতেন। এই নিয়োগপত্রগুলি পর্ষদের অফিস থেকে না দিয়ে এসএসসির নবনির্মিত ভবন থেকে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিচারপতি বাগের কমিটি। এমনকি লেনদেনের হিসাব নিকাশ করার জন্য ছিল আলাদা রেজিস্টার। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো স্কুল সার্ভিস কমিশন একটি স্ব-শাসিত সংস্থান। সেই স্ব-শাসিত সংস্থার উপরে ছড়ি ঘোরানোর জন্য কোন কমিটি গঠন করায় চূড়ান্ত বেআইনি। এসব ঘটনা মনে করায় অনিল কাপুরের নায়ক সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়ালগ — 'স্যাব কে স্যাব চোর হে শালা।' অথচ চাকরি প্রার্থীরা বা বর্তমান শিক্ষকরা দুর্নীতির কথা তুলে ধরে কোন ডেপুটেশন নিয়ে গেলে। এই সমস্ত আধিকারিকরা আক্রমণাত্মক কথা বলতেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় — “চোরের মায়ের বড় গলা।”

তদন্তের শেষ দিকে যখন বেরিয়ে আসলো রাঘব বোয়াল তথা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাম তখন বিস্ফোরণ ঘটল হাইকোর্টে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই গল্পের অন্যতম অংশীদার হিসেবে নির্দেশ করেন রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। ১২ এপ্রিল যখন এই দুর্নীতির মামলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সিবিআই দপ্তরে হাজিরা নির্দেশ দেন। তখন তৃণমূলপন্থী আইনজীবীরা হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপরে। শুরু হল ধুমধুমার। সঙ্গে সঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চ মন্ত্রীর সিবিআই তদন্তের উপরে স্থগিতাদেশ জারি করল। প্রসঙ্গত বলা দরকার অভিজিৎ গাঙ্গুলি এই দুর্নীতি মামলায় বারংবার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলেও ডিভিশন বেঞ্চ বারংবার তা খারিজ করে দেয়। ফলে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বাধ্য হয়ে এই সমস্যার কথা জানিয়ে চিঠি লেখেন হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে। তারপর লক্ষ্য করা যায় আরও এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এসএসসি, গ্রুপ-ডি, গ্রুপ-সি মামলা যেন অরুচি হয়ে উঠেছিল সমস্ত বেঞ্চের কাছে। কোনো বেঞ্চই আর মামলা গ্রহণ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। তৃণমূল বার অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্নভাবে এই মামলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা অব্যাহত। সুতরাং বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ এবং আতঙ্ক কতটা গভীর তা সহজেই অনুমান করা যায়। পার্থবাবু মুখে যতই বলুক আইন আইনের পথে চলবে। পিছন থেকে আইনের হাত পা বেঁধে রাখার যে চক্রান্ত চলছে তাতে মনে হচ্ছে — বিচারের বাণী যেন নিভৃতে কাঁদে।

The furnace of corruption

এদিকে রাজ্যের বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর নাম ২০১৯ সালে এসএলএসটি’র মেধা তালিকায় উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল। যা ছিল সম্পূর্ণরূপে অনভিপ্রেত। এই ইস্যুকে সামনে রেখে এবং গেজেট মেনে নিয়োগ না করার দাবিতে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কোলকাতার মেয়ো রোডে প্রেসক্লাবের সামনে যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের ব্যানারে শুরু হয় অনশন আন্দোলন। যদিও এই অনশন আন্দোলনের অনেক আগে থেকেই যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চ স্বচ্ছ নিয়োগের দাবি নিয়ে বিকাশ ভবন, আচার্য সদন, এমনকি নবান্ন অভিযানের মতো কর্মসূচিও পালন করেছে। এই সমস্ত দাবিগুলির অন্যতম ছিল প্রাপ্ত নম্বর সহ মেধাতালিকা প্রকাশ করা, গেজেট মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা। অন্যান্য দাবি পূরণ না হলেও স্কুল সার্ভিস কমিশন ২টি কাউন্সিলিং করতে বাধ্য হয়। যার প্রথমটা ছিল এম্পানেল কাউন্সিলিং এবং দ্বিতীয় থেকে ওয়েটিং-এ থাকা ক্যান্ডিডেটদের কাউন্সিল। ওয়েটিং কাউন্সিলিংয়ের বিষয়টি একটু স্পষ্ট করা দরকার। যেহেতু মেধাতালিকা ছিল মাল্টিপল রাঙ্ক যুক্ত। তাই এক একটা কাউন্সিলিংয়ের পর একাধিক সিট ফাঁকা থেকে যেত। যেমন — একজন এসসি ফিমেল ক্যান্ডিডেট মেধা তালিকায় চার জায়গায় এম্পানেল হিসাবে স্থান পেয়েছিল (জেনারেল-পুরুষ/মহিলা, জেনারেল-মহিলা, এসসি পুরুষ/মহিলা, এসসি-মহিলা) এই চার স্থানে তার নাম থাকলেও সে পছন্দ করবে একটাই। ফলে তার একটা পছন্দের সিট গ্রহণ করার পরে তিনটি ফাঁকা হয়ে যাবে। পরবর্তীকালে তিনজন ওয়েডিং এম্পানেল হিসেবে উঠে আসবে। এইভাবে সর্বমোট আটটা কাউন্সিলিং-এর খবর প্রকাশিত। এই বিষয়ে পরবর্তীকালে বিস্তারিত আলোচনা করছি। আপাতত অনশনের প্রসঙ্গে আসা যাক। দীর্ঘ ২৯ দিন যাবৎ চলতে থাকে এই আন্দোলন। সেই মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে চাকরিপ্রার্থীদের আশ্বস্ত করেছিলেন। তিনি তাদের ন্যায় পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে। লোকসভা ভোটের পরে প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করেও এই সমস্যার সমাধান করবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। ঐ মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি শিক্ষা দপ্তরকে ঘুঘুর বাসা নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। এখান থেকেই তিনি সরকারপক্ষের ৫ জন এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে ৫ জনকে নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন শিক্ষামন্ত্রীকে। বলাবাহুল্য সরকারপক্ষ দ্বারা মনোনীত পাঁচজন সদস্য আর কেউ নন পূর্বোক্ত ব্যক্তিরাই। শোনা গেছে এদের মাথায় ছিলেন শিক্ষাসচিব এবং শিক্ষামন্ত্রীও। আন্দোলনকারীদের ৫ কমিটির কাজ হবে সরকারি কমিটির কাছে সমস্ত দুর্নীতির প্রমাণ এবং অভিযোগগুলি প্রদর্শন করা। সরকারি কমিটি মারফত প্রাপ্ত প্রত্যুত্তর আন্দোলনকারীদের কাছে সরবরাহ করা। এককথায় একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে লক্ষ্য করা গেল আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধ্বংস করতে আন্দোলনকারীদের এই পাঁচ কমিটি এবং তাদের আত্মীয়স্বজনকে অবৈধভাবে চাকরিতে নিয়োগ করে দেওয়া হল। যাদের রাঙ্ক ছিল অন্যান্য আন্দোলনকারীদের অনেক পরে। অনশন আন্দোলন শুরু হলো চতুর্থ কাউন্সেলিং। এই কাউন্সেলিং এরফলে আনুমানিক ৪,০০০ জনের চাকরি হয়েছিল। এরপরেও আরো চারটি কাউন্সিলিং হয়। লকডাউন পিরিয়ডে সম্পন্ন করা হয়েছিল অষ্টম কাউন্সিলিং। এই কাউন্সিলিং হয়েছিল এসএমএস’এর মাধ্যমে। যা সম্পূর্ণরূপে বেআইনি। বলা বাহুল্য প্রথমদিকে কাউন্সিলিংয়ের যেভাবে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল শেষের দিকের কাউন্সিলিংগুলোতে তেমনভাবে তথ্য সরবরাহ করেনি স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইট। লকডাউন পিরিয়ডে দেওয়া হয়েছে অজস্র অবৈধ নিয়োগ। যার প্রমাণ রয়েছে যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের হাতে। সেই প্রমাণ সমূহ নিয়ে স্কুল সার্ভিস কমিশন, বিকাশ ভবন, শিক্ষামন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে দপ্তরে ঘুরলে। তাচ্ছিল্য আর পুলিশ দিয়ে অ্যারেস্ট করিয়ে দেওয়ার হুমকি ছাড়া আর কিছু মেলেনি চাকরিপ্রার্থীদের। লকডাউন, মহামারীর অজুহাত দেখিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার স্বাধীনতাও ধ্বংস করা হয়েছিল। অবশেষে বাধ্য হয়ে কোর্ট পারমিশনের মাধ্যমে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে নবম থেকে দ্বাদশ স্তরের দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীরা যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের ব্যানারে আজ ১৭৮ দিন যাবত চালিয়ে যাচ্ছে তাদের হকের লড়াই।

নিয়োগ দুর্নীতির অগ্নিকুণ্ড চোখের সামনে দাউদাউ করে জ্বলছে। রাস্তায় রাস্তায় দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে প্রতিদিন। দুর্নীতির প্রমাণিত সত্যগুলো হাইকোর্টের দেওয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পশ্চিমবাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে। নেতা-মন্ত্রী আমলাদের ললাটে স্বর্নাক্ষরে লেগে যাচ্ছে দুর্নীতি পরায়ণতার সীলমোহর। কিন্তু তাতে চাকরিপ্রার্থীদের কী কোনো লাভ হচ্ছে? দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, মন্ত্রী আমলাদের কি আদৌ কিছু শাস্তি হচ্ছে? অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে যে সমস্ত চাকরিপ্রার্থী হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে পারছে না, তাদের ন্যায়বিচারের স্বপ্ন দেখাবে কে? নেতা-মন্ত্রী-আমলাকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার পরে যে ছেলেগুলো হাইকোর্টের নির্দেশে চাকরি হারাল সে না হয় শাস্তি পেল। কিন্তু যে পিটিশোনার নিজের প্রাপ্যের আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল সে কি তার হকের চাকরি পেল? যে নেতা-মন্ত্রীকে মোটা টাকা দিয়ে অবৈধ চাকরি পাওয়ার পরেও কর্মহীন হল, সেই নেতা বা মন্ত্রীর কি কোনো শাস্তি হল? এই অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের কাছে নেই। চোখের সামনে অবৈধ নিয়োগকারীদের বুক বাজিয়ে দুর্নীতি স্বীকার করতেও দেখেছি। কিন্তু কিছু কি হয়েছে তাদের? প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার তৃণমূল কংগ্রেসের তৎকালীন বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডু প্রকাশ্য স্বীকার করেছেন ২০১৪ প্রাইমারিতে তিনি তার বউ, বৌদি সমেত ৬২ জনকে চাকরি দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এখানে স্বপন দেবনাথ (মন্ত্রী) থেকে শুরু করে তপন চট্টোপাধ্যায় (পূর্বস্থলী ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ও প্রাক্তন বিধায়ক), অনুব্রত মণ্ডল (তৃণমূল জেলা সভাপতি, বীরভূম) সহ অনেক নেতারাই এই প্রাইমারিতে চাকরি দিয়েছেন। তারপর তিনি একলাফে চলে গেলেন ঘাসফুল ছেড়ে পদ্মফুলের মধু খেতে। আবার প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে আদালত নির্দেশ দিয়েছিল ১৯ জন মামলাকারীকে নিজের পকেট থেকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা দেওয়ার। সেটাও স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বন সহায়ক কর্মী নিয়োগ দুর্নীতিতে বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা গিয়েছিল একে অপরকে অভিযুক্ত করতে। তারপর নির্বাচন শেষ হলে সেই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় গঙ্গা স্নান করে আবার মুখ্যমন্ত্রীর চরণতলে আশ্রয় উপায়। তারপর সব দুর্নীতিগ্রস্ত রায় ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে যায় একসময়। অনেক দুর্নীতি অনেক প্রমান শুধু শাস্তির ক্ষেত্রে প্রহসন। সত্যি সত্যি খেলা হচ্ছে কিনা জানিনা। তবে বেকার যুবক-যুবতীদের নিয়ে সবাই খেলা করছে। বেকার যুবক-যুবতীরা যেসব দুর্নীতি হাইকোর্টকে ধরিয়ে দিয়েছে, সেই সমস্ত দুর্নীতিগ্রস্তরা যদি চুনোপুটি হয়ে থাকে তবে তারা ধনঞ্জয় হয়েছে। বাকিরা স্কুলে, অফিসে রমরমিয়ে তাদের স্ট্যাটাস দেখিয়ে চলেছে। আর এভাবে পথ চলতে চলতে কখনো রাস্তার আন্দোলন, কখনো হাইকোর্টের দরজায় দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে পাক ধরেছে তাদের চুলের। সরকারের নেতা-মন্ত্রী এবং আমলাদের দুর্নীতির পাপ ভোগ করতে হচ্ছে বেকারদের। কোর্টে গেলে উকিলদের পকেট ভরছে, আর কোর্টের বাইরে এলে নেতা-মন্ত্রী আর দালালদের পকেট ভরছে। ২০১৬ সাল থেকে এসএলএসটি’র হবু শিক্ষক শিক্ষিকা দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত হয়ে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। মাথার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে ছয়টা বছর। ২০১৫ সালে সংঘটিত আপার প্রাইমারি প্যানেলের মধ্যে তীব্র অসঙ্গতি থাকায় আদালত নির্দেশ দিয়েছিলো তা সংশোধন করতে। কিন্তু নেতা-মন্ত্রীরা এত টাকা তুলে রেখেছিল যে চার চারবার সংশোধনের পরেও প্যানেলর স্বচ্ছতা আসেনি। আজও এই নিয়োগ সম্পন্ন হলো না। ফলে প্যানেলের মধ্যে থাকা যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা ২০১৫ থেকে ২০২২ দীর্ঘ সাত বছর ধরে স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গুমরে গুমড়ে মরছে।

এই হতাশা পশ্চিমবাংলার আমজনতা বুঝতে পারবে না। আমরা জানি এই যন্ত্রণা কতটা। দুর্নীতির অগ্নিকুন্ডে প্রতিনিয়ত পুড়ে ছাই হওয়া আমাদের ইতিহাস একদিন ধারালো অস্ত্রে পরিণত হবে। মাস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে একদিন শিক্ষিত বেকাররা মাস্টারদা সূর্য সেনে পরিণত হবে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আবার কোনো চট্টগ্রাম নতুন দিনের সূচনা করবে।

- মহঃ মেহবুব আলম, সভাপতি, প্রোগ্রেসিভ টিচার্স এ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল

The investigating agency is accountable to the constitution

পুলিশ কার — কেন্দ্রের না রাজ্যের? কেন্দ্রের পুলিশ আছে, যথা সিবিআই; আবার, বিভিন্ন রাজ্যেরও পুলিশ বাহিনী রয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় পুলিশের কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। এই প্রসঙ্গে চর্চিত বিষয় হিসাবে উঠে এসেছে সিবিআই’এর এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি এন ভি রমনার কিছু তীক্ষ্ণ মন্তব্য যা অবশ্যই সম্যক আলোচনার দাবি রাখে।

বিচারপতি রমণাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সিবিআই প্রতিষ্ঠা দিবস ১ এপ্রিল ডি পি কোহলি স্মারক বক্তৃতায় বক্তব্য রাখার জন্যে এবং বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘গণতন্ত্র : তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা ও দায়িত্ব’। প্রসঙ্গত, ডি পি কোহলি ছিলেন সিবিআই’এর প্রতিষ্ঠাতা অধিকর্তা। বিচারপতি রমণা তাঁর বক্তৃতায় বলেন, গঠনের পর প্রথম দিকে সিবিআই’এর ওপর জনগণের যথেষ্ট আস্থা ছিল এবং তদন্ত সিবিআই’এর কাছে হস্তান্তর করার জন্য আদালতের কাছে বহু আবেদন জমা পড়ত। প্রসঙ্গত, আজ পশ্চিম বাংলায় বেশ কিছু তদন্তের ভার সিবিআই’এর হাতে দেওয়ার দাবি উঠছে এবং সিবিআই বেশ কয়েকটি ঘটনায় তদন্ত চালাচ্ছে। তবে, এই দাবির পিছনে সম্ভবত ন্যায় লাভের প্রত্যাশার চেয়ে শাসকের মদতে পুষ্ট নিপীড়কদের সিবিআই’এর হাতে হেনস্থা ঘটা ও নাস্তানাবুদ হওয়ার আকাঙ্খাই ক্রিয়াশীল হয়ে থাকবে। আমাদের ভুললে চলবে না যে, এই রাজ্যে নোবেল চুরি, নন্দীগ্ৰাম ও নেতাই গণহত্যার মতো ঘটনার নিষ্পত্তি সিবিআই করতে পারেনি এবং সারদা ও অন্যান্য চিটফান্ড কাণ্ডে তদন্তে সমাপ্তির কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও সিবিআই’এর কার্যধারা ক্রমেই প্রশ্নের মুখে পড়ছে। রমনার বক্তৃতার কথায় ফিরে আসা যাক। রমনা জানান, আগে সিবিআই তদন্তের জন্য চাহিদা এই জন্যই ছিল যে সিবিআই তখন ছিল ‘স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার প্রতীক’। বিচারপতির কথা থেকে অতএব স্পষ্ট, সিবিআই এক সময় আদর্শ তদন্তকারী সংস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো লালন করলেও বর্তমানে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো, অর্থাৎ, ‘স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা’ থেকে তারা অনেকটাই বিচ্যুত। আজ সিবিআই, ইডি, আয়কর দপ্তরকে ব্যবহার করে বিরোধীপক্ষের নেতাদের লাঞ্ছনা ঘটানো, জেলে পোরা এবং সমালোচকদের চুপ করিয়ে দেওয়াটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কেন এমন হল? তার বিকাশের ধারায় রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে যে চরিত্র অর্জন করতে থেকেছে, বলা ভালো, সিবিআই’এর জন্য যে ভূমিকা শাসকরা নির্দিষ্ট করেছেন, সেটাই যে সিবিআই’কে আজ শাসকের এমন ধামাধরা করে তুলেছে তা সহজেই বোধগম্য। কংগ্রেসও কেন্দ্রের শাসনে থাকার সময় সিবিআই’কে বিরোধীপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জমানায় সুপ্রিম কোর্ট কয়লা কেলেঙ্কারির তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে সিবিআই’কে ‘খাঁচাবন্দী তোতাপাখি’ বলে অভিহিত করেছিল। কিন্তু সেসময় ছাড়িয়ে সিবিআই’এর বশ্যতা আজ অনেক গভীরে, তাকে পরানো বেড়ির নেপথ্য নিয়ন্ত্রণক্ষমতা রাখেন সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, সেখান থেকে নাড়ালে তবেই যেন সিবিআই নড়ে। ফলে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা আজ পুরোপুরি সংশয়িত। প্রধান বিচারপতির ব্যাখ্যায়, “সময় পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে অন্যান্য প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মতো সিবিআই’ও আজ জনগণের বিচারের মুখে। তার সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তা প্রায়শই তার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্নকে তুলে ধরছে।” বিচারপতির এই মন্তব্যে ‘সক্রিয়তা’ ও ‘নিষ্ক্রিয়তা’ শব্দ দুটো যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। শব্দ দুটো এটাই বোঝাচ্ছে যে, তদন্তের সিদ্ধির চেয়ে শাসকের প্রয়োজনেই সিবিআই বা অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা তৎপর হয়; আর সাধারণ জনগণের স্বার্থ যেখানে জড়িত সেখানে নিষ্ক্রিয়তাই তাদের অবলম্বন হয়। এর নিদর্শন হিসাবে উল্লেখ করা যায় যে, সরকারের বহু সমালোচক, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের নিগ্ৰহে ও গ্ৰেপ্তারে মোদী-শাহদের পুলিশ যত তৎপরতা দেখায়, বিজেপি নেতাদের, অন্য দল থেকে বিজেপি’তে যোগদান করা নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অন্যান্য অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্তকারী পুলিশ হাত গুটিয়ে থাকে। শাহিনবাগে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে অমিত শাহর অধীনস্থ দিল্লী পুলিশকে চূড়ান্ত সক্রিয়তা দেখাতে দেখা গিয়েছিল, তাদেরই আবার সেই সমস্ত বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে চোখ বুজে থাকতে দেখা গেল — যাদের প্ররোচনামূলক মন্তব্যই ২০২০’র দিল্লীর দাঙ্গাকে উস্কিয়ে তুলেছিল। পশ্চিম বাংলাতেও আনিস খানের মৃত্যুতে পুলিশি সক্রিয়তাই নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিল, আর বগটুই গণহত্যা আটকাতে সক্রিয় হওয়ার কোনো তাগিদই পুলিশ অনুভব করতে পারেনি।

নিজেদের কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার ফলে পুলিশের ভাবমূর্তি কোথায় দাঁড়িয়েছে তার বর্ণনায় বিচারপতি রমনা বলেছেন, “পুলিশের ভাবমূর্তি দুঃখজনকভাবে কালিমালিপ্ত হয় দুর্নীতি, পুলিশের বাড়াবাড়ি, নিরপেক্ষতার অভাবের এবং রাজনৈতিক শাসকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আঁতাতের অভিযোগে।” এই অভিযোগগুলোর সঙ্গে আপামর জনগণ সমধিক পরিচিত এবং বিশেষ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তবে, বিরোধী নেতাদের নাস্তানাবুদ করে বিজেপি তথা হিন্দুত্বের পক্ষে পরিস্থিতিকে অনুকূল করে তুলতে মোদী সরকার অনুসৃত কৌশল ও তার প্রয়োগে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর ব্যবহারের সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। তামিলনাড়ুতে নির্বাচনের আগে ডিএমকে নেতা স্ট্যালিনের মেয়ের বাড়িতে তদন্তকারী সংস্থার হানাদারি, পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনের আগে অভিষেক ব্যানার্জি ও তার স্ত্রীকে কয়লা পাচার তদন্তে ডেকে পাঠানো, কর্ণাটকে নির্বাচনের আগে কংগ্রেস নেতা ডি কে শিবকুমার ও তার ভাই সুরেশের বিরুদ্ধে সিবিআই’এর হানাদারি, অখিলেশ সিং, মায়াবতী — বিরোধী শাসিত রাজ্যের ও বিজেপি শাসিত রাজ্যের বিরোধী পক্ষের নেতারা বলতে গেলে কেউই তদন্তকারী সংস্থাগুলোর নিষ্পেষণ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। প্রশ্নটা অতএব খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠবে যে, যাদের বিরুদ্ধে তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে তারা কি দুর্নীতির কালিমা থেকে মুক্ত এবং অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন? বিচার্য এখানে সেটা নয়, প্রশ্নটা বরং হল – হয়রানি ও অপদস্থ করা ছাড়া তদন্তকে তার যুক্তিসম্মত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার কোনো আগ্ৰহ কি তদন্তকারী সংস্থাগুলোর থাকছে? বিজেপি নেতারা দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে তদন্তকারী সংস্থাগুলো কি দুষ্কর্মের উন্মোচনে আদৌ উৎসাহী হয়? কর্ণাটকে বি এস ইয়েদুরাপ্পা, রেড্ডি ভাইদের দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে সত্য উন্মোচনের কোনো যথার্থ আগ্ৰহ কি সরকারের ছিল? লোহা খনিজ খননে রেড্ডি ভাইদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের পরিমাণ ছিল বিপুল, কিন্তু সিবিআই তাদের ‘ক্লিন চিট’ দেওয়ায় সেই তদন্ত নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ কম হয়নি। জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক গতবছরের ১৭ অক্টোবর অভিযোগ করলেন – তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল থাকার সময় তাঁকে দুটো ফাইলে অনুমোদন দিতে বলা হয়েছিল, বিনিময়ে ঘুষের প্রস্তাব ছিল ৩০০ কোটি টাকার। ফাইল দুটোর একটা ছিল ‘আম্বানি’র (অনিল) এবং আর একটা ছিল ‘আরএসএস ঘনিষ্ঠ’ এক ব্যক্তির যিনি পিডিপি-বিজেপি মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন এবং ‘প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ’। ফাইল দুটোতে অনুমোদন তিনি দেননি। এই অভিযোগের পর প্রশাসন ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কোনো হেলদোল দেখা গেলনা। অভিযোগ নিয়ে কিছু আলোড়ন উঠলে ছ’মাস পর এবছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে জম্মু ও কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা জানিয়েছেন যে অভিযোগগুলো নিয়ে তদন্ত হবে। তবে, সেই তদন্তে সত্য উন্মোচনে নিষ্ঠা কতটা দেখানো হবে তা সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়।

আবার, শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়দের মত নেতারা তৃণমূল থেকে বিজেপি’তে যাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত একরকম গতিহীন হয়ে গেছে। আসামের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা কংগ্ৰেসে থাকার সময় বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে গলা চড়িয়েছিল। কিন্তু বিজেপি’তে যোগদানের পর সেই অভিযোগ নিয়ে বিজেপি’র আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। একইভাবে, মায়াবতীর বিজেপি-বিরোধী ধার সম্পূর্ণরূপে ভোঁতা হয়ে যাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিজেপি কোনো রা কাড়ে না, আর তদন্তকারী সংস্থাগুলো অভিযোগ ভুলে থাকে। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কি কথা হয়েছিল তা সাংবাদিকদের জানালেন – “কিসের ভিত্তিতে সঞ্জয় রাউতের (শিবসেনা নেতা) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হল? এটা অবিচার। রাউতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পিছনে কোন প্ররোচনা কাজ করছে — তিনি কিছু বিবৃতি দিচ্ছেন বলে?” মহারাষ্ট্রে শাসক জোটের অনেক নেতার বিরুদ্ধেই তদন্তকারী সংস্থাগুলো লেগে রয়েছে – শারদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ার, অনিল দেশমুখ, হাসান মুশরিফ ও অন্যান্য নেতা, এবং নবাব মালিক ও অনিল দেশমুখকে গ্ৰেপ্তারও করা হয়েছে। এসবের সঙ্গে মহারাষ্ট্রে এনসিপি-শিবসেনা-কংগ্ৰেস জোট সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করার দুরভিসন্ধি কাজ করছে বলছেন ভাষ্যকাররা। এইভাবে, মোদী জমানায় তদন্তকারী সংস্থাগুলোর তদন্তসমূহ দুর্নীতি বিরোধী অভিযান না হয়ে বিরোধীপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিপ্রায়ে নিয়োজিত বলে আমাদের বোধ হলে তাকে খুব একটা অমূলক বলা যাবে না।

এর থেকে নিষ্কৃতির, তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে কাঙ্খিত পথে ফিরিয়ে আনার উপায় কি কিছু আছে? প্রধান বিচারপতি তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, তাদের আনুগত্য “সংবিধানের প্রতি এবং কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়”। তাদের উদ্দেশ্যে বলছেন, “গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে এবং শক্তিশালী করে তুলতে হবে”। আর, “আমাদের মতো বহুত্ববাদী সমাজের পক্ষে এটাই উপযুক্ত”। তিনি আরো পরামর্শ দিয়েছেন, “স্বেচ্ছাচারী প্রবণতাকে চুপিসারে ঢুকতে দেওয়া যাবে না”, কেননা, “একনায়কতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে দিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখা যাবেনা”। এখন যেটা সবচেয়ে জরুরি, তাঁর অভিমতে সেটা হল, “আজকের দিনে প্রয়োজন সামাজিক বৈধতা ও জনগণের আস্থার পুনরুদ্ধার। এই লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপটা হবে রাজনৈতিক প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত ছিন্ন করা।” তাঁর প্রস্তাব, এটা করতে গেলে আইন করে তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে একটা ছাতার তলায় নিয়ে এসে একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। একটা কমিটি এই সংস্থার অধিকর্তা নিয়োগ করবে। অধিকর্তার অধীনে কয়েকজন উপ-অধিকর্তা থাকবেন যাঁরা ভিন্ন-ভিন্ন বিষয়গুলোর তত্ত্বাবধান করবেন।

প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন তার অনেকটাই তাক করা কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদের দিকে। সেই শাসক এই বক্তব্যকে কি চোখে দেখেছে? এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেছেন, “একটা সময় ছিল যখন সরকারে থাকা লোকজন তদন্তে বাধা দিত। কিন্তু এখন সেরকম কিছু ঘটে না। সিবিআই এখন আর ‘খাঁচায় বন্দী তোতাপাখি’ নয়। ভারতে অপরাধ তদন্তের সর্বোচ্চ সংস্থা হিসাবে সে তার কাজ করে চলেছে।” রিজিজু যা বললেন সেটা মোদী-শাহদেরই বক্তব্য। যে সরকার প্রতিদিন সংবিধানের নিয়মগুলো লঙ্ঘন করে চলেছে, রাষ্ট্রের চরিত্রে আমূল পরিবর্তনের অভিপ্রায়েই প্রশাসনকে চালিত করছে, যার প্রতিটি মজ্জায় স্বৈরাচারের অবস্থান, স্বভাবগতভাবেই যে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে — সেই সরকারের কাছে প্রধান বিচারপতির অভিমত ও পরামর্শ একেবারে অপ্রীতিকর হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে, প্রধান বিচারপতি আজকের তুঘলকি রাজত্বের, প্রশাসনিক অপশাসন ও অরাজকতার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেশের জনগণকেই সতর্ক করেছেন। জনগণকে যেমন এই প্রশাসনিক অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, আদালতের কার্যকরী নজরদারিও সমান জরুরি।

- জয়দীপ মিত্র

organize the culinary staff

পশ্চিমবাংলায় মিড-ডে-মিল প্রকল্পের রন্ধনকর্মীদের ভাতা ২০১৩ সালের পর বাড়েনি। অন্যান্য প্রকল্পগুলির কর্মীদের ভাতা বেশ কয়েকবার বৃদ্ধি পেয়েছে কিংবা রাজ্য সরকার অবসরের পর এককালীন টাকা ঘোষণা করেছে। ফলে রন্ধন কর্মীদের বেশিরভাগ তৃণমূল প্রভাবিত হলেও, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। বিগত বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে গোষ্ঠী মারফত এই কাজকে যুক্ত করার দরুন, অনেক কর্মী কম ভাতায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে কিছু পরিকল্পনা মাফিক কাজ করলে ইউনিয়নে রন্ধন কর্মীদের সংগঠিত করা যায়। বেশিরভাগ কর্মী মহিলা। পার্টি যেখানে নারী শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য জোর দিতে বলেছে সেখানে আমাদের সংগঠনগতভাবে এক্ষেত্রে যথেষ্ট অবহেলা আছে। যেখানে ইউনিয়ন গড়ে তোলা গেছে, সেখানে নেতৃত্বের তদারকির অভাবের ফলে, উত্তর ২৪ পরগণা বাদে অন্য জেলাগুলিতে ইউনিয়ন নেই বললেই চলে। এআইসিসিটিইউ নেতৃত্বকে সামিল করে সংগঠন আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। ১২ মাসের ভাতা বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষা, কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র ইত্যাদি দাবিগুলি নিয়ে কর্মী ইউনিয়নের আগামী রাজ্য ডেপুটেশনের প্রচার পার্টির জেলা কমিটিগুলিকে রন্ধন কর্মীদের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। অন্যান্য রাজ্যে যেখানে ভাতা বেড়েছে তার তালিকা, প্রচারে যুক্ত করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘদিন রন্ধন কর্মীদের ভাতা বাড়াতে কোনও উদ্যোগ নিচ্ছেনা। অন্যান্য রাজ্যের মতো গোষ্ঠী মারফত নয়, রন্ধন কর্মীদের সরাসরি নিযুক্ত করতে হবে। কাজের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় রন্ধন কর্মীদের মধ্যে সংগঠিত হবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। ২০১৯ সালের রাজ্য জমায়েতের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শ্যামনগরে রন্ধন কর্মীদের সংগঠিত করার উদ্যোগ শুরু হয়। পরবর্তীতে ধারাবাহিক যোগাযোগ ও উদ্যোগে শ্যামনগর, জগদ্দল, কাঁকিনাড়ার প্রায় অধিকাংশ প্রাইমারি ও হাইস্কুলে রন্ধন কর্মী ইউনিয়ন গড়ে উঠে। অনেকগুলি স্কুল ধরে লাগাতার সরাসরি কর্মীদের সাথে কথা বলে, প্রথম বৈঠক করা হয় রাজ্য সম্পাদিকাকে নিয়ে। প্রায় ১০০ জন কর্মী উপস্থিত হয়েছিল। এটা হতে পেরেছিল রন্ধন কর্মীদের নিজস্ব উদ্যোগে প্রচারের দরুণ। উল্লেখ করা যেতে পারে একজন সংগঠকের উদ্যোগেই এ অঞ্চলে রন্ধন কর্মী ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলন করতে গেলে রন্ধনকর্মী ইউনিয়নগুলির ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার যা আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। ফলে এত বঞ্চনা সত্ত্বেও প্রয়োজন অনুযায়ী আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কর্মীদের একটা অংশ যখন ধর্মঘটের কথা বলে, সংগঠকরা তাকে বাস্তবায়িত করার কথা ভাবতে পারেন না। আজকের পরিস্থিতিতে ইউনিয়নকে নেতৃত্বকারী ভূমিকা নিতে গেলে চিন্তা এবং উদ্যোগের ক্ষেত্রে গতিশীল হতে হবে। এভাবেই সংগ্রাম ও সংগঠনকে লাগাতার শক্তিশালী করার প্রক্রিয়ায় ইউনিয়নকে সামনের সারিতে হাজির করা সম্ভব হবে।

- নারায়ণ দে

= OOOOOOOOOOOO =

খণ্ড-29
সংখ্যা-16