দেউচা-পাঁচামি হরিণসিঙ্গা থেকে প্রায় ৫০ জন আন্দোলনরত সাথী কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক বৈঠকে মিলিত হন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ইতিমধ্যেই দেউচা-পাঁচামি’র প্রতিবাদ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, প্রেস ক্লাবের বৈঠক আয়োজনেও বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। দেউচা’র জনগণ অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় এই খনি প্রকল্পের বিরোধিতা করেছেন। সরকারি আধিকারিক কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করেনি। কেউ সরকারকে জমি দেয়নি এবং দিতে রাজি নয়। এমনকি সামান্যতম প্রতিবাদ মিছিল করলে মহিলারা আক্রান্ত হন, অথচ কেউ শাস্তি পান না। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি দেউচায় গণজমায়েত কর্মসূচি আছে।
‘বীরভূম জমি, জীবন, জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা’ ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, কলকাতার প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করে যে — দেউচা-পাঁচামি-হরিণশিঙ্গা-দেওয়ানগঞ্জ অঞ্চলে প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য জোর করে কোনো জমি না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু বাস্তবে বীরভূম জেলার পুলিশ-প্রশাসন ও শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস নানারকম ছলচাতুরি, তথ্যের কারচুপি, হুমকি এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। স্থানীয়রা ‘স্বেচ্ছায়’ জমি দিয়ে দিচ্ছে বলে একটি বিভ্রান্তকর, মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে। বাস্তবে প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কয়লাখনির বিরুদ্ধে।
এই কয়লাখনি প্রকল্পের বিরোধিতায় স্থানীয় সাঁওতাল ও বাঙালি গ্রামবাসীদের আন্দোলনের যৌথমঞ্চ ‘বীরভূম জমি, জীবন, জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা’ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এবং জনগণের সামনে নিম্নলিখিত বক্তব্য তুলে ধরছে।
১) আইন অনুযায়ী যেকোনো প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করার প্রথম ধাপ প্রস্তাবিত প্রকল্প অঞ্চলের মানুষের সম্মতি নেওয়া। অথচ দেউচা-পাঁচামি-হরিণশিঙ্গা-দেওয়ানগঞ্জ অঞ্চলে কয়লাখনি প্রকল্প হওয়া উচিত কিনা, সেবিষয়ে স্থানীয় মানুষের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। অগণতান্ত্রিক পন্থায় কয়লাখনি প্রকল্প শুরু করার আমরা তীব্র বিরোধিতা করছি।
২) কয়লাখনি হবে এই সিদ্ধান্ত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মিলে নিয়েছে। তারপর সেই সিদ্ধান্ত সরকার স্থানীয় মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। স্থানীয় মানুষের মতামত না নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা করে দিয়েছেন। এই চাপিয়ে দেওয়া কয়লাখনির সিদ্ধান্ত এবং তথাকথিত ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের প্যাকেজ সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামবাসী সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ আমরা কোনও কিছুর বিনিময়েই জমি থেকে উচ্ছেদ হতে রাজি নই।
৩) প্রস্তাবিত কয়লাখনি বাস্তবায়িত করতে হলে এলাকার পাঁচ-ছ হাজারের উপর পরিবারকে উচ্ছেদ হতে হবে, যাদের অধিকাংশই আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু, এছাড়াও দলিত এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর পরিবারও আছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে, প্রকল্প অঞ্চলের বাইরের বহুদূর পর্যন্ত নদী, নালা এবং কৃষিক্ষেত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই ক্ষতিপূরণ টাকা বা চাকরির বিনিময়ে কিছুতেই হতে পারে না।
৪) পশ্চিমবঙ্গে কোনো নতুন কয়লাখনির আর প্রয়োজন নেই বলেই আমরা মনে করি। প্রকৃতি বিরোধী কয়লাখনি প্রকল্পের পিছনে দশ হাজার কোটি টাকা খরচ না করে, রাজ্য সরকার এই অর্থ সৌর, বায়ু ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচা করলে জনগণের মঙ্গল হবে।
৫) গ্রামবাসী মহিলাদের লাঠিপেটা এবং নির্যাতন করে, ভয় দেখিয়ে, জমি দখলের যে অপচেষ্টা মহম্মদবাজার থানার পুলিশ ইতিমধ্যেই করেছে, তার বিরুদ্ধে আমরা আইনি পদক্ষেপ নিতে চলেছি।
৬) দেউচা-পাঁচামি-হরিণশিঙ্গা-দেওয়ানগঞ্জ অঞ্চলে প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্প বাতিল করার দাবিতে আগামী ২০ ফেব্রুয়ারী, বেলা ১টা থেকে দেওয়ানগঞ্জ গ্রামে মহাসভার পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদ জনসভার ডাক দেওয়া হচ্ছে। এই দাবির স্বপক্ষে দাঁড়ানো সমস্ত প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক শক্তি এবং ব্যক্তিদের আমরা আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
ধন্যবাদসহ,
লক্ষী রাম বাস্কে, মাইনামতি সোরেন, জগন্নাথ টুডু, গণেশ কিস্কু, হপণমই হেমব্রম, সুকল মুর্মু, মাকলু কিস্কু, বুধি হাঁসদা, রতন হেমব্রম, মোহন মণ্ডল, লক্ষী মুর্মু;
সঙ্গে ছিলেন পার্থ ঘোষ, প্রসেনজিৎ বসু, অভীক সাহা, ইন্দ্রাণী দত্ত, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী
বিদ্বেষের রাজনীতি-বিরোধী জনমঞ্চের প্রথম সম্মেলন কলকাতার তপন থিয়েটারে আয়োজিত হয় গত ৬ ফেব্রুয়ারি। ঐ সম্মেলন থেকে দেউচা-পাঁচামি খনি প্রকল্প বাতিলের দাবিতে কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। জনমঞ্চের নবনির্বাচিত আহ্বায়ক জয়রাজ ভট্টাচার্য এবং উপদেষ্টা মন্ডলীর সভাপতি শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়।
জনমঞ্চের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেউচা-পাঁচামি প্রস্তাবিত কয়লা খনি প্রতিরোধ আন্দোলন — পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, আদিবাসী জনগণের জল, জমি ও জঙ্গলের অধিকার এবং তাদের সংস্কৃতি ও জীবন রক্ষার সংগ্রামের প্রশ্নকে সামনে রেখে কলকাতা থেকে দেউচা-পাঁচামি পায়ে হাঁটার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
একটি ভ্রান্ত ও প্রতারণামূলক পরিকল্পনা এই দেউচা-পাঁচামি প্রস্তাবিত কয়লা খনি নির্মাণ। তাই এই প্রকল্পের বিরোধিতায়, আদিবাসী জনগণের অধিকার রক্ষার স্বপক্ষে এবং তাদের ওপর নির্যাতন অত্যাচার-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, বৃহত্তর পরিসরে জনমত তৈরি করার জন্যই এই কর্মসূচি।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষার অধিকার মাতৃভূমির অধিকার থেকে পৃথক কিছু না, বরং সম্পর্কিত। তাই এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হবে দেউচা-পাঁচামিতে।
কর্মসূচির আহ্বান
যেখানে আগ্রাসন সেখানেই প্রতিরোধ, যেখানে নিপীড়ন সেখানেই লড়াই — ভাষা হোক বা ভূমি।
মাতৃভাষা দিবসে মাতৃভূমির অধিকার রক্ষার শপথ নিতে পথ পথে চলুন দেউচা-পাঁচামিতে।
১৫-২১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে দেউচা-পাঁচামি পায়ে হাঁটার কর্মসূচি
১৫ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার — রাণু-ছায়া মঞ্চ থেকে মেয়ো রোড গান্ধী মূর্তি, কলকাতা, বেলা ৩টে।
১৬ ফেব্রুয়ারি, বুধবার — হাওড়া ময়দান থেকে বালি, হাওড়া, বেলা ৩টে।
১৭ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার — উত্তরপাড়া থেকে শ্রীরামপুর, হুগলি, সকাল ৯টা।
১৮ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার — বর্ধমান শহর পুলিশ লাইন, কার্জন গেট থেকে নবাবহাট, সকাল ৯টা, পানাগড় (পশ্চিম বর্ধমান) থেকে ইলমবাজার (বীরভূম), বেলা ৩টে।
১৯ ফেব্রুয়ারি, শনিবার — বোলপুর থেকে সিউড়ি, বীরভূম, সকাল ৯টা।
২০ ফেব্রুয়ারি, রবিবার — সিউড়ি থেকে মহম্মদ বাজার, সকাল ৯টা।
২১ ফেব্রুয়ারি, সোমবার — মহম্মদ বাজার থেকে দেউচা-পাঁচামি, সকাল ৯টা, পায়ে হাঁটার শেষে দেউচা-পাঁচামিতে, ২১ ফেব্রুয়ারি, সাংস্কৃতিক কর্মসূচিসহ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন।
জনমঞ্চ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই কর্মসূচি পালন করবে।
বোধহয় শীতঘুম ভেঙেছে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অবশেষে সুপারিশ করল এমএনআরইজিএ খাতে বছরে ন্যূনতম একশো দিনের বদলে দেড়শো দিনের কাজের লক্ষ্যমাত্রা পাকা করতে হবে। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির কোনও সুপারিশ করেছে বলে শোনা যায়নি। এর আগে উদ্যোগী হয়ে এরকম সুপারিশ না করলেও, অনেক দেরীতে হলেও, লাগাতার চাপের মুখে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির নতুন সুপারিশ – জারি থাকা দাবির প্রাসঙ্গিকতাকে আরও একবার অংশত কোনো-না-কোনো মাত্রায় স্বীকার করল। তবে কোভিড পরিস্থিতির অনেক আগে থাকতে, সম্ভবত ২০১৪-তে মোদী জমানার গোড়াপত্তন থেকেই প্রকল্পটির সপক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত দাবি উঠতে থাকে – বছরে অন্তত দুশো দিনের কাজ আর ছয়শো টাকা মজুরি চাই। পক্ষান্তরে মোদী সরকার প্রথম থেকেই একে ‘গর্ত খোঁড়ার প্রকল্প’ বলে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। কাজের সংস্থান করে দেওয়ার নাম নেই, মজা মারার মাস্টার! কিন্তু সামগ্রিক বেড়ে চলা বেকারত্ব, প্রধানত ক্রমবর্ধমান গ্রামীণ বেকারির চাপের মুখে কোনো সুরাহা দিতে পারেনি, সেই বাধ্যতা থেকে প্রকল্পটিকে ইচ্ছা না থাকলেও রেখে দিতে বাধ্য হয়। তবে বছর বছর এর বাজেট বরাদ্দের প্রশ্নে – হয় খুব নগণ্য পরিমাণ বৃদ্ধি, নয়তো যথাস্থিতি বা সংকোচনের পন্থা অবলম্বনের পন্থা নিয়ে আসছে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের হানার পর ২০২০-২১ বাজেট বছরে কেন্দ্র যা বরাদ্দ করেছিল তাতে পরিকাঠামো খাতে ব্যয়বৃদ্ধির শর্ত জুড়ে দেয়, ফলে কার্যত মজুরি বাবদ অর্থের কোটা কমে যায়। তবু কোভিডে কাজ হারানো অসংগঠিত ক্ষেত্রের মজুরদের নিরুপায় হয়ে গ্রামেই ফিরে কাজের দাবি প্রচন্ড বেড়ে যায়। সেই চাপে কেন্দ্র ২০২০-২১ আর্থিক বছরে এই খাতে সংশোধিত বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হয়। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিই জানাচ্ছে সেবছর মোট খরচ হয়েছিল ১ লক্ষ ১১হাজার কোটি টাকা। কোভিডের জের চলে পরের বছরেও। যারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ হারিয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে গ্রামে ফিরে আসে, তারা পুনরায় পরিযায়ী কর্মসংস্থানের ডাক পাননি। ফলে গ্রামেই রয়ে যান, আর নির্ভর করতে হয় এমএনআরইজিএ প্রকল্পের উপর। অর্থাৎ এই খাতে কাজের চাহিদার তীব্রতা-ব্যাপকতা একই রকম থেকে যায়। অথচ মোদী সরকার কী নির্মম অমানবিক! ২০২১-২২ আর্থিক বছরে বরাদ্দ নামিয়ে আনে ৭৩ হাজার কোটি টাকায়। ২০২০-২১-এর সংশোধিত ব্যয়ের তুলনায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও চাহিদার প্রবল চাপ একেবারে উড়িয়ে দিতে পারে নি। তাছাড়া কেন্দ্রকে তাড়া করতে শুরু করে কৃষক আন্দোলনের বছরভর ঐতিহাসিক উত্তর-পশ্চিমী গরম হাওয়া-বজ্র বরিষণ-শৈত্য প্রবাহ। বিজেপির ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন। এসবের সম্মিলিত ঠ্যালা সামলাতে এমএনআরইজিএ-তে সংশোধিত বরাদ্দ ৯৮ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়ায়। পূর্ববর্তী বছরের সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় ঘাটতি রেখে দেয় ১৩ হাজার কোটি টাকার। এবারের অর্থবর্ষে (২০২২-২৩) নির্লজ্জের মতো ফের বরাদ্দ কমিয়ে এনেছে ৭৩ হাজার কোটি টাকায়। প্রকৃত নির্মম বাস্তবতা হল, কোভিডে কাজ হারানো কর্মপ্রার্থীদের বড় অংশ, যারা পরিযায়ী মজদুর, এখনও পুরানো কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেনি। উপরন্তু এই প্রকল্পে রাজ্যে রাজ্যে মজুরি স্তর চালু রয়েছে ২০০-৩০০ টাকা মাত্র। সরকারি গণবন্টন ব্যবস্থায় বিনামূল্যে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মেলে তা ন্যূনতম প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সব মিলে কি এই দুর্গতিতে দিন চলে? অধিকন্তু যখন মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে রমরমিয়ে? এই ব্যবস্থার কী নিষ্ঠুর প্রহসন! সরকারি কোভিড সচেতনকরণের প্রচার চলে ‘জীবনীশক্তি বাড়াতে হবে’! বঞ্চনার শেষ নেই, সমান তালে চলছে প্রতারণা ও প্রহসন।
কিন্তু না, হাল ছেড়ে দিলে চলবে না! সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আর কেন্দ্রের মর্জির ওপর ভাগ্য ছেড়ে রাখার কোনো মানেই হয় না। বরং ঝাঁপাতে হবে নতুন করে, অধিকার আদায়ে নাছোড় লক্ষ্যে।
৩০ জানুয়ারি মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধীর শহীদ দিবস। নাথুরাম গডসে ভারতের প্রথম সন্ত্রাসবাদী যে নিরস্ত্র গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করেছিল। আজ, আমরা দেখছি, তথাকথিত ‘ধর্ম সংসদে’ বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর এবং বিজেপি নেতা সাক্ষী মহারাজ ও অন্যান্য ঘৃণা-বর্ষণকারীরা সন্ত্রাসী গডসেকে সম্মান জানাচ্ছেন। আমরা সবিস্ময়ে এটাও দেখছি, আরএসএস-মতাদর্শের তাত্ত্বিকরা বলছেন — গান্ধী হত্যার জন্য দায়ী নেহরু, সাভারকর ও গডসে নয়! প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গান্ধীজীর প্রতি মৌখিক সৌজন্য দেখিয়েছেন — কিন্তু তারা গডসে এবং তার আজকের অনুগামীদের সম্পর্কে নীরব কেন? কেন তারা সাভারকরকে সমর্থন করেন, যে গান্ধী হত্যার সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রের মূলচক্রী ছিল?
গান্ধীর শহীদ দিবসে, আরএসএস তাত্ত্বিক রাকেশ সিং ট্যুইট করে সাফাই গেয়েছেন — নেহরু, গান্ধীর নিরাপত্তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করেছেন, যেজন্য হত্যার এক ব্যর্থ চেষ্টার ১৫ দিন পরেও গান্ধীর নিরাপত্তায় ঢিলেমি ছিল। শ্রীযুক্ত রাকেশকে স্মরণ করানো দরকার যে সেই সময়ে গান্ধীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সর্দার প্যাটেল যাঁর জন্য আরএসএস নেহেরু-বিরোধী এক ‘নায়কের’ মর্যাদা দাবি করে। আমাদের অবশ্যই শ্রীযুক্ত রাকেশকে এটাও মনে করিয়ে দিতে হবে যে গান্ধীজীর জীবনের মূল্য নিয়ে প্যাটেল নিজে নিঃসংশয় ছিলেন! আরএসএস প্রধান গোলওয়ালকরকে লেখা এক চিঠিতে প্যাটেল আরএসএস’কে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে লেখেন, “তাদের (আরএসএস নেতাদের) সমস্ত ভাষণই ছিল সাম্প্রদায়িক বিষে ভরা — এই বিষের চূড়ান্ত পরিণতিতে, দেশকে গান্ধীজীর মহামূল্য জীবন বলিদানের কষ্ট সইতে হয়েছে — গান্ধীজীর মৃত্যুর পর আরএসএস’এর লোকেরা আনন্দোচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে এবং মিষ্টি বিতরণ করেছে।” প্যাটেল গান্ধীজীর হত্যা নিয়ে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকেও লিখেছিলেন, “আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা সম্পর্কে — আমাদের পাওয়া রিপোর্ট নিশ্চিত করেছে যে, এই দুটি সংগঠনের, বিশেষ করে পূর্বোক্তটির কার্যকলাপে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যা এই ভয়ানক ট্র্যাজেডি ঘটতে দিয়েছিল।”
১৯৪৭’র ৮ ডিসেম্বর, ২,৫০০ আরএসএস সদস্যের এক জমায়েতে ভাষণ দিতে গিয়ে গোলওয়ালকর গান্ধীজীকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিলেন, “মহাত্মা গান্ধী আর হিন্দুদের বিভ্রান্ত করতে পারবেন না। আমাদের জানা আছে কী করে এই ধরণের লোকেদের সঙ্গে সঙ্গে চুপ করিয়ে দিতে হয়, কিন্তু হিন্দুদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন না হওয়াটাই আমাদের ঐতিহ্য। যদি আমাদের বাধ্য করা হয়, আমাদের সে পথেই যেতে হবে।”
নাথুরাম গডসে নিজে প্রাক বিচারপর্বে এক বিবৃতিতে স্বীকার করেছিল যে সে আরএসএস’এর এক সক্রিয় কর্মী হিসাবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিল এবং তারপর সে আরএসএস’এর সদস্যপদ না ছেড়েই হিন্দু মহাসভার হয়ে কাজ শুরু করে। নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে ১৯৬৪-তে জেল থেকে ছাড়া পাবার পর স্পষ্ট ভাবে জানায়, নাথুরাম আরএসএস’এর আজীবন সদস্য ছিল।
গডসের মেন্টর (প্রশিক্ষক উপদেষ্টা) সাভারকর গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রের মূল চক্রী হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছিল, কিন্তু কোনভাবে ছাড়া পেয়ে যায় যেহেতু গডসে এবং অন্যান্যরা তাকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলেছিল। আদালতে সাভারকর দাবি করেছিল যে ১৯৪৮’র ১৭ জানুয়ারি সে নাথুরাম গডসে ও মদনলাল আপ্তের সঙ্গে দেখা করেনি। কিন্তু নতুন প্রমাণ প্রকাশ্যে আসার পর, ১৯৬৪ সালে গঠিত বিচারপতি কাপুর কমিশন সাভারকরের এই দাবিকে ‘মিথ্যা’ বলে প্রমাণ করেছিল। বস্তুত, কাপুর কমিশন এই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে “সাভারকর ও তার গোষ্ঠীদ্বারা হত্যার একটি ষড়যন্ত্র” হয়েছিল এবং সেটা তৈরি হয়েছিল সাভারকর সদনে বসেই। সাভারকরের দেহরক্ষী এবং কাপুর কমিশনের সচিবের সাক্ষ্য প্রমাণ করেছে যে গান্ধীজীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের মূলচক্রী ছিল সাভারকর, সে গডসেকে বন্দুক সরবরাহ করেছিল ও “যশস্বী ভব (সফল হও)!” বলে আশীর্বাদ করেছিল।
গডসে ও সাভারকরের উত্তরসূরীরা একসঙ্গে ‘অভিনব ভারত’ নামে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন চালাতো। পুলিশ আধিকারিক হেমন্ত কারকারে, যিনি পরবর্তীতে শহীদ হন, বোমা বিস্ফোরণে সংগঠনটির ভূমিকার সূত্রে তার সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে প্রকাশ্যে আনেন। বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর বারবার গডসেকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলে উল্লেখ করেছে এবং হেমন্ত কারকারে সম্পর্কে কুমন্তব্য করেছে — কিন্তু তারজন্য মোদী অথবা শাহ’র তরফ থেকে কোনো শাস্তিবিধান করা হয়নি। গান্ধীর জন্য প্রশস্তি আসলে যে নেহাতই বিজেপি’র ভণ্ডামি, তা ধরা পড়ে গেছে আজকের গডসে, প্রজ্ঞা ঠাকুর, সাক্ষী মহারাজ, যতি নরসিংহানন্দ এবং অন্যান্য ঘৃণা-বর্ষণকারীদের প্রতি তার প্রচ্ছন্ন সমর্থন থেকে। গডসে এবং সাভারকর ভারতের সংবিধান এবং তার সাম্য ও গণতন্ত্রের স্বপ্নকে ঘৃণা করতো, ব্রিটিশ শাসনকে সমর্থন করতো এবং সন্ত্রাসবাদকে পোষণ ও অনুশীলন করতো। এই ধ্বংসাত্মক ভারত-বিরোধী দুরাকাঙ্ক্ষার প্রতি বিজেপি’র গোপন সমর্থন আর ‘গোপন’ থাকতে পারে না!
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২২)
সম্প্রতি ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় ইজরায়েলি সফটওয়্যার ‘পেগাসাস’ — যার মাধ্যমে সরকার বেআইনিভাবে অন্যের ব্যক্তিগত ফোনে বা কম্পিউটারে আড়িপাতে, সেই সম্পর্কে একটি তথ্যমূলক বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে মোদী যখন ইজরায়েলে যান তখন মোদী এবং নেতানিয়াহু’র মধ্যে ২০০ কোটি ডলারের একটি প্যাকেজ কেনার সমঝোতা হয়। এই প্যাকেজের মূল বিষয় ছিল ফোনে আড়িপাতার প্রযুক্তি পেগাসাস এবং একটি ক্ষেপণাস্ত্র ইজরায়েল ভারতকে রপ্তানি করবে।
আমরা জানি ভীমা কোরেগাঁও মামলায় বন্দীদের ফোনে পেগাসাসের সাহায্যে আড়িপেতে মিথ্যা প্রমাণ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া পেগাসাস এমন একটি গোয়েন্দাগিরি তথা আড়িপাতার ব্যবস্থা যা ফোনের ক্যামেরাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। এহেন পেগাসাসকে দেশের বহু সাংবাদিক, বিরোধী নেতা, অন্যান্য নেতা ও বহু মহিলাদের ফোনেও গোপনে স্থাপন করা হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে ভারত সরকার এই পেগাসাস কিনেছেন। সুতরাং ভারতীয় নাগরিকদের ওপর এই গোয়েন্দাগিরি ও তাদের ব্যক্তিগত পরিসরে হানা দিয়ে নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারকে লঙ্ঘন করেছে মোদী সরকার। সরকারি কোষাগারের করদাতাদের কোটি কোটি টাকা এবং বাজেট বহির্ভূতভাবে পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া এই ব্যয়বহুল বেআইনি সফটওয়্যার (পেগাসাস) কেনা হয়েছে। কেবলমাত্র শাসক পার্টির কাছে রাজনৈতিকভাবে যারা বিপদজনক, তাদের ফোনেই এই আড়িপাতা হয়েছে। বিজেপি’র কয়েকজন নেতার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য জনগণের করের টাকা ব্যবহার করে এই বেআইনি পেগাসাস কেনা মহা দুর্নীতির নমুনা।
নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনে নজরদারি বিশেষত সাংবাদিক, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক নেতা যাঁরা সরকারের সমালোচক তাঁদের ফোনে পেগাসাসের মাধ্যমে আড়ি পাতার জন্য মোদী প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ও তাঁর শাস্তি পাওয়া উচিত।
রাঁচীর অ্যালবার্ট এক্কা চকে সিপিআই(এমএল)-এর রাঁচী শহর কমিটি পেগাসাস দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সভায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের পেগাসাস নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় বিজেপি নেতাদের একের পর এক মিথ্যাচারের মুখোশ খুলে যাচ্ছে। ভারতের মত দেশে যেখানে বহু মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে সেখানে নজরদারি চালানোর জন্য কোটি কোটি টাকা সরকারিভাবে খরচ করাটা আপামর জনতার প্রতি অপমানজনক। মোদী সরকার মিথ্যাচার বন্ধ করুন, সত্যকে মেনে নিয়ে অবিলম্বে পদত্যাগ করুন।
৩০ জানুয়ারি গান্ধীর ৭৪তম শহীদত্ব বরণের বর্ষপূর্তিতে বিহারের আরওয়ালে ইতিহাস যেন জীবন ফিরে পেল। বিহারের এই ছোট জেলা আরওয়ালের সাথে গান্ধীর শহীদত্বের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।
১৯৩৩ সালে আরওয়ালে একটি ছোট গ্রন্থাগার গঠিত হয়। এই গ্রন্থাগারটি খুব শীঘ্রই স্থানীয় যুবদের মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ১৯৪২সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে এই পাঠাগারের মাঠে ১১জন শহীদ হন, যাদের অনেকে এই পাঠাগারে প্রত্যহই যাতায়াত করতেন। গ্রন্থাগারটি পরিচিত ছিল ‘ফ্রেন্ডস ন্যাশনাল লাইব্রেরী’ নামে কিন্তু গান্ধী হত্যার পরে এটির নতুন নামকরণ হয় ‘গান্ধী পুস্তকালয়’ নামে।
১৯ এপ্রিল ১৯৮৬, গান্ধী পুস্তকালয়ের মাঠে নিরস্ত্র ভূমিহীন কৃষি মজদুররা একটি সভায় সমাবেশিত হয়েছিলেন এবং শান্তিপূর্ণ সেই সভায় পুলিশ গুলি চালিয়ে ২৩ জনকে হত্যা করে। শহীদ হন — চন্দ্রশেখর রাম, আশরাফ মিঁয়া, রাজেন্দ্র সাউ, অনিল রাম, জয়েন্দ্র রবিদাস, করিমন রবিদাস, প্রেমন রবিদাস, শ্রীবংশ পন্ডিত, বাঙালি রবিদাস, পখোরা রবিদাস, চন্দ্রমা পাসওয়ান, রামদেব যাদব, বিজেন্দ্র সাউ, পাপ্পু রবিদাস, বালকেসিয়া দেবী, গঙ্গা মাঁঝি, মনমতী দেবী, একজন বালিকা যিনি সঞ্জীবন মোচীর কন্যা এবং তিনজন অপরিচিত ব্যক্তি। সারা দেশের মানুষ গর্জ্জে উঠলেন স্বাধীন ভারতে জালিয়ানওয়ালাবাগের এই পুনরাবৃত্তিতে।
২০২০’র বিধানসভা নির্বাচনে আরওয়ালের বিধায়ক হিসাবে নির্বাচিত হন সিপিআই(এমএল)-এর মহানন্দ। সোন নদীর ওপারে ভোজপুর জেলার তরারি থেকে পুনর্নির্বাচিত হন সুদামা প্রসাদ। সিপিআই(এমএল)-এর মোট ১২ জন বিধায়কের মধ্যে এই অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকা পাটনার পালিগঞ্জ এবং জাহানাবাদের ঘোষী থেকে নির্বাচিত হন এআইএসএ নেতা সন্দীপ সৌরভ ও রামবলি সিং যাদব। সুদামা বিহার বিধানসভার লাইব্রেরি কমিটির প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁর প্রধান কাজ এখন বিহারের পরিত্যক্ত ও ভগ্নদশাপ্রাপ্ত সরকারি গ্রন্থাগারগুলির সংস্কার করা।
১৯৪২ এবং ১৯৮৬ সালের ঘটনার স্মৃতি উদযাপন সভায় শহীদদের পরিবারদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে ছিলেন ১৯৪২ সালের শহীদ খাখো পাসওয়ানের নবতিপর স্ত্রী ধানওয়া কুঁয়ার। সভায় বিভিন্ন পেশার মানুষের অংশগ্রহণ এটা প্রমাণ করে যে গান্ধী পুস্তকালয়ের নবপর্যায়ের জন্য তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এই আরওয়াল। স্থানীয় মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে ১৮৫৭ সালের তৎকালীন স্থানীয় বীর যোদ্ধা জীবধর সিং, আমরুদ্দীন খান এবং সেখ গুলাব। গান্ধী পুস্তকালয়ের পরে স্থানীয় খাবাইনি পঞ্চায়েত কোমর বাঁধছে আগামী ১০ মে, ১৮৫৭ সালের বীর নায়কদের স্মৃতি উদযাপনের জন্য।
গান্ধীকে হত্যা করে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তরা ভেবেছিল নয়া প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে সময়মতো অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলে দেওয়া যাবে। কিন্তু এই ঘটনা তাদের মুখোশ খুলে দেয় এবং মানুষ তাদের বিচ্ছিন্ন করেন। নয়া ভারত, নয়া সংবিধানকে নিয়ে চলতে থাকে। ৭০ বছর পর দেশ এখন আরও মারাত্মক ও সর্বাত্মক ফ্যাসিস্ত আক্রমণের মুখোমুখি। তাদের নির্বাচিত সরকার দানবীয় আইন এবং প্রযুক্তি নির্ভর গোয়েন্দাগিরি নিয়ে সংবিধানকে বানচাল করার জন্য উদয়াস্ত খাটছে। তাদের ‘ধর্ম সমাবেশে’ ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীরা সন্ন্যাসীর ভেক ধরে ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে মাঠে নেমেছে এবং ইতিহাস হচ্ছে তাদের মুখ্য ময়দান। আমরা এরথেকে শিক্ষা নিতে চাই যাতে ইতিহাসের মর্মন্তুদ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় এবং এরজন্য আমাদের ধিকৃত না হতে হয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনের থেকে অনুপ্রেরণা ও সাহস সঞ্চয় করে, নতুন গণতান্ত্রিক ভারত গড়ার লক্ষ্যে আমরা এই আন্দোলনের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। স্বাধীনতা আন্দোলনের ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্যের উত্তরসূরীদের পুনরায় সর্বশক্তি নিয়ে সংহত হতে হবে এই ফ্যাসিস্তদের চক্রান্তের জাল ছিন্ন করার জন্য। ভগৎ সিং, গান্ধী এবং আম্বেদকরদের পরবর্তী প্রজন্মকে সাভারকর, গডসে ও গোলওয়ালকরের উত্তরসূরীদের অবশ্যই গদিচ্যুত করতে হবে।
৭ ফেব্রুয়ারি বারুইপুর ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের অন্তর্গত নরেন্দ্রপুর থানা অকথ্য পুলিশী সন্ত্রাস চালালো মত-প্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে সংগঠিত এক প্রতিবাদ সভায়।
প্রসঙ্গত, দলিত আন্দোলনের নেতা শরদিন্দু উদ্দীপন ফেসবুকে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে একটি পোস্ট দেন। এই পোস্টকে ঘিরে শরদিন্দু উদ্দীপনের গ্রেপ্তারি ও হেনস্থার বিরুদ্ধে ৭ তারিখ বিকেলে কামালগাজি মোড়ে জমায়েত ও মিছিলের ডাক দেয় আইসা, অ্যাপোয়া, এপিডিআর, একুশের ডাক সহ বিভিন্ন গণসংগঠন। সভা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উক্ত থানার পুলিশ চুলের মুঠি ধরে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে কমরেড রুদ্রপ্রভাকর দাস ও আরো অনেককে। তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করলে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্যনেত্রী চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরীকেও আটক করে। গ্রেপ্তার করা হয় ছ’জন বিক্ষোভকারীকে। কমরেডদের মুক্তির দাবিতে থানার সামনে জড়ো হন পড়ুয়া, সামাজিক ও গণআন্দোলনের কর্মীরা। বেশ কিছুক্ষণ টালবাহানার পর ব্যক্তিগত বন্ডে গ্রেপ্তার হওয়া সাথীরা ছাড়া পাওয়ায়, সংহতিতে জড়ো হওয়া যাদবপুরের পড়ুয়ারা স্লোগানে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন মুক্তি পাওয়া সাথীদের। স্লোগান ওঠার সাথে সাথে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় কমরেডদের। চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে এলোপাথাড়ি লাঠি আর লাথি চালাচ্ছিল পুলিশ, এরপর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে থানায় নিয়ে যায়। এক মহিলা কমরেড ‘লাল সেলাম’ স্লোগান তোলায় জঘন্য অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করে তাকেও লাঠিপেটা করা হয়। অপরাধ — তার দৃঢ় কণ্ঠের ‘লাল সেলাম’ স্লোগান। লাঠির ঘা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে অন্য দুই মহিলা কমরেডের বুকে ধাক্কা মারে, শরীরের বিভিন্ন অংশে নির্বিচারে আঘাত করে পুরুষ ও মহিলা পুলিশ। সাথে চলে অশ্রাব্য গালিগালাজ, থানায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণের হুমকি। দু’জন পুরুষ পুলিশ সিঁড়ি দিয়ে টেনে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে থানায় তোলে এক মহিলা কমরেডকে। আবারো গ্রেপ্তার হয় ১১ জন কমরেড। থানার ভিতরে ফোনের পাসওয়ার্ড দিতে অস্বীকার করায় নির্বিচারে লাথি মারা হয় মহিলা কমরেডদের। পুলিশ লকআপেও সমস্ত কমরেডদের উপর অকথ্য মারধর চলে। গুলি করে মেরে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। পুলিশ লকআপে এই নজিরবিহীন অত্যাচারের ঘটনা দেখিয়ে দেয় তৃণমূল সরকারের পুলিশ বাহিনীর এক অংশ হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের ধারক ও বাহক।
কমরেড মলয় আর চন্দ্রাস্মিতাকে মেডিকেল করাতে নিয়ে গেলেও আগে থেকে লিখে রাখা সার্টিফিকেটে নাম বসিয়ে দেওয়া হয়। লকআপে বাকি আটক কমরেডদের কোনো মেডিকেল চেক-আপ করানো হয়নি। মেরে রক্তাক্ত করে দেওয়ার পরেও কমরেডদের ন্যূনতম চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়নি।
গ্রেপ্তার হওয়া সাথীদের পরের দিন বারুইপুর কোর্টে তোলা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, অপরাধমূলক কাজে উস্কানি দেওয়া ইত্যাদি ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। বারুইপুর কোর্টে, গ্রেপ্তার হওয়া সাথীদের কোমরে দড়ি বেঁধে আনা হয়, যা মধ্যযুগীয় বর্বরোচিত আচরণ। পুলিশের মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে জামিন খারিজ হয় সমস্ত কমরেডের।
এর আগেও, সোহরাব হোসেন নামের এক পুলিশ কনস্টেবল ও তার পরিবারের মহিলাদের উপর একইরকম নিপীড়ন চালিয়েছিল এই থানার পুলিশ। শরদিন্দু উদ্দীপনের মত-প্রকাশের স্বাধীনতার উপর আক্রমণসহ গতরাতের পুলিশী সন্ত্রাস আদপে উক্ত থানার ব্রাহ্মণ্যবাদী ও পিতৃতান্ত্রিক চেহারার প্রতিফলন।
ফ্যাসিস্ট বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মত আজ পশ্চিমবাংলায় পুলিশ প্রশাসন যেভাবে মত-প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণআন্দোলনকারীদের বেআব্রু আক্রমণ করছে আমরা তার তীব্র নিন্দা করছি।
আমরা, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশের বর্বরোচিত ও পিতৃতান্ত্রিক সন্ত্রাসকে ধিক্কার জানাই। গ্রেপ্তার হওয়া কমরেডদের অবিলম্বে মুক্তি চাই। নরেন্দ্রপুর থানার হেনস্থাকারী ও অত্যাচারী অফিসারদের শাস্তি চাই।
সমগ্র গণতান্ত্রিক মহলের কাছে আমাদের আহ্বান, মত-প্রকাশের স্বাধীনতার উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক হোন।
(সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে প্রচারিত বিবৃতি)
নরেন্দ্রপুরে পুলিশী সন্ত্রাসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসার ৯ জন ছাত্রছাত্রীকে গ্রেপ্তার ও পুলিশ হেফাজতে নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে, এবং সব ছাত্রছাত্রীর অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে একটি প্রতিবাদী মিছিল বের করে ছাত্রছাত্রীরা। মিছিলটি যাদবপুর থানা ঘুরে ৮বি বাস স্ট্যান্ডে উপস্থিত হয়। এক ঘণ্টার উপর অবরোধ করে রাখে ছাত্রছাত্রীরা। মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশ মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কুশপুতুল দাহ করে ছাত্র ছাত্রীরা। আইসা ছাড়াও যাদবপুরের অন্যান্য ছাত্র সংগঠন ডিএসএফ, রিফ্রাকশন, পিডিএসএফ, এসএফআই, আরএসএফ যোগ দেয় এই কর্মসূচিতে।
নরেন্দ্রপুর থানা যে ধারাগুলিতে দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার আইসা’র ছাত্রছাত্রীদের ওপর মামলা দিয়েছে তারমধ্যে আছে ৩৩৩ ধারা — “পুলিশকে তার ডিউটিতে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হামলা চালিয়ে মারাত্মক জখম করা”। পুলিশ সকলকে রাস্তায় ফেলে পেটালো, থানার ভেতরে নিয়ে মারল, মহিলাদের রেপথ্রেট দিল, তারপর অভিযোগ আনল পুলিশেরই ওপর হামলা চালিয়ে মারাত্মক জখম করার! পুলিশ মারাত্মক জখম হওয়ার মেডিক্যাল সার্টিফিকেটও জমা দিয়েছে নিশ্চয়। গভীর রাতে দু’জন কমরেডকে থানা লকআপ থেকে বারুইপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বডি ফিটনেস সার্টিফিকেট আনতে; হলুদ রঙের স্লিপে আগে থেকেই ফিটনেস সার্টিফিকেট লেখা ছিল, সেখানে নাম ও বয়স বসিয়ে দিলেন ইমার্জেন্সিতে বসে থাকা ডাক্তার! একই পদ্ধতিতে পুলিশের ‘মারাত্মক জখম’ হওয়ার সার্টিফিকেটও ডাক্তারবাবুরা বানিয়ে রেখেছিলেন নিশ্চয়।
নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্রছাত্রীদের ওপর, থানার সামনের রাস্তায়। থানার ভেতরে নেগোশিয়েশন চলছিল, ছাত্রছাত্রীরা রেলিঙের ধারে বসেছিল তাঁদের কমরেডদের ছাড়া পাওয়ার অপেক্ষায়। তারা গান গাইছিল মৃদুস্বরে ডাফলি বাজিয়ে। থানার বারান্দা থেকে কমরেডদের নেমে আসতে দেখে শ্লোগান দিতে শুরু করে তারা। নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ এই শ্লোগান তোলাকে তাদের কর্তৃত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হিসেবে নেয় এবং তৎক্ষণাৎ ছাত্রছাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তে ওপর থেকে নেমে আসে আরও কয়েকজন। অধিকাংশই সাধারণ পোশাকে, তারা পুলিশ না ভাড়াটে গুণ্ডা বোঝার উপায় নেই। রাস্তায় ফেলে মারা শুরু হয় এবং তারপর চ্যাংদোলা করে থানার ভেতর নিয়ে যায় ওরা। সেখানে আরেক পর্ব অত্যাচার চলে। ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। পাসওয়ার্ড দিতে না চাওয়ায় বুকে লাথি মারে পুলিশ। লকাপে ঢুকিয়ে নেওয়ার পরেও ক্রমাগত হেনস্থা করে চলে কমরেড সৌমি জানা ও বর্ষা বড়ালকে।
মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার ঊর্ধে তুলে ধরে একটা ছোট প্রতিবাদ ছিল। থানা থেকে অনেকটা দূরে বিশ-বাইশ জনের একটা ছোট সাধারণ প্রতিবাদকেও সহ্য করতে নারাজ পুলিশ। প্রথম পর্বে গ্রেপ্তার করে আইসার তিনজন, এপিডিআরের দু’জন ও আইপোয়া’র একজনকে। খবর পেয়ে অনেকে আসতে শুরু করেন। গ্রেপ্তার হওয়া কমরেডদের ছাড়ার বিষয়ে কথা বলতে যারা ভেতরে যান তাঁদের সাথেও দুর্ব্যবহার করে পুলিশ। শেষে দশটা নাগাদ ছাড়া পাওয়ার পর শ্লোগান তোলায় আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ।
‘বারুইপুর পুলিশ জেলা’র অন্তর্গত এই থানা। প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের পেটানোর সময় যে আক্রোশ ও জিঘাংসা পুলিশ প্রকাশ করছিল তার ধরণ খানিকটা আরএসএস অনুপ্রাণিত মবলিঞ্চিং ধরণের। সঙ্ঘীদের মতোই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও মহিলাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য এবং ‘হিন্দু ভাবাবেগ’ আহত করার অভিযোগ তুলছিল ওরা। ছাত্রছাত্রীদের কোমরে দড়ি বেঁধে অপমানিত করতে করতে আদালতে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও পুলিশের এই মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। কিছুদিন আগে এই পুলিশ জেলারই সোনারপুর থানার সোহরাব হোসেন ও তাঁর পরিবারের ওপর নির্মম সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়েছিল। এই মামলাটি এখন নরেন্দ্রপুর থানার আওতায় চলছে এবং সেখানে তাদের সাম্প্রদায়িক অবস্থান প্রকট হয়েছে। বৃহত্তর কলকাতার মধ্যেই, কামালগাজি মোড়ে অবস্থিত, এই থানার বাড়িটিও উদ্ভট। ছয়তলা বিশাল বিল্ডিং জুড়ে একই সাথে থানা ও বিয়েবাড়ি। বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল, আলোকমালায় সাজানো ছিল থানা। থানার ভেতর শাসানোর সময় পুলিশ আক্ষেপ করছিল যে এইসব ঝামেলার ফলে আর বিয়েবাড়ি ভাড়া নিতে চাইবে না কেউ!
ভারতীয় সমাজের পুরানো ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা দলিত আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হবে কি হবে না সে প্রশ্ন তোলার অধিকারও সকলের আছে। এই অধিকারের পক্ষে না দাঁড়ালে তা ব্রাহ্মণ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ। ছোট ছোট প্রতিবাদগুলি স্পর্ধা তৈরি করে। বিকট শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে একলা মানুষের রুখে দাঁড়ানো যে কত বড় হয়ে উঠতে পারে তা বারবার দেখছি আমরা। সেই কারণে এই ছোট প্রতিবাদকে নৃশংস প্রতিহিংসা নামিয়ে সন্ত্রস্ত ও স্তব্ধ করে দিতে চাইছে পুলিশ প্রশাসন। এ ধরনের প্রতিটি হামলার ঘটনাকে বৃহত্তর ঐক্যের সমাবেশমঞ্চ বানিয়ে আমাদের এগোতে হবে এবং ছড়িয়ে দিতে হবে প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ছোট ও দৃঢ় প্রতিবাদের প্রতিস্পর্ধা।
- মলয় তেওয়ারি
৭ ফেব্রুয়ারি শিলিগুড়ি পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের সিপিআই(এমএল) মনোনীত প্রার্থী মোজাম্মেল হক (মোজামিল)-এর সমর্থনে গোটা ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় এক বর্ণাঢ্য মিছিল পরিক্রমা করে। ওয়ার্ডের নিকাশি-ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে প্রচার চলাকালীন বক্তব্য রাখেন রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বোস, প্রার্থী মোজাম্মেল হক, জেলা কমিটি সদস্য মুক্তি সরকার প্রমুখ। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন মীরা চতুর্বেদী। এলাকার বেশ কিছু মানুষ বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচারে অংশ নেন। মিছিলের নেতৃত্ব দেন দলের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ প্রমুখ।
রাজ্যে বন্ধ হওয়া জুটমিলগুলি খোলা, চটকলে ন্যূনতম ২৬,০০০ টাকা মজুরি সহ সহ ১২ দফা দাবিতে ৮ ফেব্রুয়ারি চটকলের ২১টি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কলকাতা বিবাদী বাগে আইজেএমএ দপ্তরের সামনে ভুখ হরতাল দিবস পালিত হয়। একই সাথে রাজ্যজুড়ে চটকলের গেটে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। বেঙ্গল চটকল মজদুর ফেডারেশন সহ বিভিন্ন ইউনিয়ন অংশগ্রহণ করেন। বক্তব্য রাখেন বিসিএমএফ রাজ্য সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী, রাজ্য নেতা শম্ভু ব্যানার্জি, মাজাহার খাঁন, বটকৃষ্ণ দাস প্রমুখ। উপস্থিত থাকেন রাজ্যনেতা দেবব্রত ভক্ত। অবস্থান মঞ্চে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায়।
২০২১ সালে প্রণীত ‘ত্রিপুরা কৃষিজমি ভাড়া আইন’ আসলে কেন্দ্রীয় জনবিরোধী তিন কৃষি আইনের মতো বেসরকারি কোম্পানি পথে কৃষির বিকাশকে উৎসাহিত করবে। এরফলে কৃষকের সর্বনাশ হবে এবং কৃষক জমি থেকে উচ্ছেদ হবে। তাই, এই ‘ত্রিপুরা কৃষিজমি ভাড়া আইন’ বাতিল করতে হবে।
গত শীতকালীন বিধানসভার অধিবেশনে ত্রিপুরা সরকার ‘দি ত্রিপুরা এগ্রিকালচারাল ল্যান্ড লিজিং বিল’ এনেছে এবং বিরোধীদের অনুপস্থিতিতে বিনা বাধায় তাকে আইনে পরিণত করেছে। এই আইনে সর্বোচ্চ ৯ বছর ১১ মাস মেয়াদ পর্যন্ত নাল, টিলা ও সব ধরনের কৃষিভূমি এক আইনী চুক্তিপত্রের মাধ্যমে লিজ বা ভাড়া দেওয়ার বন্দোবস্ত করার কথা বলা হয়েছে। গত তিনদশক ধরে কৃষিতে চলমান সংকটে জর্জরিত-ঋণগ্রস্ত কৃষকেরা ও অনাবাদী ক্ষুদ্র জোতের মালিকেরা যাতে সহজে জমি লিজে দিতে পারে তার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এই আইনে সরকার জমির ভাড়া ঠিক করে দেবে এমন বিধান রয়েছে। যাতে জমি ভাড়ার পরিমাণ ন্যূনতম ঐ জমিতে উৎপাদিত ফসলের বাজার মূল্যের চার ভাগের এক ভাগ হবে। তার কম হবেনা। এই আইন কৃষক স্বার্থবিরোধী কেন্দ্রীয় তিন কৃষি আইনের আদলে তৈরী করা হয়েছে। যাতে কৃষিকে বেসরকারি কোম্পানি পথে ঠেলে দেওয়া যায়।
সরকার এখানে সংকটের দায়ভার কৃষকদের ঘাড়েই চাপাতে ব্যস্ত। কৃষিতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও ফসলের দাম কম হওয়ার ফলে কৃষি এখন সংকটগ্রস্ত ও অলাভজনক। এখানে এই সংকট নিরসনে সরকারি ন্যায্য দামে কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা, উৎপাদন করা, ফসলের নূন্যতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করার প্রশ্নে সমস্ত দায়বদ্ধতা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে বাজারের থেকে বেশি দাম দিয়ে ১৯.৪০ টাকা কেজি দরে ধান কিনছে ঠিকই। কিন্তু এইক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের দেড়গুন দাম প্রায় ২৮ টাকা কেজি দরে দেওয়া হচ্ছেনা। সার, বীজ, কীটনাশক সবকিছুই বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছে। ফলে কৃষি উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। রাজ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুন করার প্রতিশ্রুতি এক প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। ডাবল ইঞ্জিন সরকারের সময়ে কৃষকেরা আরো বেশি সংকটাপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে। তাই রাজ্যে গরিব ও প্রান্তিক কৃষক, নিম্ন মধ্য কৃষক ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনাবাদী জোতের মালিক বাধ্য হয়ে জমি ভাড়া দেবে, কিন্তু আর ফেরত নিতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত জমি হাতছাড়া হবে। জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হবে। ত্রিপুরা ভূমি রাজস্ব ও ভৃমি সংস্কার আইনের ১২তম সংশোধনী, ২০২১ আইনে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্গাদারদের কৃষক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাদের সার, বীজ কীটনাশক ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা, ফসলহানিতে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাই এই ‘কৃষিজমি ভাড়া আইন ২০২১’ ও ১২তম সংশোধনী আইন বাতিল করার দাবিতে এবং ত্রিপুরার কৃষিকে বাঁচাতে গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে রাজ্যে কৃষকদের কছে আহ্বান জানাচ্ছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি এবং এআইকেএম ত্রিপুরা রাজ্য পরিষদ।
সুপ্রিম কোর্ট হাইলাইট করেছে যে রাজ্যগুলি দ্বারা প্রকাশিত কোভিড-১৯ মৃত্যুর সরকারী পরিসংখ্যান ‘সত্য নয়’ এবং রাজ্য সরকারগুলিকে মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়দের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, যারা ক্ষতিপূরণের আবেদন করেছেন।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র সূত্র অনুসারে, বিচারপতি এম আর শাহ এবং বি ভি নাগারাথনা’র বেঞ্চ বলেছেন, “কোভিড-১৯ মৃত্যুতে সরকারী পরিসংখ্যান সত্য নয় এবং এটা বলা যাবেনা যে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের পরিবারের দ্বারা প্রতারণামূলক দাবি করা হচ্ছে”৷
দ্য ওয়্যার সায়েন্স রিপোর্ট করেছে, “জনসংখ্যাবিদ এবং মহামারী বিশেষজ্ঞ প্রভাত ঝা’এর নেতৃত্বে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রে ৬ জানুয়ারী ২০২২এ প্রকাশিত হয়েছে যে জুন ২০২০ থেকে জুলাই ২০২১ পর্যন্ত ভারতের আনুমানিক কোভিড১৯ মৃতের সংখ্যা ছিল ৩২ লক্ষ — তারমধ্যে ২৭ লক্ষ মৃত্যু সম্ভবত দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় ঘটছে। অথচ, ভারতের সরকারী মৃত্যুর সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ৪.৮ লক্ষ।”
দ্য ওয়্যার, দ্য ওয়্যার সায়েন্স এবং অন্যান্য কয়েকটি পত্রিকা বিভিন্ন রাজ্য সরকার দ্বারা উপস্থাপিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি কোভিড-১৯ মৃত্যুর বিষয়ে রিপোর্ট করেছে। একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে শুধুমাত্র রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড এবং অন্ধ্রপ্রদেশে, ২০১৯ সালের সংশ্লিষ্ট মাসগুলির তুলনায় ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে ৩.৬ লক্ষ অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে৷ যেখানে, কেন্দ্র সরকার বলছে যে ৪.৮ লক্ষ লোক কোভিড’এ মারা গেছে৷
শীর্ষ আদালত সমস্ত রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে এজন্য রাজ্য আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সদস্য সচিবের সাথে সমন্বয় করার জন্য একটি নোডাল অফিসার নিয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছে। শীর্ষ আদালত আরও বলেছে, “কর্তৃপক্ষের আইনি পরিষেবা প্রচেষ্টা সেই সমস্ত ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছাতে হবে যারা এখনও যোগাযোগ করেনি। প্রযুক্তিগত কারণে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার আবেদনগুলি প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয় এবং যদি কোনও প্রযুক্তিগত ত্রুটি পাওয়া যায় তবে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিকে তাদের ত্রুটিগুলি নিরাময়ের সুযোগ দেওয়া উচিত, কারণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল ক্ষতিগ্রস্তদের কিছুটা সান্তনা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।” “দাবি পাওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য রাজ্যগুলির সমস্ত প্রচেষ্টা করা উচিত,” এতে বলা হয়েছে। ক্ষতিপূরণের জন্য অফলাইনে জমা দেওয়া আবেদনগুলি প্রত্যাখ্যান করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট মহারাষ্ট্র সরকারকেও তিরস্কার করেছে। “অফলাইনে জমা দেওয়া কোনও আবেদন প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়। আপনি দাতব্য করছেন না। কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে এটা আপনাদের কর্তব্য। পিলার থেকে পোস্টে লোক পাঠাচ্ছেন কেন? হৃদয় দিয়ে এটি করুন”, বেঞ্চ বলেছে।
শীর্ষ আদালত ৪ অক্টোবর ২০২১এ বলেছিল, “কোনও রাজ্য সরকার কোভিড-১৯’এর কারণে মৃতের নিকট আত্মীয়কে ৫০,০০০ টাকার এক্স-গ্রেসিয়া দিতে যেন অস্বীকার না করে, যেহেতু মৃত্যুর শংসাপত্রে ভাইরাসটিকে মৃত্যুর কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়নি”। শীর্ষ আদালত বলেছিল “কোভিড-১৯’এর কারণে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য তার নির্দেশাবলী খুব স্পষ্ট এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের কোনও প্রয়োজন নেই”।
শীর্ষ আদালত আরও বলেছিল “যেখানে মৃত্যুর শংসাপত্রে, কোভিড-১৯’এর কারণে মৃত্যু দেখানো হয়নি, কিন্তু যদি দেখা যায় যে মৃতকে করোনাভাইরাস পজিটিভ ঘোষণা করা হয়েছিল এবং তার ৩০ দিনের মধ্যে মারা গেছে, তাহলে তার পরিবারের সদস্যরা আর কোনও শর্ত ছাড়াই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী”।
- দ্য ওয়্যার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২
ক্ষিদে পেয়েছে — চোপ! এদেশ এখন ডিজিটাল হয়েছে
চাকুরি পাচ্ছেন না — কোনো কথা নয়, দেশ ডিজিটাল হচ্ছে
রোজগার কমে গেছে — তাতে কী হয়েছে? আমরা ডিজিটাল হয়েছি
দেশজোড়া অসাম্য — বলার দরকার নেই, সকলের জন্য সর্বত্র ডাটার বন্দোবস্ত করছি
গত দু’বছর ধরে বিদ্যালয় বন্ধ — কুছ পরোয়া নেই, ই-লার্নিং’এর বন্দোবস্ত পাকা
হাসপাতালে জায়গা নেই, অক্সিজেনের অভাবে প্রিয়জন মারা গেছে — মন খারাপ করবেন না, ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য পরামর্শের বন্দোবস্ত হয়েছে এমনটাই মনে হয় অর্থমন্ত্রীর (থুড়ি প্রধানমন্ত্রীর) ভাবনা। কাগজহীন বাজেট, কাগজহীন করের রিটার্ণ এগুলিকে তিনি আক্ষরিক অর্থে এতটাই গ্রহণ করেছেন যে, দেশের সমস্ত সমস্যার জন্য ডিজিটাল সমাধানের বটিকা হাজির করেছেন। তাই এই অতিমারীর সময়ে প্রিয়জন হারানো, রুজি হারানো, মিড-ডে-মিল হারানো, শ্রেণীকক্ষ হারানো, কাজ হারানো, সম্পদ হারানো দেশবাসীকে আগামী ২৫ বছরের অমৃতকালের ধোঁকা দিতে তাঁর একটুও বাধেনি। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার, সকলের জন্য ঘর বানানোর, ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি বানানোর, সব কালো টাকা ফেরত আনার, বছরে ২ কোটি বেকারের চাকুরির বিবিধ প্রতিশ্রুতি জলাঞ্জলি দিয়ে ২৫ বছরের নয়া দীর্ঘকালীন সময়সীমা ধার্য করেছেন দেশকে ও তাদের জনসাধারণকে অমৃতলোকে পাঠানোর জন্য।
ভেবে দেখুন ২৫ বছর বাদে শত বছরের ভারতবর্ষের কথা যেখানে টিভি’র চ্যানেল দিয়েই শিক্ষালাভ হবে। ডিজিটাল শিক্ষকরা ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদান করবেন। কৃষকরা তাদের শস্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন কিষাণ ড্রোনের মাধ্যমে। তাইতো অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “শস্য মূল্যায়নে, জমির রেকর্ডে, কীটনাশক ছড়ানোতে কিষাণ ড্রোনের ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির ঢেউ তুলবে।” তাই কৃষিক্ষেত্রের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর তেমন দরকার পড়েনি। এমনকি ৩ বছর আগে শুরু করা গত ২০১৯ সালের নির্বাচনে কৃষকদের ভোট বাগানোর পিএম কিষাণ প্রকল্পে কোনো বরাদ্দ বাড়ানো হযনি। যদিও গত তিনবছরে মূল্যবৃদ্ধিতে কোনো ফাঁক পড়েনি, ফলে টাকার দাম কমেছে।
ডিজিটালের দুনিয়ায় গরিব মানুষ ডিজিটাল টাকায় ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং পরিষেবা গ্রহণ করবে, ডিজিটাল খরচ করে ডিজিটাল সম্পদ গড়বে। জাতীয় টেলি-মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দারিদ্রকে অনায়াসে মানিয়ে নিয়ে খিদে ভুলিয়ে রাম-কৃষ্ণ-শিব মন্দিরে আচ্ছন্ন করে দরিদ্র জনতার মানসিক স্বাস্থ্যকে সবল করে তুলবে; তাছাড়া সর্বব্যাপী ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হবে।
এই ডিজিটাল কালে দেশজুড়ে অসাম্য ও বৈষম্য বিরাজ করলেও তাকে অমৃত হিসেবে গলাধঃকরণ করতে হবে। ভুলে যেতে হবে যে দেশে চরম অসাম্য তৈরি হয়েছে। তাই বাজেট বক্তৃতার কোথাও ক্রমবর্ধমান অসাম্য নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। অর্থমন্ত্রীর ভাবনার চৌহদ্দিতে অসাম্যের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না।
যদিও অর্থনৈতিক অসাম্য কেবল ন্যায় ও সমতার বিষয় নয়, উন্নয়ন ও বৃদ্ধির জন্যও তা যথেষ্ট সমস্যার বিষয়। দেশে যে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে তা সরকার এবং জনগণের পক্ষে উদ্বেগের বিষয় হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অবশ্য অসাম্যের এই বাড়বাড়ন্তের কারণ হল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ধরণ — কর্মসংস্থানহীন বৃদ্ধি। এবিষয়ে বহুল পরিমাণ আলোচনা সত্ত্বেও বৃদ্ধির দায়িত্ব ডিজিটাল অর্থনীতি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে সঁপে দেওয়ার ভাবনায় মশগুল দেশের ‘চিন্তানায়করা’। আদতে এই বন্দোবস্তকে পাল্টাতে গেলে প্রয়োজন অর্থনীতির সম্পূর্ণ পরিমার্জন যেখানে উপযুক্ত কর্মসংস্থানকে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে পরিগণিত করতে হবে। এই বাজেট কর্মসংস্থানকে কেবল মুখের কথায় পর্যবসিত করেছে। কোন কোন উৎপাদন ক্ষেত্রে কী পরিমাণ কর্মসংস্থান হতে পারে তা কোথাও বলা হয়নি। বাজেট বক্তৃতায় ৬ বার নিয়োগ (এমপ্লয়মেন্ট) ও ৩ বার কাজ (জব) শব্দদুটির উল্লেখ আছে। কিন্তু নির্দিষ্ট সংখ্যা আছে একবার। ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থান সেই ‘আত্মনির্ভর ভারত’ বাগাড়ম্বরের ক্ষেত্রগুলিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কতদিনে হবে তার উল্লেখ নেই। ২০১৪ সালের বিজেপি’র নির্বাচনী ইশতেহারের সেই বছরে ২ কোটি চাকুরির কোনো টুকরোও বাজেটে নেই, যদিও গত ৭ বছরের গুণকীর্তনের কল্পকথা বাজেটে ছলকে ছলকে পড়েছে।
বাজেট অবশ্যই ভোগব্যয় বাড়াতে সক্ষম এমন খরচ বাড়াতে পারত, ও অত্যাবশ্যক গণপরিষেবার ব্যাপ্তি ঘটাতে পারত যা অপরদিকে কর্মসংস্থান বাড়াত। তা না করে যোগানের দিক থেকে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর কথা ভাবা হয়েছে। মূলধনী ব্যয় বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে বিপুল পরিমাণে, যদিও যে পরিমাণ বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে আদতে তাতে কারচুপিও রয়েছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রকল্প এমএনআরইজিএ’র জন্য বাজেট বরাদ্দ সংশোধিত (২০২১-২২) বরাদ্দের তুলনায় অনেকটাই কমানো হয়েছে, এমন একটা সময়ে যখন কোভিড ও তজ্জনিত ডিজ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের অত্যাচার বজায় রয়েছে। ফলে গ্রামাঞ্চলে ১০০ দিনের কাজের চাহিদা রয়েছে।
কয়েকটি সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়ের দিকে একটু দৃষ্টি দিয়ে দেখা যাক বাজেট ২০২২ কী চাইছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ২০২১-২২ সালের বাজেট বরাদ্দের (৯৩,২২৪ কোটি টাকা) তুলনায় সংশোধিত বরাদ্দ, ৮৮,০০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ২০২১-২২ সালে শিক্ষাখাতে ব্যয় না করে সরকার ৫,২২২ কোটি টাকা বাঁচিয়েছে। বর্তমান বাজেটে অবশ্য বরাদ্দ বাড়িয়ে ১,০৪,২৭৮ কোটি টাকা করা হয়েছে। গতবারের বাজেট বরাদ্দের তুলনায় ১১,০০০ কোটি টাকার এই বরাদ্দ বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির সুবাদে বেশ খানিকটা কম। তার উপরে ওই ডিজিটাল শিক্ষা পরিকাঠামোর জন্যই এর বেশির ভাগটা ব্যয়িত হবে। যখন দরকার ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমুখি করে তুলে গত দু’বছরে যে লাখো লাখো ছাত্রীছাত্র শিক্ষাঙ্গনের বাইরে চলে গেছে তাদের বিদ্যালয়মুখি করে তোলার, তখন ডিজিটাল শিক্ষার উপরে জোর দিয়ে তাদের আরো বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। ই-বিদ্যার জন্য ২০০ টিভি চ্যানেল, ৭৫০ ভার্চুয়াল ল্যাব, ৭৫ ই-ল্যাবের ঢক্কানিনাদ কতটা কার্যকরী হবে জানা নেই। কিন্তু তা অধিকাংশ বিদ্যালয় ছুটদের যে বিদ্যালয়ের বাইরেই রেখে দেবে তাই নয় ডিজিট্যাল-বিভক্ত সমাজে শিক্ষাক্ষেত্রে আরো বেশি অসাম্য সৃষ্টি করবে। যেখানে দেশের ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে ডিজিটাল পরিকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ বা পয়সা নেই সেখানে এর মানে কী? আদতে এর মাধ্যমে শিক্ষাকে আরো বেশি করে বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়াই উদ্দেশ্য। সেই জন্যই যে ১১ লক্ষ শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে সে ব্যাপারে বাজেটে কোনো উল্লেখই নেই। সেই লক্ষ্যেই পূর্বের মিড-ডে-মিল প্রকল্পে, বর্তমানে যার গালভরা নাম হল পিএম পোষণ শক্তি নির্মাণ, টাকার বরাদ্দ গত কয়েক বছর ধরেই কমছে, এবারো কমানো হয়েছে। গতবছরের ১১,৫০০ কোটির থেকে ১,৩০০ কোটি কমিয়ে ১০,২০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। যা ২০২০-২১ বাজেটের (১২,৯০০ কোটি) তুলনায় ২,৭০০ কোটি টাকা কম। সরকারের যদি বিদ্যালয়ছুট ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়ে আসার সদিচ্ছা থাকত তাহলে বরাদ্দ বাড়ত, কমত না।
১০০ দিনের কাজের জন্য বাজেটে ৭৩,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যদিও গতবছরের সংশোধিত বরাদ্দের পরিমাণ ৯৮,০০০ কোটি টাকা। ওই পরিমাণ বরাদ্দ সত্ত্বেও ২০২২’র ১ ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুসারে ৭৭ লক্ষ পরিবারের কাজের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ৭,০০০ কোটি টাকার বেশি সংশোধিত বরাদ্দের থেকে বেশি খরচ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফলে ওই বকেয়া মিটিয়ে থাকবে ৬৬,০০০ কোটি টাকার মতো, যা ২০২১-২২’র সামগ্রিক খরচ ১,০৫,০০০ কোটি টাকার তুলনায় ৪০ শতাংশ কম। গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রেও সরকার বাজেট বরাদ্দ (১,৩৮,২০৩ কোটি) গতবছরের সংশোধিত খরচের (১,৫৫,০৪২ কোটি) তুলনায় কমিয়েছে প্রায় ১৭,০০০ কোটি টাকা।
গতবছরের বাজেটের তুলনায় সরকার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণে অধিক ব্যয় করেছিল। ফলে সংশোধিত খরচ হয়েছিল ৮৬,০০০ কোটি টাকা। এবছর, অতিমারীর সময়ে ও পরে যখন স্বাস্থ্যের প্রয়োজন সর্বাধিক তখন টাকার অঙ্কে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ২০০ কোটি টাকা। বছরে ৬ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ধরলে যা গতবছরের ব্যয়ের তুলনায় ৫,০০০ কোটি টাকা কম। গতবছর বাজেটে পিএম আত্মনির্ভর স্বাস্থ্য ভারত যোজনার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। তারমধ্যে বহুকিছুর সাথে ছিল ব্লকস্তরে ১১টি রাজ্যে জনস্বাস্থ্য ল্যাব তৈরি, ৬০২টি জেলায় ক্রিটিকাল কেয়ার ব্লক তৈরি, ১৫টি জরুরি স্বাস্থ্য অপারেশন কেন্দ্র, দু’টি মোবাইল হাসপাতাল প্রভৃতি। রূপায়ণের যে খতিয়ান দাখিল করা হয়েছে সেখানে এগুলির কোনো উল্লেখ নেই।
অতিমারীর অমৃতকালে খাদ্যে ভর্তুকিও কমছে গতবছরের সংশোধিত বরাদ্দ ২,৯৯,৩৫৫ কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২,০৭,২৯১ কোটি টাকা, ৯২,০৬৪ কোটি টাকা কম। যদি ৬ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি ধরা হয়, তাহলে হ্রাসের পরিমাণ দাঁড়াবে ১,১০,০০০ কোটি টাকায়। অসাম্য ও দারিদ্রের ফলে যখন খাদ্যের পরিমাণ সর্বোচ্চ তখন খাদ্যে ভর্তুকি কমানোর ভাবনাই পাপ। ঠিক এই দিক দিয়েই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিষয়টিকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি বাজেটে। যদিও অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, “সকলের জন্য উন্নয়ন সরকারের অগ্রাধিকার যারমধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১ কোটি কৃষকের জন্য লাভজনক গম, ধান, খরিফ ও রবিশস্যের সংগ্রহ”। তিনি এও বলেন যে, ১৬৩ লক্ষ কৃষকের কাছ থেকে ১,২০৮ লাখ মেট্রিক টন গম ও ধান কেনা হবে। তাদের খাতায় সরাসরি ২.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া হবে। কিন্তু বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ১,৩২,৫১৪ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে যা গতবছরের বরাদ্দ ১,৩১,৫৩১ কোটির তুলনায় মাত্র ৯৮২ কোটি টাকা বেশি। এক্ষেত্রেও যদি মুদ্রাস্ফীতিকে ধরা হয় তাহলে বরাদ্দ প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা কম।
এই বাজেট অধিকাধিক বেসরকারিকরণের দিক দেখাচ্ছে। মূলধনী ব্যয়ের মাধ্যমে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে খরচ বাড়িয়ে সরকার বেসরকারি ক্ষেত্রকে বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার তত্ত্বই বাজেটে প্রচ্ছন্ন। তাই মধ্যবিত্ত বা নিচের দিকে থাকা বেতনভোগীদেরও কোনোরকম করের সুবিধে দেওয়ার কথা নেই। অর্থাৎ ভোগব্যয় বাড়ানোর জন্য সাধারণ করদাতাদের জন্য কোনো উৎসাহ দেওয়ার নামগন্ধ নেই বাজেটে। কিন্তু কর্পোরেটদের জন্য কিছু সুবিধে দেওয়া হয়েছে। তেলা মাথায় তেল দিয়ে একদিকে অর্থনীতিতে অসাম্য বাড়ানো অপরদিকে শাসক বিজেপি’র তহবিল বাড়ানোর কৌশল চলতেই থাকছে।
- অমিত দাশগুপ্ত
মাননীয়া,
খাদ্য সুরক্ষা দপ্তর (এফএসএসএআই — ফুড সেফটি এ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস্ অথরিটি অব ইন্ডিয়া) জেনেটিক্যালি মডিফায়েড (জিএম) খাবার সংক্রান্ত একটি খসড়া বিধিমালা প্রকাশ করেছে নভেম্বর মাসে। এবং আগামী ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা নিয়ে মতামত চাইছেন। এপ্রসঙ্গে আমরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যে নানা গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জিএম খাবার অপ্রয়োজনীয়, অস্বাস্থ্যকর এবং প্রকৃতির পক্ষেও ক্ষতিকর। জনস্বাস্থ্য একটি রাজ্য নিয়ন্ত্রিত বিষয় হলেও এই বিধিমালা প্রস্তুতিতে সম্ভবত রাজ্য সরকারকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। এছাড়াও খসড়া বিধিমালায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি যা জিএম খাবারের বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য। এছাড়াও ভারতের বৈচিত্র্যময় খাদ্য ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য এবং খাবারের পছন্দের অধিকারটিকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। জিএম খাবারগুলি নিয়ন্ত্রিত করতে হচ্ছে কারণ তারা মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং নাগরিকদের এই জাতীয় খাবারের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা দরকার। বাণিজ্য নিরাপত্তা, কৃষকদের বীজ সার্বভৌমত্বও এরসঙ্গে জড়িয়ে।
আমাদের আবেদন এই যে আপনি এই খসড়া বিধিমালা সংক্রান্ত নিম্নলিখিত বিষয়গুলি পর্যালোচনা করুন এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে রাজ্যবাসীর পক্ষ থেকে এই দাবি/আবেদনগুলি দয়া করে নথিবদ্ধ করান।
আমরা জিএম খাবার চাইনা, লেবেল যুক্ত বা লেবেলবিহীন — এফএসএসএআই’এর বিধিমালায় এটি নিশ্চিত করা হোক। একমাত্র নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা যা আমরা দেখতে চাই তা হল জিএম খাবারের উপর কঠোর নজরদারি।
রাজ্য সরকারের জিএম খাবারের এবং সাধারণভাবে জিএমও চাষের প্রসঙ্গে নীতিগত অবস্থানগুলি যাতে সম্মান করা হয়।
জিএম খাবারের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বিকল্প আমাদের দেশে প্রচুর। সেগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন না করে জিএমও খাবারের জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন একধরণের হঠকারিতা। প্রয়োজন না থাকলে জিএম আনার কী দরকার?
এফএসএসএআই কোনও ধরণের জিএম খাবারের জন্য প্রাপ্ত অ্যাপ্লিকেশনগুলির উপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কোনও স্বাধীন, দীর্ঘমেয়াদী, কঠোর এবং স্বচ্ছ জৈব সুরক্ষা পরীক্ষার প্রক্রিয়া/প্রোটোকল প্রস্তাব করছেনা। এই অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দেশের শীর্ষ খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়, যা সকলের জন্য খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যতামূলক।
জিএম উপাদানের উপস্থিতির পরিমাণ ১ শতাংশ থেকে থ্রেশহোল্ড স্তর ০.০১ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত।
এফএসএসএআই’এর ভারতে জিএম খাবারের গোপন আমদানি রোধ নিশ্চিত করা উচিত, এবং লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
আমরা আপনার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এও আশা করছি যে এফএসএসএআই এমন নিয়মকানুন আনবে যা স্বাস্থ্যকর খাবার উৎপাদন ও আমদানীতে জোর দেবে — জিএম খাবার আমদানির মাধ্যমে ভারতীয়দের পরীক্ষাগারের ইঁদুর করা হবে না।
এই চিঠির সঙ্গে বিধিমালা সংক্রান্ত বিস্তারিত সমালোচনা দেওয়া হল।
আন্তরিকভাবে, ‘জিএম মুক্ত পশ্চিমবঙ্গ’এর পক্ষে
অংশুমান দাশ (কৃষি প্রশিক্ষক),
বিতান দত্ত (কৃষক),
বহ্নি চক্রবর্তী (অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা),
অরূপ রক্ষিত (ব্যবস্যায়ী),
দেবাশীষ পান্ডা (সমাজকর্মী),
বিশ্বরূপ চক্রবর্তী (জৈব কৃষক),
বিকাশ চন্দ্র পতি (জৈব চাষি),
অন্তরা রায় (শিক্ষকতা),
মহুয়া দত্ত (পাঠাগার আন্দোলন কর্মী),
সুব্রত দাস (জৈব কৃষক),
নির্মাল্য ঘোষ (টোনা অর্গানিক ফার্ম),
উদয় ভানু রায় (টোনা অর্গানিক ফার্ম),
প্রবীর কুমার সরকার (জৈব চাষি),
সঞ্জয় সরকার (পরিবেশ কর্মী),
অদিতি সিংহ রায় (ডিজাইনার),
অরূপ দাস (সমাজকর্মী),
নীলাঞ্জন মিশ্র (সমাজকর্মী ও ছাত্র),
বাবলু ব্যানার্জি (রাজনৈতিক কর্মী),
রূপা চক্রবর্তী খান (সমাজকর্মী),
প্রদীপ বসু (গণবিজ্ঞান কর্মী),
নীলাঞ্জন মিশ্র (ছাত্র, শিল্পী ও সমাজকর্মী),
বুদ্ধদেব নায়েক (কৃষক, সমাজকর্মী),
প্রদীপ গিরি (শিক্ষক, সমাজকর্মী),
অসীম বেরা (ছাত্র ও সমাজকর্মী),
আইভি দত্তরায় (সমাজকর্মী),
টুম্পা মন্ডল (সমাজকর্মী),
দীপঙ্কর জানা (সমাজকর্মী),
সঞ্জয় সেনগুপ্ত (শিল্পী ও গবেষক),
অনীত ঘোষ (পরিবেশবিদ),
স্বপন ভট্টাচার্য (সমাজকর্মী),
শিবনাথ মাইতি (বিজ্ঞানী), প্রমুখ আরও অনেকে।
“তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যপ্তি ছিল বিশাল। একদিকে নীতিগত প্রশ্নে বলিষ্ঠতা অপর দিকে বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা — এই দুটি দিককে মেলানোর দক্ষতা ছিল শিক্ষনীয়”। এভাবেই সুবিমল সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণ করলেন পার্টির পলিটব্যুরো নেতা কার্তিক পাল। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ধুবুলিয়ার নেতাজী পার্কে অনুষ্ঠিত হল পার্টির রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর ভূতপূর্ব সদস্য, নদীয়া জেলা সম্পাদক এবং গণনেতা সুবিমল সেনগুপ্তের প্রথম প্রয়াণ বার্ষিকী স্মরণ। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের রাজনৈতিক ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিলেন সুবিমল। দলীয় পরিধির বাইরে গিয়ে তিনি সমগ্র বামপন্থী আন্দোলনের অগ্রণী নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ধুবুলিয়ার বুকে সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াজগতের সাথেও ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত থেকে তিনি সর্বক্ষেত্রে একটা সুস্থ মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলেন — বললেন সিপিআই(এম) দলের রামচন্দ্র দাস, আরএসপি’র রাহুল মুখার্জী। ধুবুলিয়া এলাকার সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া জগতের কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ স্মরণসভায় অংশ নেন। উপস্থিত ছিলেন তার পরিবার পরিজন এবং শতাধিক পার্টি কর্মীরা। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায় ও বাবুনি মজুমদার। বর্তমান সময়কালে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকারের দেশবিক্রির নীতি এবং এরাজ্যে তৃণমূলের দুর্নীতি ও নানারকম চটকদারী কৌশলের আড়ালে গরিব মানুষের প্রতি প্রতারণার বিরুদ্ধে গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। সকলেই বলেন, আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আজীবন সংগ্রামী সুবিমলের আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পার্টির নদীয়া জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ বলেন, সুবিমলের স্মৃতি অতীত হয়ে যাবে না, বর্তমানে পার্টির নানাবিধ কর্মকান্ডের মধ্যে তা বেঁচে আছে, থাকবে।
তাঁর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী, কৃষ্ণ প্রামানিক, কাজল দত্তগুপ্ত, রণজয় সেনগুপ্ত, জয়কৃষ্ণ পোদ্দার, নীহার ব্যানার্জী, সাইদুল মোল্লা, শংকর রায়, ঠান্ডু সেখ, আনসারুল হক, সন্তু ভট্টাচার্য সহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ।
এই দিন সকালে ধুবুলিয়ার টিবি হাসপাতালের গেটে লোডিং আনলোডিং ইউনিয়নের অফিসের সামনে অবস্থিত শহীদ বেদীতে পতাকা উত্তোলন ও মাল্যদানের মধ্য দিয়ে স্মরণসভা অনুষ্ঠান হয়। উপস্থিত ছিলেন ইউনিয়নের সম্পাদক বিনয় রায় এবং বাবুলাল দাস, অমিত মন্ডল প্রমূখ।
কাঁঠালবাগানে সুবিমল সেনগুপ্তের বাসস্থানের কাছে নির্মিত শহীদ বেদীতে অনুরূপ কর্মসূচী সংগঠিত হয়।
একটা মুহূর্ত। স্তব্ধ হয়ে থাকার! স্মৃতির গভীরে অবগাহনের! হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে অনুরণিত সুরঝর্ণায় স্নাত হওয়ার!
আজ তিনি চিরঘুমে শায়িত। তাঁর শেষ বিদায়ের ক্ষণটিতে আমজনতাও বিষণ্ণ, স্মৃতিমেদুর। তিনি যে তাদেরও- দশকের পর দশক ধরে! আজকের উবের চালক তরুণটি থেকে শুরু করে তার জুটমিল-শ্রমিক বাবা, তার এককালের হাত-টানা রিকশার চালক ঠাকুর্দা পর্যন্ত — সবার! নির্মাণ শ্রমিকটি রোজ কাজে যাবার আগে বৌকে একপ্রস্থ বকাবকি করে নিজের মনের ক্লেদ ঝাড়ে। ঠিকাদারের প্রতারণা, বড় মিস্ত্রির সঙ্গে খুচরো ঝামেলা, পাড়ার দোকানির বাকির খাতায় বেড়ে চলা অঙ্ক, মেয়ের ইশকুলে হেড মাস্টারনীর বকুনি — কত গ্লানি তার! বৌও রোজ রোজ কারণে অকারণে গালি শুনে শুনে ক্লান্ত বিরক্ত। নিত্য অশান্তির জের বয়ে সেও পরের বাড়ি খুন্তি নাড়তে যায়। সেদিন রেগে গিয়ে নতুন কেনা মোবাইলে গান চালিয়ে রুটি সেঁকতে থাকে। তার প্রিয় শিল্পীর গান। উচ্ছে আলু ভাজি দিয়ে রুটি খেতে খেতে ক্ষণিক গানে তন্ময় হয়ে যায় তার বর। “আহা! কী গলা! কী সব গান!” জল খেয়ে প্রকাণ্ড এক ঢেঁকুর তুলে গুন গুন করতে করতে সে কাজে চলে যায়। ভুলেই যায় বৌ ছেঁড়া বোতামটা আজও সেলাই করেনি।
ঐযে সত্তরোর্ধ মানুষটি অবেলার জীর্ণ অবসরে দোকানের রেডিওতে গান শুনতে শুনতে কাগজে অন্যমনস্ক ভাবে চোখ বোলাচ্ছেন, তারও কি বহুদিন আগের কথা মনে পড়ে যায়নি? বা মরা রোদে বড়ি দিতে দিতে ‘ঠাকুমার’ কি মনে পড়ে না ম্যাটিনি শো-তে দল বেঁধে সিনেমা দেখার কথা? বই পাড়ার মুটিয়া মজদুর বয়স্ক মানুষটি, ক্লান্ত শরীরটা জিরিয়ে নিতে ভাঙা চোরা ফুটপাতের পাঁজর ফাটানো চিকণ সবুজের দিকে তাকিয়ে খৈনি ডলছেন; গান শুনতে শুনতে তার কি দেশ-গাঁও, ক্ষেতি-জমীন, বহুকাল আগে গত মা বা বাল্যসঙ্গিনীর কথা মনে পড়ছে না?
এইভাবেই তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন আরও বহু দিন-মানুষের দিন গুজরানে, শোকে দুঃখে, ভালোবাসায়-প্রেমে, অনুশোচনায়, স্বপ্ন দেখায়, ঘর বাঁধায়! তাঁর অনন্য কণ্ঠমাধুর্য আর সুরের ইন্দ্রধনু নিয়ে! বাসে বাসে, স্টেশন চত্বরে রুক্ষু চুলের যে বালিকাটি গান শুনিয়ে শীর্ণ হাতটি পাতে, তারও ভুখা কচি গলার আপ্রাণ চেষ্টায় সেই ‘তিনি’ই! মাইনাস ডিগ্রির বরফ রাজ্যে, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী জওয়ানদেরও বিরল দুর্লভ অবসরের সঙ্গী ‘তিনি’ (তাঁর গান)। শুধু আসমুদ্রহিমাচল নয়, তাঁর সুরের প্লাবনে ভেসেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত। উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ এসব বিতর্ককে একপাশে রেখে।
তিনি সুরসম্রাজ্ঞী ‘লতাজী’ — লতা মঙ্গেশকর — ‘ভারতের বুলবুল’। যাঁর গানকে দেশ কাল ধর্ম বর্ণ ভাষা সম্প্রদায়ের কাঁটাতার অবরুদ্ধ করতে পারেনি। যাঁর গানের ভুবনে চল্লিশটি ভাষায় স্বচ্ছন্দ বিচরণে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব এক সম্ভার — যে ডালিতে শুধু হিন্দি গানের সংখ্যাই পনেরো হাজারেরও বেশি। যিনি তাঁর অনন্য গায়কীতে ধরে রেখেছেন ভারতীয় মার্গ সংগীতের ঐতিহাসিক পরম্পরাকে। যিনি বিভিন্ন প্রজন্মের সুরকার, গীতিকার, গায়কের সঙ্গে কাজ করেও নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেননি। অথচ যিনি যুগবদলের চিহ্নকে সাদরে স্বাগত জানিয়ে নিজের সৃজনভাণ্ডারকে ঋদ্ধতর করে গেছেন অনবরত!
এই মানুষটির শেষ বিদায়ের সেই পরম ক্ষণটিকেও কালিমালিপ্ত করল হিন্দুতূবাদীরা! শিবাজী পার্কে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বহু বিশিষ্ট মানুষ। এসেছিলেন বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খানও। সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর হিন্দু ম্যানেজার পূজা দাদলানি। তাঁরা নিজ ধর্মীয় রীতি মেনে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। সেই ছবি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের এক সুন্দর মুহূর্ত উপহার দিয়েছিল দেশবাসীকে। কিন্তু জাতি-বিদ্বেষের চরম কলঙ্ক লেপে দেওয়া হল সেই ছবিতে! হরিয়ানার বিজেপি সভাপতি অরুণ যাদব এক টুইটারে দাবি করেন শাহরুখ নাকি সুরসম্রাজ্ঞীর উদ্দেশে থুতু ছিটিয়েছেন! উত্তর প্রদেশের বিজেপি মুখপাত্র প্রশান্ত উমরাও তাকে সমর্থন জানান। বিজেপির আইটি সেল তাকে হাতিয়ার করে কুৎসিত প্রচারে নামে। হিটলার মুসোলিনির এই উত্তরসূরীরা শুধু ঘৃণা ছিটিয়ে সব কিছুর দখলদারি চায়। যে মানুষটির বিদায় ঘিরে এই কুৎসিত অপপ্রয়াস, তিনি কিন্তু তার শিল্পী জীবনে বহু মুসলিম গীতিকার গায়ক বাদক সুরকারের সান্নিধ্যে এসেছেন, স্বভাবসিদ্ধ নম্রতায় তাঁদের থেকে শিখেছেন, অন্তরের উষ্ণতায় তাঁদের বন্ধুত্বকে বরণ করে নিয়েছেন, বয়োকনিষ্ঠদের প্রাণ ঢেলে শিখিয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন হসরত জয়পুরী, সাহির লুধিয়ানভী, মজরুহ সুলতানপুরী, উস্তাদ আমানত আলি, গোলাম হায়দার, বিসমিল্লা খাঁ, বড়ে গোলাম আলি, আমজাদ আলি, নৌশাদ, রশিদ খান, এ আর রহমান প্রমুখ। মনুষ্যত্বহীন ঐ জাতি বিদ্বেষীরা জানে না, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে!
নিজের ৯২তম জন্মদিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দেশে ক্রমাগত বেড়ে চলা বিদ্বেষ-বিভাজন এবং তিক্ততার বাতাবরণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন “আমি হিন্দু, ও মুসলমান” এই ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে একজন ‘ভারতীয়’ বলে ভাবতে শিখুন। ধর্মের জন্য পরস্পর হানাহানি বন্ধ হোক। এটা ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শনের পরিপন্থী। এইসব আরও অনেক আগে বন্ধ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আজও তা আছে এবং ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তিনি আরও বলেছেন, ফিরে জন্ম নেওয়ার সুযোগ থাকলে, এই ভারতের মাটিতেই তিনি জন্ম নিতে চান কারণ এই মাটিতেই রামকৃষ্ণ পরমহংস থেকে স্বামী বিবেকানন্দের মত জ্ঞানী চিন্তকরা জন্মেছিলেন, সমৃদ্ধ করে গেছেন তাদের জ্ঞানভাণ্ডারে।
একজন ‘ভারতীয়’ হিসাবে যে মননের পরিচয় দিয়েছেন, যে সম্পদ রেখে গেলেন, দেশবাসীর কাছে তা গর্ব, অহংকার, প্রেরণা হয়ে থাকবে।
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
কোনও কোনও বৌদ্ধ পুরাণ মনে করে, সমন্তভদ্র জগতের প্রথম মানব। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বৌদ্ধ সাহিত্যে বড় একটা আলোচনা নেই। সমন্তভদ্র বা আদি-বুদ্ধের শ্রীপাদ থেকে হাঁটা শুরু করার আগে বলে নেওয়া দরকার, সেমেটিক পুরাণের আদমও হাঁটা শুরু করেছিলেন এই আদম’স পিক বা শ্রীপাদায়া থেকে। আদম জগতের প্রথম মানব।
বুদ্ধকে তাঁর শিষ্যরা একবার জিগ্যেস করেছিলেন, “এই জগৎ কোথা হইতে আসিল?”
শাক্যসিংহ বুদ্ধদেব জবাব দিয়েছিলেন, পৃথিবী ও তারকারাজি যখন আপনা-আপনি তৈরি হল তখন থেকে জগতের উৎপত্তি। অতঃপর অপ ও মরুৎ এলো, তারপর পৃথিবীতে সৃষ্টি হল সাগরের। জীবন তখনও তৈরি হয়নি।
এরপর সৃষ্টি হল এক অনবদ্য বিষয় — তার নাম ফ্রম বা প্রম, যাকে সহজ ভাবে অতল সত্তারাজি বলা যেতে পারে। এই সত্তা হল স্বর্গের বা পরলোকের বাইরে/অতিবর্তী একটি বিস্তার/ডাইমেনশন।
“তাহলে মানব এলো কোথা থেকে?”
মানব এসেছে যুগপৎ দোজখ/নরকের সত্তা এবং ফ্রম থেকে।
হিন্দু পুরাণ বলে, প্রথম মানব মনু। তাঁর সঙ্গিনী শতরূপা। আবার ভবিষ্যপুরাণে আদম ও হব্যবতীর কথা আছে। কাহিনীসমূহের মধ্যে মিল থাকা স্বাভাবিক। আদমের মতো সমন্তভদ্র বা আদি-বুদ্ধকে প্রথম মানব বলেন বহু মানুষ। আবার সমন্তভদ্র ‘ত্রয়ী’ হিসাবেও উপস্থাপিত হন — সমন্তভদ্র, শাক্যমুনি ও বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী — এই তিনের সমন্বয়ে। অনেকটা আমাদের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের আদলে। মহেশ্বর বা শিবের পীঠস্থান ওই আদম’স পিক বা শ্রীপাদায়া — অনেকের বিশ্বাস, ওই বিরাট পদচিহ্ন শিবের ছাড়া আর কারও হতে পারেনা। তবে কি শিব প্রথম জাগতিক সত্তা?
মহাদেবকে কোনও রসিক ভক্ত জিগ্যেস করেছিলেন, আপনার পিতা কে? জবাব এসেছিল — বিষ্ণু। আর আপনার পিতামহ? ব্রহ্মা। তা হলে আপনার প্রপিতামহ কে? শৈব উত্তরঃ আমি নিজেই।
সমন্তভদ্র কেন বঙ্গোপসাগর পার হতে চান? এই জলরাশি সহসা আবির্ভূত হলোই বা কেন? সমন্তভদ্র মানুষ, সন্তরণ তাঁর সহজাত নয়, অর্জন করতে হবে। বিরাট বিরাট ঢেউ দেখে ভয় পাচ্ছেন তিনি। সমন্তভদ্রী আছেন সাগরের ওপারে। যেতেই হবে। প্রমালোক থেকে সাহায্য এল। কী এই প্ৰমালোক ? প্ৰম বা ফ্রম হল আলো। স্বর্গ হল মানুষের কাছে আলোস্বরূপ। আর প্ৰমালোক হল স্বর্গের কাছে আলো।
প্রম বা ফ্রমের কোনও অনুভূতি নেই, কিন্তু সে অনুভূতি ব্যক্ত করতে সক্ষম।
সমন্তভদ্র জলরাশি পার হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। এলেন তৎ-আগত শক্তি যাকে বলা যায় প্রমালোক কিংবা জিব্রাইল। তিনি তামাটে আলোর মতো দেখতে। জিব্রাইল এসে বলে দিলেন, সামনের ওই মহোদধি, যাকে বলা যেতে পারে ‘পূর্বপয়োধি’ তা অতিক্রম করার উপায়। জলের মতো স্বচ্ছ সেই পথ। তামাটে আলো দেখিয়ে দিল, অগভীর জলস্তরের শুলুকসন্ধান। সেই ছায়াপথ ধরে ধরে পাথর ফেলতে ফেলতে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে থাকলেন সমন্তভদ্র। পরে সমন্তভদ্রের উত্তরসূরিরা ওই জলরাশির নাম রাখবেন বঙ্গোপসাগর/কলিঙ্গ সাগর/চোল সাগর।
‘মাটা আলোকে গিনাদেবি সনসার ইয়ে/ মাগে জীবন হাদে তেমে ইশক রবে’ নামে সিংহলী ভাষায় একটি ধ্রুপদী গান আছে, যে গানটি পপাকারে রিমেক করেছেন ‘মানিকে মাগে হিথে’-খ্যাত য়োহানা। মূল গানটি বহু কাল ধরে প্রচলিত সিংহলে, “সংসারে আলো এনে দাও আমাকে, আমার জীবনের দেওয়াল বেশ শক্ত, আমি ভালবাসি তোমাকে”… ১৯৩৫ সালে গানটি গেয়েছিলেন পিল্লাভালু গজপতি কৃষ্ণবেণী। যেন-বা সমন্তভদ্রের সুরে। প্রশান্ত পদছায়ায় তৈরি হল ‘সমন্তভদ্র-সেতু’, যাকে কেউ বলে আদমের ব্রিজ, কেউ বা রামসেতু।
সমন্তভদ্রের কাছে ঈশ্বর বলে কিছু নেই। তাঁর কাছে একটি জগত আছে, যাকে তিনি সংসার বলে থাকেন। রাতে খুব ভয় করে তাঁর, তাই সব সময় দিনের অপেক্ষা করেন। সর্বদা আলো খোঁজেন তিনি। আলোর মধ্য দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন দুস্তর পারাবার পার হলেন আদিবুদ্ধ। ক্রমে ক্রমে তিনি বুঝেছেন, এই জগত পরিচালনা করে পঞ্চবাণ। বাণ হল নিয়ম। তিনি সংখ্যার ধারণা নিয়ে জন্মেছেন, তাই পাঁচ বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু বাণ বড় শক্ত বিষয়। তাঁর চিত্তে আছে এক প্রকারের বাণ। আর গাছপালা, সাগর, পাহাড় চলে আর এক নিয়মে, প্রমালোকে তার নাম ‘ঋত’। এবংবিধ রয়েছে বীর্য বাণ — যে নিয়মে তিনি সেতু বানিয়েছেন। আর আছে মনের শক্তিনীতি — তাকে বলে ধর্ম নিয়ম, সে ক্ষণে ক্ষণে পালটাতে থাকে। শেষ বাণ হল কর্মনিয়ম। এই পাঁচ স্কন্ধ মিলিয়ে ঈশ্বর বললে ঈশ্বর; না বললে নয়। এই পঞ্চবাণ নিরাকার, অপার সাগর, তিনি মহোদধি, তিনিই পয়োধি। সেই নিরাকারের উপর সেতু বানিয়ে সমন্তভদ্রীর কাছে যাওয়ার পথ সুগম করলেন আদিবুদ্ধ। একের সঙ্গে একের মিলনে হবে দুই। এই সংখ্যাও নিরাকার।
মন্নর থেকে পম্বনে পৌঁছলেন সমন্তভদ্র। কিন্তু কোথায় সমন্তভদ্রী? তিনি আছেন বহু দূরে। সে অনেক দিনের পথ। হেঁটে যেতে হবে বহু দিন, অনেক মাস।
- শামিম আহমেদ
সাঁওতালরা হলেন ভারতের অন্যতম একটি তৃতীয় বৃহত্তম প্রধান আদিম অধিবাসী গোষ্ঠী। তাঁরা নিজেদেরকে হড় বা হড় হপন আবার সান্তাড় বলেও অভিহিত করে থাকেন। সান্তাড় তথা সাঁওতালরা হলেন ভারতের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর মতো একটি জাতি, যে জাতি নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী শাসন ব্যবস্থার দ্বারা নিজেদেরকে পরিচালিত করে থাকেন। সান্তাড়দের পুরাণ তথা ধর্মগ্রন্থ জমসিম বিন্তি (যা হল সারিধরম-এর ধর্মগ্রন্থ) থেকে জানা যায় যে, সেরমাপুরী তথা স্বর্গে চাঁওরিয়া মেলা নামক এক দৈব বিচারালয়ে এমন একজন শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা ও সম্পাদন করতেন যিনি হলেন সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও ধ্বংসকর্তা। সান্তাড়দের কাছে ইনি হলেন ঠাকুর জিউ। ঠাকুর জিউ’র আদেশ মতো বিচার সভার আয়োজন এবং সকল দেবতাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল মারাংবুরুর উপর, যাঁর পূর্ব নাম হল লিটা এবং এই বার্তা বাহকের জন্য তিনি লিটা গোডেৎ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সান্তাড়ি গোডেৎ বা গডেৎ কথাটির বাংলা অর্থ হল বার্তা বাহক।
সান্তাড়দের এই পৌরাণিক তথা স্বর্গীয় চাঁওরিয়া মেলা’র প্রতিরূপ হল প্রতিটি সান্তাড় গ্রামে এক একটি করে মাঁঝিথান এবং এক একজন করে মাঁঝি বা গ্রাম প্রধান থাকেন এবং মূখ্যত তাঁরাই শাসনকার্য ও বিচারকার্য পরিচালনা করে থাকেন। প্রতিটি সান্তাড় গ্রামেই মাঁঝিদের বার্তা বাহকরূপে এক একজন গোডেৎ বা গডেৎ থাকেন। এটিও হল মানব সমাজে স্বর্গীয় লিটা গোডেৎ এর প্রতিরূপ।
আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত সান্তাড়দের সমাজ ব্যবস্থায় মঁড়ে হড় বা পঞ্চজন ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। এই পাঁচজন হলেন – মাঁঝি (গ্রাম প্রধান), পারানিক (সহকারী গ্রাম প্রধান), জগ-মাঁঝি (নৈতিক অভিভাবক), জগ-পারানিক (সহকারী নৈতিক অভিভাবক) এবং গোডেৎ বা গডেৎ (বার্তা বাহক)। এছাড়াও নায়কে (সান্তাড় পুরোহিত) এবং কুডাম নায়কে (সহকারী সান্তাড় পুরোহিত) নামে আরোও দু’জন উক্ত পঞ্চজন ব্যবস্থার অন্তর্গত থাকেন যাঁরা গ্রামের সকলের পক্ষ থেকে দেব-দেবীদের পূজা দিয়ে থাকে।
মাঁঝি - ইনি হলেন গ্রামের সর্বসাধারণের পিতাস্বরূপ এবং ইনি সকলের মঙ্গল ও কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত থাকেন। তাই গ্রামের সকলের এবং সকল কিছুর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত থাকে। এই মাঁঝি পদটি আদিতে দৈবনির্বাচিত পদ হিসেবে থাকলেও বর্তমানে তা সর্বসাধারণের দ্বারা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ মাঁঝি হল একটি পদ এবং যিনি মাঁঝি পদে নির্বাচিত হয়ে জনসাধারণের কল্যাণ ও মঙ্গল সাধন করতে ব্যর্থ হন তাহলে গণতান্ত্রিক উপায়ে তাঁকে ওই পদ থেকে পদচ্যুত করা হয়। তাই তিনি সর্বদাই জনকল্যাণকামী হন এবং গ্রামের সকলকে নিজ সন্তানস্বরূপ দেখবেন ও সর্ব কাজে তাদের সহযোগিতা করবেন।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশ ও আদেশ অনুসারে ধর্মীয় পূজার্চনা অনুষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। সামাজিক ক্ষেত্রে সমাজে তাঁর নির্দেশ ও আদেশ অনুসারে জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যুতে শ্রাদ্ধাদি কার্য পরিচালিত ও সম্পাদিত হয়ে থাকে। প্রশাসন ও বিচারসভার ক্ষেত্রে তিনি হলেন মঁড়ে হড় ব্যবস্থার (পঞ্চজন ব্যবস্থার) রূপায়ণ তথা বাস্তবায়ন করেন এবং বিচারের ক্ষেত্রে সমস্ত গ্রামীণ তথা সামাজিক সমস্যার বিচার ও মীমাংসা করে থাকেন পঞ্চজন ব্যবস্থার দ্বারা।
পারানিক – ইনি হলেন মাঁঝি এর সহকারী। ইনি মাঁঝির অনুপস্থিতিতে মাঁঝির সমস্ত দায়িত্ব সম্পাদন করে থাকেন। এছাড়া মাঁঝির পদচ্যুতিতে বা পদত্যাগে বা মৃত্যু হলে এবং মাঁঝির কোনো পুত্র সন্তান (মাঁঝি যোগ্য) না থাকলে পারানিকই মাঁঝি পদে নিযুক্ত হন। এই পদটিরও গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন ও পদচ্যুতি রয়েছে।
জগ-মাঁঝি – ইনি হলেন গ্রামের নৈতিক অভিভাবক। এই পদটিরও গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন ও পদচ্যুতি রয়েছে। ইনি গ্রামের যুবক-যুবতীদের নৈতিক শিক্ষা দিয়ে থাকেন এবং তাদের আচার-আচরণের নৈতিক মূল্যায়নও করে থাকেন। অর্থাৎ যুবক-যুবতীদের আচার-আচরণের নৈতিকতা দেখার দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত থাকে। গ্রামের মধ্যে যুবক-যুবতীদের দ্বারা যেমন কোনো অনৈতিক এবং অসামাজিক কিছু না ঘটে এবং একই সঙ্গে বাইরে থেকেই যেন নিজ গ্রামে (তথা সমাজে) কোনো অনৈতিক ও অসামাজিক কিছু না প্রবেশ করে সেই দিকটিও দেখাশোনা করেন।
জগ-পারানিক – ইনি হলেন গ্রামের সহকারী নৈতিক অভিভাবক। ইনি জগ-মাঁঝির অনুপস্থিতিতে তাঁর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এই পদটিরও গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন ও পদচ্যুতি রয়েছে।
নায়কে – ইনি হলেন প্রধান সান্তাড় পুরোহিত। ইনি গ্রামের সকলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী বিভিন্ন ধর্মীয় পূজায় জাতীয় দেব-দেবীদের পূজা দিয়ে থাকেন। তবে ইনি প্রধানত সান্তাড়দের জাতীয় দেবদেবীদের এবং শুভাকাঙ্ক্ষী দেবদেবীদের পূজা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত হন। আদিতে থেকে এখন পর্যন্ত এই পদটি হল দৈবনির্বাচিত যারফলে এটি বংশগতভাবে চলতে থাকে।
কুডাম নায়কে – ইনি হলেন সহকারী সান্তাড় পুরোহিত কিন্তু ইনি গ্রামের সকলের পক্ষ থেকে জাতীয় দেবদেবীদের থেকে নিম্নস্তরের দেবদেবীদের পূজা দিয়ে থাকেন। এটি ও দৈবনির্বাচিত পদ তবে এটির পদত্যাগ, পদচ্যুতি ইত্যাদি রয়েছে।
উপরের আলোচনায় সান্তাড়দের যে সমাজ শাসন ব্যবস্থা আমরা দেখলাম তা হল সারিধরম গ্রন্থ জমসিম বিন্তি ভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী পৌরাণিক তথা স্বর্গীয় শাসন ব্যবস্থা তথা সমাজ ব্যবস্থার প্রতিরূপ বা দৃষ্টান্ত।
- সুব্রত টুডু
প্যারীচরণ সরকার উনবিংশ শতাব্দীর অনন্য এক সমাজ সংস্কারক ছিলেন। অবিভক্ত বাংলায় প্রথম যে বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে তারও অন্যতম কারিগর ছিলেন প্যারীচরণ। অপর দু’জনের একজন ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা তথা বিদ্যাসাগর, আরেকজন কালীকৃষ্ণ মিত্র। যদিও বারাসাতে প্রথম যে বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে তার প্রধান দুই রূপকার হিসেবে কালীকৃষ্ণ মিত্র ও প্যারীচরণ সরকারের নামই অনেকের লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু নারী শিক্ষা বিস্তারে প্রথম উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে প্রেরণা ও সক্রিয়তা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র শর্মার। তৎকালীন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জি টি মার্শাল (যিনি মেজর ছিলেন একসময়) ও শিক্ষা সচিব মোয়াট নারী শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপনে ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রচন্ড সহযোগিতা করেছিলেন। প্যারীচরণকে বিদ্যাসাগর হুগলির এক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সচিবকে বলে বারাসাতের বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করার বন্দোবস্ত করেন। বিদ্যাসাগরের চেয়ে বয়সে সাড়ে তিন বছরের ছোট প্যারীচরণের জন্ম হয়েছিল ১৮২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় তদানীন্তন কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, অধুনা বিধান সরণীর শ্রীমানী মার্কেট সংলগ্ন চোরবাগান এলাকায় অমর বসু সরণীতে। তিনি হিন্দু কলেজে পড়াশুনা করেন এবং পরে ঐ প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনাও করেন। উত্তর ২৪ পরগণার জমিদাররা কালীকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধ সেধেছিল। বিদ্যালয়টির ‘কালীকৃষ্ণ’ নামকরণ হয় তাঁর মৃত্যুর পরে। সেই সময়ে মোয়াট সাহেবকে অনুরোধ করে বিদ্যাসাগর সরকারি কোষাগার থেকে টাকা মঞ্জুর করিয়ে বিদ্যালয়টি স্থাপনে প্যারীচরণ ও কালীকৃষ্ণকে সহযোগিতা করেন। জমিদাররা লেঠেল বাহিনী পাঠিয়ে বিদ্যালয়টি যাতে হতে না পারে তার অপচেষ্টা করে। মঞ্জুরিকৃত টাকা ফেরত চলে যায়। পরে মার্শাল সাহেবকে ধরে জমিদারদের কড়া বার্তা দিয়ে তাদের বিরত করেন বিদ্যাসাগর। প্যারীচরণ ও কালীকৃষ্ণের অক্লান্ত পরিশ্রমে অবশেষে বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ডাঃ নবীনকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণদের বাড়িতে। প্রধান সমস্যা দাঁড়ায় ছাত্রী পাওয়া নিয়ে। তবে অভিভাবকরা প্যারীচরণ ও কালীকৃষ্ণের প্রতি আস্থাভাজন হয়ে ছাত্রীদের পাঠাতে শুরু করেন। নবীনকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণ দুই ভাই তাঁদের কন্যা সন্তানদের পাঠান। এসমস্ত তথ্য জানা গেল বিদ্যাসাগর চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রাণপুরুষ প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। ‘বঙ্গদূত’ বের হোত গোবরডাঙ্গা থেকে, ঐ পত্রিকাতে এসব তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছিল।
প্যারীচরণ সরকারের জন্মের দ্বিশতবর্ষ উদযাপন শুরু হয়েছে। শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার নবজাগরণের রূপকার বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় কুমার দত্ত। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও উল্লেখ করা যায়। তারও আগে রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও ডিরোজিও সলতেটা পাকিয়ে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে রামমোহন রায়। প্যারীচরণ সরকার, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রামগোপাল ঘোষ, ইয়ংবেঙ্গলের প্যারীচাঁদ মিত্র, রামকৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ ব্যক্তিত্বও নবজাগরণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। মনে রাখতে হবে নারী শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন মিশনারীরাও। ড্রিংক ওয়াটার বেথুন সেইরকমই একজন মিশনারী যিনি বারাসাতের বিদ্যালয়টি দেখে কলকাতায় ১৮৪৯ সালে একটি বাালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সহযোগী হিসাবে পেয়েছিলেন রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা, মদনমোহন তর্কলঙ্কারকে। বেথুনের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা স্ত্রী শিক্ষা আন্দোলনে প্রচন্ড গতি এনে দেয়। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীও নারী শিক্ষার সক্রিয় সমর্থক ছিল। বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগরকে তাঁর বিদ্যালয়ের অবৈতনিক সম্পাদক করেছিলেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরে বেথুন সাহেবের প্রয়াণ ঘটে, পরবর্তীতে তাঁর নামে বিদ্যালয়টির নামকরণ হয় ‘বেথুন বালিকা বিদ্যালয়’।
বেথুন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পরে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বালিকা বিদ্যালয় গড়ার কাজে হাত লাগান সমাজের বিদ্যোৎসাহী ও সম্পন্নশালী কিছু মানুষ। সুখসাগরের কাশীশ্বর মিত্র, কোন্নগড়ের শিবচন্দ্র দেব, বারুইপুরের প্রসন্নকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজকুমার রায়চৌধুরী এবং কালীকুমার রায়চৌধুরী, খড়দহের রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জানবাজারের প্রিয়নাথ দত্ত, রাণাঘাটের রামশঙ্কর সেন, ঘাটালের রামচন্দ্র পালিত ও প্যারীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ আরও অনেকে স্ব স্ব অঞ্চলে মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বামবোধিনী পত্রিকার ১৮৬৬’র অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ১৮৬৫ অব্দের “শিক্ষাসংক্রান্ত বিজ্ঞাপনীতে নিহিত হইয়াছে বঙ্গদেশে ১৮১টি বালিকা বিদ্যালয় সংস্থাপিত হইয়াছে এবং তাহাতে ৪,১১১টি বালিকা অধ্যয়ন করিতেছে”। (আশীষ খাস্তগীর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমী, ২৫ নভেম্বর ২০১৯, পৃঃ ৯০)।
বিদ্যাসাগর ও অন্যান্যদের উদ্যোগে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার সাথে সাথে শিশুদের জন্য বাংলা ও ইংরেজীতে স্কুল শিক্ষার পাঠ্য বই লেখার উদ্যোগও শুরু হয়। বিদ্যাসাগর ও প্যারীচরণ মিলে স্থির করেন বিদ্যাসাগর বাংলা বই ‘বোধদয়’ ও প্যারীচরণ ইংরেজী বই ‘ফার্স্ট বুক অফ রিডিং ফর নেটিভ চিলড্রেন’ লিখবেন। তাঁদের বই পড়েই শিশুরা বাংলা ও ইংরেজী শিখেছে। প্যারীচরণের বইটি প্রকাশ হয়েছিল ১৮৫০ সালে। বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সাল নাগাদ, যদিও বোধদয় প্রকাশিত হয় আগেই। ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশে দেরী হওয়ার কারণ ছিল তাঁর অধ্যাপনা, অধ্যক্ষতা ও সরকারি স্কুল পরিদর্শন, বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত যুক্তি নির্মাণ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা, বন্ধু অক্ষয় দত্তকে সহযোগিতা করা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকা। প্যারীচরণ আপামর শিক্ষার্থীদের ইংরেজী শিক্ষার প্রাণপুরুষ। পরে তিনি ইংরেজী শিক্ষার সবচেয়ে বিখ্যাত পাঠ্যবই লিখেছেন। মদনমোহন তর্কলঙ্কার লিখেছিলেন শিশু পাঠ্যবই।
প্যারীচরণের জন্ম কলকাতায় হলেও তাঁদের আদি বাড়ি ছিল হুগলী জেলার তারগ্রামে। তিনি সহপাঠি ছিলেন শিক্ষাবিদ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের, পড়েছেন হিন্দু কলেজে। তাঁর পিতা ভৈরব চন্দ্র সরকার ইংরেজদের জাহাজ মেরামতিতে সহায়তা করে প্রচুর অর্থোপার্জন করেছিলেন। তবে অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় তাঁর লেখাপড়া চালানো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র প্যারীচরণ হেয়ার সাহেব প্রতিষ্ঠিত কলুটোলা শাখা বিদ্যালয় থেকে সব বিষয়ে সোনার মেডেল ও বৃত্তি পেয়ে লেখাপড়ায় অগ্রগতি ঘটিয়েছেন। পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর ফলে হিন্দু কলেজের পাঠ শেষ করতে পারেননি, পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে হুগলীর ব্যাঙ্কে চাকরি নিতে হয়। তারপরে হুগলীর সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান। আর তারপরে বারাসাত সরকারি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান। আরও পরে হন কলুটোলা হেয়ার স্ট্রীট স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তারপরে হিন্দু কলেজে (১৮৫৫ থেকে পরিচিত প্রেসিডেন্সী কলেজ) অধ্যাপক পদে যোগ দেন। চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর তিনি ইংরেজী পড়ানোর দায়িত্ব পান। ঐ কলেজে তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসাবে ইংরেজী পড়ানোর অধ্যাপক। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আলোচনা করে যেহেতু ‘ফার্স্ট বুক’ রচিত হয় তাই বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে এর বিন্যাস অনেকটা একরকম। ‘বর্ণপরিচয়’ দ্বিতীয় ভাগের সঙ্গে অবশ্য এর সামঞ্জস্য খোঁজা অর্থহীন। কেননা ইংরেজীতে যুক্তব্যঞ্জন নেই। দ্বিতীয় ভাগ থেকে বর্ণপরিচয়’এর পরিকল্পনা আলাদা হয়ে গেছে। ‘ফার্স্ট বুক’এ বর্ণালীর বিন্যাস করা হয় বড় ও ছোট হরফে। পবিত্র কুমার সরকার লিখেছেন, “১৮৭০ সালে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এক স্কুল রিভিউ কমিটি তাঁর ইংরেজী শিক্ষার বইগুলি সম্পর্কে মন্তব্য করে — অন দ্য হোল, দ্য বেস্ট উই হ্যাভ সীন ফর দ্য লোয়ার ক্লাসেস।”
তিনি শুধু পাঠদান ও পাঠ্য পুস্তক লিখিয়ে হিসাবে খ্যাত ছিলেন না, বহুমুখী সামাজিক কার্যকলাপেও জড়িত ছিলেন। এ সংক্রান্ত একটি ইংরেজী পত্রিকা ‘দ্য ওয়েল উইশার’ এবং বাংলায় ‘হিতসাধক’ তিনি কিছুদিন প্রকাশ করেছিলেন। উনিশ শতকের বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির মতো তিনিও ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন, কর্মোদ্যোগী, বহুমাত্রিক সফল এক সমাজ সংস্কারক। বিদ্যাসাগরের প্রতিভার বিকিরণের ছায়ায় তাঁকে আচ্ছন্ন হতে হয়নি। নিজ প্রতিভার বিকিরণেই তিনি বিদ্যাসাগরের মতো মহান পুরুষের সহযোদ্ধা হিসাবে প্রতিভাত হয়েছিলেন। এরকম এক বহু গুণসম্পন্ন মহান হৃদয়ের প্রয়াণ ঘটে ১৮৭৫’র ১ অক্টোবর, হাত কেটে যাওয়া থেকে গ্যাংগ্রীন হয়ে।
উনিশ শতকে নারী শিক্ষা বিস্তারের অগ্রণী — নারী মুক্তির দিশারী এই মহান পুরুষের দ্বিশত জন্ম বার্ষিকীতে আমরা বিস্মৃত থাকব?
- নিত্যানন্দ ঘোষ
কমরেড মহঃ প্রদীপ সাকিল
কাঁকিনাড়া জুট মিলের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক এক সময় সিপিআই(এমএল) এবং এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য, মহঃ প্রদীপ সাকিল কয়েকদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন। কাঁকিনাড়া জুট মিলের পার্টি ব্রাঞ্চের সদস্য নবীকরণ সভায় কমঃ শাকিলের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়। শ্রমিক নেতা নারায়ণ দে, ইউনিয়নের সদস্য কৃষ্ণা ও আলি, প্রদীপ শাকিলের পরিবারবর্গের সাথে দেখা করে সমবেদনা জানান এবং কোন প্রয়োজন মনে করলে পার্টিকে জানাতে বলেন।
কমরেড মহঃ প্রদীপ সাকিল লাল সেলাম।
কমরেড নিমাই মন্ডল
পূর্ব বর্ধমান জেলার রায়না থানার শ্যামসুন্দর গ্রামের দীর্ঘদিনের পার্টি সদস্য নিমাই মন্ডল ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা তার গ্রামের বাড়ীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দীর্ঘদিন কর্কট রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে বয়স ছিল ৬৭ বছর। পরিবারে তাঁর একমাত্র ছেলে ও স্ত্রীকে রেখে গেলেন। তিনি কৃষিফার্মে সরকারি কর্মচারী ছিলেন। সত্তর দশক থেকে পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। সরকারি কর্মচারী আন্দোলনে তৃতীয় ধারায় সক্রিয় ছিলেন। পার্টির সদস্য ছিলেন। কমরেডের মৃত্যুতে পার্টির পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটি শোক জ্ঞাপন করছে। তাঁর পরিবার পরিজন ও এলাকার কমরেডদের কাছে সমবেদনা জানাচ্ছে।
কমরেড নিমাই মন্ডল লাল সেলাম। তাঁর স্মৃতি অবিনশ্বর হোক।
== সমাপ্ত ==