কোভিড অতিমারীর যন্ত্রণা ও কৃচ্ছতার সময়কে অমৃত-কাল নামে চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও বাজেট জনতার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল
নয়াদিল্লি, ১ ফেব্রুয়ারি
মোদী সরকারের বারম্বার উচ্চারিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০২২ সাল কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হওয়ার বছর। সে বিষয়ে ২০২২-২৩-এর বাজেটের নিস্তব্ধতা অতি প্রকট। বাজেটে কৃষি-বিনিয়োগে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হয়েছে ও কৃষকদের মূল চাহিদা সমস্ত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা সম্পর্কে কোনো নির্দেশ নেই।
বাজেটের অব্যবহিত আগে প্রকাশিত অক্সফ্যামের বৈষম্য সংক্রান্ত প্রতিবেদনটিতে ভারতে অর্থনৈতিক অসাম্যের চূড়ান্ত বৃদ্ধি প্রতিফলিত হয়েছিল, যেখানে দেশের ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় ২০২১ সালে কমেছে, কিন্তু সমকালে ভারতে শত-কোটিপতির সংখ্যা ১০২ থেকে বেড়ে ১৪২ হয়েছে। কর্পোরেট কর কমিয়ে ও দরিদ্রদের আয় বৃদ্ধির জন্য কোনো সুরাহা না করে বাজেট ওই বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তোলার রাস্তা বেছে নিয়েছে।
ক্রমহ্রাসমান অর্থনৈতিক বৃদ্ধির মাঝে ভারত বিপুল বেকারির জ্বালায় ধুঁকছে (সিএমআইই তথ্য অনুসারে ডিসেম্বর ২০২১-এ ৫.২ কোটি ভারতীয় কর্মপ্রার্থী বেকার রয়েছে)। কর্মসংস্থান ও সাধারণ জনতার আয়ের নিশ্চয়তা সম্পর্কে বাজেট লজ্জাজনকভাবে নিশ্চুপ।
একটি সংসদীয় কমিটির সুপারিশকৃত এমএনআরইজিএ-র শহুরে সংস্করণের বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি তো দূরের কথা, অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় এমএনআরইজিএ-র মতো জীবন-দায়ী প্রকল্পের উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছেন।
বর্তমান সময়কে ‘অমৃত কাল’ বলে ঘোষণা করে পোষা প্রচারমাধ্যমের দ্বারা বাজারজাত করার মতো আকর্ষক হেডলাইন খুঁজে বের করার ঝোঁক অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বজায় রেখেছেন। যখন কোটি কোটি সহনাগরিক টিঁকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত তখন রহস্যময়ভাবে দাবি করছেন যে এই বাজেট কেবল ১ বছরের জন্য নয়, দেশের শততম বছরের স্বপ্নকে বহন করছে, এবং ফলে আগামী ২৫ বছরের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত সরকারের একটি বার্তা রয়েছে এই বাজেটে।
বাজেট বক্তৃতায় অনুপস্থিত ছিল ২০২২ সালের জন্য মোদী সরকারের পূর্বতন বৃহৎ ঘোষণাগুলির নির্দিষ্ট মূল্যায়ন, যথা কৃষি আয় দ্বিগুণ করা, সকলের জন্য বাসস্থান, সকলের জন্য বিদ্যুৎ। ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির প্রতিশ্রুতি প্রদানকারি মোদী-২ সরকার কর্তৃক পেশযোগ্য বাজেটের এটি হচ্ছে প্রাক-চূড়ান্ত বাজেট; কিন্তু সে বিষয়ে বাজেট কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি। গ্রামীণ দরিদ্র, কৃষি শ্রমিক, কৃষক, ও পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধাপ্রদান বিষয়ে সরকারের অতিরঞ্জিত দাবিগুলিকে মেটানোর জন্য অতিরিক্ত বর্ধিত বরাদ্দের কোনো চিহ্ন বাজেটে দেখা যায়নি।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা দাবি করেছে যে, ২০২১-২২ সালে প্রকৃত বৃদ্ধি হবে ৯.২ শতাংশ, যা ভারতীয় অর্থনীতিকে প্রাক-কোভিড স্তরে নিয়ে যাবে, এবং কর সংগ্রহ ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তব হল যে কর রাজস্বের এই মনমাফিক বৃদ্ধিও লকডাউনের কৃচ্ছতা এবং অতিমারীর সময়ে পেট্রল ডিজেল সমেত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপরে আরোপিত করের রেকর্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে জনতার সঞ্চয় চুষে নিয়ে ও তাদের ছোট্ট পকেট কেটেই ঘটেছে, যা ২০২১-২২ সালের সংশোধিত অনুমিত উৎপাদন শুল্কের রেকর্ড সংগ্রহের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে যা লাফিয়ে ৩,৯৪,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যথাযথভাবে দেখতে গেলে, গত অতিমারীর বছর ২০২০-২১-এও উপরোক্ত সংগ্রহ ছিল ৩,৯১,৭৪৯ কোটি টাকা, কিন্তু অতিমারীর আগের বছরে তা ছিল মাত্র ২,৩৯ লক্ষ কোটি টাকা। রাজস্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃদ্ধিটি ঘটেছে আরবিআই-এর উদ্বৃত্ত থেকে অর্থ সংস্থান করে যা ২০২১-২২ সালের সংশোধিত অনুমানে ১,৪৭,৩৫৩ কোটি টাকা, এবং ২০২২-২৩-এর বাজেটে যার পরিমাণ ১,১৩, ৯৪৮ কোটি টাকা, যা পরিবারের সোনা দুঃসময়ে বেচার সামিল। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার বছরে ২০১৪-১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের মাঝারি সময়ের গণঋণ ছিল ৫৮.৬৬ লক্ষ কোটি টাকা যা এখন ১১৭.০৪ লক্ষ কোটি টাকা। এর কারণ হল বিজেপির তহবিল সরবরাহকারী কর্পোরেট ও উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তিদের থেকে কর আদায়ের ক্ষেত্রে অনীহা। এটি সরকারি তহবিলের উপর চাপ বাড়ায় ও মানবোন্নয়নের দিক থেকে গণ ও সামাজিক কল্যাণের নিমিত্ত ব্যয়কে খর্বিত করে।
পেট্রল ডিজেলের উপর কর বাড়িয়ে, আরবিআই-এর উদ্বৃত্ত তুলে নিয়ে, এবং ক্রমাগত রাষ্ট্রায়ত্ব উদ্যোগকে বিক্রি করে সরকার যখন জনগণের সঞ্চয়কে রিক্ত করছে, আগামী বছরের বাজেট কেবল ভর্তুকি ছাঁটাই করেছে ও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামোন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির বরাদ্দ স্থির রেখেছে। সরকার খাদ্যের উপরে ভর্তুকির পরিমাণ ২০২১-২২-এর সংশোধিত বাজেটের ২,৮৬,৪৬৯ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২,০৬, ৮৩১ কোটি টাকা করেছে। অনুরূপভাবে, সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকির পরিমাণ সংশোধিত বরাদ্দের ১,৪০,১২২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১,০৫,২২২ কোটি টাকায় নামাতে চাইছে।
কৃষি ও সহযোগী ক্ষেত্রে বরাদ্দ হয়েছে ১,৫১,৫২১ কোটি টাকা (২০২১-২২-এ সংশোধিত বরাদ্দ ১,৪৭,৭৬৪ কোটি), কোভিড আক্রান্ত স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ ৮৬,৬০৬ কোটি (সংশোধিত বরাদ্দ ৮৫,৯১৫ কোটি) টাকা এবং গ্রামোন্নয়নে ২,০৬,২৯৩ কোটি (সংশোধিত বরাদ্দ ২,০৬,৯৪৮ কোটি) টাকা। মুদ্রাস্ফীতিকে ধরলে বাস্তবে বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে। শিক্ষায় বরাদ্দ ১৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১,০৪,২৭৮ কোটি টাকা করা হলেও গত দুবছরে অতিমারীর ফলে আক্রান্ত শিশু শিক্ষার সহায়তার জন্য বিপুল প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টার কথা খেয়াল রাখলে এই সীমিত বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়।
অতিমারীর ফলে দুর্দশাগ্রস্ত মধ্যবিত্তরাও বাজেটে আয়করের ক্ষেত্রে কিছু সুবিধার প্রত্যাশা করছিল কিন্তু সরকার করহারে পরিবর্তন ঘটায়নি। পরোক্ষ কর থেকে রাজস্ব সংগ্রহকে প্রত্যক্ষ করের স্তরে পৌঁছে দিয়ে জনসাধারণকে রাজস্বের বোঝা বহন করতে বাধ্য করে কর্পোরেট ক্ষেত্রে পৃথিবীর সর্বনিম্ন কর হারের সুবিধে বজায় রাখা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলিকে বিক্রির তথাকথিত ‘কৌশলগত বিলগ্নিকরণ’ নীতির ঘোষণা দেশের অর্থনীতির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এয়ার ইন্ডিয়া, আইডিবিআই ব্যাঙ্ক, পবন হংস এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিক্রির ঘোষণার মধ্য দিয়ে বেসরকারিকরণের ধারা বজায় রাখা হয়েছে। বিপুল বিরোধিতা সত্বেও, সরকার এই বাজেটে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্ক ও সাধারণ বীমা কোম্পানির বেসরকারিকরণ পরিকল্পনা কার্যকরী করার কথা ঘোষণা করেছে। প্রকারান্তরে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করার ধাপ হিসেবে এলআইসি-র আইপিও ছাড়ার পরিকল্পনাকে কর্মচারি সংগঠনগুলি ধারাবাহিকভাবে বিরোধিতা করা সত্বেও সেটি আবার ঘোষণা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি কোনো ধরনের পরিকল্পনা ব্যতিরেকে অর্থমন্ত্রীর ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করার ঘোষণা প্রকৃত প্রতিশ্রুতির বদলে মিথ্যা বলেই মনে হয়েছে।
আন্তর্জাতিক স্তরে, অশোধিত তেলের দাম বেড়ে চলেছে (ফলে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির নগদ যোগানকে খর্বিত করার ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে যা বৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য মোদী সরকারের ভরসাস্থল বিদেশি প্রত্যক্ষ ও বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকে প্রভাবিত করতে পারে)। ভারতের মুদ্রাস্ফীতি দু-অঙ্কের স্তরে পৌঁছে গেছে যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সেই ধূমধাম করে ঘোষিত ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজে থাকা ঋণের যোগানের মাধ্যমে সামগ্রিক চাহিদার ঘাটতি মেটানোর কৃত্রিম সরকারি কৌশল শেষ সীমায় পৌঁছেছে। তা সত্বেও মোদী সরকার জনসাধারণকে তাৎক্ষণিক সুরাহা প্রদান বা যথেষ্ট পরিমাণ সরকারি বিনিয়োগের দ্বারা অর্থনীতিতে রাজকোষ-উদ্দীপনা যোগান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ঋণের রাস্তাটিও সঙ্কটে পড়ায় ভারতীয় অর্থনীতি কীভাবে ২০২২-২৩ সালে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় অনুমিত ৮-৮.৫ শতাংশ বৃদ্ধির হারে পৌঁছবে সেটাও দুর্বোধ্য। এই প্রসঙ্গে এটি বলা অনুচিত হবে না যে ২০১৯-২০ সালে প্রাক-কোভিড বর্ষে বৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশের কম।
সব মিলিয়ে তাই বাজেট ২০২২ যুবক, কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, কিন্তু ভারতের শত-কোটিপতিদের সহায়তা করেছে।
- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি
পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এক অভিনব পদক্ষেপ করল! সম্প্রতি সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়েছে, কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের ভিতরে তৈরি হবে এক নতুন ভবন, যার ধাঁচ আঁচ পুরোপুরি কর্পোরেট হাসপাতাল মডেলের। যেখানে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যাবে কেবল নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে। একটা আপাত পোশাকী নামও ভাবা হয়ে গেছে — ‘প্রাইভেট কেবিন বিল্ডিং’। এখন সরকারি হাসপাতালে ‘পে বেড, পে কেবিন’, এবং আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে টাকার বিনিময়ে। কিছু কিছু পরীক্ষার বন্দোবস্ত খুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি ইউনিটকে। আর উপরোক্ত নতুন প্রকল্পে চলবে সবকিছুতেই ‘ফেলো টাকা নাও নিরাময়’ নিয়ম। ডাক্তাররা সরকারি বেতনের বিনিময়ে রোগীর চিকিৎসা করার পাশাপাশি সময় করে নতুন ভবনে ‘ফী’ নিয়ে আউটডোর-ইনডোর সবই দেখতে পারবেন। বাকি সবরকমের স্টাফ নিয়োগ হবে আলাদা। বলা হচ্ছে, সরকারি বিনিয়োগে, সরকারি নিয়ন্ত্রণে, সরকারি পরিচালনায় এই ব্যবস্থাটি চালানো হবে বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কের নিয়মে। এযাবত এরাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা দুই বন্দোবস্ত। একদিকে সরকারি হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রসমূহ, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও আনুষঙ্গিক কেন্দ্রসমষ্টি।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর এক উল্লেখযোগ্য অংশ সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যে বা অতি স্বল্প মূল্যে জমি পেয়ে ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ ‘মাল্টি স্পেশ্যলিটি’ হাসপাতাল খুলে বসেছে। যাদের প্রতি সরকারের পূর্বশর্ত আজও কাগজে-কলমে এই বলে রয়েছে যে সেখানে গরিবদের জন্যও একাংশে অতি স্বল্প মূল্যে চিকিৎসার বন্দোবস্ত থাকতে হবে। অন্তত টাকার কথা তুলে রোগী ফেরানো যাবে না। কিন্তু এ শুধু কথার কথা হয়ে রয়েছে, দরজা দেখিয়ে দিতে দু’বার ভাবা হয় না।কোভিড কালেও সেটা আরও নির্মম ভাবে দেখা গেল। এমনকি ‘স্বাস্থ্য সাথী’ কার্ড বহু ক্ষেত্রে রেয়াত করা হয়নি, অথবা ‘বেড নেই’ বা ‘যন্ত্র বিকল’ বলে চালাকির আশ্রয় নিয়ে রোগী নিতে অস্বীকৃতি দেখিয়েছে। মমতা সরকার ‘লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া’র আওয়াজ দিলেও তা শূন্যগর্ভ রয়ে গেছে। এখন সরকারি হাসপাতালে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেলের যে রূপটি চালু রয়েছে, আর যে নতুন রূপটি পিজি-তে চালু করতে চাওয়া হচ্ছে – দুটোর মধ্যে তফাৎ গুণগতভাবে বিস্তর আলাদা।
পিজি হাসপাতালের ভিতরে মোট এগারো কাঠার জমির ওপর মাথা তুলবে বহুতল নতুন স্বাস্থ্য বাজার। এজন্য বরাদ্দ হয়ে গেছে ৪৫ কোটি টাকা। পূর্তদপ্তর প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রমোটার-ডেভেলপার টেন্ডার ডাকার। অন্য কিছু রাজ্য সরকার নাকি এহেন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাফল্য পেয়েছে! ‘সাফল্য’ বলতে সরকারি কোষাগারে টাকার যোগান নিশ্চিত করতে লাভবান হয়েছে। তবে হতে পারে, সমাজের এক অংশ অর্থমূল্যের বিনিময়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে উন্মুখ হবে। এদের টাকার অভাব নেই, অঢেল আছে, সচরাচর ঝোঁক বেসরকারি হাসপাতালের প্রতি। অবশ্য নিম্নবিত্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষদেরও সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ না পেয়ে কখনও নিরুপায় হয়ে যেতে হয় বাজারি হাসপাতালে, বাঁচা-মরা যাইই ঘটুক, সর্বস্বান্ত হতে হয়।
কোভিড পরিস্থিতি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার গলদগুলো আজও কী ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে তা দেখিয়ে দিয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্লক হাসপাতাল ও জেলা হাসপাতাল চেইনের পরিকাঠামো আজও পরে রয়েছে অত্যন্ত প্রকট দুর্বলতর অবস্থায়। যে কারণে ‘রেফার’ এখনও এক নিত্য প্রবণতা। গ্রাম থেকে ব্লকে, ব্লক থেকে জেলায়, জেলা থেকে কলকাতায় — সমস্ত স্তরের সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা ব্যবস্থায় ‘রেফার’ও এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তৃণমূল সরকার শুধু মাঝেমধ্যে পরিসংখ্যান শোনায় সরকার জেলায় জেলায় ‘সুপার’-‘মাল্টি’ স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল বানিয়েছে, বানাচ্ছে, আরও বানাবে। রাজ্য সরকার ‘স্বাস্থ্য সাথী’ কার্ড বিলিয়েছে ভালো। কিন্তু তা দেখিয়েই ‘দায়িত্ববান’ ঢাক পেটানোর কিছু নেই, তার উপযোগিতাই বা কি যদি না হাসপাতাল ব্যবস্থায় সংস্থান সুলভ পর্যাপ্ত না থাকে! চিকিৎসামুখী মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই, বঞ্চনা-প্রতারণার শেষ নেই।
রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এই সামগ্রিক চেহারার দর্পণে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সরকারি উদ্যোগে পিজি-তে উপরোক্ত বাজারি উদ্যোগ কেন? সরকার স্বাস্থ্যব্যবসায় নামবে কেন? সেখানে যে কোটি কোটি টাকা ঢালার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা দিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার আরেকটি ভবন হবে না কেন? আর কেনই বা গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ব্লক ও জেলা হাসপাতালকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলা হবে না। যতই সাফল্যের সাতকাহন রাজ্য সরকার, স্বাস্থ্য দপ্তর, স্বাস্থ্য প্রশাসন শুনিয়ে চলুক — জনস্বাস্থ্য অবহেলিত থাকা আড়াল করতে পারছে না। আজও সরকারি হাসপাতালে যত রোগীর সংস্থান হয় তার চেয়ে কয়েকগুণ রোগী হসপাতালের ভিতরে-বাইরে খোলা আকাশের নিচে পরে থাকে ভর্তির অপেক্ষায়, প্রহর গোনে। অথচ কী ধৃষ্টতা! রাজ্য সরকার ফন্দি আঁটছে স্বাস্থ্য ব্যবসার!
২০২২ ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের দখলদারি নিতে, আত্মসাৎ করতে মরিয়া মোদী সরকার সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিবস, ২৩ জানুয়ারিকে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের আনুষ্ঠানিক সরকারি সূচনা হিসাবে আখ্যায়িত করেছে এবং ইন্ডিয়া গেটে ভারতের এই দেশবরেণ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর বিশাল এক মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। বসু-কন্যার প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা জানি, বসুর ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উদযাপনের পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে যে কমিটি তৈরি হয়েছিল তা একবারও বসেনি। আর আসল মূর্তি তৈরি না হওয়ায় একটি হলোগ্রাম মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পেশ করা সুভাষ চন্দ্র বসুর ট্যাবলো প্রস্তাব খারিজের পর। ইতিহাসখ্যাত কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বদের দখলদারি নেওয়ার সংঘাত অতীতে কখনও এতটা কদর্য চেহারা নেয়নি।
এই ‘ছিনতাই-যুদ্ধের’ থেকেও যা আরও অনেক বেশি উদ্বেগজনক, তা হল অবিরাম ইতিহাসের বিকৃতি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাশ্রয়ী পরিবর্তন ঘটানো, ইতিহাস নিয়ে নির্লজ্জ নাশকতামূলক তৎপরতা চালানো এবং সাংবিধানিক কাঠামো ও আমাদের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সেই আবেগদীপ্ত চেতনাকে নস্যাৎ করে চলা। মোদী সরকার ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-মুক্তির প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করেছে। ক্রমবর্ধমানভাবে এবং নজিরবিহীন অশালীন স্পর্ধায় সরকার প্রলম্বিত স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কাল্পনিক আখ্যান তৈরি করে চলেছে, যে ‘সংগ্রাম’ কয়েক শতাব্দীব্যাপী প্রসারিত — যাকে বলা হচ্ছে ‘হিন্দু ভারতের’ উপর ‘মুসলিম আক্রমণ’। মধ্যযুগীয় ভারতে কোনও হিন্দু ও মুসলিম শাসকের মধ্যে সংঘাতের উদাহরণ, অথবা হিন্দু তীর্থকেন্দ্রগুলির উন্নয়ন — এসব কিছুই প্রলম্বিত স্বাধীনতা যুদ্ধের আখ্যায়িকায় গেঁথে দেওয়া হচ্ছে।
ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি) প্রকাশিত ‘নিউ ইন্ডিয়া সমাচার’এ সম্প্রতি এক চমকপ্রদ দাবি রাখা হয়েছে যা স্তম্ভিত করে দেয়। দাবি করা হয়েছে — ভক্তি আন্দোলন নাকি ১৮৫৭’র গণবিদ্রোহের অগ্রদূত! এবং রমণ মহর্ষি (১৮৫৭-১৯৫০) ও স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)-কে ভক্তি আন্দোলনের ‘আইকন’ হিসেবে চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬-১৫৩৪)-র সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে! পরবর্তীতে, পিআইবি এই সংযুক্তিকে ‘অসতর্কতাজনিত ভুল’ বললেও ভক্তি আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ‘ভিত্তি’ বলা অব্যাহত থেকেছে। ভক্তি আন্দোলন মূলত জাতিভেদ প্রথার উৎপীড়ন ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন হিসেবেই উঠে এসেছিল এবং ঐক্য, সর্বধর্ম সমন্বয় ও মানবতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল। ভক্তি আন্দোলন এবং ১৮৫৭’র মধ্যে যদি কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা সাদৃশ্য থাকে, সেটা হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক ভারতীয় জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানে মারাত্মক ভয় পেয়েছিল এবং ১৮৫৭’র পরপরই সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ছড়িয়ে দেওয়া, তীব্র করে তোলার জন্য সম্ভবপর সমস্ত রকম চেষ্টা চালিয়েছে, যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭’র দেশভাগ।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের এই মিথ্যা, বিকৃত আখ্যানের দুরভিসন্ধিমূলক নির্মাণের পাশাপাশি সংবিধানের নিগূঢ় চেতনা ও কাঠামোর উপর বিরামহীন আক্রমণ চলছে। সরকার সাংবিধানিক উদ্দেশ্য ও অঙ্গীকারকে নস্যাৎ করার জন্য নিরলস অতিসক্রিয়তা চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে প্রজাতন্ত্রকে ধর্মনিরপক্ষেতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিপরীত অভিমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে ক্রমাগত নাগরিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী বারংবার একটা বিষয়ে সংশোধন চাইছেন, যাকে তিনি বলছেন ‘অধিকারের উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব’। তিনি আমাদের শুনিয়েছেন, একটা জাতি হিসেবে আমরা নাকি আমাদের অধিকারের জন্য লড়াই করে অনেক সময় নষ্ট করে চলেছি! তিনি চান অধিকারকে দায়িত্বের অধীন করতে, দায়িত্বকে মৌলিক এবং অধিকারকে ক্রমশ বাছাই এবং শর্তাধীন করার মাধ্যমে। নাগরিকদের তাদের দায়িত্বের বোঝায় ভারাক্রান্ত করাটা আরেকটি চালাকি; এইভাবে রাষ্ট্র ও সরকার নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।
জাতিয়তাবাদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ঝুটা আখ্যান আর সংবিধান সংক্রান্ত ক্রমবর্ধমান বিধ্বংসী তৎপরতা — ৭৫’এর ভারত এইভাবে এক দ্বি’মুখী আভ্যন্তরীণ অবরোধের সম্মুখীন; তারসঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি এবং বাইরের হুমকি ও বর্তমান পৃথিবীর নানা চ্যালেঞ্জ। বাহাত্তর বছর আগে ভারতের সংবিধান যখন প্রথম বলবৎ হয়েছিল, আমরা ভারতের জনগণ ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে গড়ে তোলার এবং ভারতের সকল নাগরিকের জন্য সার্বিক ন্যায়, মুক্তি এবং সমতা সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার নিয়েছিলাম। আজ সেই গণঅঙ্গীকার সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়ে আছে এবং আধুনিক ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতার উপর। এই যুদ্ধে হার মানা নয়! আমাদের জিততেই হবে!
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়)
পবন শর্মা, বিহারস্থিত বর্ষীয়ান সিপিআই(এমএল) লিবারেশন নেতা পবন শর্মা গত ৩০ জানুয়ারি প্রয়াত হয়েছেন। তার আগের দিন তিনি আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পাটনায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাঁর অ্যাঞ্জিওপ্লাষ্টি করা হয়, তবে অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক ছিল। তবু আশা করা যাচ্ছিল শঙ্কা কাটিয়ে উঠবেন। কিন্তু সমস্ত আশার বিপরীতে পরদিন বিকাল নাগাদ পবনজী চিরবিদায়ের পথগামী হয়ে যান।
কমরেড পবন শর্মা বিহারের ভোজপুর ও মগধ অঞ্চলে ১৯৮০ ও ’৯০ দশকে গ্রামীণ গরিব ও কৃষক জনতার বহু বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একইসাথে পার্টি সংগঠন গড়ে তোলা ও তাকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দীর্ঘসময় যাবৎ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন, বিহার রাজ্য সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন। সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ গরিবদের সমিতির। পার্টিতে তিনি “পবনজী” নামেই সম্বোধিত হতেন।
প্রয়াত পবন শর্মার মরদেহ নিয়ে আসা হয় পার্টির বিহার রাজ্য শাখার অফিসে, অন্তিম শ্রদ্ধা ও বিদায় জানানোর জন্য। পরদিন ৩১ জানুয়ারি পার্টি সংগঠন, গণসংগঠন সমূহের নেতা-কর্মী-সমর্থক সারির লোকজন অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদন করার পর প্রয়াত কমরেডের মরদেহ নিয়ে মিছিল বের হয় শেষকৃত্যের উদ্দেশ্যে। কমরেড পবন শর্মার অন্তিম যাত্রায় সহযাত্রী হন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সহ বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ।
লাল সেলাম কমরেড পবন শর্মা, লাল সেলাম।
উদ্ধত মোদী সরকারকে হঠিয়ে দিয়ে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন অসামান্য জয় ছিনিয়ে এনেছে। কর্পোরেট স্বার্থবাহী তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই কৃষক আন্দোলন এবং তার অভূতপূর্ব জয় দেশের ব্যাপক মানুষের মধ্যে সঞ্চার করেছে নতুন আশা উদ্দীপনা। কিন্তু আন্দোলনকে দেওয়া লিখিত প্রতিশ্রুতিগুলিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কেন্দ্রীয় শাসকেরা সেই জয়কে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অর্জিত বৃহত্তর সংগ্রামী ঐক্য ও প্রত্যয়কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে মোদী সরকারের প্রতারণার বিরুদ্ধে সমস্ত কৃষক সংগঠন সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার ডাকে এআইকেএসসিসি’র পক্ষ থেকে গত ৩১ জানুয়ারি সারা দেশ জুড়ে সংগঠিত হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা দিবস। প্রায় দু’মাস হতে চললো দিল্লীর বুকে কৃষক আন্দোলন স্থগিত রাখার সময় ঘোষণা করা হয়েছিল সরকারের নীতি বদলের জন্য আন্দোলন জারি থাকবে। সেই বার্তা তুলে ধরে এই দিন রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ব্লকে ব্লকে অনুষ্ঠিত হল বিক্ষোভসভা ও মোদীর কুশপুতুল দাহ কর্মসূচি।
“যতক্ষণ না কৃষকের দাবি পূরণ হচ্ছে আমাদের আন্দোলন লাগাতার চলবে। মোদী সরকারকে আমরা এক ইঞ্চি জমি ছাড়বো না। আগামী ২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটকে আমরা রাস্তায় নেমে সফল করে তুলবো। এভাবে এগিয়ে যাবে শ্রমিক কৃষকের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। এরাজ্যেও কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম গ্যারান্টি আইন প্রণয়ন করতে হবে।” কলকাতার ধর্মতলায় ওয়াই চ্যানেলে আয়োজিত এক বিক্ষোভসভায় একথা বলেন এআইকেএসসিসি রাজ্য সচিব ও এআইকেএম’এর নেতা কার্তিক পাল। সারা ভারত কৃষি শ্রমিক ইউনিয়নের তুষার ঘোষ বলেন, সরকারের নীতির কারণে কৃষিক্ষেত্র চরম অবহেলিত, সেখানে লাগাতার সরকারি বিনিয়োগ কমছে। কৃষকের হতাশাকে ব্যবহার করে কৃষিজমি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিলো মোদী সরকার। একে কৃষকরা ঠান্ডাঘরে পাঠাতে বাধ্য করেছে। অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে আমাদের দেশে দারিদ্র সবচেয়ে বেশি। আজ কর্পোরেট লুঠের স্বরূপ একেবারে সামনে চলে এসেছে। মোদীকে হুশিয়ারী জানিয়ে আজ দেশের প্রায় ৫০০ জেলায় আন্দোলন চলছে। পশ্চিমবাংলার বুকে চাষিরা ফসলের সরকারী দাম পাচ্ছে না। শাসকেরা দেশের খাদ্য বন্টন চক্রটাকে ভেঙে দিয়ে দুর্ভিক্ষের দিনগুলি ডেকে আনতে চাইছে। এর বিরুদ্ধে গড়ে উঠবেই জনগণের প্রতিরোধ। জয় কিষাণ আন্দোলনের অভীক সাহা বলেন, মোদী সরকার যদি মনে করে থাকে আন্দোলন শেষ হয়ে গিয়েছে, কৃষকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলেও চলবে, তা হলে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে! আন্দোলনকারী কৃষকদের উপর থেকে মামলা প্রত্যাহার, মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, ন্যায্য মূল্যের আইন তৈরির জন্য প্রতিশ্রুত কমিটি গঠন, লখিমপুর খেরি-কাণ্ডে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে বরখাস্ত-সহ বকেয়া দাবির কথা তিনি তুলে ধরে বলেন, ৩ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঘোষিত হবে। মীরজাফরদের উচিত শিক্ষা দিয়ে ওদের হারাতে হবে। আজ সারা দেশের প্রায় ৫ হাজার স্পটে সভা চলছে, শুরু হয়েছে আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায়। এআইকেএম’এর জয়তু দেশমুখ বলেন, ফ্যাসিস্ট শাসকদের ধর্মীয় মেরুকরণের চক্রান্তকে নাকচ করে কৃষকের সাধারণ স্বার্থে বৃহত্তর সংগ্রামী ঐক্য গড়ে উঠেছে। এই শিক্ষা পাথেয় করে আন্দোলন আগামীদিনে এগিয়ে যাবে। এরাজ্যে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষকরা চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার কোনও ক্ষতিপূরণ দেয়নি। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। রাজ্য সরকার নানা রকম তথ্য পরিসংখ্যান তুলে ধরে ধানের সরকারী সংগ্রহের কৃতিত্ব জাহির করছে, যা এক সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। বাস্তবে ব্যাপক দুর্নীতির কারসাজি করে ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে। প্রকৃত চাষিরা বিশেষত লিজ বা চুক্তি চাষিরা সরকারী দরে ফসল বিক্রি করতে পারছে না।
এছাড়াও সভায় বক্তব্য রাখেন সারা ভারত কৃষক সভার বিপ্লব মজুমদার, সারা ভারত অগ্রগামী কিষাণ সভার হরিপদ বিশ্বাস, সারা ভারত কৃষক খেতমজুর সংগঠনের গোপাল বিশ্বাস, পশ্চিমবঙ্গ কৃষক খেতমজুর সংহতি সমিতির সমীর পুততুন্ডু, এআইকেএমএস’এর সুশান্ত ঝা, এআইকেএস (বৌবাজার)-এর অজিত মুখার্জি, সারা ভারত ক্রান্তিকারী কৃষকসভার শংকর দাস, জয় কিষাণ আন্দোলনের প্রবীর মিশ্র, কল্যাণ সেনগুপ্ত, রত্না পাল, মহিলা স্বরাজের সুফিয়া খাতুন প্রমুখ।
কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সভায় বক্তব্য রাখেন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। সিআইটিইউ’এর অনাদি সাহু বলেন, কৃষকের আয় দ্বিগুন করা, ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে মোদী সরকার জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বেকার যুবকদের সামনে কর্মসংস্থানের কোনও আশা নেই, বন্ধ রুগ্ন কলকারখানা খোলার কোনও ভাবনাই সরকারের নেই। বিভিন্ন রেল স্টেশন বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এই ভয়ংকর আক্রমনের মোকাবিলায় আগামী ধর্মঘট আন্দোলনকে সর্বাত্মক করে তুলতে হবে। এআইসিসিটিইউ’র বাসুদেব বসু বলেন, কেন্দ্রের সরকার মূক ও বধির। কৃষক আন্দোলন দেশের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে এক অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে, সরকারকে মাথা নীচু করতে বাধ্য করেছে। আসন্ন ধর্মঘট দেশ বিক্রির বিরুদ্ধে। এরাজ্যেও সরকারি সম্পদ বিক্রি করা হচ্ছে৷ এই সামগ্রিক নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন আইএনটিইউসি’র কামারুজ্জামান কামার, আইএফটিইউ’র আশীষ দাশগুপ্ত প্রমুখ। বিভিন্ন মহিলা সংগঠনের নেত্রীরা কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। মহিলা কৃষকদের সংকটের দিকগুলি, তাদের স্বীকৃতি ও সমকাজে সমমর্যাদা সহ বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে ধরে তাঁরা বলেন, ব্যাপক সংখ্যক মহিলারা কৃষক আন্দোলনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত রয়েছে। বক্তব্য রাখেন প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ইন্দ্রাণী দত্ত, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কনীনিকা ঘোষ, মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠনের কল্পনা দত্ত, বিপ্লবী মহিলা সংগঠনের শিখা সেন রায় প্রমুখ। পরিশেষে ধর্মতলায় বিশ্বাসঘাতক মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়।
ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের চাপে ফ্যাসিস্ট নরেন্দ্র মোদী সরকার কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষাকারী তিন কৃষি আইন বাতিল করতে বাধ্য হয়। কৃষক আন্দোলনের অন্যান্য দাবিসমুহ সমাধান করার জন্য লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর কৃষক নেতারা আন্দোলন তুলে নেন। তারপর প্রায় দু’মাস হতে চলল। এখনও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইন প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠনের কোনও পদক্ষেপ করার উদ্যোগই নিচ্ছেনা। আন্দোলনে শহীদ ৭০০’র বেশি কৃষকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যপারে কেন্দ্রের কোনও সার্কুলার নেই। আন্দোলনকারীদের উপর থেকে সমস্ত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করার নির্দেশ রাজ্যগুলোকে দেওয়া হল না। বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিলের কোনও ব্যবস্থাই নেই। উত্তর প্রদেশের লখিমপুর-খেরীতে গাড়ি চাপা দিয়ে কৃষক হত্যাকারী কুখ্যাত খুনীর বাবা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে বরখাস্ত করা হল না। তাই এই সমস্ত দাবি আদায়ের জন্য সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা দেশজুড়েই আন্দোলন শক্তিশালী করার জন্য ৩১ জানুয়ারি বিশ্বাসঘাতকতা দিবস পালন করার ডাক দেয়।
উত্তর চব্বিশ পরগণা
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এবং সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির আহবানে সাড়া দিয়ে বারাসাত স্টেশন চত্বরে এআইপিএফ, আইসা, গণপ্রতিবাদি মঞ্চ এবং বন্দী মুক্তি কমিটির সম্মিলিত উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৭১৮ জন কৃষকের আত্মদান, এক বছরের অধিককাল দিল্লীর সীমানায় ঐক্যবদ্ধ ভাবে অবস্থান করে অন্নদাতারা এক ইতিহাস রচনা করেছে। মোদী সরকার তিন কালা কৃষি কানুন প্রত্যাহার করলেও নির্লজ্জভাবে কিছুতেই তা কার্যকরী করছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের এই বিশ্বাসভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানালো এই সভা। সভায় বক্তব্য রাখেন রূপা ঘোষ, নোটন কর, সাহেরুল ইসলাম, নির্মল ঘোষ, অনিমেষ চক্রবর্তী প্রমুখ। গণগায়ক অনুপ মজুমদারের গান এবং শোভনা নাথের আবৃত্তি সভাকে প্রাণবন্ত করেছে। সভা পরিচালনা করেন দুলাল চ্যাটার্জী।
বাঁকুড়া
৩১ জানুয়ারি বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর শহরে ‘বিশ্বাসঘাতকতা দিবস’এ প্রতিবাদসভা করা হয় সত্যপীরতলা মোড়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে। বক্তব্য রাখেন বিল্টু ক্ষেত্রপাল, ফারহান হোসেন খান, এআইএসএ’র সুশান্ত ধীবর, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির তিতাস গুপ্ত, আরওয়াইএ’র প্রান্তিক, সিপিআই(এম)-এর বিষ্ণুপুর এরিয়া কমিটির সম্পাদক অসিত ঘোষ এবং গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রী অতসী মাদ্রাজি।
কুচবিহার
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার আহ্বানে দেশব্যাপী বিশ্বাসঘাতকতা দিবসে কুচবিহার শহরের দেশবন্ধু বাজার মোড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। পরিশেষে মোদীর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। রাজু গোস্বামী, প্রজাপতি দাস এই কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন।
পশ্চিম মেদিনীপুর
মেদিনীপুর শহরে বিশ্বাসঘাতকতা দিবস পালন উপলক্ষে মিছিল ও পথসভা করা হয়। শহরের পার্টি কর্মীদের পাশাপাশি ভালো সংখ্যক পৌরসভার মজদুররা মিছিলে অংশ নেয়। পথসভায় বক্তব্য রাখেন পাটির রাজ্য কমিটি সদস্য তপন মুখার্জি ও বাবলু ব্যানার্জি। ছিলেন রাজ্য কমিটি সদস্য শৈলেন মাইতি, মেদিনীপুর শহর কমিটি সদস্য বানীকান্ত বারিক, রাজু দাস প্রমুখ।
জলপাইগুড়ি
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ট্র্যাফিক মোড়ে বামপন্থী কৃষক ও কৃষিমজুর সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে যুক্তভাবে অবস্থান বিক্ষোভ হয়। এআইকেএম’এর প্রদীপ দেবগুপ্ত, আয়ারলা’র মুকুল চক্রবর্তী বক্তব্য রাখেন।
দার্জিলিং
দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়া ব্লকের রানিডাঙ্গা কালারাম সব্জি বাজারে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা এবং সারা ভারত কৃষকসভার প্রতিবাদ কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে বাজারে মিছিল পরিক্রমা করে। বক্তব্য রাখেন এআইকেএম’এর পবিত্র মোহন সিংহ। উপস্থিত ছিলেন আয়ারলার জেলা সম্পাদক শরৎ সিংহ, আরওয়াইএ’র জেলা নেতা কৃষ্ণপদ সিংহ প্রমুখ। মিছিলে কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়।
হুগলী
হুগলীর বলাগড় ব্লকের সায়রা গ্রামে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি এবং সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের আহ্বানে বিশ্বাসঘাতকতা দিবস পালন করা হয়। পান্ডুয়া রেল স্টেশনের বুকিং কাউন্টারের পাশে বিক্ষোভসভায় এআইকেএম’এর পক্ষে বক্তব্য রাখেন মুকুল কুমার ও বিনোদ আহির। আয়ারলা’র তরফে বক্তব্য রাখেন নিরঞ্জন বাগ ও আব্দুল কাশেম। বহু মানুষ সভার বক্তব্য শোনেন।
নদীয়া
নদীয়া জেলার গাছা বাজারে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভসভা স্থানীয় কৃষক ও ব্যাপক সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেন্দ্রীয় দাবিগুলির পাশাপাশি চাষিদের ধান কেনায় দুর্নীতি, গ্রামীণ রাস্তা নিয়ে পঞ্চায়েতের ইচ্ছাকৃত টালবাহানায় ভূক্তভোগী মানুষ নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে সহমর্মিতা জানায়। বক্তব্য রাখেন কৃষ্ণপদ প্রামানিক, সন্তু ভট্টাচার্য, আসারুদ্দিন সেখ, হবিবুর রহমান প্রমূখ। ধুবুলিয়া বাজারে এক যৌথ মিছিল এলাকা পরিক্রমা করে। তারপর নেতাজী পার্কে বিক্ষোভসভা হয়। বক্তব্য রাখেন আনসারুল হক, জীবন কবিরাজ প্রমুখ। চাপড়া বাজারে আয়োজিত যুক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন এআইকেএম’এর ধনঞ্জয় গাঙ্গুলী।
পূর্ব বর্ধমান
পুর্ব বর্ধমান জেলার পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া স্টেশন সংলগ্ন সব্জির বাজারে যৌথভাবে সভা করা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন আয়ারলার জেলা সম্পাদক আনসারুল আমান মন্ডল ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। বিশ্বাসঘাতক নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়।
বর্ধমান শহরের নবাব হাট বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন মোড়ে যৌথ সভার আয়োজন করা হয়েছে। বক্তব্য রাখেন আয়ারলা’র জেলা কমিটির সদস্য শ্রীকান্ত রানা, এআইসিসিটিইউ’র পক্ষ থেকে প্রাণ বল্লভ সরকার ও অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। সভার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়।
গলসী থানার গলসী বাজারে যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি সদস্য মোজাম্মেল হক ও অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করার মধ্যে দিয়ে সভা সমাপ্ত হয়।
ভাতার থানার ভাতার বাজারে যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন এআইকেএম’এর পক্ষ থেকে সত্যনারায়ন বিশ্বাস ও অন্যান্য গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ। সভার শেষে নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়।
কালনা ২নং ব্লকের অকালপৌষ গ্রাম পঞ্চায়েতের আগ্রাদহ বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন রাস্তার উপর এআইকেএম, আয়ারলা, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও আরওয়াইএ’র পক্ষ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা দিবসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানিয়ে ফ্যাসিবাদের নায়ক নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল দাহ করা হয়।
প্রতিটি সভায় বক্তারা পশ্চিমবঙ্গে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কার্যকরি করা, বছরে ২০০ দিনের কাজ ও দৈনিক মজুরি ৬০০ টাকা করার দাবি ও অন্যান্য স্থানীয় দাবি তুলে ধরেন।
এআইএসএ-আরওয়াইএ মিলিতভাবে রেলের পরীক্ষায় দুর্নীতি এবং যুব-ছাত্রদের ওপর পাশবিক লাঠি চার্জের প্রতিবাদে ২৮ জানুয়ারি বিহার বনধে্র ডাক দেয়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো সদস্য ও বিহার রাজ্য সম্পাদক কুণাল ছাত্র-যুবদের এই আন্দোলনকে সর্বতোভাবে সমর্থন করে বলেন, মোদী সরকার প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে রেলওয়েকে ব্যক্তিমালিকানার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ও রেলের চাকরি খতম করার যে প্রচেষ্টায় রত তার বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবদের এই প্রতিবাদ খুবই যুক্তিযুক্ত।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট : ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে ২১টি রেলওয়ে বোর্ডের ৭টি পোস্টের জন্য স্নাতক স্তরের ৩৫,২৭৭টি শূন্যপদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। ৭টি পোস্টের মধ্যে স্টেশন মাস্টার, গার্ড এবং টিকিট পরীক্ষকের পোস্ট ছিল। একবছর পরে ২৮/১২/২০২০ প্রথম পরীক্ষা হয়, কোভিডের জন্য বাকি পরীক্ষাগুলি স্থগিত হয় ৩১/০৭/২০২১ পর্যন্ত। অবশেষে ১৪ জানুয়ারি ২০২২এ রেলওয়ে বোর্ড পারফরম্যান্স টেস্টের ফলাফল ঘোষণা করে।
এই ফলাফল ছিল রেলমন্ত্রক দ্বারা ২০১৯ সালে ঘোষিত স্নাতক স্তরের ৩৫,২৭৭ পোস্ট ও গ্রুপ ডি’র ১.৩৭ লক্ষ পোস্টের জন্য নেওয়া পরীক্ষার। ঘোষণা অনুযায়ী স্নাতক স্তরের শূন্যপদের ২০ গুণ সংখ্যক অর্থাৎ ৭ লক্ষ পদপ্রার্থীর নাম বিবেচনা করা উচিত ছিল। রেলওয়ে বোর্ড ৭ লক্ষের নাম ঘোষণা করলেও এরমধ্যে ৪ লক্ষ প্রার্থী ২টি বা তার বেশি এমনকি ৭টি পোস্টের জন্য আবেদন করেছিলেন ও পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন। তাই বাস্তবে মাত্র ২.৭৬ লক্ষ সফল পদপ্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। পদপ্রার্থীদের দাবি তাই সঠিক ছিল — প্রতিটি পোস্টের জন্য ১ জনেরই নাম ঘোষণা করতে হবে। রেলওয়ে বোর্ড ঘোষিত সমস্ত পদের জন্য লোক নিয়োগ করতে ইচ্ছুক নয় এটা পরিষ্কার বোঝা গেল। সরকারের এই ধোঁকা পদপ্রার্থীরা ধরে ফেলে।
গ্রুপ ডি’র জন্য ঘোষিত ১.৩৭ লক্ষ পদের জন্য প্রায় ১ কোটি প্রার্থী আবেদন করেন। বেরোজগারির কি নিদারুণ অবস্থা তা এই ঘটনা প্রমাণ করে। বোর্ড প্রথমে ঘোষণা করেছিল পারফরম্যান্স টেস্ট একবারই নেওয়া হবে, কিন্তু ফলাফলের সময় বলা হল ২য় পরীক্ষা নেওয়া হবে।
ছাত্র-যুবরা প্রতিবাদে, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পাটনা, প্রয়াগরাজ, নালন্দা সহ বহু শহরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। গ্রুপ ডি প্রার্থীদের নিয়ে পরীক্ষক বোর্ডের এই ধোঁকাবাজির বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবদের মূল দাবি — আরআরবি-এনটিপিসি’র ফলাফলের সংশোধন। পুলিশের যথেচ্ছ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, প্রতিবাদীদের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল) তীব্র প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানায়। রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের নন-টেকনিক্যাল পপুলার ক্যাটেগরির পরীক্ষার ফলাফলের দুর্নীতি, প্রতিবাদীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, মোদী সরকারের রেলে চাকরির সুযোগ বন্ধ করার চক্রান্ত ও বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে গত ২৮ জানুয়ারি বিহারে বনধ্ করার ডাক দেয় এআইএসএ-আরওয়াইএ।
প্রচন্ড ঠান্ডায় ছাত্র-যুবরা পাটনা ও আরাতে ১০ ঘন্টার জন্য রাত্রিবেলায় রেল অবরোধ করেন, রাজধানী এক্সপ্রেস সহ ৩০ ট্রেনের চলাচল ব্যাহত হয়।
মোদী সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থান এবং নীতীশ সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল ১৯ লক্ষ চাকরি — ছাত্র-যুবদের কাছে তাঁদের জবাব দিতে হবে কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি? কর্মসংস্থান তো হয়নি বরং বিদ্যমান চাকরির পদ ছেঁটে দিয়ে, রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রকে বেসরকারি করে, বেচে দিয়ে যুব ছাত্রদের অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। মোদী সরকারের ৭ বছরে চাকরির পদ অর্ধেক হয়েছে। পরীক্ষায় সফল প্রার্থীদের নিয়োগপত্র না দেওয়ায় বছরের পর বছর তারা অপেক্ষারত। ইউপিএসসি’র পদ পর্যন্ত অর্ধেক ছাঁটা হয়েছে এবং বাইরে থেকে নিয়োগ করা হচ্ছে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ছাত্র যুবদের এই আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন করছে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হাওড়া জেলা দ্বাদশ সম্মেলন গত ৩০ জানুয়ারী ফাদার স্ট্যান স্বামী ও কমরেড গৌরী শঙ্কর দত্ত নগরে (ঘোরাঘাটা), কমরেড অমিতাভ দে (ফুচকন) ও কমরেড রাজেন্দ্র গুপ্তা নামাঙ্কিত সভাগৃহে (মোহরকুঞ্জ অনুষ্ঠান গৃহ) এবং কমরেড রঞ্জিত দে ও শৈলেন্দ্র নাথ মিত্র নামাঙ্কিত মঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়। এক ঝাঁক ছাত্র ও স্থানীয় সদস্যদের এক সম্মিলিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর কয়েক দিনের পরিশ্রমে ঘোরাঘাটা অঞ্চল সম্মেলন উপলক্ষে লাল পতাকা ও সুসজ্জিত গেট দিয়ে সেজে ওঠে। সম্মেলন উপলক্ষে গোটা হাওড়া জেলা সংগঠন জনগণের মধ্যে এক জোরদার প্রচার অভিযান চালায়। বিগত কয়েক বছর যাবত গ্রামাঞ্চলে পার্টির বিস্তারের কিছু সম্ভাবনা গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু নতুন এলাকায় যোগাযোগ ও পার্টি ব্যবস্থা গড়েও উঠেছে। হাওড়া জেলা সম্মেলনের প্রস্তুতি পর্বে নিচের তলার সম্মেলন, জেলা সম্মেলনের প্রচার ও আয়োজন এবং গ্রামাঞ্চলে আরো নুতনতর যোগাযোগ গড়ে ওঠার সূত্র ধরে জেলা পার্টি সংগঠন এক নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পেরেছে। তার ছাপ স্বাভাবিকভাবেই সম্মেলনেও এসে পড়ে এবং সম্মেলনে ৮৭ জন প্রতিনিধি উপস্থিত হন। এ’ছাড়াও পর্যবেক্ষক ও অতিথি হিসেবে ৮ জন উপস্থিত ছিলেন।
পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের সূচনা হয়। জেলার বর্ষীয়ান পার্টি সদস্য সবিতা কোলে পতাকা উত্তোলন করেন। শহীদ স্মরণ কর্মসূচি পরিচালনা নীলাশিস বসু। তিনি ৩০ জানুয়ারী দিনটি যে গান্ধী হত্যার বার্ষিকী সে কথা স্মরণ করিয়ে ও ফ্যাসিস্ট হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলেন। এরপর একে একে শহীদ বেদিতে মালা দেন সবিতা কোলে, রাজ্য পর্যবেক্ষক ইন্দ্রানী দত্ত, রাজ্য সুম্পাদক কমরেড অভিজিৎ মজুমদার, জেলা ইনচার্জ প্রবীর হালদার, জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, বাসুদেব বসু এবং অন্যান্যরা। নীরবতা পালনের পর সম্মেলনের মূল পর্ব শুরু হয়।
কমরেড এনএন ব্যানার্জী, অঙ্কিত মজুমদার, কল্যাণী গোস্বামী, সেরিনা সেখ, নন্দিনী দাসকে নিয়ে প্রেসিডিয়াম সম্মেলন পরিচালনা করেন। সম্মেলনের উদঘাটন করে রাজ্য পর্যবেক্ষক ইন্দ্রানী দত্ত জেলার কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান রাখেন। রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বহুমুখী লড়াইয়ের বিষয়টি আলোচনা করেন। বাসুদেব বসু হাওড়া জেলার শিল্প ও শ্রমিকদের পরিস্থিতির নিরিখে শ্রমিকদের সংগঠিত করার আহ্বান রাখেন। জেলা ইনচার্জ প্রবীর হালদার তাঁর ভাষণে জেলা কমিটিকে সুসংহত করে গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের উপর ৪ জন মহিলা সহ ১৮ জন বক্তব্য রাখেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক সাংগঠনিক বিষয়গুলি তাদের বক্তব্যে উঠে আসে। জেলা সম্পাদক তার চমৎকার জবাবী ভাষণে যথাযথভাবে সেগুলির উত্তর দেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবেদন পাশ হয়।
এরপর নতুন কমিটি নির্বাচিত হয়। সম্মেলন ৫ জন মহিলা ও ৩ জন ছাত্র সহ ২১ জনের কমিটি নির্বাচিত করে এবং দেবব্রত ভক্ত পুনরায় জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। সঙ্গীতের মূর্ছনার মধ্যে দিয়ে হাওড়া জেলার সংগঠনকে আরো বিস্তৃত ও দৃঢ় করার সংকল্প নিয়ে সম্মেলন সমাপ্ত হয়।
পার্টির বাঁকুড়া দশম জেলা সম্মেলন সফল হল গত ২৮ জানুয়ারি ভাষ্কর বাউরি (আঞ্জুমান-ই-ইসলামিয়া) হলে, সুবিমল সেনগুপ্ত নগরে (বাঁকুড়া শহরে)। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ৮০ জন প্রতিনিধি। খসড়া প্রতিবেদনের ওপর আলোচনাতে অংশগ্রহণ করেছেন ২২ জন প্রতিনিধি। নতুন জেলা কমিটিতে ৩ জন মহিলা সহ বেশ কিছু যুবক আছেন।
প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন বনের জমি বাঁচানোর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আদিবাসী কমরেডরা, তারসাথে ওন্দা সহ ছাতনা, হিড়বাঁধ, খাতড়া, ইঁন্দপুর, বাঁকুড়া ১ ও ২ নং ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রামের ক্ষেতমজুর ও কৃষক আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক ও নেতৃবৃন্দসহ, বিষ্ণুপুর পৌরসভার শ্রমিক আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বাস্তুঘর সহ অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে মুখর সাথীরা এবং ঋণমুক্তি কমিটির মহিলারাও।
সম্মেলনের শুরুতে কৃষক আন্দোলন থেকে শুরু করে জেলা ও রাজ্যের প্রয়াত লড়াকু সাথীদের স্মরণ করা হয়। রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন বাঁকুড়ার বর্ষীয়ান কমরেড মলয় দুবে। অতিথি ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রাজ্য কমিটির পর্যবেক্ষক সজল পাল, রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জয়তু দেশমুখ ও পলিটব্যুরো নেতা কমরেড কার্তিক পাল। নতুন জেলা কমিটির সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন বাবলু ব্যানার্জী।
সম্মেলনে গৃহীত আগামী কর্মসূচিগুলি হল
১) এরাজ্যে চাষিদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) আইন লাগু করে ধান-আলু সহ সব ধরনের ফসল সরকারকে কিনতে হবে এবং কাগজে নয়, সরেজমিন তদন্ত করে প্রকৃত চাষিদের ক্ষতিপূরণ সহ সব ধরনের সরকারি সাহায্য দিতে হবে। এই দাবিতে ব্যাপক কৃষকদের সমাবেশিত করে মার্চ মাসের শেষ দিকে ২৫,০০০ সদস্য সংগ্রহ করে কৃষক সমিতির জেলা সম্মেলন সংগঠিত করতে হবে।
২) আগামী সারা ভারত ধর্মঘটে জেলাজুড়ে প্রচার সংগঠিত করতে হবে এবং বিষ্ণুপুর পৌরসভার শ্রমিকদের নিয়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট করতে হবে।
৩) রাঁচির আদিবাসী কনভেনশনের শিক্ষা নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে আদিবাসী সমাজের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে কনভেনশনের মধ্যে দিয়ে নতুন করে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ গঠন করতে হবে।
৪) আগামী পৌরসভা নির্বাচনে বিষ্ণুপুরে কয়েকটি ওয়ার্ডে লড়াই করা হবে। জেলা কমিটি সহ সমস্ত সংগঠনকে বিষ্ণুপুরের পাশে সব ধরণের সাহায্য নিয়ে দাঁড়াতে হবে, যাতে নজরকাড়া ফল করতে পারা যায়।
৫) আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি, ডিএফও ডেপুটেশন সফল করে তুলতে সকলকে মনোযোগ দিতে হবে।
৬) আগামী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন দু’হাজার সদস্যের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে মহিলা সংগঠনের জেলা সম্মেলন করতে হবে।
আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন মাথায় রেখে লোকাল কমিটিগুলির অধীন গ্রামগুলিতে গ্রাম কমিটি গঠন করার জন্য ব্রাঞ্চগুলিকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
অক্সফ্যাম জানুয়ারি ২০২২’র অসাম্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেশ করেছে। বিশ্বজোড়া অসাম্য, ধনী দেশের সঙ্গে দরিদ্র দেশের, ধনী দেশের উচ্চবিত্তের সঙ্গে সেখানকার নিম্নবিত্তের, দরিদ্র দেশের ধনীদের সঙ্গে সেখানকার গরিবদের হরেক কিসিমের বৈষম্যই এই পৃথিবীর দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে, ভারত তার ব্যতিক্রম নয়। ওই প্রতিবেদনের গোড়াতেই জানানো হয়েছে, কেবল বৈষম্যের দরুণ প্রতি ৪ সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হয়, অর্থাৎ, প্রতি বছরে প্রায় ৮ লক্ষ মানুষ মারা যায়।
বিশ্বের ধনীতম ১০ জনের সম্পদ দ্বিগুণ হয়েছে অন্যদিকে ৯৯ শতাংশের, অর্থাৎ ৭৮০ কোটি মানুষের আয় কমেছে, গত মার্চ ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২১, এই ২০ মাসের কোভিডকালে। ২৫২ জন ধনীর যত সম্পদ আছে, তার পরিমাণ আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ক্যরিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ১০০ কোটি পুরুষ ও নারীর সম্মিলিত সম্পদের থেকে বেশি। ১৯৯৫ সাল থেকে গত ২৭ বছরে উপরদিকের ১ শতাংশ অতিধনীরা নিচের ৫০ শতাংশ বিশ্ববাসীর তুলনায় ২০ গুণ বেশি সম্পদ কুক্ষিগত করেছে। যদি মার্কিন দেশের কালো মানুষদের গড় আয়ু সাদা আমেরিকাদের সমান হত তাহলে ৩৪ লক্ষ অতিরিক্ত কালো মানুষ সেদেশে এখন বেঁচে থাকত; কোভিডের আগে সেই ভয়ানক সংখ্যাটা ছিল ২১ লক্ষ। কোভিড তাকে দেড়গুণ করে তুলেছে। বিশ্বের ধনীতম ২০ জন শতকোটিপতি দরিদ্রতম ১০০ কোটি মানুষের তুলনায় ৮,০০০ গুণ কার্বন গ্যাস নিঃসরণ করে চলেছে। অতিমারীর শুরু থেকে প্রতি ২৬ ঘন্টায় বিশ্বে একজন করে নতুন অর্বুদপতি তৈরি হয়েছে, অপরদিকে ১৬ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে।
সামগ্রিকে এই বিশ্ব এখন ধনীদের দ্বারা গরিবদের শোষণের নরক হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষও তাই। গ্লোবাল ইনইকোয়ালিটি ল্যাবের প্রতিবেদন তেমনটাই বলছে। এদেশের আয় ও সম্পদের তালিকা অনুযায়ী নিচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশ অধিবাসীর মাথাপিছু আয়ের তুলনায় উপরের দিকে থাকা ১০ শতাংশের মাথাপিছু আয় ২২ গুণ, এবং অতিধনী ১ শতাংশের মাথাপিছু আয় ৭৭ গুণ। সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্য আরো ভয়ানক। অতিধনী ১ শতাংশের মাথাপিছু সম্পদ এবং ধনী ১ শতাংশের মাথাপিছু সম্পদ নিচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশের মাথাপিছু সম্পদের যথাক্রমে ২৮০ গুণ ও ৫৫ গুণ। লক্ষ্যণীয় যে, ভারতে অসাম্য বরাবরই বেশি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে উপরের ১০ শতাংশ মোট জাতীয় আয়ের ৫০ শতাংশের ভাগিদার ছিল। স্বাধীনতার পরে পরিকল্পিত অর্থনীতির সুবাদে এই অনুপাত ৩১ শতাংশে নেমে এসেছিল। ৮০’র দশকের মধ্যভাগ থেকে ক্রমাগত অর্থনৈতিক উদারীকরণ বৈষম্যকে বাড়িয়ে চলেছে ও সেই অনুপাত বাড়তে বাড়তে ৫৭ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। কেবল তাই নয়, অতিধনী ১ শতাংশের আয়ের অনুপাত দাঁড়িয়েছে মোট আয়ের ২২ শতাংশ।
কেবল আয় বা সম্পদের বৈষম্যই নয় লিঙ্গ বৈষম্যও এদেশে প্রকট ও প্রবল। ভারতে আয়ের ক্ষেত্রে মহিলা শ্রম থেকে প্রাপ্ত আয়ের অনুপাত মাত্র ১৮ শতাংশ। যা এশিয়ার (চিন বাদে) অনুপাতর (২১ শতাংশ) থেকে কম ও পৃথিবীতে সর্বনিম্নগুলির মধ্যে একটি, কেবল মধ্য এশিয়ার (১৫ শতাংশ) থেকে উন্নত। মনে রাখা দরকার মধ্য এশিয়ায় নারী স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য ভাবে নিম্নস্তরের। পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রেও ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। ভারতের নিচের স্তরের ৫০ শতাংশ মাথাপিছু ১ টন কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী, উপরের ১ শতাংশ তার ৩২ গুণ অর্থাৎ মাথাপিছু ৩২ টন কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। ফলে ধনীদের হাতে কেবল আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে গরিবরা শোষিত হচ্ছে তাই নয়, পরিবেশকে বাস-অযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রেও সেই শোষণ ব্যাপ্ত হয়েছে।
- অমিত দাশগুপ্ত
কোভিডের প্রতিষেধক তৈরির প্রক্রিয়ায় গতি আনতে ‘পিএম কেয়ার্স’ তহবিল থেকে দেওয়ার কথা ছিল ১০০ কোটি টাকা। অন্তত ২০২০ সালের ১৩ মে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ‘পিএমও’র প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তেমনই বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তথ্যের অধিকার আইনে প্রশ্নের উত্তরে জানা গিয়েছে, সেই টাকা না পেয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক, না পেয়েছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)। কেন্দ্রের জৈবপ্রযুক্তি দফতর উত্তর এড়িয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর দফতর ফের জানিয়ে দিয়েছে যে, ‘পিএম কেয়ার্স’ কোনও সরকারি সংস্থা নয়। কাজেই সেটা তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় পড়ছে না।
লকডাউন ও কোভিড অতিমারীর মোকাবিলায় পিএম কেয়ার্স তহবিল তৈরির সময়েই বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থাকা সত্ত্বেও কেন আরও একটি তহবিল তৈরির প্রয়োজন পড়ছে। ওই তহবিলের হিসাব প্রকাশ্যে আনার দাবি উঠলেও সরকার তাতে আমল দেয়নি। নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার তথা তথ্যের অধিকার কর্মী লোকেশ বাত্রা এর আগেও পিএম কেয়ার্স সম্পর্কে তথ্য চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। এবং উত্তর পেয়েছিলেন, এই তহবিলে ব্যক্তিগত অনুদান জমা পড়ে বলে তা তথ্যের অধিকারের আওতায় আসে না।
এবার বাত্রা তথ্য চেয়েছিলেন ২০২০’র সালের ওই প্রেস বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর তাতে বলেছিল, ‘‘কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ৩,১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে পিএম কেয়ার্স অছি পরিষদ। প্রতিষেধক তৈরির প্রক্রিয়ায় গতি আনতে পিএম কেয়ার্স থেকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে তা ব্যবহার করা হবে।’’ গতবছরের ১৬ জুলাই তথ্যের অধিকার আইনে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মুখ্য তথ্য আধিকারিকের কাছে পিএম কেয়ার্স তহবিল থেকে খরচের সবিস্তার হিসাব চেয়ে আবেদন করেন বাত্রা। বিশেষত, কোভিডের প্রতিষেধক তৈরিতে প্রত্যেক আর্থিক বছরে ভারত সরকার পিএম কেয়ার্স তহবিল থেকে মোট কত টাকা পেয়েছে, কোন কোন সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান প্রতিষেধক তৈরিতে যুক্ত আছে, তা জানতে চান তিনি।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক সরাসরি জানিয়ে দেয়, তাদের কাছে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, ওই খাতে পিএম কেয়ার্সের কোনও টাকা আসেনি। কোভিডের টিকাকরণ সংক্রান্ত সেলের মুখ্য তথ্য আধিকারিকের দফতর বলেছে, ‘‘প্রতিষেধক তৈরির জন্য পিএম কেয়ার্স তহবিল থেকে এই দফতর কোনও টাকা পায়নি।’’ এও জানানো হয়, বাত্রার আবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর দফতর, আইসিএমআর এবং জৈবপ্রযুক্তি দফতরের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আইসিএমআর বাত্রার প্রশ্নের উত্তর দিয়েও দিয়েছে। সেই উত্তরেও একই কথা, ‘‘প্রতিষেধক তৈরির জন্য আইসিএমআর কোনও টাকা পিএম কেয়ার্স তহবিল থেকে পায়নি।’’ আর জৈবপ্রযুক্তি দফতর জানাচ্ছে, বাত্রার আবেদন ‘অন্যান্য সরকারি কর্তৃপক্ষের’ কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গোটা বিষয়টিই অস্পষ্ট থাকায় গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দফতরে আবেদন করেন বাত্রা। দু’দিন পরে সেখানকার মুখ্য তথ্য আধিকারিকের থেকে উত্তর পান, ‘‘পিএম কেয়ার্স কোনও সরকারি কর্তৃপক্ষ নয়, যাকে তথ্যের অধিকার আইন, ২০০৫’র ২(এইচ) ধারার আওতায় আনা যায়।’’ এরপরে, ১ অক্টোবর পিএমও’র মুখ্য তথ্য আধিকারিকের চিঠিতে পুরনো জবাবের সঙ্গেই বলা হয়, ‘‘আর কোনও তথ্য আপনাকে দেওয়া যাবেনা।’’ পিএমও’র আপিল কর্তৃপক্ষের পোর্টালে বাত্রার আবেদন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘‘নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে।’’
বাত্রার আবেদনটি অবশ্য নীতি আয়োগ এবং সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন বা সিডিএসসিও’র কাছেও পাঠানো হয়েছিল। সিডিএসসিও’র ওয়েবসাইটে সেই প্রসঙ্গে গত ১৪ সেপ্টেম্বর জানানো হয়েছে, তারা প্রতিষেধক-সহ বিভিন্ন ওষুধের মান-নির্ধারক সংস্থা। প্রতিষেধক তৈরির টাকা বরাদ্দের ক্ষেত্রে তাদের কোনও ভূমিকা নেই।
প্রধানমন্ত্রীর নামেই পিএম কেয়ার্স তহবিল। তিনিই চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য মন্ত্রীরা এর অছি পরিষদের সদস্য। পিএম কেয়ার্সের ওয়েবসাইটে প্রধানমন্ত্রীর ছবি, সই, অশোক স্তম্ভ, জাতীয় পতাকা — সবই রয়েছে। কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রক এবং তাদের কর্মীদের বেতন থেকে নেওয়া টাকা এই তহবিলে জমা পড়েছে। তা সত্ত্বেও এটিকে সরকারি তহবিল বলতে নারাজ কেন্দ্র।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ জানুয়ারি ২০২২
গৌরী লঙ্কেশ যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে গত ২৯ জানুয়ারি তিনি বয়সে হতেন ষাট। ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবাদী সাংবাদিক, সম্পাদক, অনুবাদক এবং সমাজকর্মীকে রাত্রি আটটা নাগাদ নিজের বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই কালো রাতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কর্নাটক এবং দেশের সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতা বিরোধী অন্যতম কণ্ঠস্বর। গৌরী তাঁর সাপ্তাহিক ‘গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকে’তে শেষ যে সম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন সেটির শিরোনাম ছিল, ‘ইন দ্য এজ অফ ফলস নিউজ’। তিনি লিখেছিলেন দেশে মোদী-ভক্তরা গোয়েবলসের অনুসরণে ভূয়ো খবর ও মিথ্যাচারের কারখানা খুলে বসেছে। তিনি এধরণের অনেক মিথ্যা খবরের সন্ধান দিয়েছিলেন এবং বিশেষ করে গণেশ চতুর্থীর সময়ে একটি গুজবের উল্লেখ করেছিলেন যার থেকে অনায়াসে সাম্প্রদায়িক হানাহানি হতে পারত। সৌভাগ্যবশত কর্ণাটক পুলিশ প্রেস কনফারেন্স করে সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। এই গুজবের উৎস খুঁজতে গিয়ে তিনি ‘পোস্টকার্ড.নিউজ’ নামে একটি ওয়েবসাইটের সন্ধান পান যেটি উগ্র হিন্দুত্ব বাহিনী দ্বারা পরিচালিত।
আমরা জানি গৈরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান দৌরাত্মের বিরুদ্ধে গৌরী ছিলেন এক অদম্য, অকুতোভয় সৈনিক। এরজন্য তাঁকে প্রতিনিয়ত ট্রোল করা হয়েছে, উড়ো চিঠি এসেছে, ফোনে খুন করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি এসবে কোনও গুরুত্ব দেননি, তাঁর ঘনিষ্ঠদের মতে, তিনি ভাবতেই পারেননি তাঁকে হত্যা করা হতে পারে। অবশেষে সেটাই হল। সোশ্যাল মিডিয়ায় হিন্দু ধর্মান্ধরা তাঁর হত্যায় উল্লসিত হয়। এঁদের মধ্যে আছেন এক যুবনেতা যাঁর টুইটার একাউন্ট খোদ প্রধানমন্ত্রী অনুসরণ করেন।
গৌরীর ষাটতম জন্মদিনে ‘সিটিজেন্স ফর পিস এন্ড জাস্টিস’ একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করে যেখানে গৌরীর মতন প্রতিবাদী নারীদের আজকের যুগে যে কী সর্বাত্মক এবং ভয়ানক হিংসার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা হয়। গত সাড়ে তিনবছরে ভার্চুয়াল মিডিয়ায় ট্রোল বাহিনীর উপস্থিতি বহুগুণ বেড়ে গেছে। খুন, ধর্ষণের হুমকি দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে গেছে, এমনকি গণহত্যার ডাকও দেওয়া হচ্ছে। সরকার বা শাসক দলের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে সাইবার ও বাস্তব জীবনের হামলাকারীরা লাগামছাড়া ভাবে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
সফুরা জরগরকে আমাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে। শাহীনবাগের অন্যতম সংগঠক ছিলেন, দিল্লী ‘দাঙ্গা’র পরে অন্তঃসত্বা অবস্থায় যাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঐ অবস্থায় তিনি তিন তিনবার জামিনের আবেদন করলেও নাকচ হয়ে যায়। সরকারি উকিল যুক্তি দেয় এর আগে বহু মহিলা কয়েদী জেলে সন্তান প্রসব করেছেন, তাঁর ক্ষেত্রে কেন ব্যাতিক্রম হবে? তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে কুৎসার বন্যা বয়ে যায়। অবশেষে জামিন পাওয়ার পর সফুরা স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনে ফিরে যান। তখন সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু হয়েছে, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, ফেসবুক, টুইটারে তাঁর বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীর গ্রেপ্তার নিয়ে তুমুল হৈচৈ। দেখা গেল অনেকে রিয়াকে উপদেশ দিচ্ছেন তুমিও সফুরার মতো অন্তঃসত্বা হয়ে যাও, তোমার জামিন হয়ে যাবে! সফুরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন! তিনি তো কোনও কিছুতে নেই, পারিবারিক জীবনে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। তিনি বুঝে গেলেন তাঁর নিস্তার নেই। যে ভয়ঙ্কর ইস্লামোফোবিক, নারী-বিদ্বেষী বাতাবরণ সারা দেশ জুড়ে ডালপালা বিস্তার করেছে তা তাঁকে নিশ্চিন্তে থাকতে দেবেনা। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, চুপ করে থেকে লাভ নেই, সরব হতে হবে। এরপরে সফুরা বলেন যে, আজ যখন মুসলিম মহিলাদের একই রকমভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, নেট মাধ্যমে তাঁদের শরীর নিলাম করা হচ্ছে, তখন অনেকে আমাদের উপদেশ দিচ্ছেন যে এগুলো শুধু নেটজগতেই ঘটছে, বাস্তবে এসব কিছু হবেনা। কিন্তু গৌরীর বেলায় তো তিনি সেটাই ভেবেছিলেন, কিন্তু খুন হয়ে গেলেন। আজ ‘সাল্লি ডিলস’এ যে নারীকে নিলাম করা হয়েছে তাঁকে যে কেউ রাস্তায় চিনে ফেলে আক্রমণ করবে না এর কি নিশ্চয়তা আছে?
দেশজুড়ে যে মুসলিম ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে সেটা নিয়ে খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেন সফুরা। দেখুন প্রথমে মুসলিম পুরুষদের শয়তানি (ডেমোনাইজ) রূপ দেওয়া হল। তাঁরা বহু বিবাহ করেন, তুতো বোনদের বিয়ে করেন, গাদাগাদা বাচ্চার জন্ম দেন, নারীদের মধ্যযুগীয় হিজাব, বোরখা পরিয়ে রেখে নির্যাতন করেন, তাঁরা অপরাধপ্রবণ ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর দেশজুড়ে নানা ছুতোয় তাঁদের পিটিয়ে মারা শুরু হল। তাঁদের অপদস্ত করার জন্য প্রকাশ্যে মোল্লা, কাটুয়া, পাকিস্তানি ইত্যাদি বলা শুরু হল। মুসলিম নারীরা তখন ঘরে বসে না থেকে ধীরে ধীরে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শুরু করলেন। শাসক দল তিন তালাক বিরোধী বিল পাস করে তাঁদের খুশী করার, তাঁদের ত্রাতা সাজার চেষ্টা করল। কিন্তু নাগরিকত্ব আইন আসার পর যখন মুসলিম মহিলারা দলে দলে রাস্তায় নেমে এলেন, বিভিন্ন শহরে শাহীনবাগ গড়ে উঠল, তখন এই প্রতিবাদী জনতাকে আটকানোর জন্য তারা নিত্য নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করল। প্রকাশ্যে নারীদের কুৎসা করা শুরু হল, তাঁদের যৌন অঙ্গভঙ্গির ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হল; সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে এব্যাপারে মিডিয়া পুরো নীরব রইল, যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব! এরফলে এতো সাংঘাতিক সব ঘটনাকে আজ মনে হচ্ছে স্বাভাবিক; বাস্তব হচ্ছে একটা বারুদের স্তুপ তৈরি হয়ে গেছে, যেটা থেকে যখন তখন বিস্ফোরণ হতে পারে, চূড়ান্ত নৈরাজ্য শুরু হতে পারে দেশজুড়ে।
ইসমত আরা এই অস্বাভাবিক পরিবেশে একজন মুসলিম সাংবাদিকের কাজ করার নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরেন। গৌরী যখন মারা যান তখন তিনি একজন শিক্ষানবীশ ছিলেন এবং তাঁকে হত্যার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ কভার করতে বলা হয়। এ’নিয়ে তাঁর মধ্যে নানা দ্বিধা দানা বাঁধে, তিনি ভাবেন আমি এটা করে নিজেকে বিপদে ফেলছি না তো। এখন ফোনে কারো থেকে কিছু জানতে চাইলে আমি চেষ্টা করি নিজের নাম না দেওয়ার, ইসমত বলেন।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই কলকাতায় যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবচেয়ে নিরাপদ মনে করা হয়, এখানে সাল্লি ডিলসের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে একমাস সময় লেগে গেছে। নুর মহভিশ, আইনের ছাত্রী বলেন তাঁকে অভিযোগ দায়ের করার জন্য বারবার থানায় যেতে হয়েছে, বারবার অফিসারদের কেসটা মনে করিয়ে দিতে হয়েছে।
তিস্তা শেতলওয়াদ বলেন, আজ বিষয়টা খালি অসহিষ্ণুতা নয়, ঘৃণা একটা রাষ্ট্রীয় প্রকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পকে রূপায়িত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু গৌরী-পরবর্তী প্রজন্মের সংগ্রামী নারীরা তাঁর লড়াই ও আদর্শে উজ্জীবিত। তাঁদেরকে চুপ করিয়ে দেওয়া যাবে না।
- সোমনাথ গুহ
নরেন্দ্র মোদী যা বলেন তার প্রতি তিনি বিশ্বস্ত থাকেন, এমন কথা কেউই জোর দিয়ে বলতে পারবেন না। সংসদে ঢুকে তিনি সংবিধানকে প্রণাম করেন, আবার বলেন “আমাদের সংবিধানই আমাদের সবাইকে এক সূত্রে বেঁধেছে”। এরপরও আমরা দেখি সংবিধানের লাগাতার লঙ্ঘন, সংবিধানে বিধৃত অধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করার নিরবচ্ছিন্ন সক্রিয়তা। প্রধানমন্ত্রী পদে ২০১৪ সালে বসার পরই নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ভারতের “গণতন্ত্র টিকবে না যদি না আমরা বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে পারি”। উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাঈয়া নাইডুর কণ্ঠেও শোনা গিয়েছিল, “সংবাদপত্রের ওপর যে কোনো আক্রমণই জাতীয় স্বার্থের প্রতি ক্ষতিকারক এবং সবাইকেই এর বিরোধিতা করতে হবে”। কিন্তু সাত বছরেরও বেশি নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি জমানায় সংবাদ মাধ্যমের প্রতি ঘোষিত এই গুরুত্ব উপেক্ষিতই থেকেছে, স্বাধীনতাকামী সংবাদ জগতের প্রতি, সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকদের প্রতি বৈরিতাকেই তারা জাহির করে এসেছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ‘দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন’ হতে হবে বলে তারা বলেছে, এবং দায়িত্ববোধের এই দাবি ঐ স্বাধীনতার কাছে কাঁটা বলেই প্রতিপন্ন হয়েছে। মোদী সরকারের সমালোচকরা, ভিন্নমত পোষণকারীরা যেমন সরকারের বিষ নজরে পড়েছে, সরকারের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির সরকারের দুরভিসন্ধির দিকে আঙুল তোলা সাংবাদিকদেরও সরকার তার নিশানা বানিয়েছে, দেশদ্রোহ ও ইউএপিএ’র মতো দানবীয় আইন তাদের কারান্তরীণ করেছে, দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় অভিযুক্ত হয়ে তারা হাঁসফাঁস করেছে, সাংবাদিক নামের পেশাটাই বিপন্নতার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। বৈরী জ্ঞানে বন্দিত যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণতা দেখিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন বিনোদ দুয়া, রাণা আয়ুব, মৃণাল পাণ্ডে, রাজদীপ সরদেশাই, বরখা দত্ত, প্রভৃতি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নির্ভীক সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত রেখে যাওয়া গৌরী লঙ্কেশের এই জমানায় হত্যাও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতি জমানার অসহিষ্ণুতাকেই নির্দেশিত করে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতি মোদী সরকার কতটা ক্রোধোন্মত্ত তার প্রতিপাদনে আমরা এখানে দুটো ঘটনার উল্লেখ করব।
গতবছর ২৬ জানুয়ারি তিন কৃষি আইন বিলোপের দাবিতে প্রতিবাদরত কৃষকরা বড় প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করলেন। প্রতিবাদের সেই কর্মসূচি পালনের সময় এক কৃষক মারা গেলেন। পুলিশ বলল ট্রাক্টর উল্টে কৃষকের মৃত্যু ঘটেছে। আর পরিবারের সদস্যরা বললেন — ঐ কৃষককে গুলি করে মারা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যকে তুলে ধরে খবর করায় নরেন্দ্র মোদী সরকার আট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করল — তাদের বিরুদ্ধে জাতীয় সংহতিকে বিপন্ন করে তোলা এবং এমনকি দেশদ্রোহের অভিযোগও পেশ হল। অভিযুক্ত সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন ‘দ্য ওয়্যার’ ওয়েব পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভরদরাজন। তিনি বললেন, “মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা ময়না তদন্তের রিপোর্ট বা মৃত্যুর পুলিশি ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাদের বিবৃতির ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করাটা কি মিডিয়ার পক্ষে অপরাধ?”
বাংলাদেশে দুর্গামণ্ডপে কোরান রাখার প্রতিক্রিয়ায় গতবছর অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে ত্রিপুরায় কয়েকটা মসজিদের ওপর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের হামলা হল, সংখ্যালঘুদের দোকানপাটও আক্রমণের মুখে পড়ল। বিজেপি শাসিত ত্রিপুরায় সংখ্যালঘুদের ওপর এই ধরনের আক্রমণের কথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অস্বীকার করলেও হামলার ভিডিও সমাজ মাধ্যমে ভাইরাল হল। ত্রিপুরা সরকার সমাজ মাধ্যমে ভিডিও তোলা ও শেয়ার করার জন্য ১০২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করল। এবং এফআইআর’এ বলা হল যে, এরা সমাজ মাধ্যমে ভিত্তিহীন খবর ছড়িয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বৈরিতাকে বাড়িয়ে তুলেছে, সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে আইনজীবী, সমাজ আন্দোলনের কর্মীরা ছাড়াও কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন। দু’জন সাংবাদিককে গ্ৰেপ্তার করা হয় এবং তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। প্রশাসনিক পক্ষপাতে গোটা ব্যাপারটায় এভাবে ওলটপালট ঘটে গেল। সাংবাদিক সহ যাঁরা ঘটনার তদন্তে নামলেন, প্রকৃত ঘটনাকে উন্মোচিত করলেন, বিজেপি প্রশাসনের চোখে তাঁরা হয়ে গেলেন অপরাধী, আর যারা হামলা চালাল তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব নিয়ে চলার, সরকারের সমালোচকদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ন মনোভাব পোষণের এই সরকারের কাছে সাংবাদিকদের কাজের স্বাধীনতার আমল না পাওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। চলমান ঘটনাবলীকে হিন্দুত্ববাদীদের অভিপ্রেত ধারায় উপস্থাপিত করতে অস্বীকার করা মুসলিম সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানও নরেন্দ্র মোদীদের প্রতিহিংসার লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়লেন। কিন্তু কেন?
সিদ্দিক কাপ্পান হলেন কেরলের সাংবাদিক এবং তিনি মালায়ালম ভাষাতেই লেখেন। কাপ্পান একটা গাড়িতে আর তিনজনের সঙ্গে যাচ্ছিলেন হাথরস, গণধর্ষিতা দলিত যুবতীর মৃত্যু এবং পরিবারের অনুমতি না নিয়েই পুলিশের তাকে রাতের অন্ধকারে দাহ করা সম্পর্কিত খবর সংগ্রহে। কিন্তু হাথরস পৌঁছানোর আগেই টোল প্লাজার কাছে গাড়ি থামিয়ে পুলিশ তাদের আটক করে ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর। পুলিশ বলে, গাড়িতে তার সঙ্গীরা ছিল পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার (পিএফআই) সদস্য এবং কাপ্পানের সঙ্গে এই সংগঠনের যোগ রয়েছে। আরও বলল, সাম্প্রদায়িক হিংসা উস্কিয়ে তোলার জন্য, সামাজিক অশান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই তিনি হাথরস যাচ্ছিলেন। পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া মুসলিম সংগঠন হলেও তা সরকার নিষিদ্ধ সংগঠন নয় এবং কেউ তার সদস্য হলে বা তারসঙ্গে কারো যোগ থাকলে সেটাকে অপরাধ বলে বিবেচিত করার যুক্তিগ্ৰাহ্য কোনো কারণ থাকতে পারে না। বিজেপি জানতো এবং তাদের পুলিশের কাছেও এই তথ্য ছিল যে, দিল্লীর নিজামুদ্দিনের মারকাজ মসজিদে তাবলিগি জামাতের ধর্মীয় জমায়েতই ভারতে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য দায়ী বলে বিজেপি ও তাদের প্রশাসন যে প্রচার চালাচ্ছিল, কাপ্পান তাঁর প্রতিবেদনে সেটাকে মিথ্যাচার বলে প্রতিপন্ন করেন; তাঁর প্রতিবেদনে দিল্লীর শাহিনবাগে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রতিফলিত হয়েছিল; দিল্লীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রকৃত উস্কানি কাদের ছিল তার উন্মোচন তিনি তাঁর লেখায় ঘটিয়েছিলেন; শাহিনবাগে সিএএ বিরোধী আন্দোলনস্থলের কাছে কপিল গুর্জর নামে হিন্দুত্ব সমর্থক যে গুলি চালিয়েছিল এবং “হিন্দু রাষ্ট্র জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিয়েছিল, সেটাকে তিনি গান্ধীর ওপর নাথুরাম গডসের গুলিচালনার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সংখ্যাগুরুর আধিপত্য জনিত উৎপীড়নকে মান্যতা দিতে না চাওয়া সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের বিজেপি’র বিষদৃষ্টিতে না পড়াটাই বিচিত্র ব্যাপার হত।
বিজেপি এবং উত্তরপ্রদেশ পুলিশ আরো জানতো আরএসএস মুখপত্র অর্গানাইজার-এর সহকারী সম্পাদক জি শ্রীধাথনের সঙ্গে সিদ্দিক কাপ্পানের সংঘাতের কথা। কাপ্পানকে গ্ৰেপ্তারের পর পুলিশ ৫,০০০ পৃষ্ঠার যে চার্জশিট দাখিল করে তাতে এই বাদানুবাদকে একটা বিষয় করা হয়েছে। ওয়েব পত্রিকা ‘নিউজলন্ড্রি’ কাপ্পান মামলায় তাদের তদন্তে জানিয়েছে — উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্কফোর্স চার্জশিট তৈরিতে ‘ইণ্ডাস স্ক্রলস’ নামক ওয়েবসাইট-এর প্রধান সম্পাদক এবং অর্গানাইজার-এর সহকারী সম্পাদক জি শ্রীধাথনের একটা মন্তব্যে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। শ্রীধাথন তাঁর লেখায় অভিযোগ পেশ করেছিলেন — জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রর মৃত্যু নিয়ে কাপ্পান ভুয়ো খবর ছড়িয়েছেন এবং তিনি পিএফআই’এর টাকা নিয়ে হিন্দু-বিরোধী সংবাদ প্রচার করে থাকেন। গ্ৰেপ্তার হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে কাপ্পান জি শ্রীধাথনের মন্তব্যের প্রতিবাদ করে তাঁর কাছে মানহানির মামলার নোটিস পাঠিয়ে লেখাটি সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানান এবং নোটিসে উল্লেখ করেন, “এটা অত্যন্ত ধিক্কারজনক ও নিন্দনীয় যে আপনাদের এই প্রকাশনায় মানহানির এরকম একটা প্রবন্ধ থাকবে যেটা নিজেই একটা ‘ভুয়ো খবর’।” উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্টে বলে, কাপ্পান সাংবাদিক না হয়েও নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে জাহির করেন। আবার তাঁর প্রতিবেদনগুলোতে প্ররোচনা সৃষ্টির জন্য কাপ্পান কি ধরনের লেখা লেখেন তা দেখানোর উদ্দেশ্যে পুলিশ তাদের চার্জশিটে কাপ্পানের লেখা ৩৬টা প্রতিবেদনও জুড়েছে! অতএব, নরেন্দ্র মোদীরা চায়, ‘দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন’ সাংবাদিকতা সেটাই হবে যেটা হিন্দুত্বর অনুগামী বলে দেখা যাবে এবং যেটা বিজেপি অনুসৃত নীতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে না। সুপ্রিম কোর্টে কাপ্পানের হয়ে মামলা লড়ছে ‘কেরল ইউনিয়ন অব ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস’। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের চার্জশিটের বিরুদ্ধে তারা যথার্থভাবেই বলেছে, “উত্তরপ্রদেশ পুলিশ যা করেছে তা সাংবাদিকতাকে অপরাধ বলে গণ্য করা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এটা সংবিধান প্রদত্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রকৃত স্পিরিটের বিরুদ্ধেই রায়।” কাপ্পান হিন্দুত্ব বিরোধী মনস্ক হওয়ায়, বিজেপি’র সংখ্যালঘু বিরোধী অনাচারের প্রতিবাদী হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের রোষ সহজেই বোধগম্য। এরপরও একটা প্রশ্ন জাগে — হিন্দুত্ববাদ বিরোধী অবস্থান নিয়ে লেখালেখি করায় অনেককে কেন্দ্রের ও বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলোর কোপে পড়তে হলেও সবাইকে দীর্ঘ কারাবাস ভোগ করতে হচ্ছেনা। কিন্তু কাপ্পানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি, নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বোধকে আহত করা, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং আরো অনেক অভিযোগ এনে, দেশদ্রোহী আইন ও ইউএপিএ প্রয়োগ করে ১৫ মাসেরও বেশি কারান্তরীণ করে রাখাকে অনুধাবন করতে গেলে সাংবাদিক সমর হরলঙ্কারের এই মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য, যেটি স্বাতী ভট্টাচার্য আনন্দবাজার পত্রিকায় ১০ জানুয়ারির সংস্করণে ‘একে সাংবাদিক, তায় সংখ্যালঘু’ শীর্ষক উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “সিদ্দিক কাপ্পান যেসব বিষয়ে লেখেন, তার অনেকগুলো নিয়ে আমিও লিখি, যেমন ভারতীয় রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য, মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য। তিনি যে জেলে আছেন, আমি নেই, তার কারণ আমি হিন্দু, এবং ইংরেজিতে লিখি।”
সাংবাদিকতাকে ‘দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন’ করতে চাওয়ার নরেন্দ্র মোদীদের তৎপরতা যেমন বস্তুনিষ্ঠ, সরকারের কাছে প্রশ্ন তোলা সাংবাদিকতাকে কোণঠাসা করেছে, অন্যদিকে তা উদ্ভব ঘটিয়েছে ‘গোডি’ মিডিয়ার যারা সরকারের প্রচারযন্ত্র হিসেবে কাজ করে চলে, বিজেপি-আরএসএস’এর সাম্প্রদায়িক দুরভিসন্ধিতে মদত জোগায়। ভুয়ো সংবাদ পরিবেশন করে, ঘৃণা ও ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের নিশানা বানায়; সরকারের নীতির সমালোচকদের, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরোধীদের, সত্য উদঘাটনের প্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ নামিয়ে তাদের দেশদ্রোহী, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী, পাকিস্তানপন্থী, মাওবাদী, শহুরে নকশাল বানিয়ে দেয়। এরই সাথে আবার আবির্ভাব ঘটেছে বিজেপির ট্রোল বাহিনীর —তারা সমাজ মাধ্যমে অন্যান্যদের সঙ্গে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও ঘৃণার অভিযান চালায়; আর সাংবাদিক নারী হলে ধর্ষণ এবং এমনকি হত্যার হুমকিও পান। ‘ফ্রি-স্পিচ কালেকটিভ’ সংস্থার পক্ষে গীতা সেসু তথ্য সংকলিত করে জানিয়েছেন, ২০২০ সালে ভারতে ৬৭ জন সাংবাদিক গ্ৰেপ্তার হয়েছিলেন এবং দৈহিক আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন প্রায় ২০০ জন। সংবাদ জগৎ এবং সাংবাদিকদের ওপর এই আক্রমণ আন্তর্জাতিক নজরেও এসেছে। ফরাসি এনজিও ‘রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস’ বিশ্বে সংবাদ জগতের স্বাধীনতার যে সূচক বার করে তাতে ভারতের স্থানের ক্রমাবনতি ঘটেছে বলে দেখা যাচ্ছে। তাদের মূল্যায়নে ১৮০টা দেশের মধ্যে ২০১০ সালে ভারতের স্থান ছিল ১২২, তারপর ২০১৬তে ১৩৩ থেকে ২০২১ সালে তা নেমে এসেছে ১৪২তম স্থানে। রিপোর্টে ভারত সাংবাদিকদের পক্ষে সবচেয়ে ‘বিপজ্জনক’ দেশগুলোর অন্যতম বলে যে অভিমত ব্যক্ত হয়েছে তার যথার্থতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। ২০২১ সালের রিপোর্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এমন ৩৭ জন রাষ্ট্রপ্রধানের তালিকায় রাখা হয়েছে যাঁরা হলেন ‘সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার লুণ্ঠনকারী’। নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে বলতে গিয়ে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, “সংবাদ জগতের ভালো অংশের মালিকানা থাকা শত-শত কোটির অধিকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে”, এবং তারা তাঁর “চূড়ান্ত বিভেদজনক ও নিন্দনীয়” বক্তৃতাগুলোকে প্রচারের আলোয় নিয়ে এসে তাঁর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের প্রসার ঘটায়। এই অভিমতের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হুবহু মিলে যায়। এবং এটা যে আবশ্যকতাকে তুলে ধরে তা হল, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার বিপর্যয় রোধে বিভেদকামী মতাদর্শের বিরুদ্ধে ও ক্ষমতা থেকে তার বাহকদের অপসারণের লক্ষ্যে লড়াইটা যেমন জরুরি, সেরকমই গুরুত্বপূর্ণ হল সংবাদ জগতের ওপর কর্পোরেট আধিপত্যকে খর্ব করা।
- জয়দীপ মিত্র
মৌর্য সম্রাট অশোককে নিয়ে দয়া প্রকাশ সিং-এর সাম্প্রতিক একটি বই অসত্য ঘটনা ও বিদ্বেষপূর্ণ। নানা কোণ থেকে প্রতিবাদ হওয়ার জন্য বিজেপি বলতেই পারে যে দয়া প্রকাশ সিং তাদের সংগঠনের কেউ নয়। কিন্তু সত্য হল, আরএসএস ভারতের ইতিহাস নিয়ে যে কর্মসূচি চালাচ্ছে এই প্রচেষ্টা তারই একটি অংশ। প্রথমে মুসলিম শাসকরা লক্ষ্যবস্তু ছিল, এখন দলিত পিছিয়ে পড়া বর্গের শাসকরা তাদের লক্ষ্যবস্তু।
ঐতিহাসিক সত্য হল, অশোক প্রথম জীবনে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে জয়লাভ করে ক্ষমতায় বসেন এবং তারপরে তাঁর অনুতাপের ফলে মানবিকতার উন্মেষ ঘটে এবং তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘ধম্ম’ প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপক বিস্তার ঘটান। তিনি কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব না করে সমস্ত ধর্ম ও ভাবধারাকে রাষ্ট্রীয় আশ্রয় দেন। অজীবন সমাজের জন্য অনেক হিতসাধন করেন। তাঁর ‘ধম্ম’ কর্মসূচির প্রতিরূপ ইতিহাসে প্রায় অমিল। সমাজে সমস্যা ও উত্তেজনা প্রশমনের জন্য ‘ধম্ম’ কর্মসূচি ছিল ঐকান্তিক। অশোক প্রজাদের হিতের জন্য বহু কিছু করেছেন এবং উদারতাও দেখিয়েছেন।
অশোককে লক্ষ্যবস্তু বানানোর পিছনে আরএসএস’এর দুটি কারণ আছে। প্রথমত বৌদ্ধ, জৈন এবং অজীবক গোষ্ঠী নিয়ে প্রচার ছিল চরিত্রগত দিক দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী। অশোক নিজে পিছিয়ে পড়া বর্গ থেকে শাসক হন। শুঙ্গদের আগে মগধের শাসন চলছিল পিছিয়ে পড়া বর্গের শাসকদের দ্বারা। ব্রাহ্মণ্যবাদের সমর্থক শুঙ্গরা যখন শাসক হল তখন বহু বৌদ্ধদের হত্যা করা হয়।
একই উদারতার পরিচয় দিয়েছেন আকবরও। তাঁর শাসনেও সব ধর্মের প্রতি তিনি একই আচরণ করেছেন। সংঘীরা তাদের ইতিহাস প্রকল্পে ঔরঙ্গজেবকে উগ্র ধর্মান্ধ বলে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। কিন্তু তারা উদাসীনতা দেখিয়েছে যে ঔরঙ্গজেবের আমলে মনসবদারী ব্যবস্থায় হিন্দুরা সর্বদা সর্বোচ্চ পদাসীন ছিলেন।
সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরো সদস্য কুণাল ইতিহাসকে বিকৃত করার এই অপচেষ্টার বিরোধিতা করে বলেন, সাম্প্রতিক কালে দলিত, পিছিয়ে পড়া বর্গ এবং সংখ্যালঘুদের ওপর বিজেপি ও সংঘ পরিবার ক্রমান্বয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে এবং এই লক্ষ্যেই তারা ইতিহাসে অনুপ্রবেশ করছে। ইতিহাসকে পাল্টে দেওয়ার এই কর্মসূচি বিজেপি তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে — এটা চলতে দেওয়া যায় না। অশোকের ধ্যানধারণা এবং অনুশীলনে রাষ্ট্রের ও সর্বধর্মের প্রতি সমভাবাপন্নতাকে অবহেলা করে ও তার থেকে শিক্ষা না নিয়ে সঙ্ঘীরা যে আক্রমণ করছে তার কারণ হল সঙ্ঘী-আরএসএস’এর ইতিহাস প্রকল্পে অশোক মোটেই খাপ খায় না।
“তোমার লেবুগাছের কড়াগুলি কত বড় হইসে? ডাক্তার বলছে, ছয়মাস পর ভাত খাইতে পারুম — কী জানি।” মেয়েটা উদাস গলায় বলেছিল। বেশ কয়েক মাস আগে। কতদিন ভাত খায় না। গরম ভাত। পাতলা মুসুর ডাল। গন্ধ লেবু দিয়ে মাছের ঝোল। প্রায় দু’বছর শুধু তরল পানীয় খেয়ে বেঁচে থাকা মেয়েটার মুখে আর কোনোদিন কোনো আক্ষেপ শুনিনি।
সত্যি কখনও ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে। বলা যায় না। এড়িয়ে যেতে হয়। আমার অজানা কোনও কারণে গন্ধলেবুর কড়াগুলো শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছিল। গাছটাও ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছিল। আমি সেকথা বলতে পারিনি ওকে। ও হেনরির সেই মর্মস্পর্শী গল্পটা মনে পড়ে গিয়েছিল।
প্রায় দু’বছর বীরাঙ্গনার মতো লড়ে অবশেষে হার মানতেই হল কালান্তক রোগের কাছে। ঠোঁটের ক্যানসার। তার বন্ধুরা, পরিবার, পার্টি কমরেডরাও অক্লান্ত লড়াই চালিয়েছিলেন সমান তালে। শেষ প্রায় একবছর তার শয্যার পাশে থাকা সেবিকা দিদিও প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন ওকে একটু ভালো রাখার। তবু চলে গেল স্বজন বন্ধু সংগঠন পড়শিদের অতি প্রিয় ‘কুহেলি’। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে। রেখে গেল ঊনিশ বছরের একমাত্র সন্তানকে, যে এগারো বছরে পিতৃহীন হয়েছিল। শবানুগমনে দল-মত-বয়স-লিঙ্গ নির্বিশেষে অগুন্তি মানুষের ভীড় দেখে বোঝা গেল ঐ ‘সাধারণ মেয়ে’র কী অসাধারণ ক্ষমতা ছিল মানুষকে আপন করে নেওয়ার!
কোনও কেতাবি পাঠ নিয়ে সে রাজনীতিতে আসেনি। এসেছিল জীবনের সুতীক্ষ্ণ অভিজ্ঞতা থেকে; কয়েকটি দরদী মানুষকে দেখে যারা ওর ভয়ঙ্কর সংকটে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, বিপর্যস্ত জীবনটা খানিক গুছিয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। তার সহজাত মানবিকতা তো ছিলই — যেটা ‘বামপন্থী’ হওয়ার জন্য আবশ্যিক।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ‘কুহেলি’ সংগঠনে একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। কমরেডদের প্রতি মমত্ব, প্রত্যেকের খোঁজ রাখা, অতুলনীয় সময়নিষ্ঠতা, প্রত্যেকটি কর্মসূচিতে তার উজ্জ্বল মুখর উপস্থিতি, সংগঠনের ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ বা কোনও কমরেডের কোনও আচরণ তার সাংগঠনিক বোধ থেকে অসঙ্গত মনে হলে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করা — যে কোনও সংগঠনের সম্পদ তার এই বৈশিষ্ট্যগুলো কোনোদিন ভোলা যাবে না।
কত দিনের কত কথা। মিছিল, পথসভা, পোস্টারিং, গণ অর্থসংগ্রহ অভিযান, পার্টি বৈঠক, পার্টি মুখপত্র নিয়ে আলোচনা, মহিলা সমিতির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান — সবেতেই সে উপস্থিত সবার আগে। দেরিতে আসার জন্য অন্যদের প্রতি বরাদ্দ ছিল তার বকুনি। একদিন পথসভার পর সবাই দোকানে চা খাচ্ছি। ও কিছুতেই খাবে না। কেন? না, গরম চা খেতে পারবে না। আমরা নীরবে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম সভয়ে। ওর ব্যাগে সব সময়ই ‘শিখর’এর প্যাকেট থাকতো। দিনে চার প্যাকেট। নিজেই জানিয়েছিল। কত বলেছি, ভয় দেখিয়েছি, “ছেলেটাকে অনাথ করে চলে যাবি?” কিছুতেই তাকে ঐ বিষ খাওয়া থেকে নিরস্ত করা যায়নি। গরম চা-সিঙাড়া খেতে না পারার সংকেত স্পষ্ট হওয়ার পর জানিয়েছিল, ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ততদিনে যা হবার হয়ে গেছে।
উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা পার্টি অফিস থেকে, কাঁচের গাড়িতে ফুলে ফুলে ঢাকা কমরেড কুহেলি বসুকে শেষযাত্রায় এগিয়ে দিলেন সিপিআই(এমএল), সিপিআই(এম)-এর স্থানীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে আইসা, এসএফআই’এর ছাত্রবন্ধুরা, আন্তর্জাতিক গাইতে গাইতে।
কিন্তু জীবনে এত বৈপরীত্য কেন? যে মানুষটা জীবনকে এত বর্ণময় প্রাণোচ্ছলতায় ভালোবাসতো, এই সেদিনও বিছানায় শুয়ে শুয়ে অসুস্থ কমরেডের বাড়ি ছেলেকে দিয়ে বাজার পাঠিয়েছে, কোনও দূরপনেয় গভীর চোরা অবসাদে সে দিনের পর দিন জেনেশুনে বিষ পান করে গেছে? প্রিয় সন্তানের কথাও ভাবেনি? আমরা শুধু বকেছি, কিন্তু সেই নৈরাশ্যের ঠিকানা কেন খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করিনি? কেন? কেন আমরা শুধু শারীরিক কুশল জানতে চাই, মনের অ-সুখের কথা মনে রাখিনা?
আজ মাছধোওয়া জল ফেলতে গিয়ে দেখি, মরা লেবুগাছের পাশ দিয়ে গজানো ছোট্ট চারাটা বেশ বড় হয়ে রোদ খুঁজছে। কিন্তু কুহেলি? আরেকটি কুহেলি কবে, কোথায়, কীভাবে পাব, যে বলবে, “সমিতির চান্দা দিতে তোমাগো মনে থাকে না ক্যান বুঝি না” বা “এত আগে ঠিক করা প্রোগ্রামে শেষমুহূর্তে আইতে পারবা না ক্যামনে কও?”
কমরেড কুহেলি! লাল সেলাম!
নতুন বসন্তের চিকণ সবুজে, লাল নিশানের ঝড় তোলা মিছিলে, বজ্রকণ্ঠের শ্লোগানে বেঁচে থাক! লড়াকু মানুষের মাঝেই পেয়ে যাব তোর ঠিকানা!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
এক মহিলা বারো বছর ধরে স্বামীর যৌন নির্যাতন সহ্য করেছেন। রাতের পর রাত। অসুস্থ অবস্থায়, কন্যার সামনেও, এমনকি যেদিন তার মা মারা যান সেদিনও রেহাই মেলেনি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে তিনি পারিবারিক আদালতের দ্বারস্থ হন। বিচার মেলেনি। অবশেষে তিনি বৈবাহিক ধর্ষণ থেকে মুক্তি পেতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন নিয়ে কেরালা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। গতবছর সেই মামলায় আদালত এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে।
কী এই বৈবাহিক ধর্ষণ? তা নিয়ে হঠাৎ এত বিতর্ক কেন? পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইন ২০০৫-এ শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও যৌন নির্যাতনের উল্লেখ আছে। তাহলে আলাদা করে বৈবাহিক ধর্ষণকে স্বীকৃতি দিতে হবে কেন?
বৈবাহিক ধর্ষণ হল ‘স্ত্রী’র অনিচ্ছা বা সম্মতি না থাকা সত্ত্বেও শারীরিক সম্পর্কে জোরপূর্বক লিপ্ত হওয়া বা কোনও বস্তু বা জিনিস স্ত্রীর যৌনাঙ্গে ঢোকানো এবং তার সমতুল্য কোনও কাজ। পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইনে ‘সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ’ হিসেবে এর উল্লেখ আছে বটে — ‘sexual abuse’ includes any conduct of a sexual nature that abuses, humiliates, degrades or otherwise violates the dignity of woman। কিন্তু আইনে নির্দিষ্টভাবে ‘ধর্ষণ’ হিসেবে স্বীকৃতি নেই আর এই আইনটি হলো ‘সিভিল ল’ বা দেওয়ানী আইন, আর ‘ধর্ষণ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মানে হল ‘ক্রিমিনাল ল’ বা ফৌজদারি আইন’এর আওতাভুক্ত হওয়া। একটু ভেঙে বলি। দেওয়ানী মোকদ্দমায় আদালত জরিমানা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি বিবেচনা করে আর ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে উল্লেখযোগ্য শাস্তি দেওয়া হয়। যেমন ধর্ষণের ফৌজদারি মামলায় কমপক্ষে ৭ বছরের জেল ও তৎসহ ক্ষতিপূরণের রায় দেওয়া হয়। আর পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইন যেহেতু দেওয়ানী মোকদ্দমা তাই এই আইনের আওতায় নির্যাতিতা বিবাহিত মহিলা নির্যাতন বন্ধের আদেশ পান, বসবাসের অধিকার পান, বাচ্চাদের কাছে রাখার অধিকার পান, ক্ষতিপূরণ পান ইত্যাদি। কিন্তু বৈবাহিক ধর্ষণ হিসেবে স্বীকৃতি না থাকায় জোরপূর্বক যৌন নির্যাতনের কোনও শাস্তি অভিযুক্ত ‘স্বামী’ পান না। বিবাহিত মহিলারা বাইরের পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হলে সেটা ধর্ষণ আর ঘরের ভিতরে ধর্ষিত হলে সেটা পারিবারিক ব্যাপার! স্ত্রীর দায়িত্বই তো স্বামীর সেবাযত্ন করা, স্বামী বা মালিক ইচ্ছেমত তাকে ব্যবহার করতেই পারেন!
ভারতীয় পেনাল কোডেও বিবাহিত মহিলাদের ধর্ষণ ও সম্মতির (কনসেন্ট’এর) বিষয়টিকে রীতিমত জগাখিচুড়ি পাকিয়ে দেওয়া আছে। পেনাল কোড ৩৭৫-এ রেপ বা ধর্ষণের সংজ্ঞা অনুযায়ী সেকশন-৪ এবং ব্যাতিক্রম হিসেবে উল্লেখই আছে যে — আইনত স্বামী ছাড়া অন্য কেউ ধর্ষণ করলে তবেই সেটা ধর্ষণ এবং ১৫ বছরের উপরে বিবাহিত মহিলাদের সঙ্গে স্বামীর কোনও রকম যৌনসঙ্গম (ইন্টারকোর্স) ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে না। এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন জড়িয়ে। যে জায়গা থেকে পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী আইনটাও সিভিল আইন হিসেবে পরিগণিত — সেই বিষয়টি হল, মেয়েরা এটা শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠে — পতি পরম গুরু, স্বামীই ধর্ম। ছোটবেলায় বাবার অধীনে, তারপর স্বামী, তারপর পুত্রের অধীনে থাকাটাই নারীর জন্য শাস্ত্রসম্মত বিধান — এই ধারণা ছোট থেকে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। তারা শেখে ‘মানিয়ে নেওয়া’। মেয়েদের পড়াশোনার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তথা আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার প্রশিক্ষণটা সেখানে গৌণ, গুরুত্বহীন! ‘ভালো স্ত্রী’ হওয়াটাই বড় কথা! ফলত আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়াটাও হয়ে ওঠে না। কোনওক্রমে যোগ্যতা অর্জন করে চাকরি করলেও তার উপার্জন পুরোটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যায় পরিবার সামলাতে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মহিলারা খুব স্বাভাবিকভাবেই নির্যাতিত হলেও চান যে স্বামী নির্যাতন বন্ধ করুন কিন্তু তার সঙ্গেই থাকুন। না থাকলে খোরপোষটুকু দিন কিন্তু শাস্তি দিতে চাননা বা বলা ভালো, তাদের বেড়ে ওঠা/গড়ে ওঠা পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ তা চায় না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দাবি করা হচ্ছে, বৈবাহিক ধর্ষণ আইনের স্বীকৃতির। একটা আইন সবসময় যেকোনও রকম সামাজিক মূল্যবোধের ঊর্ধ্বে। বিচার বা জাস্টিসকে প্রতিষ্ঠিত করাই তার অন্যতম উদ্দেশ্য, সামাজিক প্রেক্ষিত মাথায় রেখেও। আইন থাকলে তার পক্ষে প্রচার করা যায়, লড়াই করা যায়। আইনে স্বীকৃতই যদি না হয়, মহিলারা প্রতিবাদে এগিয়ে আসবেন কী করে?
দ্বিতীয়ত, দিল্লী হাইকোর্ট ৪ বছর আগে একটি রায়ে বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকৃতির বিপক্ষে বলেছিল — একজন বিবাহিত মহিলা তার স্বামীর যে কাজ ধর্ষণ হিসেবে দেখছেন, অন্যদের কাছে নাও হতে পারে সেটা সেরকম। বৈবাহিক ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বিবাহ প্রতিষ্ঠানটা হুমকির মুখে পড়বে। কারণ তিনি বিবাহিত এবং স্বামী যাই করুন সেটাই চূড়ান্ত বৈধ। বিবাহ প্রতিষ্ঠান নামক একটা পুরুষতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাটাই সমাজের একমাত্র পবিত্র কর্তব্য!
আমরা বলতে চাই — ধর্ষণ হয়েছে কিনা তার একমাত্র মাপকাঠি হল একজন মহিলা কোনওভাবে ভায়োলেটেড হয়েছেন কিনা তার সম্মতি ছাড়া, অন্যকিছু কখনোই নয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ যা মহিলাদের আচরণবিধি, জামাকাপড়, যাপন পদ্ধতি সব নির্ধারণ করে সেগুলো কখনই ধর্ষণের মাপকাঠি হতে পারে না। বৈবাহিক ধর্ষণকে অস্বীকার করা মানে সেই পুরুষতান্ত্রিক ধারণাকে স্বীকৃতি দেওয়া, যে স্বামীর অধিকার আছে স্ত্রীর শরীরের উপর, তাকে ভায়োলেট করার, এবং স্ত্রী একজন মহিলা হিসেবে বাধ্য তার স্বামীর সমস্তরকম যৌন চাহিদা সে যখন চাইবে, মেটাতে। অর্থাৎ বিবাহে ‘না’ বলার অধিকার কোনও মহিলার থাকতে পারে না, একজন স্ত্রী সবসময়ই যৌনবস্তু হিসেবেই পরিগণিত হবেন — এই বস্তাপচা পিতৃতান্ত্রিক সামন্তী ধারণাকে ছুঁড়ে ফেলার সময় এসেছে। একজন নির্যাতনকারীর একমাত্র পরিচয় সে নির্যাতনকারী — সে স্বামী হোক, বাবা হোক, দাদা হোক, কাকা হোক, আত্মীয় হোক, অপরিচিত হোক। কোনও সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে, ‘ধর্ষণ’ হয়েছে কি হয়নি তা নির্ধারণ করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। ‘সম্মতি’ ছিল কি ছিল না — সেটাই একমাত্র বিচার্য।
তৃতীয়ত প্রশ্ন ওঠে যে, এই স্বীকৃতি দেওয়া হলে বহু মিথ্যা কেস আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি। খুবই আজব ব্যাপার, যে কোনও আইনেই এই মিথ্যা কেসের ভাণ্ডার থাকে। কিন্তু প্রশ্নটা তোলা হয় শুধু মহিলাদের অধিকার নিশ্চিতকারী আইনগুলো নিয়ে! যে দেশে প্রতিদিন ৩০৭ জন মহিলা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন, সেখানে সত্যিই এই ধরণের প্রশ্নগুলো অবান্তর শুধু নয়, উদ্দেশ্যে প্রণোদিত।
গতবছর কেরালার হাইকোর্টে তার ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়েছিল, বিবাহিত নারী-পুরুষের ক্ষেত্রেও সম্মতিহীন যৌনসঙ্গম ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ যা পাশবিক, নৃশংস এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর আক্রমণ। আইনে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ না হলেও, বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসাবে গ্রাহ্য হতে পারে।
এবছর ন্যাশনাল উইমেন্স কমিশনের তরফে ‘ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট’ নিয়ে আলোচনা চলছে, প্রয়োজন বৈবাহিক ধর্ষণের স্বীকৃতির দাবিতে আরও সরব হওয়া।
প্রয়োজন বাকি লড়াইটার। প্রয়োজন সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন। চাই নারীর ক্ষমতায়ন, স্বায়ত্ততা ও সমানাধিকার।
- সৌমি জানা
৩০-৩১ জানুয়ারির মধ্যরাতে জলপাইগুড়ি জেলার দীর্ঘদিনের সিপিআই(এমএল) সদস্য বাবু মজুমদার প্রয়াত হয়েছেন। দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টজনিত অসুখে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩। বাবু মজুমদার নকশালবাড়ি আন্দোলনের শুরুতে সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে কুচবিহার জেলায় কাজ করতেন। পরবর্তীতে জলপাইগুড়িতে ফিরে আসেন। ভারতীয় ডাকঘরে চাকরিতে যোগদান করেন। প্রথম থেকেই কর্মচারীদের সংগঠিত করার কাজে ইউনিয়নের কাজে যুক্ত হন। ন্যাশনাল ফেডারেশান অব পোস্টাল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের মূল সংগঠক হিসাবে জনপ্রিয় ছিলেন।
কমরেড বাবু মজুমদার লাল সেলাম।
== সমাপ্ত ==