নাট্যকার মনোরঞ্জন বিশ্বাসের জন্ম ১৯২৪ সালে পূর্ব বাংলার দর্শনায়। প্রয়াণ ২১ জানুয়ারি ২০২২। স্কুল পাশ করেন পশ্চিমবাংলার ‘রানাঘাট লালগোপাল পাল হাইস্কুল’ থেকে। তারপরে সেকালের রিপন, অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ও কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে স্নাতক হন। স্নাতক হয়েই সংসার সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়। জীবিকার জন্য ছিলেন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কর্মী। কিন্তু সে যদি পেশা হয়, আজীবন কলাচর্চা ছিল ধ্যানজ্ঞান।
কলেজের ছাত্র থাকাকালীন নাটক রচনার সূত্রপাত। প্রথম নাটক কর্মখালি। নাটক লিখেই প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন প্রখ্যাত নাট্য সমালোচক সাধন ভট্টাচার্য ও অজিতকুমার ঘোষের। নাট্যরচনা তো ছিলই, তারসঙ্গে চিত্রকলা ও সঙ্গীত সাধনা ছিল সঙ্গী। পাশাপাশি বাম মতাদর্শের রাজনীতি, কৃষক আন্দোলন, সেইসূত্রে জেলখাটা।
ভিতরের বামপন্থী দর্শন আর শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতায় নেমেছিলেন কৃষকের সঙ্গে মাঠে, আন্দোলনে, জমি ও ধানের লড়াইয়ে। সেই লড়াইকে তিনি মাঠ থেকে পৌঁছে দিলেন মঞ্চে। মঞ্চ থেকে মানুষের মধ্যে। একই সঙ্গে রাজনীতি, আন্দোলন ও সংস্কৃতিচর্চা। পটভূমি হল রাজারহাট থানা ও বাগুইআটি অঞ্চল। ‘চলতিবাসর’ সংস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শুরু হল সংস্কৃতি-যাত্রা। সময়টা পাঁচের দশকের গোড়ার কথা। হলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ধরলেন কলম। শুরু হল একের পর এক নাটক রচনা। একে একে লিখলেন — আমার মাটি, আবাদ, ঝড়ের কাছাকাছি, পদাতিক, রণক্ষেত্রে আছি, সারা আকাশ লাল, কমিউনার্ড, নিষিদ্ধ ভাত নিষিদ্ধ অস্ত্র, সব যুদ্ধ থেমে গেলে, সাদা অন্ধকার, দাদন, আসন্ন যুদ্ধের সামনে, ভাসান, জননী, ভাঙা কাস্তের গান, বেঁচে থাকার দরজা, প্রতিদিন মে দিবস, একমাত্র অস্ত্র, খাস দখল, কাছেই সমুদ্র, লাল নীল মাছ-এর মতো প্রায় অর্ধশতাধিক মঞ্চ ও শ্রুতি নাটক। মনোরঞ্জন বিশ্বাস বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক নিভৃত সেবক। বড়ো নিভৃতচারী শিল্পী। বড়ো অভিমানী তাঁর হৃদয়। মতাদর্শের সামান্যতম ক্ষয় দেখলেই তিনি সরে আসতেন নিজের মনের কাছে। একাকীত্বে। নাটক রচনার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাসও লিখেছেন। তবে মনে প্রাণে তিনি নাটকের কাছে যেন দায়বদ্ধ। করেছিলেন সম্পাদকের কাজও। নন্দন সাহিত্য পত্রিকার আত্মপ্রকাশ পর্বের সম্পাদক। কিন্তু আদর্শের সঙ্গে কোনো আপস না করার কারণে আদর্শের দ্বন্দ্বে বারে বারে নতুন নতুন পত্রিকায় করেছেন আত্মপ্রকাশ। কার্টেন, চারণ, সপর্য্যা, পূর্বদেশ, সবশেষে আরণিক — একের পর এক পত্রিকা বেরিয়েছে তাঁর হাত দিয়ে। তবু শতাব্দী ছুঁই ছুঁই মানুষটির চিন্তায় ও কলমে সময়ের ক্লান্তি কোন জং ধরাতে পারেনি।
গত অক্টোবরে বেরিয়েছিল আরণিকের আপাত বর্তমান সংখ্যা। স্বপ্ন ছিল ধর্ম-দর্শন ও রাজনীতি নিয়ে আরণিকের পরের সংখ্যা করা। স্বপ্নের লাটাইটা আমাদের হাতে দিয়ে চলে গেলেন।