গত ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ সকালে বিহারের মুজাফ্ফরপুরের ‘বেলা’ শিল্পাঞ্চল এলাকায় কুরকুরে নুডলস্ কারখানার ২নং ইউনিটে একটি বয়লার ভয়ঙ্কর শব্দে ফেটে পড়ে। ঘটনার অভিঘাত এতটাই যে অকুস্থল থেকে ৫ কিমি দূরের ঘরবাড়ি বিল্ডিং কেঁপে ওঠে। আকাশ থেকে নামতে থাকে অসংখ্য লোহার টুকরো। সর্বত্র আতঙ্কের সৃষ্টি হয় আসন্ন ভূমিকম্পের সম্ভাবনায়। প্রত্যক্ষদর্শী পিন্টু, যিনি দুর্ঘটনায় মৃত সন্দীপ কুমারের তুতোভাই, অভিযোগ করেন গত ছ’মাস যাবৎ বয়লারে ফুটো ধরা পড়ে। বারংবার কারখানার ম্যানেজার উদয় শঙ্কর এবং অন্যান্য পরিচালন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও কোনও ফল হয়নি। বয়লার ঐ অবস্থাতেই চলতে থাকে এবং তা ফেটে পড়ে ২৬ ডিসেম্বর। জেলা প্রশাসন মৃতের সংখ্যা ঘোষণা করে ৭ জন। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা এবং কারখানার শ্রমিকরা বলেন মৃতের সংখ্যা ও আহতের সংখ্যা কয়েক ডজন হবে। যেহেতু সময়মতো বয়লার সংক্রান্ত অভিযোগের নিষ্পত্তি করেননি পরিচালন কর্তৃপক্ষ, তাই ঘটনার জন্য তারা পুরোপুরি দায়ী। একমাত্র উচ্চপর্যায়ের তদন্তে জানা যাবে প্রকৃত সত্য।
কারখানার এক শ্রমিক পঙ্কজ বললেন, “সকালে ডিউটি করতে এসেছিলাম। হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে বয়লার ফেটে কারখানার ছাদ উড়ে যায়। অনেক শ্রমিকের ছিন্নভিন্ন দেহ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কোনোরকমে নিজের প্রাণ বাঁচাই।” আরেক শ্রমিক বিকাশ যাদব বললেন, “আমার বাবা লালন ঐ বয়লারের হেড অপারেটর ছিলেন। তিনি দুর্ঘটনায় মৃত। ছ’মাস আগেই ধরা পড়ে বয়লারের ফুটো ও সেফটি ভালভ্ কাজ করছে না। অভিযোগে কাজ না হওয়ার প্রতিবাদে শ্রমিকরা ২ দিনের ধর্মঘটও করেন।”
স্থানীয় আবাসিকরা বলেন প্রশাসনের ঘোষণা অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সংখ্যা তাঁরা বিশ্বাস করেন না। ২৬ ডিসেম্বর অন্তত ১৫০ জন শ্রমিক কারখানায় কাজ করছিলেন। কর্তৃপক্ষ বলেন ৭ জন মৃত ও ৭ জন আহত। কারখানায় ঐদিনের কর্মরত শ্রমিকের কোনও তালিকাও তারা দেননি।
‘বেলা’ শিল্পাঞ্চলে ২৫০’র বেশি কারখানা আছে। শ্রমিকের সংখ্যা ৪০,০০০’র বেশি। বেশিরভাগ কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থার মান ও যন্ত্রপাতির খামতি আছে। মোদী নুডলস্ (কুরকরে) কারখানার উপযুক্ত ছাড়পত্রও নেই। শ্রম আইন মেনে চলা হয় না। বেশিরভাগ শ্রমিক চুক্তি প্রথায় দৈনিক ১০-১২ ঘন্টা কাজ করেন। বেতন সাকুল্যে ৪,০০০-৫,০০০ টাকা মাসিক। ঐ শিল্পাঞ্চলে কোনও অগ্নিনির্বাপণ বাহিনী নেই। নেই কোনও হাসপাতাল। এসমস্ত কিছুই চলছে কারখানার মালিক ও প্রশাসনের অশুভ আঁতাতে। নীতীশ সরকার ও শিল্পমন্ত্রী এরজন্য সম্পূর্ণ দায়ী। এইজন্য বেলা শিল্পাঞ্চলে প্রতিটি কারখানা উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি দ্বারা তদন্ত করাতে হবে।
বিহার সরকারের ভূল শিল্প কর্মসূচী ও অবহেলার জন্য শুধুমাত্র বেলা শিল্পাঞ্চলের ঘটনা একমাত্র উদাহরণ নয়। কয়েকদিন আগেই বারাউনি ও সুগাউলিতে একই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সরকারের টনক নড়েনি।
উপরোক্ত সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেছেন সিপিআই(এমএল)-র তদন্তকারী টীম। টীমের নেতৃত্বে ছিলেন ফুলওয়ারি শরিফের বিধায়ক গোপাল রবিদাস। দ্রুত তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে কুরকরে কারখানা ও হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। তাঁরা অন্যান্য কারখানাও পরিদর্শন করেন। সিপিআই(এমএল) বিহার রাজ্য সম্পাদক কুণাল বলেন, নীতীশের জমানায় ক্রমশই কারখানার সংখ্যা নিম্নমুখী, কতিপয় বেসরকারি কারখানা চলছে কিন্তু তাদের প্রতি সরকার অমনোযোগী। এইসব কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার মান নিদারুণভাবে ভাঙ্গা হচ্ছে। কারখানার মালিকরা প্রশাসনকে সংকুচিত করেছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অবহেলা করেছে, ফলস্বরূপ বহু সংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু প্রশাসন মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে লুকোছাপা করছে। মৃতের পরিবারকে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ও পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দিতে হবে। আহতদের প্রত্যেককে ২৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে। কারখানার ম্যানেজারকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে হত্যার মামলা দায়ের করতে হবে। ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করতে হবে। বিধায়ক গোপাল রবিদাস অভিযোগ করেন, কারখানা ম্যানেজার সরকার এবং বিজেপির সমর্থনপুষ্ট। তাই ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত আবশ্যক। দুর্ঘটনার তদন্তকারী টীমে অন্যান্য সদস্যরা হলেন মুজাফ্ফরপুর জেলা সম্পাদক কৃষ্ণ মোহন, শত্রুঘ্ন সাইনি, আফতাব আলম, ফাহাদ জামান, আসলাম রহমানি, মনোজ যাদব, মোহঃ আইজাজ, আকবর-ই-আজম সিদ্দিকি, নৌসাদ আলম এবং আমোদ পাসওয়ান।
তিনবছর আগে মুজাফ্ফরপুর জেলার বোছাহানে একটি কারখানায় আগুন লেগে ১১ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সরকার, প্রশাসন সেই ঘটনা থেকে কোন শিক্ষাই নেয়নি। সিপিআই(এমএল) এবং এআইসিসিটিইউ মুজাফ্ফরপুর শহরে প্রতিবাদ মিছিল করেন ২৮ ডিসেম্বর। পরের দিন ২৯ ডিসেম্বর নীতীশ কুমার ‘সমাজ সুধার যাত্রা’র জন্য মুজাফ্ফরপুর শহরে পরিদর্শনে আসে। মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী অপরাধজনক অবহেলার দায় অস্বীকার করতে পারেন না।