এমএসপি-র আইনি গ্যারান্টি : কৃষি ও কৃষকদের রক্ষায় হবে এক জরুরি পদক্ষেপ
Guarantee of MSP

মাত্র দিন তিনেক আগের কথা। মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের চাষি বাপ্পু কাভাডে ২৪ বস্তায় ১১২৩ কেজি পিঁয়াজ বিক্রির জন্য পাঠালেন কমিশন এজেন্ট রুদ্রেশ পাটিলের কাছে। পিঁয়াজ বিক্রি হল, বিক্রির রসিদও কাটা হল এবং তাতে মোট দাম দেখানো হল ১৬৬৫ টাকা ৫০ পয়সা। হিসেব কষে দেখা গেল চাষি পিঁয়াজের দাম পেয়েছেন কেজি প্রতি ১ টাকা ৪৮ পয়সা দরে। বাপ্পু কাভাডের নিজের জায়গা থেকে কমিশন এজেন্টের দোকানে পিঁয়াজ পাঠাতে খরচ হয়েছিল ১৬৫১ টাকা ৯৮ পয়সা (পরিবহণ, পিঁয়াজ গাড়িতে ওঠানো-নামানো এবং ওজন মাপার মোট খরচ)। অর্থাৎ, বিক্রির জন্য পাওয়া টাকা থেকে পিঁয়াজ পাঠানোর খরচ বাদ দিয়ে চাষি কাভাডে পেলেন মাত্র ১৩ টাকা ৫২ পয়সা। ১৬৫১ টাকা ৯৮ পয়সা খরচের যে হিসেব আমরা দেখলাম, তার বাইরে রয়ে গেল পিঁয়াজ উৎপাদনের খরচ — জমি তৈরি, বীজ-সার-কীটনাশক কেনা ও ফসল তোলার জন্য মোট ব্যয়। পিঁয়াজ চাষ করতে গিয়ে চাষি বাপ্পু কাভাডের অতএব অনেক ক্ষতিই হল। কমিশন এজেন্ট রুদ্রেশ পাটিল জানিয়েছেন — অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে পিঁয়াজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, গুণমান ভালো ছিল না, তাই দাম অত কম হয়েছে। চাষি কাভাডে পিঁয়াজ কোনো মাণ্ডিতে বিক্রি করতে পারলেন না, যেখানে সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি-তে চাষি উৎপাদিত শস্য বিক্রি করতে পারেন। পিঁয়াজের এমএসপি থাকলে কি চাষি কাভাডেকে এত ক্ষতি স্বীকার করতে হত? বৃষ্টিতে পিঁয়াজের গুণমান কতটা খারাপ হয়েছিল তা জানা যায়নি, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া চাষির জন্য ভর্তুকির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ কি একেবারেই অভাবনীয় বিবেচনা? চাষকে লাভজনক জীবিকা করে তুলতে চাষিরা যে এখন এমএসপি-র গ্যারান্টি দেওয়া আইন তৈরির দাবি তুলছেন, চাষি বাপ্পু কাভাডের লোকসানের নিদর্শন কি তার যাথার্থ্যকেই জোরালো করছে না?

কৃষক স্বার্থ বিরোধী তিন কৃষি আইন বাতিল হওয়ার পরও কৃষকরা ছ-দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন যার মধ্যে অন্যতম প্রধান দাবি হল ফসল বিক্রির জন্য কৃষকের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি লাভ সুনিশ্চিত করতে সরকারকে আইন তৈরি করতে হবে। নরেন্দ্র মোদীও এক সময় কৃষকদের উৎপন্ন ফসলের জন্য এমএসপি-র দাবি তুলেছিলেন। কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “শুধু আমরাই নয়, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় নরেন্দ্র মোদী একটা আর্থিক কমিটির প্রধান ছিলেন যাতে অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও ছিলেন। সে সময় তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর কাছে একটা রিপোর্ট পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘কৃষকরা যে এমএসপি পায় না তা কেন করা হবে না। এমএসপি নিয়ে একটা আইন সরকারকে করতে হবে।’ হয় আগেকার সেই রিপোর্টটায় মিথ্যা বলা হয়েছিল, আর না হয় মোদী আজ নিজের সিদ্ধান্তকেই রূপায়িত করতে চান না।” এ কথা ঠিকই যে, মোদী কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের এবং কৃষকদের প্রতিনিধি, কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষি অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটা কমিটি গঠনের কথা বলেছেন যার লক্ষ্য হবে “এমএসপি ব্যবস্থাকে আরো কার্যকরী করা।” কিন্তু মোদী কি আন্তরিকভাবেই এমএসপি-র পক্ষে? এমএসপি-কে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যেই কি তাঁর সরকার কৃষি আইন বানায়নি? তিনটে কৃষি আইনের যেটা কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন সম্পর্কিত ছিল, যেটাতে মাণ্ডির বাইরেও ফসল বিক্রির “স্বাধীনতা” কৃষকদের দেওয়া হয়েছিল, সেই আইনটা এপিএমসি (মাণ্ডি পরিচালক) বাইপাস আইন" নামেও সুবিদিত ছিল। সরকারপন্থী অর্থনীতিবিদ ও ভাষ্যকাররা আজ এমএসপি-র আইনসিদ্ধতার বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে গিয়ে বলছেন যে, এমএসপি পাওয়াকে সুনিশ্চিত করাটা বাজেটের সাধ্যে কুলোবে না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত সাহও বলছেন যে, এমএসপি-তে ফসল কিনতে গেলে সরকারের ১৭ লক্ষ কোটি টাকা লেগে যাবে যে পরিমাণটা কেন্দ্রীয় বাজেটের অর্ধেক। তিনটে কৃষি আইন অধ্যয়ন করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট যে কমিটি বানিয়েছিল তার অন্যতম সদস্য ছিলেন অনিল ঘানওয়াত। তিনি বাতিল হওয়া কৃষি আইনগুলোর সমর্থক ছিলেন বলেই আমরা জানি। এই ঘানওয়াতও বলছেন, “সমস্ত রাজস্বই এই দিকে (এমএসপি-তে ফসল কিনতে) চালিত করতে হবে এবং রাস্তা, সেতু, ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো অর্থ আর সরকারের থাকবে না। …” এমএসপি বিরোধীদের আরও যুক্তি হল, এমএসপি-র আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলে বেসরকারি ক্ষেত্রের ব্যবসাদারদেরও এমএসপি-তে ফসল কিনতে হবে যা শুধু বাজারের ওপর অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপই হবে না, তা শস্যের মূল্যস্ফীতিও ঘটাবে। কষ্ট স্বীকারই কি তবে উপভোক্তাদের অনিবার্য নিয়তি হবে? এই প্রসঙ্গে কৃষক নেতা যোগেন্দ্র যাদব কি বলছেন শোনা যাক — “খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলা যায়, একে নিয়ন্ত্রণ করার পথ হল দরিদ্রের ভর্তুকিতে খাদ্য সরবরাহ করা, উৎপাদকদের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত করা নয়। বাস্তব ঘটনা হল, সমাজ-সংক্রান্ত সামগ্ৰিক লক্ষ্যের পূরণে সারা বিশ্বেই “মুক্ত বাজার”কে নিয়ন্ত্রিত করা হয় এবং তা অবশ্যই করতে হবে। গোটা দুনিয়াতেই কৃষকদের ভর্তুকি ও মূল্য সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে।”

Guarantee of MSP_0

বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, তিন কৃষি আইনের বিরূদ্ধে কৃষকদের লড়াইটা ছিল সরকার অনুসৃত কৃষি নীতিমালার বিরুদ্ধেই লড়াই। এই নীতিমালার অনুসরণেই কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেটদের প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছিল, আর কৃষকদের উৎপন্ন ফসলের দাম হয়ে উঠছিল অলাভজনক। শস্য উৎপাদনের জন্য কৃষকরা যে বীজ, সার, কীটনাশক, যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন তা কর্পোরেটদের ভুরি-ভুরি লাভ এনে দিচ্ছিল, কিন্তু ফসলের লাভজনক দাম অধরাই থেকে যাচ্ছিল। নীতি আয়োগের চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬-র মধ্যে চাষবাস থেকে প্রতিবছর আয়ের বৃদ্ধি সীমিত থেকেছে ০.৫ শতাংশের মধ্যে, অর্থাৎ, আয় বলতে গেলে বাড়েনি এবং এমনকি হ্রাসও পেয়েছে। এমএসপি-র আইনসিদ্ধ হওয়ার দাবি তাই কৃষিকে রক্ষা করার, চাষবাসকে মর্যাদাপূর্ণ ও গর্বের জীবিকা করে তোলার দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। সরকার ২৩টা ফসলের এমএসপি ঘোষণা করলেও সব ফসল কৃষকদের কাছ থেকে এমএসপি-তে কেনেনা। এমএসপি আইনসিদ্ধ হওয়ার পর শস্যগুলো এমএসপি-তে কিনতে বাধ্য হওয়ার জন্য যারা ১৭ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার আতঙ্ককে ফেরি করছেন তার মধ্যে অতিশয়োক্তি ও গূঢ় অভিসন্ধি আছে বলেই মনে হয়। আর একবার যোগেন্দ্র যাদবের অভিমত অনুসরণ করা যাক : “এমএসপি-কে যদি স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ করা স্তরেও তোলা যায়, সেক্ষেত্রেও ব্যয় হবে ২.২৮ লক্ষ কোটি টাকা (বাজেটের প্রায় ৭.৮% এবং জিডিপির ১.২%)। ভারত তার জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশর কল্যাণের জন্য কি এই ঝুঁকিটা নিতে পারবে না? বাস্তব এই প্রশ্নটার মুখোমুখি দেশকে হতে হবে।”

আমরা সবাই জানি, মূলত কর্পোরেটদের দেওয়া ঋণ আদায় করতে না পেরে লক্ষ-লক্ষ কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর খাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়। ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বকেয়া ঋণ আদায় করতে না পেরে ব্যাংকগুলো তাদের খাতা থেকে মুছে দিয়েছিল ৮৮৩১৬৮ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ, যার মধ্যে মোদী জমানায় শুধু ২০১৯-২০ অর্থবর্ষেই মোছা হয়েছিল ২৩৭২০৬ কোটি টাকা, এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাংকগুলোর অংশ ছিলো ৭৫ শতাংশেরও বেশি। এমএসপি আইনসিদ্ধ হওয়ার মধ্যে যাঁরা অর্থনীতির বিপর্যয়ের কথা ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছেন, ব্যাংকগুলোর এই বিপুল ক্ষতির জন্য কর্পোরেট শঠতার বিরূদ্ধে কোনো প্রশ্ন তাঁরা কি কখনো তুলেছেন?

কৃষিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার মধ্যে, কৃষির বাজারমুখী সংস্কারের মধ্যে যাঁরা কৃষির পরিত্রাণ দেখতে পাচ্ছেন, তাঁরা কি বিশ্বের অন্যত্র এর পরিণাম সম্পর্কে অবহিত আছেন? বিশ্বের অন্যান্য স্থানে, বিশেষভাবে উন্নত যে দেশ গুলোতে কৃষির বাজারমুখী জোরালো সংস্কার হয়েছিল, কৃষির কর্পোরেট চালনা প্রাধান্য পেয়েছিল, সেখানেও কি কৃষি ও কৃষকদের মঙ্গল হয়েছিল? কৃষি বিশেষজ্ঞ দাবিন্দার শর্মার বক্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য — “আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ ও চীনে কৃষির বেসরকারিকরণ ব্যর্থ হয়েছে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়; আর তাই কৃষকদের খরচ ও লাভের পরিমাণের বাস্তবতাকে কৃষি নীতির অঙ্গ না করলে কৃষি ক্ষেত্রের সমৃদ্ধি ঘটবে না।”

তাছাড়া, এমএসপি আইনসিদ্ধ হলে কৃষকদের অভাবি বিক্রিও ভালোমাত্রায় হ্রাস পাবে। এমএসপি-র আইনসিদ্ধতা জনিত সরকারের ব্যয়কে শুধুই খরচ হিসেবে দেখলে চলবে না। শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ভাঁটা চলছে; বিশেষভাবে নোট বাতিল এবং করোনা কারণে লকডাউনের পর এই ক্ষেত্রের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়েই উঠেছে। এই ক্ষেত্র কৃষিক্ষেত্র থেকে উৎখাত হওয়া মানুষদের টেনে নিতে পারছে না। কৃষিক্ষেত্রে সরকারের বেশি বিনিয়োগ মানে এই ক্ষেত্রে বেশি কর্মসংস্থান, কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং অর্থনীতিরও শ্রীবৃদ্ধি। বছরের পর বছর নিজেদের ক্ষতি স্বীকার করে যাঁরা আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাঁদের জন্য এমএসপি-র ভার নেওয়াটা সরকারের পক্ষে এক আবশ্যকীয় দায়িত্বের পালনই হবে। মোদী যে “এমএসপি ব্যবস্থাকে আরো কার্যকরি করা”র কথা বলছেন, এমএসপি-র আইনসিদ্ধতা হবে সেই লক্ষ্যে সবচেয়ে ফলদায়ক পদক্ষেপ।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-28
সংখ্যা-43