আজকের দেশব্রতী : ০৩ জুন ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
Deshabrati 3 June Online Issue

government is hiding its face in the sand

নির্লিপ্তি ও অপরাধসম উদাসীনতার বালুরাশিতে মুখ লুকিয়ে মোদী সরকার ভাবছে অর্থনৈতিক মন্দার এই সুনামি থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যাবে। গত বিত্ত-বর্ষে (২০২০-২১) জাতীয় আয় বা জিডিপির ৭.৩ শতাংশ সংকোচন ঘটল, যা বিগত চল্লিশ বছরের মধ্যে সর্বাধিক! অতল অন্ধকারের গহ্বরে পৃথিবীর অন্যতম দ্রুত বৃদ্ধির অর্থনীতি তলিয়ে যাওয়ার পরও অর্থদপ্তরের নির্লজ্জ বেহায়া প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বুক চাপড়ে বলেন, “ভারতের অর্থনীতি এখন যথেষ্ট প্রাণবন্ত। ধারাবাহিক সংস্কারে ভর করে তা ঘুরে দাঁড়াবে। নানা ক্ষেত্রে সেই লক্ষণ ও স্পষ্ট”। এদিকে, প্রাক্তন মুখ্য উপদেষ্টা কৌশিক বসু দেখিয়েছেন যে জিডিপির এই পরিসংখ্যানের নিরিখে ১৯৪টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪২-এ। স্বাধীন ভারতে অর্থনীতির এতো গভীর পতন এর আগে কখনও দেখা যায়নি।

এই নজিরবিহীন আর্থিক সংকোচনের জন্য কোভিডের দিকে যতই অঙ্গুলিনির্দেশ মোদী সরকার করুক না কেন, এটা স্পষ্ট যে কোভিড হানা দেওয়ার ঢের আগেই ভারতীয় অর্থনীতি চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ব্যাপক বেকারত্ব, অত্যন্ত কম মজুরিতে সামাজিক সুরক্ষাবিহীন ঝুঁকি পূর্ণ কাজে ভারতের সিংহভাগ শ্রমশক্তি কাজ করছেন বিভিন্ন ইনফর্মাল ক্ষেত্রে। ক্রমহ্রাসমান ক্রয় ক্ষমতার ফলে চাহিদার ক্ষেত্রে বিরাট এক কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠে, তার সমাধানে প্রথিতযশা অর্থশাস্ত্রীরা নানা পরামর্শ দিলেও মোদী সরকার তা চরম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। অর্থনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম কান্ডজ্ঞান বা ধারণা যে তাদের একেবারেই নেই, আমাদের রাষ্ট্রনেতাদের এই বোধটারই বড় অভাব। কথায় বলে, মূর্খের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হল, নিজের অন্ধত্ব সম্পর্কে অজ্ঞানতা।

প্রতিদিন কর্মহীনতা ও অর্থনীতি নিয়ে আতঙ্কজনক তথ্য সামনে আসছে। দিন কয়েক আগে, সিএমইআই-এর কর্ণধার মহেশ ব্যাস জানালেন, প্রথম কোভিড ঝড়ের পর দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ আরও গরিব হয়েছেন। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাঙ্গীণ সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে যে প্রথম লকডাউনের পর ২৩ কোটি ভারতীয় নিক্ষিপ্ত হয়েছেন আরও দারিদ্রের কবলে। কোভিড সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছে মহিলাদের কর্মসংস্থানের উপর। সাধারণ ভাবে, পৃথিবীর মধ্যে শ্রমে অংশ নেওয়া মহিলা শ্রমশক্তির হারের ক্ষেত্রে ভারত সবচেয়ে নীচে। কোভিড এই শেষ তলানিটাকে প্রায় নিঃশেষ করে দিয়েছে। গত একমাসেই লোপাট হয়ে গেল প্রায় দেড় কোটি মানুষের কাজ! ফি মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। ভারতের অর্থনীতিকে আজ গ্রাস করেছে সংকটের ত্রাহস্পর্শ। অত্যন্ত মন্থর আর্থিক বৃদ্ধি, ক্রমে বেড়ে চলা দারিদ্র ও দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসা মধ্যবিত্ত শ্রেণি – এই তিনটি মূর্তিমান বিভীষিকা আজ পর্যন্ত স্বাধীন ভারতকে কখনই সম্মুখীন হতে হয়নি। পিউ রিসার্চ সেন্টারের অনুমান, ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ৩.২ কোটি পর্যন্ত সংকুচিত হয়ে যাবে আর নতুন করে ৩.৫ মানুষ আরও গরিব হয়ে যাবেন।

এতদিন পর্যন্ত চলে আসা নয়া উদারবাদী অর্থনীতির চরম অন্তঃসারশূন্যতাকে কোভিড নির্দয়ভাবে বে-আব্রু করল। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভড়ংটাকে বজায় রেখে জনহিতৈষী যে সমস্ত পদক্ষেপ একসময় সরকারগুলো নিত, নয়া উদারবাদ সেখান থেকে নিজেকে সরিয় নেয়। রাষ্ট্র যতই নিজের জায়গা থেকে সরে এসে কর্পোরেটদের জন্য ছেড়ে দিতে থাকল মুনাফা লোটার বিস্তর পরিসর, ততই নাভিশ্বাস উঠল সাধারণ মানুষের। স্বাস্থ্য, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো ব্যক্তিগত মালিকানার কুক্ষিগত হওয়ায় মানুষের স্বার্থর বদলে মুনাফাই হয়ে উঠলো প্রধানতম লক্ষ্য। আজ, কোভিড চরম মুল্য দিয়ে এই সর্বনাশা গতিপথকে শুধরে তোলার বার্তা হাজির করেছে। তাই, নয়া উদারবাদের মক্কা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এখন কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে ভিন্ন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে কোভিডে তছনছ অর্থনীতিকে মেরামত করতে। খুব সম্প্রতি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বিডেন ২.৩ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার পরিকাঠামো বাবদ বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য - শিক্ষাখাতে অনেক বেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি কর্মনিশ্চয়তা খাতে, শিশু কল্যাণে, শ্রমিকদের মজুরিকে সুরক্ষিত করতে, সমাজের দুর্বলতম শ্রেণির জন্য সরাসরি আর্থিক অনুদান প্রভৃতি ঘোষণা করলেন। প্রত্যেক মার্কিনীকে আর্থিক অনুদান ও আছে এই প্রকল্পে। সবচেয়ে বড় কথা, কর্পোরেট ও অতি ধনীদের উপর আরোপ করা হল কর। সরকার ও রাষ্ট্র এবার নিজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অনেক বাড়ালো। উপর থেকে সম্পদ চুইয়ে পড়ার তত্ত্বের বিপরীতে নীচ থেকে উন্নয়ন স্বীকৃতি পেল। কোভিড ত্রাণে আমেরিকা তার জিডিপির দশ শতাংশের ও বেশি বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কিন্তু, আমাদের মোদীর ভারতে?

দিনকয়েক আগে সিআইআই-এর সভাপতি উদয় কোটাক সরকারকে জানালেন, আরও অনেক বেশি টাকা ছাপিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে, দরিদ্রতম মানুষদের হাতে সরাসরি নগদের জোগান বাড়াতে, গরিব মানুষদের চিকিৎসার যাবতীয় দায় সরকারকে নিতে, ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পগুলোকে সাহায্যের হাত বাড়াতে। এই প্রস্তাবগুলোই নোবেল জয়ী বেশ কিছু অর্থশাস্ত্রীরা অনেকবার বলেছেন।

কিন্তু, ভারত হেঁটে চলেছে ভিন্ন পথ ধরে। অতিমারীর সময়ে আরো বেশি বেসরকারীকরণ, আরো বেশি দেশীয় অর্থনীতিকে কর্পোরেটমুখী করে তোলার এক সর্বনাশা পথে সে এগিয়ে চলেছে। যে কোভিডকে সুযোগে পরিণত করার হাঁক দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী, পরিহাস এটাই, সেই অতিমারীর আর্শিতে দেশের মানুষ দেখলো, হৃদয়হীন, চরম উদ্ধত্য, ভাবলেশহীন এক রাজাধিরাজকে, যার কাছে নেই জীবনের প্রতি মর্যাদা, মৃতের প্রতি সম্ভ্রম। দেশবাসীর জন্য এক বিন্দু সহমর্মিতা। আছে শুধু নিজের ভাবমূর্তিকে পালিশ করার তাগিদ। তাতে যেন একটুও টোল না পড়ে, সে ব্যাপারে আছে চরম সতর্কতা। রাষ্ট্রীয় প্রহরার আয়োজন।

নির্দয় রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে আজ দেশবাসী ক্রমেই সোচ্চার হচ্ছেন। মানুষ ফুঁসছে। টিকা প্রশ্নে সর্বোচ্চ আদালতের কাছে নিত্যদিন তিরষ্কৃত কেন্দ্রীয় সরকার। মোদীর পদত্যাগের দাবি ক্রমেই ভাষা পাচ্ছে। এটাই আশার কথা। নতুন এক উন্মেষের পথে আমাদের দেশ এগিয়ে চলেছে।

investigation into the corruption of the life-saving drug Tocilizumab

কোভিড অতিমারী চিকিৎসায় সাইটোকাইনিন স্টর্ম, যা নিমেষে রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে, তা প্রতিহত করতে উল্লিখিত টসিলিজুমাব শেষ চেষ্টা হিসাবে ব্যবহার করে বহু প্রাণ রক্ষা করা গেছে। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত এই ওষুধ ব্যবহারের পূর্বে স্বাস্থ্য দপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন। বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো। প্রায় ১১-১২ লক্ষ টাকা মূল্যের ২৬টি ইনজেকশন প্রভাবশালী চক্রের মাধ্যমে চুরি হয়েছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেন্ট্রাল ড্রাগ স্টোরের দায়িত্বে থাকা আধিকারিকরা সহ ঐ দুষ্ট চক্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের জড়িত থাকার অভিযোগের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দিতে হবে।

ধন্যবাদান্তে
পার্থ ঘোষ, রাজ্য সম্পাদক
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর পক্ষে
২/৬/২১

The worker-tender role of the government

এ রাজ্যে ১৫ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হল লকডাউন। থুড়ি, এই ভীতিপ্রদ শব্দবন্ধটির গায়ে এখন পরানো হয়েছে নতুন এক জামা – ‘নিয়ন্ত্রণ বিধি’! দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা থেকে সরে এসে রাজ্যগুলোর ঘাড়ে কোভিড নিয়ন্ত্রণের সব দায় এখন চাপিয়ে দিয়েছে মোদী। ঠিক যেমন, টিকাকরণের সব দায় এখন রাজ্যের। খোলা বাজার থেকে টিকা খরিদ করা, ইত্যাদি সব কিছুই এখন কর‍বে রাজ্যগুলো, কোভিড নিয়ন্ত্রণের জন্যই বা কি পদক্ষেপ হবে নেবে সেটাও রাজ্যগুলো ঠিক করবে। আর এটা করতে গিয়ে প্রায় গোটা দেশ জুড়েই এখন চলছে লকডাউন। আজ এই রাজ্য তার মেয়াদ বাড়াচ্ছে, তো কাল ফের অন্য রাজ্য, আর দেশবাসীর কাছে এটাই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে ললাট লিখন। সংবিধানে স্বাস্থ্য রাজ্য এক্তিয়ার ভুক্ত, তাই নাকি স্বাস্থ্য বিষয়ক পদক্ষেপ রাজ্য নেবে - যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর অনবরত আঘাত হানা মোদীর মুখে যুক্তরাষ্ট্রিয়তার কথা শুনলে শিয়ালের যুক্তিই মনে পড়ে।

কত গরিব মানুষ আবার কর্মচ্যুত হলেন, কত মানুষ নতুন করে আবার তলিয়ে গেলেন দারিদ্রের অতল গহ্বরে, কত অযুত নিযুত দেশবাসী আবার নিক্ষিপ্ত হলেন অনাহার-অর্ধাহারে, তার হিসেব কি আর রাখছেন রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা? সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) তার সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে জানিয়েছে, কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ কর্মহীনতাকে আরও অনেক বাড়িয়ে দিল। এ বছর জানুয়ারিতে মাসিক কর্মহীনতার হার ছিল ৬.৬২ শতাংশ, যা এপ্রিলে বৃদ্ধি পেয়ে হল ৭.৯৭ শতাংশ। বিভিন্ন রাজ্যে লকডাউন ও পরিযানে বিধিনিষেধের জন্য ১৬ মে সপ্তাহান্তে কর্মহীনতার হার বেড়ে হয় ১৪.৫ শতাংশ, আবার পরের সপ্তাহ, যেটি শেষ হচ্ছে ২৩ মে, এই হার আরও বেড়ে হল ১৪.৭ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে, যত দিন যাচ্ছে, বেকারত্ব ততই বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। আতংকজনক হারে।

গত বছর দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একটা নির্দেশিকা জারি করে নিয়োগকর্তাদের জানায়, নেমে আসা এই মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকট কে মোকাবিলা করতে সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকার দরুণ যেন কারুর বেতন/মজুরি হ্রাস করা না হয়, যেন ছাঁটাই না করা হয় কোনো কর্মীকে। একই ভাবে রাজ্য সরকার ও ওই মর্মে নির্দেশিকা জারি করে। এর বিরুদ্ধে মালিকপক্ষ সর্বোচ্চ আদালতে গেলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তা প্রত্যাহার করে নেয়। বেতন, মজুরি ও চাকরির প্রশ্নে কর্মীদের নিরাপত্তা দিতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়। এতোদিন একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, সুরক্ষিত চাকুরি ও নিশ্চিত বেতনের ক্ষেত্রে বেতনভুক কর্মীরা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। কিন্তু কোভিড সেই ফানুসটাকে চুপসে দিল। গত বছর প্রায় ৯৫ লক্ষ বেতনভুক কর্মী কাজ হারায়। আরবিআই-এর খুব সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে রীতিমতো আশংকা জাগিয়ে বলা হয়েছে যে বিপুল হারে অতিমারী কেড়ে নিল কোটি কোটি মানুষের কাজ, তার প্রভাব হবে দীর্ঘস্থায়ী আর ফলাফল ও হবে নেতিবাচক। সিএমআইই-এর কর্ণধার মহেশ ব্যাস জানিয়েছেন, গত একবছরের মধ্যে দেশের ৯৭ শতাংশ জনতা আরও বেশি গরিব হয়েছেন, যা দেশের অর্থনীতির পক্ষে সবচেয়ে উদ্বেগজনক। গভীর বিপর্যয়ের মধ্যেও চরম নির্বিকার ও নির্লিপ্ত মোদী সরকার। কাজ হারানোর এই সুনামি যখন সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে, কাজ টিকিয়ে রাখাটাই যখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, ঠিক সেই মুহূর্তে ভারতীয় রেল অবলুপ্ত করল ১৩,৪৫০ পদ। রেলের বেসরকারীকরণের পথে এগুলোই হচ্ছে কয়েকটি ধাপ।

দিন কয়েক আগে, কোটাক মহিন্দ্রা ব্যাঙ্কের সিইও এবং কর্পোরেট জগতের কর্ণধার, সিআইআই-এর সভাপতি উদয় কোটাক কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছেন অর্থনীতিতে আরও অনেক বেশি টাকার জোগান দিতে। শীর্ষ ব্যাঙ্ককে টাকা ছাপানোর পরামর্শের সাথে দেশের সবচেয়ে নীচুতলার মানুষদের হাতে নগদ টাকার জোগান, খাদ্য সুনিশ্চিত করা, সরকারী উদ্যোগে তাঁদের চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়ার সাথে মনরেগার কাজকে আরও সম্প্রসারিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। চরম সংকটগ্রস্থ ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পের আর্থিক পুনরুজ্জীবনের জন্য প্যাকেজের পরামর্শ ও তিনি দিয়েছেন। একই পরামর্শ তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদেরা লাগাতার দিলেও মোদী সেসব কানে তুললেন না, উল্টে কোভিড অতিমারিকে সুযোগে পরিনত করতে একের পর এক স্টীমরোলার নামিয়েছে দেশবাসীর উপর।

সাধারণ সময়ে, অর্থনীতি যখন স্বাভাবিক ছন্দে চলে তখন, সকলের অগোচরে চোখের আড়ালেই থেকে যায় পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রকৃত অবস্থা। এই সমস্ত লক্ষ কোটি অযুত নামহীন অবয়বহীন শ্রমজীবী মানুষদের নিত্যদিনের দুঃসহ দুর্দশা ও যন্ত্রণা শহুরে ভারতের চোখে প্রথম প্রতিভাত হয় কোভিড সৃষ্ট সংকটের ক্রান্তিলগ্নে। গতবছর মোদী যখন আচমকা দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করলেন, তখন তাঁর চিন্তা ভাবনায় ছিল শুধু ব্যালকনি বা ছাদের উপরে উঠে থালা বাজানো উচ্চ মধ্যবিত্তের স্বচ্ছল শ্রেণিটি। দেশ ও রাষ্ট্রীয় কল্পনায় মোদীর ভারতে, ও রাষ্ট্রের কাছে এই অগণন অনুচ্চার, আড়ালে থাকা নীরবে সম্পদ সৃষ্টিকারী শ্রেণিটির কোনো ঠাঁই নেই। অথচ, সরকারের হিসাবে এঁরাই দেশের জিডিপিতে অবদান রাখেন ৫৭ শতাংশ! তাই, গত বছর ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের চোখে ধরা পড়লো না লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে নিজভূমে ফিরে আসার মরিয়া পথ চলা, সেই পরিব্রজনে প্রসব বেদনায় কাতর মায়েদের পথেই সন্তান প্রসবের অলৌকিক ঘটনা, পথক্লান্তিতে, চলন্ত ট্রেনের তলায় পিষে যাওয়া হত দরিদ্র পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম বিপন্নতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিস্ময়ের সাথে এই প্রশ্ন করতে পারেন, “সরকার তো ওদের খাবার দিচ্ছে, তাহলে মজুরি কেন চাইছে?”

এদিকে, আমাদের দেশে রয়েছে এক কেন্দ্রীয় আইন “ইন্টার - স্টেট মাইগ্রেন্ট ওয়ার্ক্সমেন (১৯৭৯) অ্যাক্ট”। কোভিড সংকট এই অগনিত শ্রমিকদের সীমাহীন দুর্দশা চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেওয়ার পরও মোদী সরকার সেই হিমঘরে পাঠানো শীতঘুমে চলে যাওয়া আইনকে আবার নতুন করে বাঁচিয়ে তাকে মজবুত করার বদলে সেটার আলাদা অস্তিত্ব বাতিল করে তার একটা অংশ মিশিয়ে দিল পেশাগত নিরাপত্তা স্বাস্থ্য কোড ও আরেকটা সামাজিক সুরক্ষা কোডের সাথে।

সংবিধানে বর্ণিত নির্দেশক নীতি বা ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপাল নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে ভারতীয় রাষ্ট্র জীবনধারনের অধিকার, সমকাজে সমমজুরী, শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় আর্থিক কর্মকান্ডে ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ক্ষেত্রে নেমে আসা যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুরক্ষা ও নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। যে কোনো শোষণ উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ভারতীয় রাষ্ট্র তাকে নিরাপত্তা দেবে, এই অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু, লকডাউনের পর পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নেমে আসা জীবন যন্ত্রণা সমস্ত মেকি আবরণকে নির্মম ভাবে ছিন্ন ভিন্ন করে কঠিন বাস্তবকে সামনে মেলে ধরল, সংবিধানের প্রতিশ্রুত নির্দেশাত্মক নীতির প্রহসনকেই বে-আব্রু করে দিল। এতো বড় একটা মানবিক ট্রাজেডি থেকেও কোন সরকারই এক রত্তি শিক্ষা নিল না। কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গে আবার সেই নিদারুণ যন্ত্রণা ফুটে উঠল, অবশ্য ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। নতুন আইনে পরিযায়ী শ্রমিকদের নাম সহ প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটির ডেটা বেস তৈরি করার আইনী নির্দেশ থাকলেও তা রূপায়িত হল না। নাম কা ওয়াস্তে হেল্প লাইন কিছু কিছু রাজ্য সরকার ঘোষণা করলেও তা অকার্যকর হয়েই পড়ে রয়েছে। শুধু পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই নয়, ২০১৭ সালে এমনকি সুপ্রিম কোর্ট ও বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, “ক্যাগ পর্যন্ত জানে না, নির্মাণ শ্রমিকদের সেস খাতে গচ্ছিত তহবিলের কত টাকা কোথায় ও কি উদ্দেশ্যে খরচ হয়েছে!” এমনকি, ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ আদালত রীতিমতো অসন্তোষ প্রকাশ করে সেস খাতে ২৬,০০০ কোটি টাকা নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণে খরচ না করার জন্য। কোভিড পরিস্থিতিতে ও এই তহবিল থেকে সর্বস্বান্ত নির্মাণ শ্রমিকদের দেওয়া হল না কোনো কানা কড়ি। রাজ্য সরকার ও এপ্রশ্নে চরম উদাসীন। দিল্লির রাজ্য সরকার নথিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য এককালীন ৫,০০০টাকা আর্থিক অনুদান ঘোষণা করেছে। কেরল সরকার ও পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য নিয়ে এসেছে কিছু প্যাকেজ। চা বাগিচার শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য এ বছর কেন্দ্রীয় বাজেটে ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও, তা এই গভীর সংকটেও দেওয়া হল না চা শ্রমিকদের। মোদী সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত “প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্নযোজনা” ঘোষিত হয় গত বছরের এপ্রিল মাসে। তা পরে বাড়ানো হয় নভেম্বর পর্যন্ত। এই প্রকল্পের অধীনে প্রতি মাসে পাঁচ কেজি করে বিনামূল্যে তাঁরাই রেশন পাবেন যাঁদের কাছে রয়েছে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের কার্ড। কিন্তু মাত্র ৪৩ শতাংশ মানুষের কাছে এই কার্ড রয়েছে, ফলে বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষ থেকে গেলেন এর বাইরে। বার বার অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন, উপচে পড়া এফসিআই-এর বিপুল শস্য ভান্ডার থেকে কোভিডের আপৎকালীন সময়ে সর্বজনীন রেশন কার্ড দেওয়া হোক। ১৩ মে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, পঞ্জাব-হরিয়ানা-উত্তর প্রদেশের রাজ্য সরকার যেন সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের নিখরচায় রেশন দেয় আর তার জন্য কোনো পরিচয় পত্রের দরকার নেই। পাশাপাশি, দুবেলা বিনা মূল্যে খাবার সরবরাহ করতে রসুই খানা চালু করার ও নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশ ও কতটা কার্যকর হয়েছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

এর মধ্যে মোদী সরকার নিয়ে এসেছে নতুন সামাজিক সুরক্ষা কোড। নতুন এই কোডের মধ্য দিয়ে নাকি সুরক্ষিত হবে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা। এই কোড দুটো পৃথক বর্গ তৈরি করেছে - প্রথমটা হল, কর্মীবৃন্দ আর দ্বিতীয়টা অসংগঠিত শ্রমিক ও নির্মাণ শ্রমিক। ফলে এরপর থেকে অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা পুরোপুরি নির্ভর হয়ে পড়ল প্রকল্পের ঘেরাটোপে।

এটা আগেকার শ্রম আইনের পর্বকালের থেকে বড় সড় এক পরিবর্তন। যেমন, আগে ছিল, বাগিচা আইন (প্ল্যানটেশন লেবার অ্যাক্ট) ১৯৫২, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য আইন, ১৯৯৬, আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের আইন, ১৯৭৯ ইত্যাদি, যেখানে সামাজিক সুরক্ষার দায়টা ছিল মূল নিয়োগকর্তার উপর। এখন, সরকারের কৃপার উপর থেকে যাবে এই সমস্ত সামাজিক সুরক্ষার ভবিষ্যৎ। তার থেকেও বড় কথা, যখনই এটা প্রকল্পের মোড়কে আসছে, তখন সামাজিক সুরক্ষা আইনী বাধ্যকতার বদলে সরকারের বাজেট বরাদ্দের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

হাজারো সীমাবদ্ধতা এই সমস্ত প্রকল্পে থাকুক না কেন, যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল, যে গ্রুপগুলোকে টার্গেট করা হচ্ছে, তাঁদের নথি ভুক্তি। ১৯৭৯-র পরিযায়ী শ্রমিক আইন শ্রমিকদের নথিভুক্তি না করে মূল নিয়োগকর্তা ও ঠিকাদারের রেজিস্ট্রেশন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এবারে অবশ্য, পরিযায়ী শ্রমিকদের সরাসরি নথিভুক্তির কথা আইনে বলা হয়েছে। অবিলম্বে সরকারকে যে দু'টো পদক্ষেপ নিতে হবে, তা হল –

১) পোর্টালে পরিযায়ী শ্রমিকদের স্ব-নথিভুক্তিকরণের সুযোগ। এর মধ্যে দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের নাম, তাঁরা কোন কোন সংস্থার অধীনে কর্মরত, নিয়োগকর্তার নাম-ঠিকানাই বা কি, তার তালিকা সরকারের কাছে থাকবে (গতবারের লকডাউনে সরকার এ প্রশ্নে অন্ধকারেই ছিল)। ফলে আইন লঙ্ঘনকারী নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া সুবিধা হবে, আর

২) যে সমস্ত কন্ট্রাক্টর ও সংস্থা পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়োগ করা সত্ত্বেও আইন মোতাবেক নিজেদের নথিভুক্ত করায়নি তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

কিন্তু ভারতের বিশাল শ্রম বাজারকে পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রণ করার প্রশ্নে সরকারের কোনো রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি নেই। একদিকে, প্রায় ৯৫ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ, যারা সমস্ত ধরনের শ্রম আইনের বাইরে, তাঁদের জন্য রয়েছে এমন কিছু সুযোগ সুবিধা যার রূপায়ণের পথে রয়েছে সহস্র বাধা, ঢিলেমি, সরকারী মেশিনারি যে প্রশ্নে চরম উদাসীন। বিপরীতে, সহজে ব্যবসা করার পরিমন্ডল তৈরি করার জন্য ও পুঁজির অবাধ বিনিয়োগের স্বার্থে শ্রম বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার যাবতীয় দায়দায়িত্ব থেকে সরকার নিজের হাত গুটিয়ে নিচ্ছে, শ্রম আইনের আওতা থেকে মুক্ত করছে নিয়োগকর্তাদের।

শ্রম কোড আসার পর আগের শ্রম আইন এখন অচল। আবার নিয়ম বিধি বা রুলস তৈরি না হওয়ায় নতুন কোড কার্যকর হতে পারছে না। সরকারগুলো যেন এখন অথৈ জলে।

এই ধরনের আইনী শূন্যতা স্বাধীন ভারতবর্ষ আগে কখনও দেখেনি।

– অতনু চক্রবর্তী 

Modi Must Go

কোভিড-১৯ সংক্রমণ যাদের প্রাণ কেড়ে নিল তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশে প্রধানমন্ত্রী মোদী টিভি ক্যামেরার সামনে যে অশ্রু ঝরালেন, তাতে দেরি হয়ে গেল অনেক; দেরি হয়ে গেল তাঁর সরকারের ঔদাসীন্যের জন্য দুঃখপ্রকাশে, যে ঔদাসীন্যই ঐ মৃত্যুগুলোর জন্য দায়ী। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের বা আমাদের হারানো স্বজনদের দুঃখে ব্যথিত হয়ে তিনি চোখের জল ফেলছেন না, ঐ মৃত্যুগুলোতে নিজের ভূমিকায় অনুতপ্ত হয়েও তিনি অশ্রুপাত করছেন না – তাঁর অশ্রুমোচন এই জন্য যে, আমরা যেন তাঁর প্রতি সমব্যথী হই এবং যে সমালোচনা তাঁর প্রতি বর্ষিত হচ্ছে তার থেকে তাঁকে রেহাই দিই। তবে, যে বিপর্যয়ের মধ্যে তিনি নিজেই দেশকে এনে ফেলেছেন, তারই এক বলি হিসাবে তিনি নিজেকে তুলে ধরতে পারেন না।

যে মোদী বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমার জন্য কৃতিত্বের ভাগীদার করেছিলেন তাঁর ‘সৌভাগ্য’কে, আজ তিনি কিন্তু কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের নির্মমতা থেকে নিজের দায়কে ঝেড়ে ফেলতে পারেন না। প্রথম ঢেউ চলার সময় তথাকথিত “করোনার উপর বিজয় অর্জনের” জন্য নিজের নেতৃত্বকেই বারবার কৃতিত্ব দিয়েছিলেন –  এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিপর্যয়ের দায় তিনি বিরোধী পক্ষের ওপর, “কংগ্ৰেসের সত্তর বছরের শাসনের ওপর” বা অন্য কোনো নন্দ ঘোষের ওপর চাপাতে পারেন না। এই যে মৃত্যুগুলোকে এড়ানো যেত, সে মৃত্যুগুলোর দায় সম্পূর্ণতই প্রধানমন্ত্রী মোদীর।

আরএসএস প্রধান এবং কয়েকজন হাতুড়ে ধর্মগুরু “নেতিবাচকতা”কে সরিয়ে তার স্থানে “ইতিবাচকতার” মনোভাব দেখানোর প্রয়োজনিয়তার উপদেশ ভারতবাসীদের দিচ্ছেন (নেতিবাচকতা বলতে সরকারের সমালোচনা এবং অতিমারীর দৈনন্দিন বিভীষিকার উল্লেখকে বোঝানো হয়েছে)। আরোপিত এই “ইতিবাচকতা” ভারতবাসীর কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে হয়েই দেখা দিচ্ছে, যে ভারতবাসীদের সরকার অতিমারীর পরিস্থিতিতে পরিত্যাগ করে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যে ভারতবাসীদের প্রতিদিনই লড়াই চালাতে হচ্ছে – যে লড়াইটা প্রায়শই ব্যর্থ হচ্ছে – অক্সিজেন, ওষুধ, হাসপাতালের শয্যা, টিকা এবং এমনকি মর্যাদা সহকারে নিকটজনদের দাহ করা বা সমাধিস্থ করার জন্যে।

এই ধরনের পরিস্থিতিতে “ইতিবাচক” হওয়ার যে দাবি ভারতবাসীদের কাছে করা হচ্ছে সেটাই চূড়ান্ত অমানবিক। ভারতে অতিমারী সৃষ্ট নির্মমতম বিভীষিকার ওপর “ইতিবাচক” আবরণ চাপাতে আর এস এস ও বিজেপির ব্যবহার করা নির্দয় ও নির্লজ্জ ভাষা বিষয়টাকে আরও কদর্য করে তুলছে। আরএসএস প্রধান ঘোষণা করলেন – কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে যাঁরা মারা গেলেন তাঁদের “মুক্তি ঘটেছে” এবং মৃত্যু নিয়ে ভারতবাসীর বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, কেননা, গোটা ব্যাপারটাই “জীবন ও মৃত্যুর চক্র”। গঙ্গায় ভেসে যাওয়া এবং গঙ্গার তীরে গণ কবর দেওয়া হাজার-হাজার মৃতদেহ সম্পর্কে বিজেপির এক নেতাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এগুলো পবিত্র হিন্দু ঐতিহ্য “জল সমাধির” সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ! উত্তরপ্রদেশের প্রত্যেকটা গ্ৰামেই এখন মৃত্যু হানা দিচ্ছে, এবং তা দ্রুতই উত্তর ভারতের সমস্ত গ্ৰামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। মর্যাদার সঙ্গে স্বজনদের দাহ করার উপায় না থাকায় বা স্থান না মেলায় দরিদ্ররা মৃত স্বজনদের হয় নদী তীরে সমাধিস্থ করতে বাধ্য হচ্ছেন, আর না হয় সেগুলোকে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন নদীর জলে যেখান থেকে স্রোত বেয়ে সেগুলো চলে যাচ্ছে বিহারে। কিন্তু কেন্দ্রে এবং উত্তরপ্রদেশেও শাসন ক্ষমতায় থাকা বেহায়া বিজেপি আমাদের বলছে যে, আমাদের নাকে যা ঢুকছে তা লাশের পচা দুর্গন্ধ নয়, বরং তা ফুলের সুবাস।

ইতিমধ্যে টিকার অনটন দেখা দিয়েছে, এবং তার সাথেই হ্রাস পেয়েছে টিকার জন্য নাগরিকদের কাছে আসা সরকারী বার্তা। এছাড়া, ফাঙ্গাস রোধী ওষুধ অ্যামফোটেরাইসিন-বি-এর আকালও প্রবল আকারে দেখা দিয়েছে, যার ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থতির জন্য ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়া যে সমস্ত কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যুকে এড়ানো যেত, তা আর সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণের জন্য নির্ভরযোগ্য এবং সস্তায় স্বাস্থ্য পরিষেবা লাভের ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতিতে অনুপ্রবেশের পথ প্রশস্ত হচ্ছে হাতুড়েদের, যারা কোভিড-১৯-এর আরোগ্য হিসাবে ফেরি করছে কুসংস্কার এবং “অলৌকিক নিরাময়”।

মোদী সরকার সংক্রমিতদের এবং মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যাকে চেপে দিচ্ছে: কোভিড মোকাবিলার যথাযথ উপায় বার করতে এবং জীবন বাঁচাতে যে তথ্য একান্তই জরুরি। গুজরাটের যে  কবি “শববাহী গঙ্গা” নামক তাঁর  কবিতায় বলেছেন “আমাদের রাজা নগ্ন”, সেই কবির ওপর তীব্র আক্রমণ হানছে বিজেপির ট্রোল বাহিনী। যে সমস্ত মানুষ এবং এমনকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অক্সিজেন অমিল হওয়া নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছেন, “জাতীয় নিরাপত্তার” প্রতি বিপদ ছাপ দিয়ে তাদের গ্ৰেপ্তার করা হচ্ছে। বিরমবিহীন এই সমস্ত আক্রমণ সত্ত্বেও প্রশ্ন ওঠানোকে কিন্তু থামানো যাচ্ছে না। মোদী সরকার শাসন ক্ষমতায় বসে থাকলে কোভিড-১৯ সৃষ্ট গণহত্যার পথই প্রশস্ত হবে। ভারতকে যদি বাঁচতে হয়, অন্তত এখনকার মতো গ্ৰামের পর গ্ৰাম উজাড় হওয়াকে যদি আটকাতে হয় – তবে মোদীকে অবশ্যই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে।
– (লিবারেশন সম্পাদকীয়, জুন ২০২১)

Lakshadweep

কেন্দ্রশাসিত লক্ষদ্বীপের বর্তমান ঘটনাবলী গভীর উদ্বেগপূর্ণ। ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে পূর্বতন প্রশাসক দীনেশ্বর শর্মার মৃত্যুর পর প্রশাসকের পদে আসেন গুজরাটের প্রাক্তন গৃহমন্ত্রী প্রফুল প্যাটেল এবং তারপর থেকে এই উদ্বেগজনক মতলব সামনে আসতে থাকে। তিনি ২০২০ ডিসেম্বরে প্রশাসক পদে নিয়োজিত হবার আগে পর্যন্ত এই দ্বীপপুঞ্জে কোভিড সংক্রমণকে ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিল কিন্তু বর্তমান প্রশাসক করোনা বিধি হাল্কা করে দেওয়ার ফলে দ্রুতই প্রায় ৫,০০০ কোভিড কেস নথিভূক্ত হয় যেখানে আগের বছরে কেউই সংক্রমিত হননি।

সরকারের জাতীয় অপরাধ পঞ্জীকরণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী এখানে একটিও হত্যার ঘটনা ঘটেনি এবং এই দ্বীপপুঞ্জ সবথেকে কম অপরাধ অঞ্চল বলে স্বীকৃত হয়েছে। অথচ সরকারের অভিপ্রায় এখানে ‘গুন্ডা আইন’ চালু করা হবে, যার মাধ্যমে নাগরিকদের বিনা বিচারে আটক করা যাবে। এটা পরিষ্কার যে, এই অঞ্চলে সরকার হিংসার আশ্রয় নেবে যা এতদিন শান্তিপূর্ণ ছিল। ২০২০-র মার্চ থেকে প্রচার চালানো হচ্ছে যে লক্ষদ্বীপ থেকে কেরালায় অস্ত্র ও মাদক দ্রব্য পাচার করা হচ্ছে যা ভারতীয় নৌবাহিনী আটক করেছে। তথ্য পরীক্ষক সংস্থা এইসব চিত্রর প্রকৃত সত্য উন্মোচিত করে বলেছে এগুলি ‘আল জাজিরা’-র প্রশান্ত মহাসাগরের রিপোর্ট। যে জলযানগুলি ভারতীয় নৌবাহিনী আটক করেছে সেগুলি প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কাগামী জলযান। লক্ষদ্বীপের উপকূল থেকে ৯০ নটিক্যাল মাইল দূরে (রাষ্ট্রপুন্জের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রাধীন জলসীমা উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত) নৌবাহিনী জলযান আটক করে।

কর্তৃত্ববাদী প্রশাসক দ্বারা প্রণীত আইনগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘ড্রাফট লক্ষদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অথারিটি রেগুলেশন ২০২১ (এলডিএআর)’-এর দ্বারা প্রশাসক শহরের প্ল্যানিং বা অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের জন্য জমি অধিগ্রহণ, দ্বীপবাসীদের সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ, স্থানান্তরিত করতে পারবেন।

অপর একটি আইন ‘সমাজ-বিরোধী কার্যকলাপ নিরোধক আইন (পিএএসএ)’ জানুয়ারী ২০২১-এ লাগু হয়েছে - এর মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তিকে বিনা ওয়ারেন্টে ১ বছর পর্যন্ত আটক করা যাবে। আরেকটি আইন হল খসড়া ‘পঞ্চায়েত নোটিফিকেশন’ যার বলে, কোনো ব্যক্তির দুটির বেশি সন্তান হলে তার পঞ্চায়েত মেম্বার পদ খারিজ করা যাবে, এবং পঞ্চায়েতের ক্ষমতা খর্ব করে কেন্দ্রীয় প্রশাসক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাছ চাষ, পশুপালন – এর এলাকা অধিগ্রহণ করতে পারবেন।

দ্বীপপুঞ্জের খাদ্যাভ্যাসের ওপর চরম আঘাত হেনেছে ‘ড্রাফট লক্ষদ্বীপ পশু সংরক্ষণ আইন’, যা আসলে দানবীয় গোমাংস ভক্ষণে নিষেধাগ্গা এবং এর সাথে যুক্ত হয়েছে স্কুলের টিফিনের জন্য আমিষ খাদ্যর ওপরও নিষেধাজ্ঞা –  যেখানে দ্বীপবাসীদের পুষ্টি ও জীবিকা নির্ভর করে সামুদ্রিক মাছের ওপর।

সম্প্রতি দ্বীপের নার্সরা ন্যূনতম বেতনের দাবিতে ধর্মঘট করলে তাদের দাবিতে কর্ণপাত না করেই গ্রেপ্তার করা হয়। এনআরসি, এনপিআর এবং সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকারী অফিসের শত শত কন্ট্রাক্ট ও ক্যাজুয়াল কর্মীরা কর্মচ্যুত হয়েছে, এছাড়া মিড-ডে-মিল কর্মী, শারীরিক শিক্ষার শিক্ষকদেরও ছাঁটাই করা হয়েছে। ৩৮ অঙ্গনওয়াড়ি বন্ধ করা হয়েছে। কেরলের বেপোর বন্দরের মাধ্যমে মাল পরিবহনের যে ঐতিহ্যবাহী বন্ধন ছিল তা রদ করা হয়েছে। পূর্ব প্রশাসকের অনুমতিতে মত্সজীবীদের মাছ ধরার জাল, যন্ত্রপাতি রাখার জন্য গড়ে তোলা অস্থায়ী শেডগুলি ভেঙে ফেলা হয়েছে, যেখানে দ্বীপবাসীদের প্রধান জীবিকা হল মাছ ধরা। দ্বীপপুঞ্জের লোক সংখ্যা কম হওয়ায় যান পরিবহনের জন্য রাস্তা চওড়া করার কোনো প্রয়োজনই যেখানে নেই সেখানে রাস্তা চওড়া করার যে প্রস্তাব প্রশাসক এনেছে তাতে বহু বাড়ি, ইমারত ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এই এজেন্ডার দ্বারা এটা পরিষ্কার যে লক্ষদ্বীপের জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হবে এবং কর্পোরেটদের অত্যাচার মসৃণভাবে চলবে।

বার লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা বিতর্কিত। লক্ষণীয় ব্যাপার হল তিনি যখন গুজরাটের গৃহমন্ত্রী ছিলেন তখন গুজরাটে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল এবং তিনি ভুলেও সেখানে এই দাবি তোলেননি। এটা দৃশ্যত পরিষ্কার যে এই প্রশাসক বালি-মাফিয়াদের সঙ্গে এবং সমুদ্র শসা (এক ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী যার ট্রেডিং ভারতে নিষিদ্ধ) পাচারকারীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলছেন এবং প্রতিবাদকারী স্থানীয় মানুষদের বাধা দিচ্ছেন। লক্ষদ্বীপের ডেয়ারী-ফার্মগুলি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে গুজরাটের ‘আমূল’ প্রোডাক্টের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য।

প্রফুল প্যাটেল অপরাধী হিসাবে সন্দেহভাজন হয়ে উঠছেন এবং এই প্রথমবার তাঁর নাম সামনে আসছে এমনটা নয়। ফ্রেব্রুয়ারী মাসে দাদরা এবং নগর হাভেলির এমপি মোহন দেলকর আত্মহত্যা করেন। তাঁর স্যুইসাইড নোটে অন্যান্যদের নামের সঙ্গে প্যাটেলের নামও উল্লেখ করেন তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী হিসাবে। দেলকরের পুত্র অভিনব পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন তাঁর পিতার কাছে ২৫ কোটি টাকা চেয়ে প্যাটেল তাঁকে হেনস্থা করেন, ‘সমাজবিরোধী কার্যকলাপ নিরোধক আইন’-এ মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয়ও দেখান টাকা না দিলে। একজন আদিবাসী নেতা প্যাটেলকে এই আত্মহত্যার জন্য দায়ী করে পুলিশের কাছে ‘এসসি/এসটি উত্পীড়ন নিরোধক আইন’-এর অধীনে এফ আই আর দায়ের করেন। প্রশাসক পদটি বহুকাল ধরেই আইএএস অথবা আইপিএস-দের জন্য সংরক্ষিত ছিল – সেখানে প্যাটেলের প্রশাসক হিসাবে নিয়োগটা সন্দেহজনক।

প্রফুল প্যাটেল দাবি করেন যে তাঁর একমাত্র এজেন্ডা হল “উন্নয়ন” – কিন্তু বাস্তবিক এই ‘উন্নয়ন’ আদৌ জনমুখী মঙ্গলদায়ক নয় বরং একটি “হিন্দুত্ব- কর্পোরেট”-এর লাভজনক উন্নয়ন। দ্বীপের জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশ মুসলমান এবং কোনোদিন কোনো সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেনি। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের আগ্রাসী বলে যে অপবাদ দেয় তা একটি ডাঁহা মিথ্যা। আরএসএস-এর পত্রিকা ‘অর্গানাইজার’-এ অভিযোগ করা হয়েছে দ্বীপের বাসিন্দাদের প্রশাসকের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করছে মুসলিম মৌলবাদীরা এবং এর জন্য এই কেন্দ্র শাসিত দ্বীপের ইন্টারনেট বন্ধ হতে পারে। দ্বীপবাসীরা কর্পোরেট-মুখী এই সংস্কারের বিরোধিতা করছেন এবং ট্যুইটারে “#লক্ষদ্বীপ বাঁচাও” ট্রেন্ড ছড়িয়ে দিয়েছেন। সারা ভারতকে আজ এই লক্ষদ্বীপের পাশে দাঁড়াতে হবে।

(লিবারেশন, জুন ২০২১ সংখ্যা থেকে)

– ঐশিক সাহা

the world is prone to hunger

করাল মহামারীর দ্বিতীয় তরঙ্গে সমগ্র দেশ আবারও নিমজ্জিত। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে জনস্বার্থের দুর্বল ভিত্তিতে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে এই দ্বিতীয় তরঙ্গ। একদিকে সংক্রমণের হার অব্যাহত, অন্যদিকে ধর্মীয় জমায়েত এবং নির্বাচনী সমাবেশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অখণ্ড নীরবতা। আর এই পরিস্থিতি ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে কোটি কোটি দরিদ্র ভারতীয়ের প্রাণের ঝুঁকি, অনাহার, কর্মচ্যুতি এবং নিরাপত্তাহীনতার সঙ্কট।

সম্প্রতি অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েকের প্রকাশিত হাঙ্গার ওয়াচের রিপোর্ট দেখিয়েছে কীভাবে কোভিড মহামারী এবং লকডাউনের কারণে বিশেষত প্রান্তিক ও বঞ্চিত সম্প্রদায়ের পরিবারগুলির আয় এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা  হ্রাস  পেয়েছে, কীভাবে তা এবং ক্ষুধা বাড়িয়ে তুলেছে।

হাঙ্গার ওয়াচ তার প্রতিবেদনে রাইট টু ফুড ক্যাম্পেইন, ইন্ডিয়া এবং সেন্টার ফর ইক্যুইটি স্টাডিজ এর যৌথ উদ্যোগে হওয়া একটি বড়ো মাত্রার সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরেছে। এই সমীক্ষা  মার্চ ২০২০ লকডাউনের আগের কয়েক মাস থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত খাদ্য সুরক্ষা পরিস্থিতির তুলনামূলক ছবির  উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। ১১টি রাজ্যের  ৩৯৯৪টি পরিবারের মধ্যে এই সমীক্ষা হয় যাদের বেশিরভাগই প্রান্তিক এবং বঞ্চিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে।

সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০২০ সালের অক্টোবরে ১০ জন উত্তরদাতাদের মধ্যে ৭ জন জানিয়েছেন যে তাদের দৈনন্দিন খাদ্যের পুষ্টিগুণ নিম্নমানের হয়ে গেছে এবং প্রায় ৬৬% শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন মার্চে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা  হওয়ার আগে তারা যে পরিমান খাদ্য খেতেন অর্থনৈতিক কারণে ততটা খাদ্য গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা এখন আর তাদের নেই, কম খেতে হচ্ছে। মানুষ শুধু ডিম এবং মাংসের মতো বেশি দামি খাবারগুলি তাদের খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি ভাত রুটির মতো প্রধান খাদ্য খাওয়াও কমাতে বাধ্য হয়েছেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে অনেকেই অনাহারে, অনেকে ঠিকমতো খেতে না পেয়ে শয্যাশায়ী এবং কেউ কেউ এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ধারে চাল, ডাল কিনে চালাচ্ছেন।

প্রতিবেদনে বলছে যে এই মহামারীতে শহরের দরিদ্র মানুষ গ্রামের দরিদ্রদের থেকে বেশি আক্রান্ত। তৎসহ দলিত, অস্তিত্ব সঙ্কটগ্রস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠী, মুসলমান জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি নিঃসঙ্গ মহিলা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী মানুষের অবস্থা আরও খারাপ। তারা জানিয়েছেন তাদের দৈনন্দিন খাদ্য গ্রহণ অনেকটা হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছেন।

শহরের দরিদ্রদের উল্লেখযোগ্য অনুপাতে রেশন কার্ড নেই। গ্রামাঞ্চলের উত্তরদাতাদের ৯০% রেশন কার্ড রয়েছে, শহরের ক্ষেত্রে তা মাত্র ৬৫%। যেহেতু উত্তরদাতাদের সকলেই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তাই সাধারণভাবে সকলের রেশন কার্ড থাকার কথা, তুলনামূলকভাবে গ্রামীণ দরিদ্রদের কাছে খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা ভালো।

যদিও খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা, মিড-ডে মিল স্কিম এবং আইসিডিএস প্রোগ্রামগুলি তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং অপুষ্টি কাটিয়ে উঠতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু প্রতিবেদনে হচ্ছে যে “আমরা দেখতে পেয়েছি যে খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা সবার কাছে পৌঁছয়নি, যারা এই ব্যবস্থার বাইরে ছিল তারা বাইরেই থেকে গেছে, এই ব্যবস্থার সুযোগ তারা পাচ্ছে না। একটা ব্যাপার স্পষ্ট ছিল যে এই খাদ্য বন্টন ব্যবস্থার অন্তর্গত মানুষের কাছে  এটি  বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় – এই ব্যবস্থা না থাকলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি আরও খারাপ হত। পাশাপাশি এই ব্যবস্থার সর্বাত্মক অধিকার না থাকায় এই মহামারী পর্যায়ে ব্যাপক ক্ষুধার খবর পাওয়া গেছে।” মধ্যাহ্নভোজ ও আইসিডিএসের মতো অন্যান্য প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে কেবলমাত্র উত্তরদাতাদের অর্ধেক পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। নভেম্বরে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি চালু করার অনুমতি পাওয়ায় আশা করা হচ্ছে যে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এই সমস্ত প্রকল্পগুলির কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণই নয় পাশাপাশি সমস্ত যোগ্য জনগোষ্ঠী যাতে এই সুবিধা পায় তার ব্যবস্থা না করলে এই ক্ষুধার থাবা ক্রমশ লম্বা হতে থাকবে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সাম্প্রতিক সরকারি নীতিমালা এবং আইনী ঘোষণার ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। সদ্য চালু হওয়া চারটি শ্রম কোড অসংগঠিত খাতের কর্মীদের ক্রয় করার ক্ষমতাকে আঘাত করবে। তৎসহ, তিনটি কৃষি আইন নিয়ে কৃষক আন্দোলনের সমাধান না করতে পারলেও খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা সংকটে পড়বে।

প্রতিবেদন আরো বলছে ২০২০-২১ থেকে ২০২১-২২-এ আইসিডিএস, মিড ডে মিল, প্রসূতি প্রাপ্য এই রকম ক্ষুধা ও অপুষ্টি হ্রাসকারী খাতগুলিতে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এনরেগার বাজেট বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় ৩৪.৫% কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ মহামারীতে একটা জন কল্যাণকর সরকার যা যা সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক তার বিপরীত জন বিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে মোদী সরকার এই ক্ষুধার সাম্রাজ্যকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।

হাঙ্গার ওয়াচ রিপোর্ট মহামারীতে উদ্ভুত খাদ্য সংকট সামলাতে সরকারের প্রতি ১২টি সুপারিশ করেছে। তারমধ্যে কয়েকটি হলো একটি সর্বজনীন খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা যা প্রতিটি ব্যক্তিকে কমপক্ষে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য ১০ কেজি শস্য, ১.৫ কেজি ডাল এবং ৮০০ গ্রাম রান্নার তেল সরবরাহ করে। তৎসহ দূরত্ব, স্যানিটাইজেশন ইত্যাদি সম্পর্কিত সমস্ত সুরক্ষা নির্দেশিকা অনুসরণ করে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এবং স্কুল মিড ডে মিল ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ডিম সহ পুষ্টিকর গরম রান্না করা খাবার বিতরণ করা, কোভিড মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের অগ্রাধিকার দিয়ে সার্বজনীন শিশু যত্ন ও তদারকি ব্যবস্থা; বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, নিঃসঙ্গ মহিলা ও দিব্যাঙ্গদের মাসে ২০০০ টাকা ভাতা; এনরেগা প্রকল্পে পরিবার পিছু বছরে ২০০ দিনের কাজ এবং সময় মতো মজুরি প্রদান নিশ্চিত করা, শহরে অস্থায়ী শ্রমিকদের সম্মানজনক মজুরি বৃদ্ধি। জাতীয় নগর কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প অবিলম্বে চালু কর দরকার যা বিভিন্ন নামে ওড়িশা ঝাড়খণ্ড ও হিমাচল প্রদেশে চলছে।

– মৃনাল 

The bait of citizenship

গত ২৮ মে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে যে পাঁচটি রাজ্যের তেরোটি জেলায় পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা অমুসলিম ছয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। এই পাঁচটি রাজ্য হল গুজরাট, ছত্তিসগড়, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং রাজস্থান – গুজরাটের চারটি জেলা, ছত্তিসগড়ের দুটি, রাজস্থানের পাঁচটি, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের একটি করে জেলা। যে ছয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে তাঁরা হলেন – হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান এবং পার্সি। লক্ষ্যনীয় যে কেন্দ্রীয় সরকার বলছে ডিসেম্বর, ২০২০-র সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) অনুযায়ী নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না কারণ সেই আইনের নিয়মকানুন এখনো তৈরি হয়নি। এই নোটিফিকেশনে বলা হচ্ছে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৫-র সেকশন ৫, ৬ এবং সিটিজেনশিপ রুলস, ২০০৯ মোতাবেক।

১৯৫৫র আইনের ৫ নম্বর ধারায় কী আছে? সেখানে কারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন বলা হচ্ছে? প্রথমত তিনি বেআইনি অভিবাসী অর্থাৎ ইল্লিগাল মাইগ্রেন্ট নন। দ্বিতীয়ত আবেদনকারীকে অন্তত সাত বছর ভারতে বসবাস করতে হবে। তৃতীয়ত তাঁকে জন্মসূত্রে ভারতীয় হতে হবে এবং অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাইরে অন্য কোনও দেশের নাগরিক হতে হবে। চতুর্থত তিনি কোনও ভারতীয় নাগরিকের পতি বা পত্নী যিনি অন্তত সাত বছর এই দেশে বসবাস করেছেন। পঞ্চমত কোনও ভারতীয় নাগরিকের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানরা। ধারা ৬ নম্বরে ন্যাচারালাইজেশন-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা বলা আছে। ন্যাচারাইলেজশন হল রাষ্ট্র যখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাউকে নাগরিকত্ব প্রদান করে অথবা যখন কেউ কোনও জটিল প্রক্রিয়া বা আইনের বাঁধা ছাড়াই শুধুমাত্র আবেদন করে নাগরিকত্ব পেতে পারেন। ২০০৯-এর সিটিজেনশিপ রুলস হচ্ছে কোন ফর্মে কীভাবে এবং কার কাছে আবেদন করতে হবে এই সংক্রান্ত নিয়মাবলী।

প্রথমেই বলা হচ্ছে ‘বেআইনি অভিবাসী’ আবেদন করতে পারবেন না। ‘বেআইনি অভিবাসী’ কারা এর ব্যাখ্যা ২০০৩-এর নাগরিকত্ব আইনে আছে। সেখানে বলা হচ্ছে যাঁরা পাসপোর্ট ছাড়া অথবা ভিসার মেয়াদ ফুরানোর পরও এ দেশে থেকে গেছেন তাঁরাই ‘বেআইনি অভিবাসী’। এর অর্থ যাঁদের পাসপোর্ট আছে কিংবা ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যায়নি তাঁরাই খালি আবেদন করতে পারবেন। যাঁরা ঐ তিনটি দেশ থেকে এখানে আশ্রয়ের খোঁজে এসেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বিভিন্ন চাপে পড়ে এসেছেন। এর ফলে তাঁদের কাছে পাসপোর্ট নাও থাকতে পারে। নতুন দেশে সরকারি আইনকানুন সম্পর্কে পরিচিত না হওয়ার কারণে অনেকেই ভিসার মেয়াদ না বাড়িয়ে থাকতে পারেন। সুতরাং এই সব মানুষ তাঁরা অমুসলিম হলেও কিন্তু নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারছেন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ১৯৫৫-র আইনের ৫ ও ৬ নম্বর ধারা দুটিতে কোনও বিশেষ দেশ (পড়ুন পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ) থেকে আসা মানুষদেরই শুধু নাগরিকত্ব দেওয়া হবে এটা কোথাও বলা হয়নি। তেমনি অমুসলিম সংখ্যালঘুদেরই শুধু নাগরিকত্ব দেওয়া হবে এটাও বলা হয়নি। ঐ আইনে কারা আবেদন করতে পারেন এবং মূলত কী কী শর্তে তার সারমর্ম ওপরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনটি দেশ থেকে আগত মানুষ এবং ছয়টি অমুসলিম জনগোষ্ঠির কথা শুধুমাত্র ২০১৯-এর কুখ্যাত সিএএতেই আছে। এর থেকে এটা পরিষ্কার কেন্দ্রীয় সরকার মুখে ১৯৫৫-র আইন এবং ২০০৯র নিয়মাবলী বললেও বাস্তবে তারা ২০১৯-এর কুখ্যাত আইনই অনুসরণ করছে, যে আইনের নিয়মাবলী তাদের কথাতেই এখনো তৈরি হয়নি। এর জন্য বিরোধীরা সংগত ভাবেই আওয়াজ তুলেছে যে এটা ঘুর পথে সিএএ চালু করার চেষ্টা। আমরা এটাও জানি যে আসামে আসু এবং অন্যান্য সংগঠন এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আন্দোলনে নেমে পড়েছে।

তাহলে হঠাৎ সরকার ঝুলি থেকে এই বিড়ালটা বার করলো কেন? তারা বলেছিলো বাংলায় নির্বাচনে জিতলে মন্ত্রীসভার প্রথম মিটিংয়েই তারা সিএএ লাগু করবে। তা বাংলার মানুষ তো মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে। কিছু পেটোয়া লোক নাকি কান্না গাইছে যে ১৩টি জেলার মধ্যে, বাংলার একটিও জেলা নেই যেখানে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। বুদ্ধুরা এটা জানেনা যে যেই মুহূর্তে যিনি আবেদন করবেন, ঠিক তখন থেকেই এতদিন তিনি যে ভারতবর্ষে বসবাস করেছেন, চাকরি-বাকরি করেছেন, ভোট দিয়েছেন সমস্ত কিছুই তিনি বেআইনি বলে স্বীকার করে নেবেন। তিনি তাঁর এতদিনের বসবাস ও কর্মসূত্রে স্বাভাবিকভাবেই নাগরিক, তাঁকে আবার নতুন করে আবেদন করতে হবে কেন? দেশটা কী কারো বাপের সম্পত্তি! দাবি হবে এটাই যে দেশের প্রতিটি মানুষকে নিঃশর্তে নাগরিকত্ব দিতে হবে।

২০১৮-র অক্টোবর মাসেও কেন্দ্রীয় সরকার সাতটি রাজ্যের ষোলোটি জেলায় নাগরিকত্ব দেওয়ার নোটিশ জারি করেছিল। তখন দু-মাসের মধ্যেই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, তেলেঙ্গানা এবং মিজোরামে বিধানসভা নির্বাচন ছিল। হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ধুয়ো তুলে একটা মেরুকরণ করার চেষ্টা হয়েছিলো যদিও চারটি প্রধান রাজ্যেই বিজেপি বিপর্যস্ত হয়েছিল। এখন তো সামনে কোনও নির্বাচন নেই কিন্তু গত সাত বছরে বিজেপি কখনো এরকম গভীর সংকটের সম্মুখীন হয়নি। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের অকর্মণ্যতাকে বেআব্রু করে দিয়েছে। বিদেশে ছত্রিশ ইঞ্চির ভাবমুর্তি কলুষিত, কৃত্তিমভাবে ফুলিয়ে তোলা তাঁর ফানুশ চুপসে গেছে, দেশে তাঁর জনপ্রিয়তা তলানীতে, অর্থনীতি অভুতপূর্বভাবে বেহাল। এই অবস্থায় মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র ঘোরানো আবশ্যক। আগামী মার্চের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, পাঞ্জাব সহ পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন। সঙ্ঘীদের সবচেয়ে চিন্তা ইউপি নিয়ে। পঞ্চায়েতে বিপর্যয়ের ফলে তাঁরা ত্রস্ত। তার ওপর অতিমারীর ফলে ঐ রাজ্যের মানুষের অবস্থা শোচনীয়। নির্বাচনের দশ মাস আগে থেকেই তারা ২০০০০ গ্রামে প্রচার শুরু করে দিয়েছে। মুখে তারা বলছে এটা করোনা সেবা প্রকল্প কিন্তু আসলে এটা নির্বাচনি প্রচারের শুরুয়াত ছাড়া আর কিছু নয়।

এই অভুতপূর্ব সংকট থেকে সাময়িক ভাবে রেহাই পাওয়ার জন্য বিজেপি এখন যে কোনও ইস্যুকে ঢাল করতে চাইছে। নাগরিকত্ব প্রদান করার এই নোটিশ এরকমই একটা জুমলা।

- সোমনাথ গুহ 

A strange thing happened in jail

বিচারের প্রত্যাশায় বা বিনা বিচারে জেলের মধ্যে কেমন কাটে? কেমন করে কাটাতে হয় রাজনৈতিক বন্দিদের?

সাতাত্তর সাল। বন্দিমুক্তি আন্দোলনের অভিঘাতে তখন জেলের বন্ধ গরাদ কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাইক্রোফোনে ভেসে আসা দূরাগত এক গানের কলি বহরমপুর জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে কেমন করে যেন ঢুকে পড়েছিল। সেলবন্দী, বহুদিনের উপোসী চোখে বাইরের পৃথিবীটা দেখার আকাঙ্ক্ষা মুহূর্তের জন্য তীব্র হয়ে উঠেছিল।

সাতাত্তরে সদ্য ছাড়া পাওয়া এক ‘মিসা’বন্দির মুখে শোনা। প্রথমবার সদ্যতরুণ আনকোরা সেই ডাক্তারি-পড়ুয়া কলেজ হোস্টেলে দাদাদের পাঠচক্রে বার কয়েক যোগ দেওয়ার ‘অপরাধে’ গ্রেফতার হয়েছিল মিথ্যা অভিযোগে। ‘চটিপরা পুলিশ’ সব শাসকেরই থাকে। সবক শেখানোর দায়িত্বটা তারাই নিয়ে বেধড়ক মারে সারা শরীর রক্তাক্ত করে, সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে, অন্তর্বাসটুকুও পুড়িয়ে দিয়ে উর্দি পরা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। মাসখানেক পরে ছাড়া পাওয়া। মিথ্যা অভিযোগে অপমান নিগ্রহ সদ্য আঠেরো পেরোনো মনে এবার সত্যি সত্যিই বিপ্লবের আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার’ আহ্বানে সাড়া দিয়ে পূর্ণোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া। কমরেড চারু মজুমদার শহীদ হওয়ার পর ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ অভিযোগে আবার গ্রেফতার হওয়া। পুলিশ অফিসার রুণু গুহ নিয়োগী বুকটা বুট দিয়ে ডলে ঘৃণাভরা তচ্ছিল্যে বলেছিল “নকশাল! বীরপুরুষ! বুকের পাঁজর গোনা যায়।” সেই ছিল প্রথম সম্ভাষণ। তারপর তো চলেছে অনেক বর্বরতা। বিনা বিচারে আটক থাকার বন্দিজীবনে ধরেই নিতে হয়েছে, যে কোনোদিন ‘এনকাউন্টারের’ নাম করে মেরে দেবে, নয়তো জেলেই পচে মরতে হবে। বাড়ির লোকজনও এরকম ভেবেই মনকে তৈরি রাখতেন। এটা নকশাল আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর একজনের কথা।

প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও ছবিটা প্রায় একই। শাসকের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই ‘দেশদ্রোহী’র তকমা। সেই শাসকের পোষা গুণ্ডাবাহিনীর সবক শেখানো। ব্রিটিশ আনুগত্যের স্মারক সেই কালাকানুন-ইউএপিএ!

গত বছর সিএএ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ‘অপরাধে’ মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন দেবাঙ্গনা কলিতা, নাতাশা নারওয়াল, সাফুরা জারগর, উমর খলিদ সহ বহু ছাত্রছাত্রী, গবেষক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মী। পঞ্চাশ বছর পরেও ছাত্রসমাজের চেহারাটা মূলগতভাবে একই রকম আছে। নাগরিকত্বের আন্দোলনে ভারতবর্ষের প্রায় প্রত্যেকটি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সমাজ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। এরপর ঘটে দিল্লীর কুখ্যাত হত্যাতাণ্ডব হিন্দুত্ববাদীদের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায়। ‘দিল্লীর দাঙ্গায়’ জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগে গত বছর ২৩ মে দেবাঙ্গনা কলিতা ও নাতাশা নারওয়ালকে গ্রেফতার করে দিল্লী পুলিশ। ‘পিঞ্জরা তোড়’-এর এই নেত্রীরা লিঙ্গ সাম্য, ছাত্র অধিকার সহ নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। জেএনইউ-এর গবেষক দেবাঙ্গনাকে প্রায় ডজনখানেক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। বেশ কয়েকটিতে জামিন পেলেও এখনও বিনা জামিনে তিহার জেলে বন্দি আছেন। দেবাঙ্গনা কবিতা লেখেন, গোন্দ শিল্প শৈলীতে চমৎকার ছবি এঁকেছেন জেলে বসে। গত বছর তিনি এক বন্ধুকে চিঠি লেখেন জেল থেকে । কবিতার মতো সুন্দর চিঠিটির অনুবাদ নীচে দেওয়া হল। মূল লেখার সৌন্দর্য অনুবাদে অনুপস্থিত – বলাই বাহুল্য।

কাল জেলে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল! গত চিঠিতে আমি বলেছিলাম, রামধনু আর জোনাকি নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে কত মজা করেছিলাম। আমি ওদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম – রামধনু কী আর তার রংগুলো কী কী। তিনটে বাচ্চা – দু’বছরও হয়নি – ওরা তো আর আমাদের মতো কথা বলতে পারে না। একটি দু’বছরের – সেটি অল্প অল্প কথা বলে। আর আছে বছর চারের কয়েকটি খুকী – তাদের মুখে তো কথার খৈ ফুটছে! আমাদের কাছে লাল ক্রেয়নের একটা ছোট্ট ভাঙা টুকরো ছিল। তাই বাকি রংগুলো আমাদের পুরোনো খবরের কাগজ থেকে খুঁজে নিতে হয়েছিল। তারপর সেগুলো ছিঁড়ে বার করে নিয়ে আমরা রামধনুর কোলাজ বানিয়েছিলাম। বাচ্চারা খুব খুশি হয়েছিল। ওদের কৌতূহলও অনন্ত। ওরা বেশ ভাবনায় পড়ে গিয়েছিল – “আকাশে এত রং কোথা থেকে আসে গো?” সবচেয়ে বড়টি জিজ্ঞাসা করেই যাচ্ছিল।

আর তারপরে, এক্কেবারে হঠাৎ সেই ঘটনাটা ঘটল! গতকাল সন্ধ্যেয়! সন্ধ্যের মুখে, সূর্যাস্তের ঠিক আগে ঝিলমিল কণাগুলো আমাদের চোখের সামনে নাচতে থাকে, মনে পড়ছে এক সন্ধ্যেয় সেই ‘আবিষ্কারের’ কথা?

আকাশটা ছিল অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি নীল আর পরিষ্কার। বিকেলের আলো ছিল নরম, মোহময়। ম্রিয়মান সূর্য কখনও মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছিল, কখনও আড়াল সরিয়ে বেরিয়ে পড়ছিল। খুব হালকা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছিল। আমার মধ্যে একটা প্রত্যাশা জাগছিল, কিন্তু আশা করতেও ভয় করছিল।

আন্টি ই ই ই! দ্যাখো *রা ম ধ নু*!! হঠাৎ সবচেয়ে বড়টি চীৎকার করে উঠল। হ্যাঁ, ওরা আমাদের ‘আন্টি’ই বলে। আমার মনে হয়, ওদের মায়েদের প্রায় সবার থেকেই, আমরা অন্তত পাঁচ বছরের বড়। ওরা (মায়েরা) সবাই আমার বেড়ে চলা রূপোলি চুলের দিকে আঙুল তুলে অনুযোগ করে, আমার চুলে রং করা উচিত। কিন্তু সবচেয়ে আগে তো চুলে চিরুনি চালাতে হবে! জেনানা ফাটকে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো, সেই চুলে জটিল বিনুনি বাঁধা, চুলে রং করা – এসব তো ‘কম্যুনাল অ্যাকটিভিটিজ’!

আরে হ্যাঁ, তাইতো! আকাশে একটা সত্যিকারের রামধনুই তো বটে! আমাদের ওয়ার্ডের সামনে আকাশ জুড়ে একটা ধনুর বিশাল টুকরো ফুটে উঠছে! বাচ্চারা উত্তেজনায় ফুটছে। সকলেই চাইছে একটু উঁচুতে তুলে ধরা হোক, আরেকটু ভালো করে তারা দেখবে! চারিদিকে হৈ হৈ, মেয়েরা চীৎকার করে এ ওকে ডাকছে, একবারটি বেরিয়ে এসে দেখার জন্যে।

মেঘ সরে যেতেই পরিষ্কার নীল আকাশ আরও উন্মুক্ত হল-আস্ত একটা রামধনু! এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত-গোটা ধনুটি ফুটে উঠতেই সব চেয়ে কুট্টিটা-এক ব্রাজিলিয়ান বাচ্চাছেলে-চীৎকার করে বলে উঠল “হাল্লেলুজা”---তার মুখে প্রথম উচ্চারিত শব্দ! সবাই হতবাক! আফ্রিকান বন্দিদের জন্য যিশুর উপাসনা অনুষ্ঠান হয়,বেশ জাঁকালো অনুষ্ঠান, কয়েক মাস আগে সেখান থেকেই হয়তো সে এটা শুনে রপ্ত করেছে।

রামধনু, আস্ত রামধনু দেখার আনন্দটা একটা প্রগাঢ় উত্তেজনা, একটা ঐকান্তিকতায় যেন সকলকে সংক্রমিত করে ফেললো।

আবেগ যেন উপচে পড়ছে। কেউ তদ্গত হয়ে উচ্চকণ্ঠে প্রার্থনা শুরু করল। কেউ আকাশের দিকে দু-হাত তুলে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। কেউ চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। কেউ আবার নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো স্মিতমুখে। কেউ তীব্রসুরে ‘দুয়া’ জানাতে লাগল। কেউ আবেগে ঈশ্বরকে ডেকে উঠল। কে আবার যেন অভিশাপ দিয়ে উঠল কাকে! কেউ চোখ পিটপিট করে সাতটা রং গোনার চেষ্টা করতে থাকল। সেগুলো কি তখন ওখানে ছিল? সত্যিই কি আসলটি তখন ওখানে ছিল? কেউ হাত দুটো আড়াআড়ি রেখে ‘উইশ’ করল। রামধনুর গায়ে একঝাঁক উড়ন্ত পাখির সিল্যুয়েট। যেমনটা শীতের গোধূলিতে নদীর ধারে দেখা যায়, আমার মনে পড়ে গেল।

অনেক বন্দির কাছেই এটা প্রথম রামধনু দেখা – “কখনও ভাবিনি জেলে এসে প্রথম রামধনু দেখব!” বাচ্চারা অবশ্য সবাই এই প্রথম দেখল। তাদের এক বন্ধু বলেছিল, “এটা আমাদের স্বাধীনতার টিকিট”

– আমাদের পথ-আমাদের খুঁজতে হবে এর শেষটা কোথায় শুরু হচ্ছে।

আশা ছিল, প্রবল আশা! বিচিত্র কোলাহলের মধ্যে ধ্বনিত অসম্ভব আশা! সব কিছু যেন মুহূর্তের জন্য থমকে দিয়ে শুধু এক আনন্দের লহর ভেসে বেড়ালো!

আমি ভীষণ মুষড়ে পড়লাম। একটা পরাজয়-রামধনুর ‘আশাপূরণের’ অক্ষমতায়-ওর অনিবার্য ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’। ওর ক্ষণস্থায়িত্ব আমাকে বিষণ্ণ করে তুলেছিল।

কয়েক মুহূর্ত পরে আমাদের তালাবন্দি হওয়ার সময়। এটা জেনেই বোধ হয় রামধনু আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। বাচ্চারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল “আন্টি, ও কোথায় চলে গেল? “ও কেন চলে গেল?” “ও কাল আসবে?” বিরামহীন প্রশ্নের অবরোধে পড়ে গেলাম। ওদের খুশি করা উত্তর থোড়ি দিতে পারলাম! এমনকি আবহমান কালের একটা প্রশ্ন, “ও কেন আসে?” – তারও উত্তর দিতে পারিনি! একটা রামধনু কেন আসে, কীভাবে আসে আর কেনই বা চলে যায়। তোমার মনে আছে?

আজ বিকেলে বাচ্চারা পার্কে অনেক আশা নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসেছিল তাদের ছোট্ট মেরী গো রাউন্ডে, “ও কি আজ আসবে?”

আমি সেই ছোট্ট বিজ্ঞ ছেলেটির কথা ভাবছিলাম, যার সঙ্গে এক শীতে, মহল্লায় আমাদের দেখা হয়েছিল। আর ভাবছিলাম, পুরোনো শহরটার আকাশে সে কি শেষপর্যন্ত রামধনু দেখতে পেয়েছিল!

২০২০-তে সাজানো মিথ্যে অভিযোগে ইউএপিএ-তে গ্রেফতার হওয়া আর এই একই বছরে রামধনুর মুখোমুখি হওয়া! পুরোনো শহরের দূষিত আকাশে, এমনকি জেলেও একটা আস্ত ‘রামধনু’ দেখতে পাওয়া! এখন আমরা একটি জোনাকির অপেক্ষায়!”

(ইংরেজিতে লেখা মূল চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছে RAIOT ২৩ মে, ২০২১ সংখ্যায়)

-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত 

Press Statement of Tripura

প্রতি
সম্মানিত জেলাশাসক ও সমাহর্তা,
উত্তর ত্রিপুরা জেলা, ধর্মনগর।
(বিডিও, কালাছড়া, আর ডি ব্লক, মহাশয়ের মাধ্যমে)

বিষয় : কোরোনা দ্বিতীয় আবহে মানবিক বিপর্যয়কালে মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাগুলি কর্তৃক গরিব অংশের মহিলাদের জন্য দলগতভাবে দেয় ঋণের কিস্তি ও সুদ আদায় নিয়ন্ত্রণ করা, আপাতকাল বন্ধ করা, বিশেষ ছাড় দেওয়া, সরকারি ব্যাংক হতে স্বল্প সুদে ঋণ মঞ্জুর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি।

মহাশয়,

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও ক্ষুদ্র ঋণ মুক্তি সমিতি, ধর্মনগর মহকুমা কমিটির পক্ষ থেকে আমরা উপরে বর্ণিত বিষয়ের উপর আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করছি। কোরোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ের তান্ডবের সাথে অর্থনৈতিক মন্দার যুগলবন্দীতে স্বাধীন উত্তর ভারতে আমরা প্রথম এমন এক মানবিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছি। এই ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতিতে অর্থনীতির অভিমুখ আমূল পরিবর্তন করে জরুরী ভিত্তিতে জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে, সাধারণ জনগণের আয় ও রোজগার সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারী ব্যয় বৃদ্ধি করতে ও ক্ষুদ্র ঋণ মুক্তির জন্য বিশেষ ছাড় দিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। ইতিমধ্যে সারা রাজ্যে ও আমাদের জেলায় ঋণ গ্রহিতা গরিব পরিবারগুলির উপর মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাগুলির জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাংকের নীতি নির্দেশিকা এক্ষেত্রে অমান্য হচ্ছে। জেলা স্তরে কঠোরভাবে এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। অধিকাংশ গরিব সাধারণ পরিবারগুলির জন্য কাজ নেই। তাঁরা রোজগারহীন। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কোরোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ের তান্ডব। এই সংকটে ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করা অবাস্তব ও অমানবিক। আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে আবার তৃতীয় ঢেউয়ের আশংকা প্রকাশ করছেন বিজ্ঞানীরা।

তাই আমাদের দাবি –

(১) মহামারীর সময় মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাগুলি কর্তৃক দলগতভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে দেয় ঋণের কিস্তি ও সুদ আদায় আগামী ছয় মাস অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত স্থগিত রাখতে হবে। এই ছয় মাসের জন্য সুদ মুকুব করতে হবে। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে যে কোনো ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সরল সুদে হিসাব করতে হবে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারকে এই ঋণের বোঝা গ্রহণ করে গরিবদের এই ক্ষুদ্র ঋণ ফাঁদ থেকে মুক্তি দিতে হবে।

(২) মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাগুলির মহাজনী কারবার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত তদারকি করার জন্য জেলা স্তরে রেগুলেটরি অথরিটি গঠন করতে হবে (রিজার্ভ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারে)।

(৩) সরকারী ব্যাংক হতে স্ব-সহায়ক দলভুক্ত মহিলাদের স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। দলভুক্ত মহিলা সদস্যদের দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শহরে টুয়েপ ও গ্রামে পাহাড়ে রেগা প্রকল্পে ২০০ দিনের কাজ ও ভোগ্য পণ্য মূল্য সূচক অনুযায়ী দৈনিক মজুরি ৬০০ টাকা বৃদ্ধি করতে হবে।

(৪) বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৫ অনুসারে লকডাউন (যে নামেই হোক না কেন) এর দায়ভার সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। আয়কর দিতে হয় না এমন পরিবারে আগামী ছয় মাস প্রতি মাসে সাড়ে সাত হাজার টাকা করে নগদে অর্থ সহায়তা করতে হবে।

(৫) পেট্রোপণ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও ঔষধপত্রের লাগামহীন আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ধন্যবাদ সহ
পম্পা নাথ, সভাপতি, ঋণ মুক্তি সমিতি।
আতারুন নেছা, সম্পাদক, ঋণ মুক্তি সমিতি।
সম্পা নাথ, কোষাধক্ষ্য, ঋণ মুক্তি সমিতি।
ধর্মনগর, উত্তর ত্রিপুরা।

Black Day was observed in Gaighata

গত ২৬ মে সারা ভারত কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির ডাকে দেশজুড়ে কালা দিবস পালন করার আহ্বান জানিয়েছিল। ৬ মাস যাবত দিল্লির বুকে কৃষক সংগঠন ৩ কৃষি আইন যা সম্পূর্ণ কৃষক স্বার্থবিরোধী তাই ওই আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এই আন্দোলন ক্রমাগত সারাদেশের সমস্ত রাজ্যের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা ভারত কিষান মহাসভার পক্ষ থেকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গাইঘাটা ব্লকের ঢাকুরিয়া গ্রামে কোভিড পরিস্থিতিতে নিয়ম মেনে ইয়াস ঝড়ের আবহাওয়ায় কালো পতাকা নিয়ে, নরেন্দ্র মোদির প্রতিকৃতি কার্টুন আকারে তৈরি করে সেটা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কৃষক স্বার্থবিরোধী মোদি সরকার নিপাত যাক! ৩ কৃষি কালা আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে! – স্লোগান দেওয়া হয়। অংশগ্রহণ করেন বাচ্চু বিশ্বাস, কমল কর্মকার, চম্পালতা প্রামানিক, গোপাল সরকার, কৃষ্ণপদ প্রামানিক, আঁখি প্রামানিক।

Naxalbari Day is celebrated

গত ২৫ মে ৫৪তম নকশালবাড়ি দিবস পালন করা হলো গাইঘাটা ব্লকে ঢাকুরিয়া পার্টি অফিসে। কৃষক আন্দোলনের বীর শহীদদের জানাই লাল সেলাম, দেশ জুড়ে কোভিড গণহত্যার জন্য দায়ী মোদি সরকার ধ্বংস হোক, স্লোগান তুলে পতাকা অর্ধনমিত করা হয়। তারপর পার্টি অফিসে বসে আজকের দিনের নকশালবাড়ি আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। পার্টির আহবানে মানুষের পাশে কিভাবে দাঁড়ানো যায়? আলোচনা শুরু হয়। সেদিনের নকশালবাড়ি, সিপিআই(এমএল) পার্টি গঠন, কমরেড চারু মজুমদার এর ভূমিকা, এবং বিহার বিধানসভা নির্বাচন ও পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে পাটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, কমিউনিস্ট আন্দোলনে সিপিএমের রাজনীতির সাথে আমাদের রাজনীতির সংগ্রাম এক নতুন সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে - সংক্ষিপ্ত এই আলোচনার কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে কয়েকজন কমরেড তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। ঢাকুরিয়া, চাঁদপাড়া, বকচারা, ফুলসড়া সহ বহু গ্রামে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। সাহিত্যিক সুরঞ্জন প্রামাণিক এর কাছ থেকে তার বোন রিনা মজুমদার কোভিড আক্রান্তের খবর পেয়ে তাকে চিকিৎসার জন্য বনগাঁ হসপিটালে ভর্তি করা হয়, পরে তিনি মারা যান। বহু মানুষ চাঁদপাড়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে টিকা পাবার জন্য কোভিড পরীক্ষার জন্য যাচ্ছেন কিন্তু সেখানে অতিরিক্ত ভিড় এবং ঠিকানা পেয়ে মানুষ ফিরে আসছে। এই পরিস্থিতিতে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য গ্রামীণ উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে টিকা ও কোভিড পরীক্ষার উপসর্গ সংগ্রহ করার উপর জোর দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা দরকার। পার্টির নেতৃত্বের কয়েকজন আলোচনা করে বিএমওএইচ-এর নিকট প্রতিনিধি ডেপুটেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারপর ২৪ মে, ডেপুটেশন হয়।

নকশালবাড়ি দিবসে অংশগ্রহণ করেন – কমরেড কমল কর্মকার, চম্পালতা প্রামানিক, বাচ্চু বিশ্বাস, হিমাংশু বিশ্বাস, সুবোধ দাস, শচীন রায়, কৃষ্ণপদ প্রামানিক।

Comrade Renu Das_0

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি লোকাল কমিটির অন্তর্গত শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির সদস্যা কমরেড রেনু দাস ৩১ মে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে মারা গেছেন। রেনু দাস বেশ কিছুদিন ধরে কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। গত ১২ মার্চ শীতলকুচির ঘটনায় ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে যে কর্মসূচী নেওয়া হয়েছিল সেখানেও উনি উপস্থিত ছিলেন।

কমরেড রেনু দাস লাল সেলাম।

Arunav Lahiri

বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক, মঞ্চ পরিচালক এবং সমাজসেবী অরুণাভ লাহিড়ী ২৩ এপ্রিল, ২০২১, শুক্রবার তাঁর অগণিত অনুরাগী, ভক্তবৃন্দ ও পরিবারের সদস্য ও পরিজনদের ছেড়ে পরলোকে চলে গেলেন। তিনি আমৃত্যু পারিপার্শ্বিক সকল মানুষকেই স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধার আলিঙ্গনে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তাঁর জীবনচলার এই অনন্য ছবি সকল মননকেই উদ্ভাসিত করে তুলেছিল। মন যেন বারবার বলে ওঠে, “দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া”।

তিনি ৫০টির বেশি মঞ্চানুষ্ঠান প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছিলেন। ‘দুই রাজা ভিন্ন আড়াল’ এক নবধারার প্রযোজনা। আবৃত্তি কোলাজ, ‘কলকাতা স্মৃতি ও সময়’ এক অভুতপূর্ব ভাবনা যা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দ্বারা সমাদৃত হয়েছিল। ‘দেশ ও মানুষ’ নৃত্য গীত সহযোগে একটি মঞ্চ উপস্থাপনা যা সংঘবদ্ধ সংগ্রাম ও সম্প্রীতির ভাবনায় উজ্জ্বল। তিনি রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা নাটক ও নৃত্যনাট্য একই মঞ্চে অভিনব আঙ্গিকে পরিবেশনা করেছিলেন। কবির গান, কবিতা ও প্রবন্ধ  আজীবন তাঁর নিবিড় চর্চার বিষয় ছিল। রবীন্দ্রনৃত্য সম্পর্কিত ভাবনায় তিনি নতুন দিক উন্মোচিত করেছেন। এই বিষয়ের ওপর তাঁর কাজ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনৃত্য সম্পর্কিত তাঁর একটি ভাষণ সর্বজনশ্রদ্ধেয় শ্রী শান্তিদেব ঘোষ বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর বই ‘নৃত্য পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ’ গুণিজন দ্বারা সমাদৃত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বই হল, ‘রুটি ও পৃথিবী’, ‘ আদি মধ্যযুগে বাংলাসমাজ’, ‘নমি চরণে’ ইত্যাদি। শিশুদের জন্যও প্রচুর লেখালেখি করেছেন। ‘শিশুর পৃথিবী’ ও ‘নদীর নাম ঘুঙুর’ শিশুদের ওপর তাঁর দুটি জনপ্রিয় ছড়ার বই। এছাড়া তাঁর সৃষ্টির তালিকায় বহু শ্রুতিনাটক ও গীতিনাটকের পান্ডুলিপি রয়েছে। উল্লেখযোগ্য দুটি হল ‘জন্মোৎসব’ এবং ‘সামাজিক বর্ণমালা’।  

রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের ৬১৭টি গানের প্রেক্ষিত নিয়ে টীকা ও দর্শন সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ যন্ত্রস্থ আছে যা শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যেটি প্রকাশনার অপেক্ষায় সেটি হল ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ’। এইচএমভি এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে তাঁর সম্পাদনায় অনেক ক্যাসেট ও সিডি প্রকাশিত হয়েছে।

অরুণাভ লাহিড়ীর জন্ম ১৯৫৩ সালে। তিনি আরএসপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুপন্ডিত তারাপদ লাহিড়ীর চতুর্থ সন্তান।

-- ভাস্বতী সান্যাল 

 

"human doctor" passed away

এক জন সদাহাস্য মানুষ যিনি খুব সহজেই মিশে যেতে পারতেন যে কোনো মানুষের সাথে। দীর্ঘ দিন পেশাগত ভাবে ডাক্তারি করেও যিনি তথাকথিত ‘এলিট ডক্টর’ হয়ে থেকে যাননি। রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল-প্রচারে অংশ নিতেন ছক-ভাঙা কায়দায়। সাধারণ মানুষের কাছে ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াকেই নিজের রাজনৈতিক-সামাজিক কর্তব্য বলে মনে করতেন। তার সাথেই রাজনৈতিক-সামাজিক সচেতনতাকে ছড়িয়ে দেওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতেন। সেই ডাক্তার কমরেড সমীর দাশগুপ্ত ৩১ মে চলে গেলেন।

১৯৫৩ সালের ২১ জুলাই তাঁর জন্ম। ১৩ মে কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট আসায় ১৪ তারিখ নিজেই ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। খবর দিয়েছিলেন শুধুমাত্র নিজের খুব কাছের সুহৃদ কমরেড অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরীকে। রাজারহাট সিএনসিআই থেকে শুরু করে কলকাতা মেডিকেল কলেজের আইসিইউ পর্যন্ত লড়াই করলেন কমরেড সমীর দাশগুপ্ত, কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

বরাবরই নিজের সম্পর্কে উদাসীন এই মানুষটি আরও আগে হয়তো নিজের যথোপযুক্ত চিকিৎসা শুরু করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরে সিপিআই(এমএল)-এর যাদবপুর-ঢাকুরিয়া লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদক, কমরেড অমলেন্দু চৌধুরী ও কমরেড প্রদীপ মন্ডল রামগড় এলাকায় তাঁর পরিবারের সাথে দেখা করেন। সেখানেই এই বিষয় নিয়ে আক্ষেপ করছিলেন কমরেড সমীর দাশগুপ্ত-র বড় মেয়ে অন্বেষা, যিনি নিজেও পেশাগতভাবে দূর্গাপুরে কর্মরত এক জন স্বাস্থ্যকর্মী। সমীর দাশগুপ্তের স্ত্রী ও পুত্র জানান, এই মানুষটি সত্যিই সকলের থেকে আলাদা ছিলেন। অন্বেষা বলেন “বাবা হাসপাতালে যাওয়ার দিন বলে গিয়েছিল ৭ দিনের জন্য বিশ্রাম নিতে যাচ্ছি। তারপর ওখান থেকে উত্তরবঙ্গে একজনের বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে যাব। তাই জামা-কাপড় গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছি”।

সত্যিই কমরেড সমীর দাশগুপ্ত হাসপাতালে যাওয়ার সময়ে একটি বড় ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে ছিল পাটভাঙা পাজামা পাঞ্জাবি। সে সব পরিজনেরা হাসপাতালেই ফেলে রেখে এসেছেন বুকের ব্যথা নিয়ে। পরিবারের চার জন সদস্য কেবল ডাক্তারবাবুকে শেষ বিদায় জানাতে পেরেছেন হাসপাতালে।

তাঁর স্ত্রী বলছিলেন, সংসার সম্পর্কে একটা অদ্ভুত উদাসীনতা কাজ করতো। নিজের বাড়ির দো-তলাটা পর্যন্ত ভালো করে চিনতেন না। একতলায় নিজের ছোট্ট ঘরে বসেই যাবতীয় কাজ করতেন, সময় কাটাতেন। মাঝে মাঝে ঝাড়খন্ডে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে মাছ রান্না করে নিয়ে যেতেন কমরেডদের জন্য। পুরোনো এমনই অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসছিল। সম্প্রতি কোভিডের সাথে লড়াই করে সুস্থ হয়ে উঠেছেন প্রয়াত সমীর দাশগুপ্ত-র স্ত্রী ও পুত্র। তাদের চিকিৎসার তদারকি করলেও কেন যে নিজের সংক্রমণ সম্পর্কে এতটা অসচেতন হলেন, সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না পরিবারের সদস্যরা। হাসপাতালে ভর্তির সময় থেকে কমরেড সমীর দাশগুপ্তের পরিবারের পাশে ছিল যাদবপুর-ঢাকুরিয়া এলাকার কোভিড টিম। হাসপাতালে ভর্তির আগের দিন পর্যন্তও তিনি যাদবপুরের কোভিড টিমের পক্ষ থেকে টেলি-মেডিসিন পরিষেবা দিয়েছেন সাধারণ রোগীদের। সেই “মানুষের ডাক্তারবাবু”-কে আজ লাল সেলাম দিয়ে বিদায় জানানো হল। তাঁর ফেলে রেখে যাওয়া কাজকে আমাদের সকলকে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতেই হবে।

- আকাশ দেশমুখ

***

উনি ডাঃ দেবীপ্রসাদ দাশগুপ্ত। বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে প্যাথোলজি ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকতা করে বেশ কয়েক বছর হল রিটায়ার করেছেন। পার্টির প্রথাগত সাংগঠনিক আধারে না থেকেও একেবারে পার্টিজান মানুষ, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা ব্যক্তিত্ব সমীর নামে পরিচিত ছিলেন। ধুর্জটিদার ঘনিষ্ঠতায় ঝাড়খন্ডের ডাক্তারবাবু থেকে শুরু করে কোথায় দূরে ময়নাগুড়ি চলে যেতেন। যাদবপুর কফি হাউসে চৌধুরীদার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা, কিংবা ক্রিক রোতে দিলদরিয়া মেজাজে সকলের সুপরিচিত সমীরদা। “ঝাড়গ্রামের মাওবাদী কমরেডদেরও পার্টিতে নিয়ে আসতে হবে বুঝলি” কিংবা দিনাজপুরের ইসলামপুরে আদিবাসীদের এআইপিএফ-এ নিয়ে আসতে হবে .... কত কিই না বলতেন, উদ্যোগও নিতেন। বাঁকুড়া থেকেই ওনার সাথে পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা। অনাবিল “তুই” করে ডাকা। মেডিকেল কলেজে ওনার কোয়ার্টার ছিল আমাদের অনায়াস শেল্টার। পার্থ ঘোষ বাঁকুড়া গেলে বলতেন, “এখানেই চলে আয়”। সমব্যাথী, পাশে থাকার একটা ভরসা। প্রাণবন্ত মানুষটা এভাবে চলে যাবেন ভাবাই যাচ্ছে না। সমীরদাকে জানাই লাল সেলাম।

- জয়তু দেশমুখ

***


কমরেড সমীর দাশগুপ্ত। যিনি শেষ দিকটা ছিলেন বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। তাঁর নিজস্ব গুনে উনি চিকিৎসক ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। পাটি সদস্য না হয়েও উনি পাটির বিরাট সমর্থক ছিলেন। বাঁকুড়াতে সামান্য একটু আন্দোলন হলে কি খুশি হতেন। গত বছর যখন বনের জমির আন্দোলন বা বিষ্ণুপুরের পৌরসভার কর্মচারীদের আন্দোলন হতে দেখে উনি বিরাট খুশি। আমার বাইকের পিছনে চেপে আদিবাসী গ্রামগুলোতে যেতেন। কিছু বলতেন না চুপচাপ শুনতেন। আদিবাসীদের খুব ভালোবাসতেন। মেডিকেল কলেজে দেখেছি আদিবাসী ডাক্তারদের সাথে বিরাট দহরম। ডেকে ডেকে আমাকে দেখিয়ে বলতেন আমাদের পাটির জেলা সম্পাদক। সদ্য নির্বাচনের পরে বললেন, কদিন পর যাচ্ছি বড় করে কর্মী বৈঠক করতে হবে। উনার আসা আর হল না। ভাবতে পারছি না উনি নেই।

- বাবলু ব্যানার্জী

***

আলিপুরদুয়ারে সমীরদার দিদির বাড়ি থাকার সুবাদে মাঝেমধ্যেই আসতেন। দিদির বাড়ির যে কোনো সময় আলিপুরদুয়ারে এলে ঠিক আগে থেকেই ফোন করতেন এবং এসেই আবার ফোন করতেন। একবারই অন‍্যথা হয়েছিল এবং সেটাই শেষবার। আলিপুরদুয়ারে এসে আবার কোচবিহারে চলে গিয়েছেন। বাবুনদার কাছে খবর পেয়ে আমি ফোন করতে বললেন “ইচ্ছে করেই ফোন করি নাই কারণ কোচবিহারে আসাটা জরুরী আছিল।” পরবর্তীতে ময়নাগুড়ি কেন্দ্রে চলে গেলেন। কোচবিহারে ফিরে তাঁর প্রস্তাব ছিল শীতলকুচিতে গুলিকান্ডের ঘটনায় পার্টির পক্ষ থেকে সরজমিন অনুসন্ধান দল যাওয়া উচিত। মূলত তাঁর উৎসাহেই তড়িঘড়ি একটা টিম গঠন করে (পার্টির রাজ‍্য কমিটির অনুমোদনক্রমে) শীতলকুচি যাওয়া হয়। কিন্তু যাঁর উৎসাহ এত বেশি সেই সমীরদাই যেতে পারলেন না। ঠিক তার আগের দিনই জরুরী প্রয়োজনে তাঁকে কলকাতা ফিরে যেতে হয়েছিল। সেটাই সমীরদার শেষ উত্তরবঙ্গে আসা।

মজার কথা যে আমার সাথে সবসময়ই পূর্ববঙ্গীয় বাংলায় কথা বলতেন।

সমীরদা নেই এটা মেনে নেওয়া খুবই শক্ত। টুকরো টুকরো অজস্র স্মৃতি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সমীরদা লালসেলাম।

– চঞ্চল দাশ 

== 0 ==

খণ্ড-28
সংখ্যা-20