কাজ হারাচ্ছে শ্রমিক, দেশের অর্থনীতি এগোচ্ছে সর্বনাশের দিকে

এদেশে বেকারদের কাজ নেই একথা কোন নিরাপদ সরকারী চাকরির বিজ্ঞাপন বেরোলেই হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীর চাকরির জন্য পিএইচডি, ইঞ্জিনিয়ার, স্নাতকোত্তর থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সর্বস্তরের বেকাররা হামলে পড়ে আবেদন করতে থাকে। তবে সরকার মানতে নারাজ যে, দেশে কর্মহীনতার প্রাচুর্য বা কর্মসংস্থানের সঙ্কট রয়েছে। তেমন কথা উঠলেই মুদ্রা যোজনায় কত যুবককে ঋণ দেওয়া হয়েছে, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচী কত তরুণকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে সেইসব গল্প ফাঁদতে বসেন মোদি, সিতারামণরা। কিন্তু সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমি (সিএমআইই) নিয়মিত যে তথ্য পরিবেশন করে চলেছে তা অন্য বার্তা দেয়। সিএমআইই-র তথ্যকে সরকার বিরোধীও বলা চলে না। ঐ তথ্য অনুযায়ীই জানুয়ারি, ২০১৬ থেকে জুলাই, ২০১৭ পর্যন্ত দেড় বছরে বেকারির হার কমতির দিকে ছিল, সামান্য ওঠানামার মধ্য দিয়ে হলেও তা জানুয়ারি ২০১৬-তে ৮.৭২% থেকে কমে জুলাই, ২০১৭-য় ৩.৩৭%-এ পৌঁছেছিল। কিন্তু তার পর থেকে অনুরূপ ছোটখাট ওঠানামার মধ্য দিয়ে বেকারির হার বাড়তে বাড়তে ফেব্রুয়ারি ২০২০-তে ৭.৭৮% -এ দাঁড়িয়েছে। সিএমআইই প্রতিদিন বেকারির হার হিসেব করে, সেইদিন পর্যন্ত ৩০ দিনের বেকারির হারের গড় হিসেবে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে সেই গড় ছিল ৭.৭৮%; এই লেখার দিনে ৪ মার্চ পর্যন্ত তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বেকারির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.০২%। ফেব্রুয়ারির তুলনায় শহুরে ও গ্রামীণ উভয় বেকারিই বেড়েছে, যথাক্রমে ৮.৬৫% থেকে ৮.৮৮% ও ৭.৩৭% থেকে ৭.৬২%। অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করবে বলে মুকুল-দিলীপদের পাশে নিয়ে সভা করছেন; কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত বেকারির হারের তালিকায় যে তিনটি রাজ্য প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে সেগুলি হল যথাক্রমে বিজেপি শাসিত ত্রিপুরা (২৮.৪%) , হরিয়ানা (২৫.৮%) ও হিমাচল প্রদেশ (১৬.৮%)। এমনকি যে গুজরাটের প্রবল উন্নতি নিয়ে মোদি-শাহেরা উচ্ছ্বাসে ডগমগ থাকেন সেই সোনার (!)রাজ্যের বেকারির হার (৬.৪%), এই অনাছিস্টি পশ্চিমবঙ্গের (৫%) থেকে বেশি।

ফেব্রুয়ারিতে বেকারির হার জানুয়ারি মাসের বেকারির হারের থেকে বেশ খানিকটা বেশি ছিল। সিএমআইই-র তথ্য অনুসারে, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বেকারির হার ছিল ৮.৫%, দ্বিতীয় সপ্তাহে তা কমে ৮.১% হয়, তৃতীয় সপ্তাহে তা আরো কমে ৭.১%এ দাঁড়ায়, চতুর্থ সপ্তাহে বেড়ে দাঁড়ায় ৮.১%-এ। ২০১৯-২০ সালে বেকারির হার ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। এপ্রিল, ২০১৯ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ পর্যন্ত ১১ মাসের গড় ছিল ৭.৫%, যা ২০১৮-১৯এর ১২ মাসের গড় হার, ৬.৩% এর তুলনায় প্রায় ২০% বেশি।

২০১৯-২০ সালে বেকারির হার সামগ্রিকে বাড়লেও আগস্ট, ২০১৯-এ বছরের সর্বোচ্চ হার ৮.২%-এ পৌঁছানোর পর তা কমতে থাকে এবং নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে গড়ে ৭.৩৩% এ দাঁড়ায়। ফলে ফেব্রুয়ারির এই বৃদ্ধি সাম্প্রতিক গড়ের তুলনায় বেশ খারাপ। ফেব্রুয়ারিতে বেকারির হার বাড়ার কারণ হল, মানুষ কাজ খুইয়েছে ও বেকারের সংখ্যা বাড়িয়েছে। জানুয়ারিতে ৪১ কোটি ১৩ লাখ কর্মী কাজ করছিল, ফেব্রুয়ারিতে তা ৫৫ লাখ কমে ৪০ কোটি ৫৮ লাখে নেমে এসেছে। ওই সময়ে বেকার ও কাজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে এমন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ২৫ লক্ষ। এর সঙ্গে আরো ৫ লক্ষ বেকার রয়েছে যারা কাজ করতে চাইছে কিন্তু ততটা সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজছে না।

এছাড়াও ৫৫ লক্ষের মধ্যে ৩০ লক্ষ কাজ হারানো মানুষ কাজ পাবে না বলে ধরে নিয়ে কাজের বাজার থেকে বিদায় নিয়েছে। এদেরকে সরকারী ভাষায় বলা হয়, ‘শ্রমিক বাহিনীর মধ্যে না থাকা মানুষ’।

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে কর্মসংস্থান কমেছে ৫৫ লক্ষ, বেকারি বেড়েছে ৩০ লক্ষ ও ‘শ্রমিক বাহিনীর মধ্যে না থাকা মানুষ’-এর সংখ্যা বেড়েছে ৩০ লক্ষ।

যেহেতু মাসিক গড় হিসেব একটু কম নির্ভরশীল কারণ তার ওঠানামা যে নমুনা নিয়ে কাজ করা হয় তার উপরে নির্ভর করে, তাই সিএমআইই চার মাসের গতিমান গড়ের হিসেব কষেছে। এক্ষেত্রে জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের (৪ মাসের) গড় ও ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের (৪ মাসের) গড়কে হিসেব করে ওই দুই গড়ের গড়কে মার্চের বেকারির হার; ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের গড় ও মার্চ থেকে জুন মাসের গড় হিসেব করে ওই দুই গড়ের গড়কে এপ্রিলের বেকারির হার, এই ভাবে হিসেব করা হয়।

ওই হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে, গত কয়েক বছর ধরে শ্রমিক বাহিনি বাড়ছে না কিন্তু ‘শ্রমিক বাহিনীর মধ্যে না থাকা মানুষ’-এর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০১৭-র মাঝামাঝি থেকে শ্রমিক বাহিনীর সংখ্যা ৪২ কোটি থেকে বেড়ে ২০২০র শেষ গড় হিসেবে ৪৪ কোটি হয়েছে। অন্যদিকে ‘শ্রমিক বাহিনীর মধ্যে না থাকা মানুষ’-এর সংখ্যা ওই সময়ে ৫৫ কোটি থেকে ৬০ কোটিতে পৌঁছেছে। যেখানে শ্রমিক সংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি, সেখানে ‘শ্রমিক বাহিনীর মধ্যে না থাকা মানুষ’-এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ কোটি। সেই সময়ে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ৪০.৬ কোটির আশে পাশে স্থির থাকলেও বেকারের সংখ্যা ১.৭ কোটি থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৩.৩ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।

যদিও স্বল্পকালিন চতুর্মাসিক গড় অনুসারে বেকারির হার তেমন বাড়ছে না ও তা ৮% কে টপকাচ্ছে না, তাও ফেব্রুয়ারি, ২০২০-র বেকারির হার সেই ধারাকে টপকেছে ও ওই মাসের সাপ্তাহিক হার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৮%র বেশি থেকেছে। কিন্তু বেকারির হারের এই ঝোঁক শ্রম-অংশগ্রহণের কম হারের ফলেই ঘটেছে। শ্রম-অংশ গ্রহণের হার প্রায় চূড়ান্ত ভাবেই ৪৩%-এর নীচে নেমে গেছে। ৮% বেকারির হারের থেকেও এটি উদ্বেগজনক।

একদিকে বেকারির হার তুলনামূলকভাবে স্থির বা উর্ধাভিমুখি ঝোঁক সম্পন্ন অন্যদিকে শ্রম-অংশ গ্রহণের হার নিম্নাভিমুখি। ফলে কর্মসংস্থানের হার কমছে। জানুয়ারি ২০২০তে কর্মসংস্থানের হার ছিল ৩৯.৯% ফেব্রুয়ারিতে তা কমে ৩৯.৩% হয়েছে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থানের হার বেকারির হারের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশের জন্য বেকারির হার বেশি প্রাসঙ্গিক। কর্মসংস্থানের হার হচ্ছে কর্মযোগ্য বয়সের অন্তর্ভুক্ত মানুষজনের কত শতাংশ কাজে নিয়োজিত আছে সেই হার। এই হার খুবই কম ও ক্রমাগত কমছে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। সিএমআইই-র বেকারির হার নিয়ে প্রকাশিত সাম্প্রতিক সমীক্ষা দেশের শিক্ষিত বেকারদের জন্য এক হতাশজনক ছবি তুলে ধরেছে। গত ডিসেম্বর, ২০১৯-এ ২০-২৪ বছর বয়সী স্নাতকদের মধ্যে বেকারির হার দাঁড়িয়েছে ৬০%। ওই রিপোর্ট অনুসারে ২০১৬ সালে ২০-২৪ বছরের স্নাতকদের মধ্যে বেকারির হার ছিল ৪৭.১%, ২০১৮ সালে ৫৫.১%।

স্নাতক বা স্নাতকোত্তরদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ২০-২৯ বছর পর্যন্ত সময়কালকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা যেতে পারে। তাদের মধ্যেও বেকারির হার বেড়েছে, ২০১৯ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪২.৮%। সিএমআইই প্রতিবেদনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও দুশ্চিন্তাজনক দিক হল কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ। ডিসেম্বর, ২০১৯ এর ওই তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে শ্রমিক বাহিনীতে পুরুষদের অংশগ্রহণের হার ৭১.২%, মহিলাদের ১০.৯%; শহরাঞ্চলে যথাক্রমে ৬৮.৮% ও ৯.৫% এবং গ্রামাঞ্চলে যথাক্রমে ৭২.৫% ও ১১.৬%। একদিকে শ্রমিক হিসেবে যোগদানের ক্ষেত্রে এই চরম লিঙ্গ বৈষম্য, অপরদিকে কাজ করতে ইচ্ছুক মহিলাদের ক্ষেত্রেও বৈষম্যমূলক বেকারির হার সামগ্রিকে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নিয়োগের হারকে পুরুষদের তুলনায় খুবই কমিয়ে দিয়েছে। সিএমআইই-র প্রতিবেদনে জানা যায় যে, সারা দেশে পুরুষ ও মহিলা বেকারির হার যথাক্রমে ৬.২% ও ১৭.৫%; শহরাঞ্চলে তা যথাক্রমে ৭% ও ২৬% এবং গ্রামাঞ্চলে ৫.৮% ও ১৩.৯%। ফলে সারা দেশে পুরুষ ও মহিলাদের কর্মসংস্থানের হার যথাক্রমে ৬৬.৮% ও ৯%। শহরাঞ্চলে তা যথাক্রমে ৬৪% ও ৭% এবং গ্রামাঞ্চলে ৬৮.৩% ও ১০%। সামগ্রিকে সারা দেশে কাজে যোগদানে ইচ্ছুক মানুষের হার ৪২.৭%, শহরে ৪০.৭% ও গ্রামে ৪৩.৭%। সারা দেশে বেকারির হার ৭.৫ %, শহরে ৯% ও গ্রামে ৬.৮%। ফলে সারা দেশে কর্ম সংস্থানের হার ৩৯.৫%, শহরে ৩৭% ও গ্রামে ৪০.৭%।

ওই প্রতিবেদনে যে ছবি ফুটে উঠছে তা মহিলাদের ক্ষমতায়নের দিক থেকে ভয়াবহ। সারা দেশে ১০০ জন ১৫ বছরের উর্ধে মহিলাদের মধ্যে মাত্র ৯ জন কাজ করছে, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটি হল ৬৭ জন। শহুরে মহিলাদের অংশগ্রহণের হার ১০০ তে ৭ জন, যা গ্রামীণ নারীদের থেকেও (১০০ জনে ১০ জন) পশ্চাদপদ অবস্থান নির্দেশ করছে। মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে এই অতি সামান্য অনুপাত অবশ্যই  সামাজিক ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রের প্রাবল্যের ফলে ঘটেছে, যার ফলে মহিলারা কাজ করতে ইচ্ছুকও হচ্ছে না। সাম্প্রতিক ইউনাইটেড নেশনস গ্লোবাল কমপ্যাক্টের সমীক্ষাতেও ভারতে কর্পোরেট চাকরির জগতে নারীর অংশগ্রহণের হার হ্রাসের দিকে দিক নির্দেশ করছে। যেখানে ২০০৬ সালে মহিলা কর্মীদের সংখ্যা ছিল ৩৪% তা ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৬%।

দেশ জুড়ে কর্মসংস্থানের হতাশাজনক ছবি যখন ফুটে বেরচ্ছে তখন সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার পরিবর্তে সারা দেশকে বিভাজনের রাজনীতির আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার খেলায় মেতেছে শাসকরা। দাঙ্গার আগুনে দিল্লিকে পুড়িয়ে দিতে নয়া শাহের (নাদির) ও তার শাগরেদদের উল্লাস চোখে পড়ার মতো। দেশের জিডিপি ক্রমাগত তলানিতে যাচ্ছে, ব্যাঙ্ক থেকে শাসকের শাগরেদরা জনসাধারণের অর্থ অনায়াসে আত্মসাত করছে। ইয়েস ব্যাঙ্ক নো ব্যাঙ্কে পরিণত হচ্ছে, জনগণ কাজ হারাচ্ছে – সব মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে অর্থনীতি।

মনে রাখা দরকার
১) কাজ করতে ইচ্ছুকদের হার বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মরত এবং বেকার কিন্তু কাজ করতে ইচ্ছুক ও কাজ খুঁজছে এমন সকল মানুষের সামগ্রিক সংখ্যার সঙ্গে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মোট সংখ্যার অনুপাতকে বোঝায়।

২) বেকারির হার বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সী বেকার কিন্তু কাজ করতে ইচ্ছুক ও কাজ খুঁজছে এমন সকল মানুষের সামগ্রিক সংখ্যার সঙ্গে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মরত এবং বেকার কিন্তু কাজ করতে ইচ্ছুক ও কাজ খুঁজছে এমন সকল মানুষের সামগ্রিক সংখ্যার অনুপাতকে বোঝায়।

৩) কর্মসংস্থানের হার বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মরত ব্যক্তিদের সঙ্গে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মোট সংখ্যার অনুপাতকে বোঝায়।

খণ্ড-27
সংখ্যা-8