ইউনাইটেড নেশনসের মানবাধিকার দপ্তরের হাই কমিশনার মিশেল ব্যাশেলেট জেরিয়া ভারতের রাজধানী শহর দিল্লীতে সহিংসতার সময় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী (সিএএ) বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জেনেভা শহরে মানবাধিকার কাউন্সিলের ৪৩তম অধিবেশনে ব্যাশেলেট বলেন : “ভারতের সমস্ত সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যক মানুষ সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ রূপে আইনটির বিরোধ করেছে এবং ভারতের দীর্ঘস্থায়ী ধর্ম নিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে সমর্থন দিয়েছে। অন্য কিছু গ্রুপের দ্বারা মুসলমানদের ওপর হামলার সময় পুলিশের নিষ্ক্রিয় থাকার খবর এবং তার আগেও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদীদের ওপর পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের খবরে আমি বিশেষ উদ্বিগ্ন বোধ করছি”। শান্তি পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে উদ্যোগ নিতে আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাশেলেট জম্মু-কাশ্মীরের জনজীবনে নেমে আসা বিপর্যয় নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে দুয়েকজন নেতাকে ছেড়ে দিলেও ৮০০ নেতাকর্মী এখনও আটক, “বিপুল অনুপাতে সেনার উপস্থিতিতে স্কুল, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবন জীবিকা বিপর্যস্ত, এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও বিভিন্ন মানবাধিকার হরণের অভিযোগগুলিতেও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি”। ৫ আগষ্ট ২০১৯ তারিখে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০নং অনুচ্ছেদ বিলোপ করে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অবশিষ্ট কয়েকটি নিজস্ব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় এবং রাজ্যটির পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের স্টেটাস হরণ করে রাজ্যটিকে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে দেওয়া হয়। সেই থেকে আজ সাত মাস জম্মু ও কাশ্মীরে কারফিউ চলছে, ইন্টারনেট, স্কুল, ব্যবসা, চিকিৎসা সহ জনজীবন স্তব্ধ অবরুদ্ধ এক অমানবিক অবস্থা।
গত ডিসেম্বরে ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাশ হওয়ার অব্যবহিত পরেই জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশন বিবৃতি দিয়ে এই আইনকে “চরম বৈষম্যমূলক” বলে অভিহিত করেছিল। জেনেভার অধিবেশনে উদ্বেগ প্রকাশ করেই থেমে থাকলেন না মিশেল ব্যাশেলেট জেরিয়া। সুপ্রিম কোর্টে মামলাও দায়ের করলেন তিনি। ভারতের বৈদেশিক বিষয় মন্ত্রক সংবাদ-বিবৃতি দিয়ে এ’কথা জানিয়েছে। মন্ত্রক থেকে যথারীতি এই মামলাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবেই তুলে ধরেছে। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ তো কোনও একক দেশ নয়, বরং বিভিন্ন নেশনের আন্তর্জাতিক যৌথ সংস্থা, ভারত যার অন্তর্গত। এই সংস্থার কাজই তো মৈলিক মানবাধিকার বলবৎ রাখতে হস্তক্ষেপ করা। সুপ্রিম কোর্টে ইউএনএইচআরসি-র মামলার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনটি আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে —
“আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিধি অনুযায়ী যে কোনও দেশকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে তার নিজের ভূখণ্ডে বা তাদের দ্বারা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বা তাদের বিচারাধীন ক্ষেত্রে সমস্ত অভিবাসীদের (মাইগ্রান্ট) প্রতি সম্পূর্ণ সম আচরণ করা হবে কোনও বৈষম্য করা চলবে না তা সেই অভিবাসীদের আইনি অবস্থা বা ডকুমেন্টের অবস্থা যাই হোক না কেন”।
জাতিসঙ্ঘের তরফে আরও বলা হয়েছে যে নতুন আইনে অভিবাসীদের ক্ষেত্রে যেভাবে ধর্মীয় নিপীড়নের ক্যাটেগরি আনা হয়েছে তা বাস্তবানুগ নয় এবং অন্য ধরনের নিপীড়নকে বাদ দেওয়াও বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। প্রয়োজনে ভারতীয় সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিধির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করতে জাতিসঙ্ঘ ভারতকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলেও জানানো হয়েছে। দেশজুড়ে প্রতিবাদকারীরা এবং আইনবিদ সহ বহু ব্যক্তিত্ব প্রথম দিন থেকেই বলে আসছে যে এই আইন দেশের সংবিধানকে অমান্য করেছে। এবারে জাতিসঙ্ঘও এই আইনকে আন্তর্জাতিক আইন-বিরোধী বলে ঘোষণা করল।