মুখ্যমন্ত্রী আরও একবার রাজ্য বাজেটকে দাবি করলেন যেন সামাজিক প্রকল্পই এর আত্মা। আর বাজেট ঘোষণার তে-রাত্তির পার না হতেই শোনালেন ‘ঘুঘুর বাসা’ ভাঙার ডাক। এই সমাপতনে অত্যাশ্চর্যের কিছু নেই। মুখ্যমন্ত্রীর স্বতন্ত্র এক দেমাক আছে। বরাবরই জাহির করে আসছেন গরিব ও প্রান্তসমাজের সামাজিক উন্নয়নমুখী বাজেট করে দেখানোয় তৃণমূল সরকার অতুলনীয়! এ প্রশ্নে অতীতের যে কোনো সরকারকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে! একসময় বামফ্রন্ট আমলে ‘ঘাটতি শূন্য বাজেট’ শুনতে শুনতে একঘেয়েমী ধরে যেত। তৃণমূল আমলের ‘গরিবমুখী’ দাবি করা বাজেটের সিরিয়াল দেখতে দেখতে বিরক্তিকর বুজরুকি মনে হয়। কাজ যত না হয় কাজ পড়ে থাকার তালিকা স্তুপীকৃত হয়ে চলে, আয় যত না বাড়ে বাজারে ঋণ বাড়ে হুহু করে। হ্যাঁ, মানা যাক পূর্ববর্তী সরকারের রেখে যাওয়া ঋণভারের বোঝা ছিল, কেন্দ্রও সংগৃহীত রাজস্ব থেকে রাজ্যের ভাগ অনেক কম দেয়, বরাদ্দ পাওনাগুলোও সময়মত ও ঠিকঠাক দেয় না। এইসব কারণে ন্যূনতম উন্নয়ন কাজে অনেক স্থবিরতা গ্রাস করেছে। কিন্তু তা ছাড়াও যে প্রকল্প উপশমের সুষ্ঠু বণ্টন সম্ভব হয় না তার কারণ সেক্ষেত্রে চলে দিনে-দুপুরে ডাকাতি। সব উন্নয়ন প্রকল্প ফোঁপড়া করে দিচ্ছে দুর্নীতি। প্রথম প্রথম ধীরে ধীরে লোকলজ্জার আড়াল রেখে, তারপর অধীর ও জঘন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে, বদনামের বালাই না রেখে, একেবারে খুল্লামখুল্লা। দুর্নীতি ছড়িয়েছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই রোগ ছড়ানোটা মুখ্যমন্ত্রীর অজানা নয়, তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ট মাথারা যে এসবের প্রতিষেধক ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে খুব নীতিবাগীশ তা নয়। বাইরে থেকে ‘সারদা’ ইত্যাদির কালি কতই না লেগেছে, তা মুছে ফেলার উপায় বার করতে কতই না কদর্য প্রয়াস চলেছে, তাতে উপরন্তু কতই না পর্দা ফাঁস হয়ে গেছে। আর ভেতর থেকে দুর্নীতির এতই বহিঃপ্রকাশ হয়ে চলেছে যে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণের বা আগল দেওয়ার উপায় নেই। তবু ধৃষ্টতা প্রদর্শনের পরিহাস এটাই যে, বাইরে থেকে কোনো সমালোচনা ও বিরোধিতাকে দপ্তরি মন্ত্রী ও ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি’রা বিন্দুমাত্র সহ্য করতে নারাজ। মানুষের ক্ষোভ সামলাতে কখনও যদিওবা নিতান্তই লোকদেখানো কিছু বলতে হয় তা স্থির করার ক্ষমতাধর একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী বা দলনেত্রী। যিনি সরকারের আভ্যন্তরীণ কোনও স্তর থেকে কোনও বিরুদ্ধতা বা মতান্তরকে রেয়াত করেন না। অনভিপ্রেত বদলির ভয় দেখিয়ে কিংবা প্রকাশ্যে কোনো বদনামের ছোপ লাগিয়ে ইস্যু চাপা দিয়ে থাকেন। মুখ্যমন্ত্রী ‘ঘুঘুর বাসা’ ভাঙার ডাক যে সদ্য সদ্য দিলেন তার পিছনে কারণ ছিল। একটা তাৎক্ষণিক চাপ তৈরি হয়েছিল।
জঙ্গলমহলের এক জায়গায় একটি ‘ওভারহেড রিজার্ভার’ ভেঙ্গে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। সেই সূত্রে কান টানলে মাথা আসার মতো লোকমুখে আলোচনায় এসে গেছে নেপথ্যে থাকা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গুরুতর অবহেলা ও দুর্নীতির কথা। ফলে সেখানে সরকারী কাজের গতিবিধির পর্যবেক্ষণে যাওয়া পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা শোনাতে হয়েছে, শুধু জনস্বাস্থ্য ও কারিগরী দপ্তরকে উল্লেখ করে, দপ্তরের মন্ত্রীকে নয়। বাধ্য হয়ে, স্বতপ্রণোদিত হয়ে নয়। কারণ, সামনে রয়েছে আরও বড় চাপ, একগুচ্ছ পৌরসভা নির্বাচনের চাপ। বলতে গেলে পরের বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেমিফাইনাল রাউন্ডের চাপ। জেলা প্রশাসন থেকে মহকুমা প্রশাসন, ব্লক প্রশাসন থেকে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত, কর্পোরেশন থেকে মিউনিসিপ্যালিটি সর্বত্র চলছে দুর্নীতির মোচ্ছব। পাশাপাশি রমরমা বেড়েছে তোলাবাজিরও। সব মিলিয়ে কালা ধান্দার এক সমান্তরাল ব্যবস্থা। এসব শুধুমাত্র কামিয়ে নেওয়ার কারবার নয়, এ হল দলের হিসাব বহির্ভূত নির্বাচনী খরচের বাহুল্য সহ আরও নানা আয়োজন-দায়-বিদায় মেটানোরও রসদের উৎস। নির্বাচন কমিশনের কাছে তৃণমূলের গত লোকসভা নির্বাচন সময়কালীন পেশ করা হিসাব রয়েছে। তাতে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল, রাজ্য পরিধিতে তহবিল ও সম্পদ বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে রাজ্যের শাসকদলই অনেক এগিয়ে। ঘোষিত পুঁজি বাড়ানোর হারে যে দল অন্যদের থেকে বহু এগিয়ে, তার হিসাব বহির্ভূত পুঁজিবৃদ্ধির হারও অনেক বেশি হয়ে থাকবে।
দুর্নীতির বিরোধী প্রমাণ দিতে মুখ্যমন্ত্রী আজ পর্যন্ত একটিও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেননি। একজনও আমলা অফিসার শাস্তি পাননি। একজনও মন্ত্রী দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেননি। কোনও নেতাকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি। কয়েক বছর আগে কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলে ভেঙ্গে পড়েছিল এক নির্মীয়মান ব্রীজ। এক তৃণমূলী ডাক সাইটে নেতার বিরুদ্ধে আঙ্গুল ওঠে অত্যন্ত নিম্নমানের সামগ্রী সরবরাহের অভিযোগে। পুলিশ কোনো পদক্ষেপ করেনি, দলও নয়। সেই কালচারই চলছে। বেশি চেপে ধরলে ‘সাধু’ সাজার চেষ্টা হয় কেবল তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া কিছু ডাকসাইটকে দেখিয়ে দিয়ে — কাঁচরাপাড়ার এক পাক্কা ঘোরেল নেতা, বিধাননগরের এক ডাকু প্রাক্তন মেয়র বা ষণ্ডামার্কা প্রাক্তন এক ছাত্রনেতা ও তাদের অনুগামীদের দিকে আঙ্গুল ঘুরিয়ে। এ হল অতি চালাকির আশ্রয় নেওয়া। সুতরাং দুর্নীতি নিয়ে মানুষের ক্ষোভ যে প্রচুর ধূমায়িত হয়ে রয়েছে, এ ধ্রুব সত্য। তাই এখন মুখ্যমন্ত্রীকে একটু-আধটু দুর্নীতির ব্যাপার-স্যাপার প্রসঙ্গে ভুলচুক স্বীকার করে চলার ছল নিতেই হবে। নাহলে দল পড়বে বেচাল অবস্থায়। দলনেত্রীকে তাড়া করবে দুঃস্বপ্ন। তাই মুখ্যমন্ত্রীর মুখে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকার হাঁকডাক। সরকারের সমস্ত কাজে অলিখিত বিধিনিয়ম ঝোলানো আছে, যা কিছু চলছে সবেতেই ঘোষণা করতে হয় ‘মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ...।’ এটাই এই সরকারের ‘ব্র্যান্ড’ বা ‘ট্রেড মার্ক’। ট্র্যাজেডি হল, স্বআরোপিত এই বিজ্ঞাপনী আবরণেই চালানো হয় প্রকল্প-বঞ্চনা, তার ওপর দেদার দুর্নীতি। অস্বীকার করতে গেলে পার পাবে! ‘সততার প্রতীক’ বহনকারী বাছতে গেলে মন্ত্রীসভা-দল উজাড় হয়ে যাবে।
দুর্নীতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, দুর্নীতি নির্মূলীকরণে পদক্ষেপ করতে বিরোধী দলগুলো থেকে বারেবারে দাবি জানানো হয়। রাজ্য সরকারকে সম্বোধন করে যে কোনো দপ্তরের কাছে দেওয়া যে কোনো ডেপুটেশনে দুর্নীতির ইস্যু উল্লেখ থাকেই। পঞ্চায়েত-পৌরসভার ক্ষেত্রেও তাই, এই দুই ক্ষেত্রেই চলছে তৃণমূলী প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য। এতেই প্রমাণ মেলে দুর্নীতিকে কি ব্যাপক মাত্রায় বাড়তে দেওয়া হয়েছে।