বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তেলেঙ্গানা পুলিশের ‘এনকাউন্টার অপারেশন’ প্রসঙ্গে বললেন, আইন হাতে তুলে নেওয়া যায় না। আর বললেন, ধর্ষণের ঘটনায় দশদিনের মধ্যে চার্জশীট দেওয়া উচিত, বলাবাহুল্য ফাস্ট ট্রাক কোর্টে দ্রুত নিষ্পত্তির বিচারের প্রয়োজনে। কথাগুলো শুনে মনে হতে পারে সাদা মনে কাদা নেই। মুখ্যমন্ত্রী আরও বললেন, তেলেঙ্গানার ঘটনাবলী তাঁর হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে। তবে কি রাজ্যের গ্রাম-নগরের গোটা নাগরিক সমাজ ধরে নেবে এখানে এখন থেকে ন্যায়বিচারের প্রয়োজনে সরকার-পুলিশপ্রশাসন আশা-ভরসার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে? মুখ্যমন্ত্রী মুখে যুক্তির বাণী দিলেও, তা এই রাজ্যের জন্য কতটা মর্মার্থে, নাকি কেবল অন্য রাজ্যের প্রতি ইঙ্গিতার্থে, সেসব অবশ্যই খোলামনে বিচারের বিষয়। মুখ্যমন্ত্রীর মুখনিসৃত বলেই এবার থেকে ন্যায়ের বিধান নিশ্চিত মিলতে থাকবে ধরে নেওয়ার কোনো মানে হয় না। আবারও যদি প্রকৃতই শিক্ষা নিতে হয় তাহলে তৃণমূল রাজত্বের এযাবৎ প্রাসঙ্গিক ঠোস মূল্যায়নটি মাথায় রাখা দরকার। অতীত-বর্তমান খোঁড়াখুঁড়ি প্রয়োজন। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল, এবারও তৃণমূলের অন্তত এক অভিনেতা ও দুই অভিনেত্রী সাংসদ তেলেঙ্গানার পুলিশের ‘এনকাউন্টার’ সমর্থন করে বসেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়ত বুঝিয়ে দেবেন, ওনারা টলিউডের শিল্পীজন, রাজনীতিতে ঠিক ধাতস্থ হওয়া নন, সেই অবস্থান থেকে যা মনে হয়েছে বলেছেন। এভাবে মুখ্যমন্ত্রী হয়ত লঘু করে আড়াল দেওয়ার কায়দা নেবেন। কিন্তু তা বললে কি করে হবে? ওঁরা তো দস্তুরমতো তৃণমূলের সাংসদ, দুজন নবাগতা হলেও প্রথমোক্ত জন দুবারের এবং তিনজনই দলনেত্রীর বিশেষ পছন্দের। এখন ওঁরা যে মতামত প্রকাশ করছেন তা তৃণমূলের অন্দরে বিশেষ ধর্তব্যের পড়বে কি পড়বে না সেটা তাদের দলের আভ্যন্তরীণ মামলা, তবে তাদের যেহেতু রয়েছে বিনোদন জগতের ভাবমূর্তি, তার দরুণ এরকম হাড়হিম ধরানো পরিস্থিতিতে তাদের বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের প্রভাব নাগরিক সমাজে পড়ার বিপদ থেকেই যায়। শুধু তাই নয়, তাদের শেয়ার করা মন্তব্য ‘‘এনকাউন্টার হ্যাপী” পুলিশের সাফাই গাওয়ার খোরাকে পর্যবসিত হবেই। ‘এনকাউন্টার’ সমর্থন করায় যথারীতি বেপরোয়া হলেন তৃণমূলের ষন্ডা-গুন্ডা মার্কা কেষ্টবিষ্টুরাও, যারা পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘আইনের শাসন’ হাতে তুলে নেওয়ার মস্তানিতে, খুনখারাবি চালানোতে, লাশ গুম করে দিতে পোড় খাওয়া এবং ‘দিদি’র থেকে লাগাতার অক্সিজেন পেয়ে আসা।
তৃণমূলের তৃণমূল স্তরে আইনের শাসনের দখল নেওয়ার এরকম নমুনা রয়েছে আরও অজস্র। সব তথ্যকে ব্যবচ্ছেদ করতে হলে একটা আস্ত বই হয়ে যাবে। তা না করলেও ফিরে তাকানো যাক কিছু ঘটনাবলীর দিকে।
তৃণমূল সরকারের গোড়াপত্তনের সময়েই জঙ্গলমহলে ‘এনকাউন্টার’-এর নামে কেন্দ্র-রাজ্যের “ট্রিগারহ্যাপী” যৌথ বাহিনীকে দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল মাওবাদী নেতা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজীকে। তার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি মমতা সরকার কখনই মানেনি। ‘এনকাউন্টার’ অপারেশন হল আইন হাতে তুলে নেওয়ার এক চরমতম রূপ। ক্ষমতা বহির্ভূত বেআইনি ‘রাজধর্ম’ পালনের আরও অনেক রূপ আমরা দেখতে অভ্যস্ত। দলীয় কর্মীকে থানার পুলিশ কোনো অভিযোগে গ্রেপ্তার করে নিয়ে হেফাজতে রাখলে খোদ দলনেত্রী/ মুখ্যমন্ত্রী থানায় ঢুকে ধৃত কর্মীকে বের করে নিয়ে যান। মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর তদানীন্তন ডেপুটি নেতাকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র আঁকার কারণে এক অধ্যাপক সহ আরও কয়েকজনকে পুলিশ মধ্যরাতে তুলে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিয়ে দেয় সাজানো মামলায়। কাকপক্ষীরও বুঝতে অসুবিধা হয়নি নেপথ্যে আইন হাতে তুলে নেন মুখ্যমন্ত্রী। পরিহাসের কথা, সেই সহচর নেতা এখন বিজেপিতে এবং প্রায় নিত্য অভিযুক্ত করছেন মুখ্যমন্ত্রীকে আগাগোড়া আইন হাতে নিয়ে নেওয়ার অভিযোগে। আর মুখ্যমন্ত্রী সেই দলত্যাগী প্রাক্তন একান্ত সহচর সম্পর্কে বলেন ‘গদ্দার’। শিলাদিত্য ঘটনা কিছুতেই ভোলার নয়। জঙ্গলমহলের এক চাষি পরিবারের সন্তান শিলাদিত্য, মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক মাঠসভায় দূরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন রাসায়নিক সারের দুঃসহ ফাটকা চড়া দাম চলছে কেন? প্রত্যুত্তরে কাকে বলে আইন হাতে নেওয়া তার মালুম পাইয়ে দিতে মুখ্যমন্ত্রী সভামঞ্চ থেকেই প্রশ্নকর্তাকে দাগিয়ে দিয়েছিলেন ‘মাওবাদী’! অন্যায়ভাবে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন উপস্থিত পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে। স্মরণ করুন কামদুনির ঘটনা। ধর্ষণ করে হত্যাকারীদের শাস্তির ন্যায়বিচার চাওয়া মহিলাদেরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন কে? রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। লাগাতার সন্ত্রাস সৃষ্টি ও সম্পত্তি লুটেরার ক্ষমতা পুলিশ অফিসারের হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে শাসকের আধিপত্য কায়েম করার ঘৃণ্য নজীর তৈরি করেছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই পুলিশ অফিসারদের কেউ পরবর্তীতে পরিণত হয়েছেন এমন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনে যে, ভিড়েছেন বিজেপিতে, তারপর রাজ্য পুলিশেরই কেসের পর কেস খেয়ে অগত্যা পুলিশের চাকরি ছেড়ে গত লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যান গেরুয়া প্রার্থীপদে। অন্যদিকে কোনো কোনো পুলিশ অফিসার পরিণত হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ সহচরে, দায়বদ্ধ হয়েছেন চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে জড়ানো শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার মতো জঘন্য কাজে। মনে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর এক পুলিশ কর্মীকে প্রকাশ্যে চড় মারার ঘটনা! তারপরে তৃণমূলের এক উচ্চস্তরের নেত্রীর সেতুসড়কে কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মীকে গাড়ি থেকে নেমে চড় মারার ঘটনা! অথবা পুলিশ কর্মচারিকে দিয়ে এক মন্ত্রীর জুতো এগিয়ে দেওয়ার দৃশ্য! অভিযোগ উঠেছে, রাজ্যের বর্তমান শাসকদলের নেতারা সারদা দুর্নীতির সুড়ঙ্গ তৈরি করেছেন আইন হাতে তুলে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেই। সেই ধারার আজও বিরাম নেই। প্রায়শই আইন তুলে নেন শাসক তৃণমূলের দিদি-দাদারা। আইনের শাসনের নামে চালানো হয় দ্বিচারিতা। শাসকদলের লোকেদের বিরুদ্ধে, রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ থামিয়ে দিতে এই ধরণের সীমা ছাড়ানো ক্ষমতা হাতে তুলে নেওয়া হয় দেদার। এই শাসন সংস্কৃতিই ঘটনাক্রমে ‘এনকাউন্টার’ পন্থা নেওয়ার দিকে ইতিপূর্বে নিয়ে গেছে, আবারও নিয়ে যাওয়ার শর্তগুলো অন্তর্নিহিত থাকছে। অতএব মুখ্যমন্ত্রীর মুখের কথায় ভেসে না গিয়ে বিচার করে চলতে হবে তৃণমূল রাজত্বকে আতস কাঁচের নীচে ফেলে।