২০১৯ শেষ প্রান্তে চলে এলো। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদী সরকারের বিগত ছ’টা বছরের মধ্যে এখনও অবধি এটাই সবথেকে মারাত্মক প্রতিপন্ন হয়েছে। পুলওয়ামা ও বালাকোটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উগ্র জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার ঢেউয়ে চেপে মে মাসের নির্বাচনে গদিতে ফিরে আসার পরেই এই সরকার ও সংঘ-বিজেপি ব্রিগেড গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রবাদকে ধ্বংস করে তাদের মতাদর্শে গোটা দেশকে রূপান্তরিত করতে তাদের আগ্রাসী ফ্যাসিবাদী অভিযানকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভেঙে ফেলা হয়েছে। দেশজুড়ে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এনআরসি ও বন্দী শিবিরের (ডিটেনশন ক্যাম্প) মডেল ছড়িয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। এই মডেলের খেলা ইতিমধ্যেই অসমে গরিব ও খেটে খাওয়া পরিবারের নারী, পুরুষ ও শিশু সহ ১৯ লাখেরও বেশি মানুষকে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ দিয়েছে আর শত শত মানুষকে বন্দী শিবিরে কোনোপ্রকার অধিকার ছাড়াই আটক করেছে, যাদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত ২৮ জন মারা গিয়েছেন। এর উপরে আবার নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের বিল এনে নাগরিকত্বের প্রশ্নে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বৈষম্য চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে।
দেশী, বিদেশী বড় কর্পোরেশনগুলোর স্বার্থে তৈরি করা ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটের সাথে দেশের সংবিধান ও তার ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব সুনিশ্চিতকারী গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের প্রতিশ্রুতির উপর চলছে সুপরিকল্পিত ধারাবাহিক আক্রমণ। জাতীয় সম্পদে নির্মিত রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের ইউনিটগুলোর লাগাতার বেসরকারীকরণ চলছে। সৃষ্টি হয়েছে অভূতপূর্ব বেকারত্ব, অনাহার ও অপুষ্টি। অন্যদিকে ধনীদের হাতে বেড়ে চলেছে সম্পত্তির কেন্দ্রীভবন। সমস্ত মাপকাঠির বিচারেই অর্থনীতির হাল বিপজ্জনকভাবে নামতে নামতে অবনতির নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে, তখনও সরকার বড় কর্পোরেট ও অতি ধনীদের সুবিধার্থে তাদের বিশাল অঙ্কের কর ও অন্যান্য ছাড় দিয়ে সংকটের সমস্ত বোঝা সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপাতে ব্যস্ত। পাশাপাশি অর্থনীতির বিপর্যয়ের পরিসংখ্যানকে ধামাচাপা দিতে উঠে পড়ে লেগেছে এই সরকার।
মে, ২০১৯ এর নির্বাচনে মোদী সরকারের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন স্তব্ধকারী হলেও জনগণের প্রতিরোধ ফের উঠে দাঁড়াতে বেশি সময় নেয়নি। ভারতের যুবসমাজ ফি বৃদ্ধি এবং সকলের জন্য শিক্ষা ও কাজের অধিকারের দাবিতে আবার রাস্তায়। বেসরকারীকরণ, ছাঁটাই ও শ্রমিক অধিকার খর্ব করার সর্বনাশা অভিযানের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে শ্রমিক কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। অনেকগুলো সেক্টরে শক্তিশালী ধর্মঘটের পরে আগামী ৮ জানুয়ারী হতে চলেছে সারা ভারত ধর্মঘট। পাশাপাশি কৃষক সংগঠন ও গ্রামীণ মজুরদের সংগঠনগুলি ঐদিনই গ্রামীণ ধর্মঘটের ডাক দিয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘটের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প নিয়েছে। জনগণের এই প্রতিরোধী মেজাজ নির্বাচনী আঙিনাতেও বেশ সোচ্চারেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচন, জম্মু ও কাশ্মীরের ব্লক উন্নয়ন পর্ষদ নির্বাচন এবং পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচনগুলোর ফলাফল পরিষ্কারভাবেই মোদী-শাহের শাসন ও সংঘ-বিজেপি ব্রিগেডের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা গণক্ষোভের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
আমাদের ভূমিকা বিস্তৃত করতে ও উদ্যোগ বাড়াতে এই পরিবেশকে যথাসম্ভব কাজে লাগাতে হবে। কলকাতা কনভেনশন গোটা পার্টির মধ্যেই আবার নতুন করে একটা উদ্যমের জোয়ার তৈরি করেছে এবং অনেকগুলো ফ্রন্টেই আমরা উন্নততর উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। আমাদের সব নেতৃত্বকারী কমিটিগুলোকে এখন কলকাতা কনভেনশনের পরে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কশপে জোর দেওয়া বিষয়গুলিকে বাস্তবায়িত করতে জনগণের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে নিবিড় গণরাজনৈতিক কাজ ও জনগণকে মতাদর্শগতভাবে সমাবেশিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের কাজের ধারার উন্নতি ঘটাতে এবং এই পরিস্থিতিতে উঠে দাঁড়ানোর জন্য সমস্ত দিক থেকে পার্টিকে শক্তিশালী করতে ঐ ওয়ার্কশপে চিহ্নিত কর্তব্যগুলোকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করা দরকার।
এই ১৮ ডিসেম্বর যখন আমরা কমরেড বিনোদ মিশ্রের ২১তম প্রয়াণবার্ষিকী উদযাপন করছি, তখন পার্টির বৃদ্ধি ও বিকাশে তাঁর মহান অবদান এবং সিপিআই(এম-এল)-কে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসাবে গড়ে তোলার তাঁর লক্ষ্য থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা নেওয়া উচিত। ৭০ দশকের শেষদিকে পার্টিতে শুদ্ধিকরণ অভিযানের মধ্যে দিয়ে সবরকম স্থবিরতা ও চিন্তাধারার জড়তার বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের জটিল সামাজিক বাস্তবতায় তার উপযোগী মার্কসবাদী ভিত্তির উপর পার্টিকে দাঁড় করানো, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের বিলোপবাদী প্রভাবের মোকাবিলায় বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠনের বুনিয়াদী নীতিগুলোকে পুনরায় ঊর্ধ্বে তুলে ধরা এবং ১৯৯০ দশকে যখন বিজেপি ভারতের শাসকশ্রেণীর পয়লা নম্বর দল হিসেবে উঠে এল তখন সেই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে সরাসরি মোকাবিলায় পার্টিকে উদ্বুদ্ধ ও প্রস্তুত করা — কমরেড ভি এম-এর এই মহান ঐতিহাসিক ভূমিকা আজকের সংকটময় সন্ধিক্ষণে আমাদের নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে অবশ্যই অনুপ্রেরণা ও দিশা প্রদান করবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন