আন্দোলনের ধাক্কায় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের ঘুম ছুটে গেছে। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, তার দুদিন বাদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে বসলেন এনআরসি নিয়ে মন্ত্রীসভায় কোন আলোচনাই হয়নি! একেবারে ২০১৪ থেকে এযাবৎ সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া তো দূরের কথা, চর্চাই নাকি করেনি! সত্যিই মিথ্যাচারে এরা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ম্লান করে দিচ্ছেন। প্রথমে মোদী উঠলেন মঞ্চে, ভাবলেন যা বলবেন মানুষ খেয়ে নেবে। কিন্তু অচিরেই তাতে অতিরিক্ত সমস্যা তৈরি করলেন। প্রশ্নের ঝড় উঠতে শুরু করল, কে সত্যিটা বলছেন? প্রধানমন্ত্রী? না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? প্রশ্নের চাপ অগত্যা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিডিয়ার সামনে আরেকবার মিথ্যাচার করতে বাধ্য করল মোদীর সুরেই। এনআরসি “সারা দেশে হবেই” বলে আক্রমণটা নামিয়ে দেওয়ার পেছনেও ভুরি ভুরি মিথ্যাচার করা হয়েছে। ‘এনআরসি হবে না’ বলতে গিয়েও মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। একেবারে ডাহা মিথ্যাচার।
সংঘবাদী মার্গদর্শনের নেতা ও প্রচারকরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে ও তার ইতিহাস প্রসঙ্গে, পরবর্তীকালে আজ পর্যন্ত বংশ পরম্পরায় নাৎসীবাদী প্রচারদর্শন ও তার শিরোমণি গোয়েবেলসকে শিরোধার্য করে এসেছে। তার মোদ্দা উদ্দেশ্য হল, লাগাতার মিথ্যাচার করে তাকে ‘সত্য’ বলে বিশ্বাস করাও। কিন্তু গোয়েবেলসদের মিথ্যার জারিজুরি বেশীদিন বাজারে চলেনি। তা উন্মোচিত হয়ে যায় দেশ, জাতি ও জনগণের চেতনায়। ঠিক তেমনিভাবেই আজকের ভারতে মোদী সম্প্রদায়ের এনআরসি জনিত আগাগোড়া মিথ্যাচার নাগরিক জনতার সচেতনতায় ধরা পড়ে যাচ্ছে। এটা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রচার-সম্প্রচার মাধ্যমের যুগ। চাইলেই সবকিছু মুছে ফেলা অস্বীকার করা যায় না। অথচ অতি ধুরন্ধর শাসকেরা আত্মরক্ষায় সংকটে পড়ে সেই মুখার্মী করে বসে। সেই মুর্খামিই ধরা পড়ল মোদী-শাহদের সর্বশেষ এনআরসি বিবৃতিতে। মিডিয়া পুনঃপ্রকাশ করে চলেছে দিনক্ষণ তারিখ সমেত ঠিক কবে থেকে এনআরসি-র গরল গেলানোর বদমাইশী শুরু হয়েছিল। যে স্বঘোষিত ‘মহামান্য’ কর্তাপ্রধানরা ধূর্তামির মুখোশ পরার তরিকা খুঁজবেন তাদের দম্ভোক্তিগুলোই তাদের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মিডিয়া বিশেষ বিশেষ তথ্য মনে করিয়ে দিচ্ছে, হুমকিটা সবার আগে দিয়েছিলেন মোদী। ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে এপ্রিলে এক মিডিয়া চ্যানেলে মুখোমুখি বসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। তারপরে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার একমাসের মধ্যেই (২০ জুন) সংসদে খোদ রাষ্ট্রপতি শুনিয়েছিলেন তাঁর সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের কথা, এনআরসি করা হবে সারা দেশে। তারপর তো খেলা শেষ করার ঢঙে খেল দেখালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ৩ ডিসেম্বর রাজ্যসভায় চূড়ান্ত ঔদ্ধত্যের সাথে ‘ক্যাব-এনআরসি’-র প্রয়োগ ফলানো হবেই দাবি করেছিলেন মন্ত্রীজী। মামলা প্রাতিষ্ঠানিক আদালতে গড়ালে কি হবে বলা মুশকিল। কারণ সর্বোচ্চ আদালতে অযোধ্যা মামলা কেমন ‘শান্তি’র জল ছেটানো ‘নিরপেক্ষতা’র রায় পেল সেও তো দেখা গেল। তাই প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক আদালতে মামলা গড়ালে কি হতে পারে সে প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায়, মিডিয়ার দর্পণে প্রকৃত তথ্যপ্রমাণ রেকর্ড হয়ে গেছে, উপরোক্ত মন্ত্রীযুগল তাই বৃথাই সত্যের অপলাপ করছেন।
আর রাষ্ট্রপতি! তাঁর মতাদর্শগত প্রেক্ষাপট যেহেতু গৈরিক, তিনি তো তোতার মতোই তথ্য উগড়ে দেবেন, তখন কল্পনাও করতে পারেননি মাত্র ছয় মাসের মধ্যে এমন ভন্ড প্রতিপন্ন হতে হবে। মোদী সরকার অসমে এনআরসি ফলিত মানবিক বিপর্যয়ের দায় এই অজুহাতে ঝেড়ে ফেলার কায়দা নিতে পারে যে, ওখানে ওটা করা হয়েছে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে। কিন্তু তা বলে পরিত্রাণের উপায় নেই। কারণ অসমে এনআরসি করা হয়েছে রাজ্যের বিজেপি সরকারের পরিচালনায়, যে সরকার কোনও মানবিক আবেদনকে গ্রাহ্যের মধ্যে রাখেনি। অসমীয়া সংগঠনগুলোর এনআরসি-তে তাৎক্ষণিক মান্যতা দেওয়ার শর্ত ছিল অসমীয়া জাতিসত্তাসর্বস্ব ভিত্তিক, অন্যদিকে বিজেপির লক্ষ্য মুসলিম বিরোধী হিন্দু ধর্মভিত্তিক, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদী সরকারও সোৎসাহে এসব চালাতে দিয়েছে। আর পঞ্জিকৃত তালিকাপ্রকাশের মধ্যে উন্মোচিত হয়ে গেল দুই দৃষ্টিভঙ্গি দুই স্বার্থের মধ্যেকার কাটাকুটির পরিণাম। তার প্রতিক্রিয়ায় অসমীয়া সংগঠনগুলো ফের রণমূর্তি ধারণ করে দাবি তুলেছে সারা দেশের সাথে অসমেও আবার এনআরসি চাই। তার তাৎক্ষণিক প্রত্যুত্তর দিতে কেন্দ্র একদিকে নামায় সেনা অভিযান, দমন অভিযানের ফলশ্রুতিতে দুজন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে ক’দিন পর থেকেই বলতে শুরু করল এনআরসি হচ্ছে না। প্রহসনের বিষয় হল, মোদী সরকার যখন এনআরসি না করার কথা ঘোষণা করছে তখন ঝাড়খন্ডে বিজেপির বিদায়ঘন্টা বাজার সময় ঘনিয়ে আসে, অবশ্য কলকাতায় বিজেপি বের করে ‘ক্যাব’ (সিএএ) প্রণয়নের ‘সুবাদে’ কেন্দ্রকে ‘অভিনন্দন’ জানানোর যাত্রা। কি আশ্চর্য সমাপতন! তবে কেন্দ্র ধাক্কা খেলেও সেখানেই থেমে থাকছে না। এনআরসি-ক্যাব বিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে যথেচ্ছ পুলিশী আক্রমণ নামায়। বিশেষ করে দিল্লী-উত্তরপ্রদেশের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। ঘটেছে পুলিশের গুলিতে ১৮ জনের মৃত্যু, গ্রেপ্তার করা হয়েছে হাজারে হাজারে, হুমকি দিয়েছে যোগী সরকার ধৃতদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত সরকারি সম্পত্তির অর্থদণ্ড আদায় করা হবে। তারপর মোদী সরকার ঝোলা থেকে বার করেছে নতুন প্রকল্প এনপিআর! এই দুঃসাহসের পুনরাবৃত্তি শুরু করতে পারল কিছু রাজ্য সরকারের তথাকথিত যুক্তিজালকে হাতিয়ার করে, যেমন বাংলার তৃণমূল সরকার চালাকির আশ্রয় নিয়ে চালিয়ে আসছিল এনপিআর চালু করতে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলছিলেন এখানে এনআরসি হবে না, এখানে যেটা হচ্ছে তা হল এনপিআর, এর সাথে এনআরসি-র কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু প্রথমে বামপন্থীরাই ধরে ফেলে, নাগরিক জনতার চোখেও ধরা পড়ে যায় এনপিআর হল এনআরসি-র প্রাক পর্ব। জনতার আন্দোলনে এনআরসি-ক্যাব/ক্যা-র সাথে একযোগে আওয়াজ উঠল এনপিআর-ও হটাও! তৃণমূল কিছুটা পশ্চাদাপসরণ করল, প্রকল্প স্থগিত রেখেছে ঘোষণা করেছে, প্রত্যহার করেনি। সেই অস্ত্র এখন হাইজাক করতে চাইছে কেন্দ্র। তাই চলমান আন্দোলনে এই আওয়াজ অব্যাহত রাখতে হবে, এনআরসি-ক্যাবএনপিআর হটাও! সংবিধান-গণতন্ত্র-রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতা-নাগরিকত্ব-প্রজাতান্ত্রিক স্বাধীন অস্তিত্ব বাঁচাও! সংসদীয় সদনে দাঁড়িয়ে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার অন্যায়-অবিচারের বিধিগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।
ভারতের জেগে ওঠা জনগণ দেখিয়ে দিচ্ছে মোদীরাজ কাঁপানো রাতদিন। লাঠি-গুলি-হতাহতের পরোয়া না করে রোজ চলছে মিছিল-বিক্ষোভ-সভা-সমাবেশ।প্রতিপক্ষ কায়েমী স্বার্থের প্রতিভূরা এখন রক্ষণাত্মক অবস্থায়, তাই এই সময়-সন্ধিক্ষণে আরও তীব্র আরও ব্যাপক করে তুলতে হবে ওদের ধাওয়া করার জনআন্দোলন।