দেশের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ক্রমাগত নিম্নমুখী। ২০১৮ সালের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের ৮% জিডিপি বৃদ্ধির হার পরবর্তী ৫টি ত্রৈমাসিকে ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ত্রৈমাসিকে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪.৫%। কয়লা-বিদ্যুৎ-সিমেন্ট সমেত সমস্ত বুনিয়াদি শিল্পক্ষেত্রে গত সেপ্টেম্বর মাসে বৃদ্ধির বদলে সঙ্কোচন ঘটেছে, -৫.২%; কলকারখানায় উৎপাদন হ্রাসের হার সেপ্টেম্বরে -৪.৩%। কৃষি ক্ষেত্রে গত বছরের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের ৫.১% বৃদ্ধি ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে কমে দাঁড়িয়েছিল ২%; জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ত্রৈমাসিকে তা হয়েছে ২.১%। গত বছরের তুলনামূলক জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে সেই বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৯%।
২০১৮ ও ২০১৯ সালে তুলনামূলক জিডিপি ও কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার
যেভাবে অর্থনীতিতে মন্দার ছায়া দেখা যাচ্ছে, সরকারি পরিসংখ্যানেই, তা দেশের সাধারণ মানুষ তথা নিম্নবিত্ত গরিবদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। অর্থনীতিবিদ অরুণ কুমারের মতে আদতে সরকারি পরিসংখ্যান সত্যি কথা বলছে না, দেশে কেবল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমছে তা নয়, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক অঙ্কে পৌঁছেছে। সামগ্রিকে অসংগঠিত ক্ষেত্র যা দেশের ৯৪% কর্মসংস্থান ও ৪৯% জিডিপি-র যোগান দেয় তা নোট বাতিল ও জিএসটির জোড়া আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতিতে যে আঘাত হেনেছে তার ফলে গ্রামীণ ভারতে চাহিদা কমেছে। কিন্তু সরকার গ্রামীণ ভারতের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কর্পোরেটদের ১,৪৫,০০০ কোটি টাকার বিপুল কর ছাড় দিচ্ছে, গৃহ নির্মাণ শিল্পের মালিকদের ২৫,০০০ কোটি টাকার সুবিধে প্রদান করছে, অপরদিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্পোরেটদের ঋণ চাহিদা বাড়বে ভেবে ক্রমাগত সুদের হার কমিয়ে চলেছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সমস্ত অভিমুখটাই কৃষক-শ্রমিকদের তাচ্ছিল্য করে কর্পোরেটদের তোষণের দিকে চলে গেছে। কৃষি পণ্যের খরচের দেড়গুণ দাম কেবল কথার কথা। শ্রমিকদের জব্দ করার জন্য মালিকদের হাতে অবারিত ক্ষমতা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রচলিত শ্রম আইনগুলিকে বাতিল করে শ্রম কোড; ১০০ দিনের কাজের কর্মসূচীকে প্রায় বাতিল করা, রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পগুলির শেয়ার বেচে সেগুলির বেসরকারিকরণ, বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছাবসরের মাধ্যমে বিএসএনএল-এর কর্মী সঙ্কোচন প্রভৃতি জনবিরোধী সরকারি কর্মসূচী সাধারণ জনতা ও নিম্নবিত্তদের বেশি বেশি করে যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তবুও যত চর্চা তা মূলত দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে নিয়েই আবর্তিত করার চেষ্টা চলছে মূলধারার প্রচার মাধ্যমগুলিতে। মনে রাখা দরকার, যত বেশি বেসরকারিকরণ হয় ততই জাতিগত ও অর্থনীতিগতভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া বর্গের, দলিত-আদিবাসী-পশ্চাদপদ জাতির জনসাধারণের সংবিধান প্রদত্ত অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ হয়, কারণ বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের নিয়ম প্রযোজ্য নয়। সব মিলিয়ে এই সরকারের কর্মনীতি একদিকে দেশকে যেমন অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে তেমনি দারিদ্র ও অসাম্যকে বাড়িয়ে তুলছে।
গত শতাব্দীর শেষ দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে জাতিসঙ্ঘ বিশ্বব্যাপী দারিদ্র নিয়ে ভীষণ চিন্তা ব্যক্ত করে ও এই শতকের গোড়াতে সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য নামে এক প্রকল্প হাতে নেয় যেখানে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বের হত দরিদ্র মানুষের সংখ্যাকে অর্ধেক করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে আবার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য শীর্ষক পরিকল্পনা করা হয়, যেখানে বলা হয়েছে যে, ২০১০ সালের মধ্যেই দারিদ্রের ক্ষেত্রে সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণ করা গিয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে দারিদ্রমুক্ত করা যাবে। তবে দারিদ্র দূরীকরণের এই সাফল্য যখন ঘটছে, যার ফলে হতদরিদ্রের সংখ্যা ১৯৯৩ সালের ১৯৪ কোটি থেকে ২০১৫ সালে ৮৪ কোটিতে নামিয়ে আনা গেছে, ঠিক তখনই সারা বিশ্বের প্রতি ৭ জনে ১ জন শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, পৃথিবীর অর্ধেক কর্মরত মানুষ অমানবিক কাজের পরিবেশে কাজ করে, এবং ২০১৪-র শেষ পর্যন্ত ৭ কোটি মানুষকে সংঘাতের কারণে তাদের বাসস্থান ত্যাগ করতে হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতে দারিদ্রের সংখ্যা সংক্রান্ত সরকারি তথ্য কেবল ২০১১ সাল পর্যন্ত পাওযা যাচ্ছে। সেই তথ্য অনুযায়ী দেশের ২১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে। ওই তথ্য তৈরি করার সময়ে তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশন ও তার প্রধান মন্টেক সিং আলুওযালিয়া প্রবল নিন্দা ও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন কারণ তেন্দুলকার কমিটি নির্ধারিত যে দারিদ্র রেখার ভিত্তিতে ওই পরিসংখ্যান তৈরি হয়েছিল সেই রেখা টাকার অঙ্কে গ্রামাঞ্চলে জনপ্রতি রোজ ২৭ টাকা ও ৩৩ টাকাকে যথাক্রমে গ্রামে ও শহরে দারিদ্র রেখা হিসেবে নির্ধারিত করেছিল। পরে রঙ্গরাজন কমিটি তৈরি হয় ও সেই কমিটি দারিদ্র রেখা হিসেবে গ্রামাঞ্চলে দৈনিক জনপ্রতি ৩২ টাকা ও শহরাঞ্চলে ৪৭ টাকার সুপারিশ করে। ফলে সেই হিসেবে ২০১১-১২ সালে ভারতে দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষের অনুপাত দাঁড়ায় ২৯.৫%। এছাড়াও ইতিমধ্যে বিভিন্ন সমীক্ষা হয়েছে কিন্তু তেমন কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়নি। এর পরে মোদি সরকার মার্চ, ২০১৫ সালে দারিদ্র দূরীকরণ নিয়ে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে। সেই টাস্ক ফোর্সের কাজ আজও শেষ হয়নি। টাস্ক ফোর্সের অন্যতম দায়িত্ব ছিল দারিদ্র রেখার ও দরিদ্রের একটি কার্যকরী সংজ্ঞা তৈরি করা। ২০১৬ সালে সেই টাস্ক ফোর্স বহুবিধ চর্চার পরে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছয় যে, জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পারিবারিক ভোগ ব্যয় সমীক্ষার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দারিদ্র সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে জাতীয় নমুনাসমীক্ষার দফতরের প্রতিবেদনকেই অবিশ্বস্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে কারণ সেই সমীক্ষা বেকারির হারকে ৪ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বলেছিল। কেবল তাই নয় সম্প্রতি বেসরকারি সূত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর যে ভোগ ব্যয় সমীক্ষা প্রকাশ করেছে তাকেও অস্বীকার করেছে সরকার। ফলে দারিদ্র রেখা বিষয়টিও অসমাধিত রয়ে গেল। সরকারিভাবে অননুমোদিত ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে, অত্যাবশ্যক ভোগ্যপণ্যের উপরে মাসিক মাথাপিছু ব্যয় গত ২০১১-১২ সালের ১৫০১ টাকা থেকে কমে ২০১৭-১৮ সালে ১৪৪৬ টাকা হয়েছে। যা ইঙ্গিত করছে যে, দারিদ্র কমেনি বরং বেড়েছে।
তথাপি, নীতি আয়োগের টাস্ক ফোর্স ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, মধ্যবিত্ত জনসংখ্যার বিস্তার, বেসরকারি ব্যবসায়ী পরামর্শদাতা সংস্থার রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে বা দেখিয়ে ভারতের দারিদ্র অনতিবিলম্বেই নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে বলে দাবি করছে। নীতি আয়োগের মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক অমিতাভ কান্ত গত ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্বে উল্লেখিত জাতীয় নমুনা সমীক্ষার কর্মসংস্থান সংক্রান্ত প্রতিবেদনকে নির্বাচনের আগে প্রকাশ না করার কারণ হিসেবেও অনুরূপ এক রিপোর্টের সাহায্য নিয়েছিলেন। ওই রিপোর্ট, যা পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে বা সাময়িক শ্রম শক্তি সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০১৭-১৮ হিসেবে জ্ঞাত, অনুযায়ী ২০১৮ সালের মার্চ মাসে বেকারির হার গত সাড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মোদি সরকারের অচ্ছে দিনের চকমকানির বিরুদ্ধে যাওয়া ওই প্রতিবেদনকে গ্রহণ না করার অন্যতম কারণ হিসেবে বেসরকারি পরামর্শদাতা সংস্থা ব্রুকিংসের একটি প্রতিবেদনকে উল্লেখ করেন যেখানে লেখা হয়েছিল, “শীঘ্রই বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশে পরিণত হতে যাওযা ভারতবর্ষ চরম দারিদ্রকে অতি দ্রুত কমিয়ে ফেলছে এবং বিশ্ব হয়তো সেই সাফল্যকে খাটো করে দেখছে। ২০১৭-১৮ সালের ভারতের পারিবারিক সমীক্ষা (যা ২০১৯ এ প্রকাশিত হবে) ভোগব্যয়কে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করবে—সাধারণ আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে সমস্ত বিষয়কে হিসেবে আনবে। ওয়ার্লড ডাটা ল্যাব (বিশ্ব তথ্য পরীক্ষাগার) প্রত্যাশা করছে যে ওইসব পদ্ধতিগত বোঝাপড়ার পরে ভারতে বর্তমানের ৫ কোটি অতি দরিদ্রের সংখ্যা কমে ৪ কোটি হবে।”
কিন্তু মজার কথা হল, যা আগেই লেখা হয়েছে যে, ভোগব্যয় কমে গেছে। ফলে অতি শীঘ্রই হয়তো শ্রীযুক্ত কান্ত কোনো পত্রিকায় আরেকটি নিবন্ধ লিখবেন জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার ভোগব্যয় সংক্রান্ত প্রতিবেদনকে খারিজ করার কারণ দেখিয়ে। যেখানে অন্য কোনো বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনকে সাক্ষী মানা হবে।
একদিকে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধিই এখন প্রশ্নের মুখে, যে বৃদ্ধিকেই দারিদ্র হ্রাসের অন্যতম সাক্ষী হিসেবে মানা হচ্ছিল। অন্যদিকে ভারতীয় অর্থনীতির চরম অসাম্য ইঙ্গিত করছে যে, বৃদ্ধি হোক বা না হোক অতি ধনীরা ভারতের সব সম্পদকে কুক্ষিগত করে চলেছে। অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে --
(১) জাতীয় সম্পদের ৭৭% দেশের ১০% বৈভবশালীর হস্তগত হয়েছে। (২) ২০১৭ সালে দেশে সৃষ্ট ৭৩% সম্পদ হস্তগত করেছে সর্বোচ্চ ধনী ১%। (৩) ওই বৎসরে দরিদ্রতম ৫০% মানুষের সম্পদ বেড়েছে মাত্র ১%। (৪) ২০০০ সালে দেশে বিলিওনিয়ারের সংখ্যা ছিল ৯; ২০১৭ সালে তা বেড়ে ১০১ হয়েছে। (৫) অনুমান করা হচ্ছে যে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে প্রতিদিন ৭০ জন মিলিওনিয়ারের সৃষ্টি হবে। (৬) গত দশ বছরে বিলিওনিয়ারদের সম্পদ ১০ গুণ বেড়েছে। (৭) অন্যদিকে প্রতি বৎসর ৬কোটি ৩০ লক্ষ দেশবাসী কেবলমাত্র স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের জন্য দারিদ্রে পতিত হচ্ছে। (৮) একটি ন্যূনতম মজুরি আয় করা শ্রমিকের ৯৪১ বৎসরের আয় বিখ্যাত পোশাক কোম্পানির একজন উচ্চ বেতনভোগী কার্যকর্তার ১ বৎসরের আয়ের সমান। (৯) সারা বিশ্বে মাতৃত্বকালিন মৃত্যুর ১৭% ও ৫ বৎসরের নীচে শিশু মৃত্যুর ২১% ঘটে ভারতে।
এছাড়াও বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে (১০) ভারতে বৈষম্য গত ৩ দশকে যারপরনাই বেড়েছে। ১৯৯৩ সালে গিনি সূচক (বৈষম্য মাপার সূচক-মান যত বেশি বৈষম্য তত বেশি) ছিল ৩১.৭। ২০১১ সালে ছিল ৩৫.৭। এখনকার পরিমাপ পাওয়া যায় না, তবে যথেষ্টই বেড়েছে। (১১) বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ১০২ (সূচকের মান-৩০.৩)। পাকিস্তানের স্থান ৯৪ (সূচকের মান- ২৮.৫), বাংলাদেশের স্থান ৮৮ (সূচকের মান-২৫.৮)। (১২) ২০১৬ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র হার ছিল ১৪.৮%, ২০১৫ সালে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা ৩.৯% ও চীনের দারিদ্র হার ২০১৫ সালে ০.৭%।
সমস্ত তথ্য পরিসংখ্যান ভারতের এক অর্থনৈতিক দুর্গতির দিকে ইঙ্গিত করছে। দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কেবল কমছে তাই নয়, দেশের দরিদ্র জনসাধারণের সংখ্যা ও মনুষ্যেতর অবস্থানও জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।