আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের প্রাক্কালে লোকসভা পাশ করল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) ২০১৯। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে খামখেয়ালি ও বৈষম্যমূলক আইন যা ভারতীয় নাগরিকত্বের মৌলিক শর্তগুলি বদলে দিচ্ছে, ভারতীয় সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে, মূল সুরকে বিকারগ্রস্ত করছে। এই বিল সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণাকে কার্যত নাকচ করে দিয়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের চরিত্রকে ধ্বংস করছে। ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড়ো গোষ্ঠি মুসলমান সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করে ভারতের সাংবিধানিক রূপরেখায় সকলকে নিয়ে গড়ে ওঠা জাতির ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে অ-মুসলমান ধর্মীয় ভিত্তিতে। উল্লসিত নরেন্দ্র মোদি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ধূর্ততায় এই বিলকে বর্ণনা করেছেন ‘ভারতের বহু শতাব্দীর মানবিক মূল্যবোধ ও আত্তিকরণ ভাবধারার অনুসারী’ বলে।
হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ ও পারসিক ধর্মের যে সমস্ত মানুষ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-র আগে কোনও বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ভারতে এসেছেন তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই বিলটি। একমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়কেই এই তালিকা থেকে দৃষ্টিকটুভাবে বাদ রাখা হয়েছে। বিলে যে পূর্বানুমান ব্যক্ত করা হয়েছে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিলটি পেশ করে তার পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে যে ধারণা বিস্তারিত আকারে বলেছেন তা হল ঐ তিনটি দেশে মুসলমানরা হলেন আধিপত্যকারী সম্প্রদায় এবং অন্য সম্প্রদায়গুলি নিপীড়িত সংখ্যালঘু। এই পূর্বানুমানটি সম্পূর্ণরূপে মনগড়া এবং খেয়ালখুশি মতো বানিয়ে নেওয়া ক্যাটাগরি। যদি ভাবনাটি এমনই হয় যে, নিজস্ব বিশ্বাসের কারণে অত্যাচারিত হয়ে যারা ভারতে এসে আশ্রয় ও নাগরিকত্ব প্রার্থনা করছেন তাদের সকলের জন্য আমরা দ্বার খুলে দেব, তাহলে কেবল মাত্র এই তিনটি দেশ আর নির্দিষ্ট ওই ছয়টি ধর্মের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? কেনই বা কৃত্রিমভাবে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-কে শেষ তারিখ হিসেবে ধরা হবে? শ্রীলঙ্কার তামিল, মায়ানমারের রোহিঙ্গা আর চীনের বৌদ্ধ ও মুসলমানদের কী হবে? বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদী মানুষরা কেন বাদ? পাকিস্তানের শিয়া, বালুচ ও আহমাদিয়াদের বিষয়টা কী হবে, কী হবে বিভিন্ন দেশের ধর্মপরিচিতি নির্বিশেষ যুক্তিবাদী নাস্তিকদের? আর, বিলে নির্দিষ্ট করা দেশগুলিতে যদি সত্যিই এমন ব্যাপক ধর্মীয় নিপীড়নের বাস্তবতা থাকে তাহলে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-র পর কি সেই বাস্তবতা হঠাৎ বদলে গেছে?
আসামে এনআরসির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তারপর তা সারা দেশ জুড়ে চালু করার বিষয়টি সামনে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যে গভীর উৎকন্ঠা তৈরি হয়েছে তার এক সাম্প্রদায়িক নিরাময় হিসেবে বিজেপি সিএবি-কে ব্যবহার করতে চায়। আসামে প্রায় বিশ লক্ষ মানুষ চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়েছেন। এবং বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন যে বাদ পড়াদের মধ্যে সিংহভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের। সারা দেশে এনআরসি হলে বাদ পড়ার সংখ্যাটা লাখে নয়, কোটিতে হবে। আসামের অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে এদের অধিকাংশই হবে দরিদ্র ভূমিহীন মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিক ও সাধারণ খেটে খাওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। সঙ্ঘ-বিজেপি পরিবার মানুষকে বোঝাতে চায় যে এনআরসি থেকে বাদ পড়া হিন্দুরা সিএবি-র মাধ্যমে পুনর্বাসন পাবে। কোনো বিহারি পরিযায়ী শ্রমিক, ছত্তিশগড়, গুজরাট বা রাজস্থানের কোনো আদিবাসী পরিবার, অথবা তামিলনাড়ু কর্ণাটক বা অন্ধ্রপ্রদেশের কোনো কৃষক পরিবার কীভাবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে আসা নিপীড়িত রিফুজি হিসেবে পুনর্বাসিত হবে! এই ধাঁধার উত্তর বোধহয় সঙ্ঘ-বিজেপির কুমন্ত্রণাদাতা অপপ্রচারকারীরাই একমাত্র জানে।
অমিত শাহ বলেছেন যে কংগ্রেস যদি ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ না করত তাহলে সিএবি প্রয়োজন হত না। এ এক নির্লজ্জ ধূর্ত মিথ্যাচার। আমাদের প্রকৃত ইতিহাসের সাথে এর কোনও যোগাযোগ নাই। আমাদের ইতিহাসের নথি খুললে দেখা যায় যে বিজেপির পরমপূজ্য সাভারকার ও হিন্দু মহাসভাই ছিল এই ভ্রান্ত ও বিপর্যয়কর দ্বিজাতি তত্বের মূল উদ্গাতা ও সেই তত্বের রাজনৈতিক-মতাদর্শগত বাহক যা শেষ পর্যন্ত ভারত ভাগের নিদারুণ ট্র্যাজেডি ডেকে এনেছিল। ভারত এই বিভাজনকে রুখতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বকে ভারত কখনই গ্রহণ করেনি। ডক্টর আম্বেদকরের তত্বাবধানে যে সংবিধান রচিত হয় তা ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করে সমতা ও সৌভ্রাতৃত্ত্বের আশ্বাস এনেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদী ভাবধারা সমগ্র সংবিধান জুড়েই প্রকাশিত হয়ে এক সংযুক্ত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ভারতের ভিত্তিকে মজবুত করেছে। পাকিস্তান নিজেকে আধিপত্যকারী ধর্মীয় পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে সংজ্ঞায়িত ও সংগঠিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে এক স্বতন্ত্র স্বাধীন সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জাতীয় সত্বা হিসেবে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তান। দেশভাগের জবাব একমাত্র দেশভাগ থেকে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই দেওয়া যেতে পারে, একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে নয় নিশ্চয়। কিন্তু বিজেপি দেশভাগের ভ্রান্ত ও বিপর্যয়কর যুক্তিকেই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত জীবনের ওপর প্রসারিত করতে উঠে-পড়ে লেগেছে। তারা সেই শুকিয়ে আসা ক্ষতকে খুঁচিয়ে তুলতে চাইছে আরএসএস-এর দীর্ঘলালিত সংখ্যাগুরুবাদী ফ্যাসিস্ট হিন্দুরাষ্ট্র বলবৎ করার লক্ষ্যে। ভারতীয় সংবিধানের খসড়া তৈরি করার সময় ডক্টর আম্বেদকর এই হিন্দুরাজকে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড়ো বিপর্যয় হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন এবং তাকে যে কোনও মূল্যে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বিবিধের মাঝে মিলন আর বহুত্বের গৌরব বরাবরই ভারতের অন্তরের বাণী হয়ে থেকেছে। ১৮৯৩ সালে তাঁর ঐতিহাসিক শিকাগো বক্তৃতায় বিবেকানন্দ এই তত্বই ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর বাণীর মাধ্যমে : “আমি গর্বিত যে আমি এমন এক দেশের বাসিন্দা যে দেশ পৃথিবীর সব জাতি সব ধর্মের নিপীড়িত শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে”। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯, এই ভাবধারাকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দিচ্ছে, সংবিধানের মূল সুরকে বিকৃত করছে এবং সুবিচার, মুক্তি, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্বের মূল স্তম্ভগুলোকে উল্টে দিচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলির নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর নামে প্রকৃতপক্ষে কোণঠাসা করছে ও ন্যক্কারজনক বৈষম্যের শিকার বানাচ্ছে নিজের দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে, যে সম্প্রদায়ের মানুষেরা স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা উত্থান পতন ও তার পরবর্তী সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা আধুনিক ভারতের মূল কারিগরদের অন্যতম। এই সিএবি-এনআরসির ভয়ানক বিপর্যয়কে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে ভারতকে।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ১০ ডিসেম্বর ২০১৯)