গত ২৮ নভেম্বর সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের এক প্রতিনিধি দল বীরভূম জেলার প্রস্তাবিত কয়লা খনি প্রকল্প এলাকার সাধারণ মানুষের সাথে দেখা করে বিস্তারিত কথা বলেন। তার ভিত্তিতে প্রতিনিধিদলের মূল মূল পর্যবেক্ষণগুলি হল –
১। সমগ্র এলাকার কেউই কয়লা খনি মন থেকে চাইছেন না।
২। সরকারি পুনর্বাসন প্যাকেজ এলাকার মানুষের বাস্তব পরিস্থিতিকে ছুঁতে পারেনি, কোনও অংশই খুশী নন, বড় অংশই বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন।
৩। ‘জোর করে খনি করা হবে না’ – মুখে একথা বললেও গভীরে অন্যরকম কাজ শুরু হয়েছে –
সামগ্রিকভাবে প্রতিনিধিদলের মনে হয়েছে যে এখানকার মানুষ আশু ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়াও সমষ্টিগত ভালোমন্দ, বিশেষত পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কমবেশি উদ্বিগ্ন। সরকার ও এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংযোগের গভীর ঘাটতি রয়েছে। এলাকার মানুষ সংগঠিত হতে চাইছেন। গাঁওতার পুরনো নেতৃত্ব শাসকদলের অঙ্গীভূত হয়ে গ্রামবাসীদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। বাইরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে নতুন প্রজন্ম উদ্গ্রীব হয়ে আছে, একই সাথে খুব সতর্কতার সাথেও এগোতে হচ্ছে তাঁদের।
আট জনের প্রতিনিধি দলে ছিলেন বীরভূম জেলার অশোক মণ্ডল ও প্রদ্যোৎ মুখার্জী, পশ্চিম বর্ধমান জেলার সুরিন্দর সিং ও কৃশানু ভট্টাচার্য এবং কলকাতা থেকে মধুরিমা বক্সী, লাবণী জঙ্গী, অনুপম রায় ও মলয় তেওয়ারি। একদিনের পরিদর্শনে এলাকার মাত্র কয়েকটি গ্রামের মানুষের সাথেই কথা বলা সম্ভব হয়েছে। এই এলাকার মানুষের কাছ এখন আরও বেশি বেশি করে যাওয়া দরকার। বিশেষত কলকাতা তথা রাজ্যের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠনের পক্ষ থেকে গিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা শোনা ও পাশে দাঁড়ানো দরকার।
গত ২৯ নভেম্বর ছিল ১৯৭৪ সালে পুনর্গঠিত সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড জহরের (সুব্রত দত্ত) ৪৭তম শহীদ দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বিহারের ভোজপুর জেলার বাবুবাঁধ গ্রামে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর ঘেরাও আক্রমণের বিরুদ্ধে কয়েক ঘন্টাব্যাপী প্রতিরোধ সংগ্রামে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন। ঐ সংগ্রামে একইসঙ্গে শহীদ হন আরও দু'জন কমরেড — কমরেড নির্মল কুমার (ডাক্তার) ও কৃষক কমরেড রতন। শহীদদের আত্মদান ব্যর্থ হয়নি। কৃষক সংগ্রাম পুনর্জীবিত হয়েছে ভোজপুরের মাটিতে, বিহারের অগ্নিগর্ভ ভূমিতে, দেশের রাজ্যে রাজ্যে গণসংগ্রামের ময়দানে। পার্টির পক্ষ থেকে এদিন শহীদ স্মরণ করা হয়, তাঁদের আদর্শ ও স্বপ্ন পূরণের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। বীর শহীদদের স্মৃতি থাকবে অবিনশ্বর, পাথেয় হয়ে থাকবে চির প্রেরণার।
২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবসের দিনে সারা দেশ জুড়ে পালিত হল কৃষক আন্দোলনের বর্ষপূর্তি। ২০২০ সালে এই দিন গোটা দেশ জুড়ে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকেরা সারা দেশব্যাপী ধর্মঘট সংঘটিত করেছিল, আর সেই দিনই তিন কৃষি আইন, বিদুৎ বিল ২০২০, বাতিলের দাবিতে সারা দেশের হাজারে হাজারে কৃষকেরা দিল্লীর সীমান্ত ঘিরে অবস্থান শুরু করেছিল। মোদী সরকার বিভিন্নভাবে এই আন্দোলনকে বদনাম ও দমন করার নির্মম প্রচেষ্টা চালালেও কিষাণ-কিষাণীরা তাঁদের অবস্থানে অনড় থেকে সরকারকে বাধ্য করেছে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রাথমিক জয় হয়েছে। তাই ২৬ নভেম্বর এই আন্দোলনের বর্ষপূর্তি হয়ে উঠেছে বিজয়ের উৎসব।
সারা দেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার অন্তর্ভুক্ত সমস্ত কৃষক এবং গ্রামীণ মজুরদের সংগঠন এবং কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনের ডাকে রাজ্যের ব্লকে ব্লকে জমায়েত এবং সভার সাথে সাথে কলকাতায় ধর্মতলা ওয়াই চ্যানেলে এক মহতি সভা ও মিছিল সগঠিত হয়। ওয়াই চ্যানেলের সভাতে কয়েক হাজার মানুষ সামিল হন। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার পক্ষ থেকে সভা পরিচালনা করেন কার্তিক পাল এবং বক্তব্য রাখেন অমল হালদার, অভিক সাহা, সমীর পুততুণ্ড, প্রদীপ সিং ঠাকুর সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন বাসুদেব বসু, অনাদি সাহু সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। মহিলা সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কনীনিকা বসু, নমিতা হালদার, কল্পনা দত্ত, সুফিয়া খাতুন ও অন্যান্যরা। ছাত্রযুব সংগঠন থেকে বক্তব্য রাখেন মীনাক্ষী মুখার্জী।
সমস্ত বক্তার বক্তব্য থেকেই উঠে আসে এই জয় মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একটা প্রাথমিক জয়। যতক্ষন না ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি গ্যারান্টি এবং বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল না করছে ততদিন কৃষকেরা পিছু হটবে না। বক্তব্যে উঠে আসে এরাজ্যের কৃষকদের দুর্দশা তথা রাজ্য সরকারের অবহেলার কথা। গত একবছর ধরে চলা এই আন্দোলনের সময়েই রাজ্যের এমএসপি আইনের প্রস্তাবনা পেশ হয়েছিল রাজ্যের কাছে, কিন্তু আজও তার সুরাহা হয়নি। রাজ্যে কৃষকেরা উৎপাদন মূল্যের কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। রাজ্যে ২০১৪’র চুক্তি চাষ সংক্রান্ত আইনের ফলে চরম বিপদের শিকার হচ্ছেন চাষিরা। অবিলম্বে এই আইন প্রত্যাহারের দাবি ওঠে।
সভা থেকে মোদী সরকারের বিপর্যয়কর নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের বার্তা ঘোষিত হয়। শ্রমিক বিরোধী শ্রম কোড, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, জাতীয় মানিটাইজেশন পলিসের নামে দেশ বেঁচে দেওয়ার নীতি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার বার্তা দেওয়া হয়। ২০২৪’র সাধারণ নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার আওয়াজ ওঠে।
সভা শেষে ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত এক সুবিশাল মিছিল বিজেপি–আরএসএস’এর বিভেদকামী বিপর্যয়কর শাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে ধর্মতলা থেকে মৌলালি হয়ে শিয়ালদহে গিয়ে শেষ হয়।
রাজ্য সরকার তেইশটি দপ্তরে জনা পঞ্চাশ পরামর্শদাতা নিয়োগের পদক্ষেপ করতে চলেছে। পদমর্যাদায় এরা হবেন বিশেষ সচিব পর্যায়ের সমতুল, বেতন মর্যাদায় সিনিয়র পরামর্শদাতারা মাসিক দু'লক্ষ টাকা, আর বাকীরা মাসিক দেড় লক্ষ টাকায় নিযুক্ত হবেন। এই নিয়োগ হবে চুক্তিতে, বলাবাহুল্য আউট সোর্সিং হিসেবে। নেওয়া হবে অবসরপ্রাপ্তদেরও। নিয়োগ বিচারে কোনও সীমারেখা রাখা হবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত-স্বশাসিত সংস্থা-বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষণা কেন্দ্র-বেসরকারি সংস্থা-কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান-এমনকি আন্তর্জাতিক মানের পরামর্শদাতা সংস্থা যেখান থেকে পছন্দ হবে বিশেষজ্ঞদের নিযুক্ত করা হবে। তবে এই বাছাইয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে ও পদক্ষেপে আদৌ স্বচ্ছতা থাকবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
যে কোনও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও রূপায়ণের কাজে বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতা প্রয়োজন হয়, সময়ে সময়ে তার পরিবর্তনেরও প্রয়োজন হয়। তবে নীতি থাকা উচিত ‘ন্যূনতম প্রশাসন — সর্বব্যাপী পরিচালনা’ — কম খরচের সহজ প্রশাসন। ওপরতলায় আয়তনে যত ছোট সম্ভব প্রশাসন পরিচালনা যন্ত্র থাকে ততই শ্রেয়। একে তো রাজ্যপাল, মন্ত্রী, বিধায়ক ও সচিব আমলাকুলের বহর বাড়ছে, তার মানে আর্থিক বরাদ্দ ক্রমেই বেড়েই চলেছে, এদের কোনও পক্ষই নিজেদের ব্যয় কমানোর প্রসঙ্গ ভুলেও উচ্চারণ করেন না। ওপরতলার এই ক্রমাগত ব্যয়বৃদ্ধির চাপ রাজকোষে অনেকটাই টান পড়ার একটা বিশেষ কারণ। তার ওপর যদি মন্ত্রীসভা, সচিবালয় ও আবার ‘পরামর্শদাতা’ নিয়োগের বহর বাড়ানো হয় তাহলে প্রশ্ন তো তুলতেই হয়। হঠাৎ কিসের প্রয়োজনে মাসিক কোটি টাকার মাসোহারার বিনিময়ে এই নিয়োগ হবে? যেখানে সাধারণ চাকরি হয় না, থুড়ি, চাকরি যেটুকু হয় শুধু পুলিশ আর সিভিক পুলিশে, প্রতিশ্রুতির চাকরি-ক্ষতিপূরণের চাকরি সবই কেবল পুলিশে! অন্যত্র চাকরির দেখা মেলে না। এই যেখানে দুঃসহ অবস্থা সেখানে এতো বিশেষজ্ঞ নেওয়ার দরকার পড়ল কোথা থেকে? যে তেইশটি দপ্তরে নিয়োগের কথা ভাবা হয়েছে সেইসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মূল কারণ কি বিশেষজ্ঞ না থাকা, নাকি সদিচ্ছার অভাব-দৃষ্টিভঙ্গীর সমস্যা-গাফিলতি থাকা! সরকার যখন সবকিছু ধোঁযাশায় রেখে পদক্ষেপ করছে সেটা স্বেচ্ছাচারিতাই। রাজ্য সরকার কিছু কিছু জনকল্যাণ খাতে সংস্কার কর্মসূচি চালু করেছে। কিন্তু বিশাল কিছু নয়, স্থায়ী কিছু নয়। ছোট করে দেখারও নয়, বিশেষ বড় করে দেখানোরও নয়। দয়া দেখানোর বিষয়ও নয়, ধন্য করে দেওয়ারও নয়। শাসন ক্ষমতায় থাকতে হলে এসব একেবারেই ন্যূনতম দায়িত্ব পালনের মধ্যে পড়ে। মমতা সরকার এরকম কিছু কিছু খয়রাতি সুরাহা দিচ্ছে ঠিক কথা। অন্যদিকে যখন যেমন শিক্ষা-স্বাস্থ্য চাকরিতে নিয়োগের ডালি সরকার সামনে আনে, তখন অনবরত তা পক্ষপাতদুষ্টতা, স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং পরিণামে জড়িয়ে যায় আইন-আদালতের জটে। মমতা সরকার কিছু আশু জনমুখী বরাদ্দ সরবরাহ করা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও আর্থিক নৈরাজ্য চালিয়ে আসার অভিযোগ বরাবরের। সারদা-নারদের দুর্নীতির কলঙ্ক মুছে যায়নি। সেইসঙ্গে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়, অথচ ক্লাব ও পুজো কমিটিগুলোকে টাকা যোগানো হয় ! চলে শিল্প টানার নামে তথাকথিত বঙ্গ বিশ্ব সম্মেলন, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ, এসবের নামে নেপথ্যে অর্থ আত্মসাৎ হয়ে কোন তহবিলকে পুষ্ট করে তা নাগরিক জনগণ বোঝেন বিলক্ষণ। এইসব কারণে আবার একদল ‘পরামর্শদাতা’র প্রশাসনিক ও আর্থিক বোঝা মেনে নেওয়া যায় না।
বিহারে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের শুরু হল পাটনায়, মহান বিপ্লবী এবং ভগৎ সিং’এর কমরেড বটুকেশ্বর দত্তর জন্মদিন ১৮ নভেম্বর। এই উদযাপনের অঙ্গ হিসাবে সেদিন এক অনুষ্ঠানের ডাক দেন ঐতিহাসিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মীবৃন্দ এবং নাগরিক সমাজের লোকজন। অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় ভারতীয় নৃত্য কলা মন্দিরে। এর আগে জক্কনপুরে বটুকেশ্বর দত্ত লেনে একটা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং বিধানসভার মূল ফটকে মহান বিপ্লবীর মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়।
সেদিনের ভারতীয় নৃত্যকলা মন্দিরের অনুষ্ঠানে একটি আলোচনাসভা সংগঠিত হয় যার বিষয় ছিল স্বাধীনতার ৭৫ বছরের স্বপ্ন ও চ্যালেঞ্জসমূহ। সেই কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ওপি জয়সওয়াল, সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, কবি অরুণ কমল, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক ভারতী এস কুমার, এএন সিনহা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক বিদ্যার্থী বিকাশ, পাসমন্দা মহাজ নেতা ও প্রাক্তন সাংসদ আলি আনোয়ার ও অন্যান্যরা। আলোচনাসভা সঞ্চালনা করেন কুমার পারভেজ এবং সভায় পাটনার বহু বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল।
আলোচনাসভায় তাঁর বক্তব্যে অধ্যাপক ওপি জয়সওয়াল বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএস ও হিন্দুত্ব বাহিনী বিশ্বাসঘাতকতার ভূমিকাই পালন করেছিল। ওরা মনুস্মৃতিকে ওদের সংবিধান মনে করায় ভারতীয় সংবিধানের বিরোধী ছিল। তিনি আরো বলেন, আরএসএস নেতৃবৃন্দ এমনকি সকলের, অর্থাৎ, সর্বজনীন ভোটাধিকারেরও বিরোধিতা করেন। আরএসএস’এর লোকজন আজ ইতিহাসের বিকৃতিসাধন করছে, মিথ্যা উপস্থাপনা ঘটাচ্ছে। আমাদের সমষ্টিগত দায়িত্ব হল এর বিরুদ্ধে এক বিস্তৃত ঐক্য গড়ে তোলা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বুনিয়াদি মূল্যবোধগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, বটুকেশ্বর দত্ত এবং সাভারকারের নাম কখনই একসাথে উচ্চারণ করা যায় না। আন্দামানের জেলে সাভারকারের ইতিহাস হল ব্রিটিশদের কাছে মার্জনা ভিক্ষার ইতিহাস, আর বটুকেশ্বর দত্ত জেলে নিরবচ্ছিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে গেছেন। আজ আমাদের লড়াইটা হল বিজেপি যে মেকি ইতিহাস তৈরি করছে, ইতিহাসের যে বিকৃতি ঘটাচ্ছে তার বিরুদ্ধে। আমরা স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে অনুপ্ররণা গ্ৰহণ করি এবং এই আন্দোলনের বিভিন্ন দিকগুলোকে স্মরণে রাখি, যার মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার জন্য ১৮৫৭’র লড়াই, ১৯৪২’র ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিম, দলিত, পশ্চাদপদ অংশ এবং নারীদের অংশগ্ৰহণ। এঁদের সংগ্ৰাম আমাদের উত্তরাধিকার এবং আমাদের দায়িত্ব হল এই উত্তরাধিকারকে লালন করা এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া।
কবি অরুণ কমল, ভগত সিং ও তাঁর কমরেডদের লড়াইয়ের কথাকে তুলে ধরেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মূল্যবোধগুলিকে লালন ও রক্ষা করার কথা বলেন। যে বটক মিঞা গান্ধীজির জীবন রক্ষা করেছিলেন, তাঁর বীরোচিত কীর্তিকলাপের কথা বিশদে বর্ণনা করেন বিদ্যার্থী বিকাশ। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে যাঁদের প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে তাঁদের লড়াইগুলোকে আমাদের প্রকাশের আলোয় উদ্ভাসিত করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন প্রাক্তন সাংসদ আলি আনোয়ার। তিনি জানান, বিজেপি ও আরএসএস বিষ ছড়াচ্ছে এবং প্রজ্ঞা ঠাকুর ও কঙ্গনা রানাউতদের উৎসাহিত করছে যারা স্বাধীনতা সংগ্ৰামের সমস্ত শহীদদের অপমানিত করেছেন এবং পরম কাম্য স্বাধীনতাকে ‘ভিক্ষা’ বলে অভিহিত করেছেন।
জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের অভিযান দু’বছর ধরে চলবে বলে সভায় জানানো হয়। জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল্যবোধ এবং স্বপ্নকে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে গণউদযাপন অভিযান দু’বছর ধরে, ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত চলবে।
এই কনভেনশন দাবি জানাচ্ছে যে, সেক্রেটারিয়েট হল, রেলস্টেশন এবং গারদানিবাগ গেট গ্ৰন্থাগারকে মহান বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তর নামে নামকরণ করতে হবে এবং জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে গড়িয়া মঠে বটুকেশ্বর গেট নির্মাণ করতে হবে।
এই কনভেনশন উদযাপন অভিযানকে ব্যাপক বিস্তৃত গণঅভিযানে রূপ দেওয়া এবং নিম্নলিখিত কর্তব্যকর্মগুলি সম্পন্ন করার আহ্বান জানাচ্ছে।
১৮৫৭: প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ
১৮৫৭’র আগে বিহারে চলা স্বাধীনতা সংগ্ৰামের অকথিত আখ্যানগুলোকে প্রকাশের আলোয় নিয়ে আসা; কুনওয়ার সিং এবং ভোজপুরের নিশান সিং, হরকিসান সিং এবং বিশেষভাবে নারীদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা, তাঁদের অবদানকে গ্ৰন্থিত করা এবং তাঁদের নিয়ে কর্মসূচি সংগঠিত করা।
১৮৫৭’র স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান যোদ্ধা জীবধার সিং’এর স্মৃতিতে আরোয়ালে একটা পার্ক নির্মাণ করা।
পাটনার গুলজারবাগে শহীদ পীর আলি স্মৃতিসৌধকে নবরূপে সজ্জিত করা।
১৮৫৭’র পর নওয়াদা জেলায় দশবছর ধরে চলা রাজওয়ার বিদ্রোহের প্রামাণ্য আখ্যান নির্মাণ করা এবং এই বিষয়ে কর্মসূচি সংগঠিত করা।
চম্পারণ সত্যাগ্ৰহ
গান্ধীজির সত্যাগ্ৰহের কর্মীদের ইতিহাসকে পরিচিতির আলোয় নিয়ে আসা, যাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছেন শেখ গুলাব, বটক মিঞা ও অন্যান্যরা এবং গান্ধী চলে যাওয়ার পরও জমিদারদের বিরুদ্ধে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলনের প্রামাণ্য আখ্যান নির্মাণ করা।
১৯৪২’র আন্দোলন
১৯৪২’র আন্দোলনে নিহত সমস্ত শহীদদের (প্রায় ৫০০) তালিকা তৈরি করা এবং তাঁদের স্মৃতিতে এক স্মারকস্তম্ভ নির্মাণ করা এবং বিহারে যে সমান্তরাল সরকার গঠিত হয়েছিল তার ইতিহাস প্রকাশ করা।
আদিবাসী আন্দোলন
অবিভক্ত বিহারে আদিবাসীদের উদ্দীপণাময় আন্দোলন আমাদের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। আমাদের লক্ষ্য হল, ভাগলপুর-পূর্ণিয়া অঞ্চলের আদিবাসী আন্দোলনের ইতিহাসকে, বিশেষভাবে আজ পর্যন্ত অনুল্লেখিত দিকগুলোকে প্রকাশের আলোয় নিয়ে আসা।
স্বাধীনতা আন্দোলনে কৃষকদের ভূমিকা
শাহাবাদ, মগধ, সারান এবং মিথিলায় ঘটা কৃষকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রামাণ্য আখ্যান তৈরি করা এবং গয়ায় যদুনন্দন আশ্রমকে নতুন করে নির্মাণ করা।
স্বাধীনতা সংগ্ৰামী
বিহারের যে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আন্দামানের জেলে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল তাঁদের জীবন ও কর্মকে উন্মোচিত করা এবং তাঁদের স্মৃতিকে সুরক্ষিত করতে উদ্যোগ নেওয়া।
নাচ্ছাতার মালাকার (আরারিয়া), বিসমিল আজিমাবাদী (পাটনা), বদরি আহীর (ভোজপুর), টাকি রহিম (পাটনা), পৃথ্বীরাজ সিং (জাহানাবাদ), রামাকান্ত দ্বিবেদী রামতা (ভোজপুর), জুব্বা সাহানি (মুজাফ্ফরপুর), তারামুণী দেবী (সারান), শেখ গুলাব (চম্পারণ), বটক মিঞা (চম্পারণ) ও অন্যান্যরা।
পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপক এবং বিজেপি সমর্থক কঙ্গনা রানাউত ঘোষণা করেছেন যে ১৯৪৭ সালে পাওয়া স্বাধীনতা ছিল ভিখিরিকে দেওয়া ‘ভিক্ষা’, এবং দেশ প্রকৃত স্বাধীনতা পায় ২০১৪ সালে। তাঁর এই বিবৃতি স্বাধীনতা লাভের পরপরই আরএসএস’এর প্রকাশ করা মনোভাবেরই অনুরূপ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রতি অপমান। আমরা রানাউতের এই মন্তব্যকে তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছি এবং তাঁকে দেওয়া পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করা ও তার মিথ্যা উপস্থাপনার যে ষড়যন্ত্র বিজেপি-আরএসএস চালাচ্ছে, এই কনভেনশন তাকে ধিক্কার জানাচ্ছে এবং গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সৌভ্রাতৃত্ব, সামাজিক ন্যায় ও সমাজতন্ত্রের মতো মূল্যবোধগুলিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করছে।
(লিবারেশন, ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যা থেকে)
বিজেপি মন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির ছেলে আশীষ মিশ্রর গাড়ির চাকায় পিষে নিহত হওয়া কৃষকদের হত্যার তদন্তে সুপ্রিম কোর্ট যে হাইকোর্টের এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করেছে, সারা ভারত কিষাণ মহাসভা (এআইকেএম) তাকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু সেই দলের তিন আইপিএস সদস্যের একজন, পদ্মজা চৌহান সম্পর্কে এআইকেএম আপত্তি জানিয়ে ঐ তদন্তকারী দল থেকে তাঁকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এই আইপিএস অফিসার নিপীড়ন চালানোর জন্য কুখ্যাত। লখিমপুর খেরি জেলায় এসপি’র দায়িত্বে থাকার সময় তিনি কৃষক আন্দোলনের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিলেন। নিপীড়নের শিকার কৃষকদের কণ্ঠস্বরে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য গণতন্ত্রের এক স্তম্ভ সংবাদ জগতও তাঁর হাতে আক্রান্ত হয়েছিল। সংবাদপত্রের ওপর আক্রমণের ঘটনার তদন্তে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া পাঁচ সদস্যের এক কমিটি গঠন করে, ঐ কমিটি এক ঐতিহাসিক রিপোর্ট দেয় যাতে পদ্মজা চৌহানের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়। রিপোর্টে আরও প্রস্তাব করা হয় — তাঁকে যেন সর্বসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের স্থানে দায়িত্বে রাখা না হয় এবং তাঁর সম্পর্কিত এই বিষয়টি রাজ্যসভা, লোকসভা, উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ও বিধান পরিষদে উত্থাপন করার পরামর্শও রিপোর্টে থাকে।
লখিমপুর খেরি জেলায় পোস্টিং থাকার সময় তাঁর সময়কালে অমর উজালার সাংবাদিক সমিউদ্দিন নীলুকে হত্যার যে চেষ্টা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে যে মিথ্যা মামলা দায়ের হয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তার নিন্দা করে, এবং তাঁকে ৫ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলে। পদ্মজা চৌহানের নির্দেশে বহু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও দায়ের হয়। এই ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সিবিআই তদন্তের প্রস্তাব করলেও পদ্মজা চৌহান পুলিশ প্রশাসনের ওপরতলায় তাঁর সংযোগকে কাজে লাগিয়ে সেই তদন্তে স্থগিতাদেশ জারিতে সক্ষম হন। বিষয়টা এখনও হাইকোর্টে ঝুলে আছে।
এআইকেএম লখিমপুর তহশিলের গুথনা বুজরুগ গ্ৰামের দরিদ্র কৃষকেদের জমির পাট্টা দেওয়ার আন্দোলন চালিয়েছিল। পদ্মজা চৌহান সেই সময় লখিমপুরের এসপি ছিলেন এবং এআইকেএম নেতা রামদারাস ও ক্রান্তি কুমার সিং’এর বিরুদ্ধে গুণ্ডা দমন আইন প্রয়োগ করেছিলেন এবং কৃষক আন্দোলনের বহু কর্মীকে জেলে পুরেছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন বর্তমানে প্রয়াত আলাউদ্দিন শশি ও অজন্তা লোহিত।
এই ধরনের নিপীড়নের সঙ্গে যিনি যুক্ত, লখিমপুর খেরির কৃষক হত্যা তদন্তে গঠিত দলের সদস্য হওয়ার কোনো যোগ্যতা তাঁর থাকতে পারেনা বলে এআইকেএম মনে করে। এআইকেএম তাই দাবি জানিয়েছে — হয়, আইপিএস পদ্মজা চৌহান নিজেই তদন্তকারী দল থেকে তাঁর নাম প্রত্যাহার করে নিন, অথবা সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারের কাছে কোনো অবিতর্কিত আইপিএস অফিসারের নাম চেয়ে তাঁকে সিট’এর সদস্য করুক।
২২ নভেম্বর সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার লক্ষ্মৌ মহাপঞ্চায়েতের বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণার পর সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার এই প্রথম মহাপঞ্চায়েত। মোর্চার ব্যানারে অংশগ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন, সারা ভারত কিষাণ মহাসভা, সারা ভারত কিষাণ সভা, জয় কিষাণ আন্দোলন এবং সারা ভারত কিষাণ মজদুর সভা। এছাড়া যে সমস্ত সংগঠন সমর্থন দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে এআইএসএ, এআইএআরএলএ, আরওয়াইএ এবং বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন। লাল এবং সবুজ পতাকা নিয়ে হাজার হাজার কৃষক সমাবেশিত হয়েছিলেন।
মহাপঞ্চায়েতে বিকেইউ নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন, কৃষকদের জন্য তিনটি কৃষি আইন যে ক্ষতিকারক, সরকারকে তা বোঝাতে একবছর লেগে গেল। মোদী চেষ্টা করেছিলেন কৃষকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার, সেইজন্য বলেছেন মাত্র কতিপয় কৃষকেরা কৃষি আইন তিনটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা কি মুষ্টিমেয় কৃষক বলে মনে হয়? কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণায় আমাদের আন্দোলন থামবে না। ক্ষমা প্রার্থনাও যথেষ্ট নয়। কৃষকদের জন্য উপযুক্ত কর্মসূচি আনতে হবে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের জন্য কমিটি গঠনের সরকারি প্রস্তাবকে নস্যাৎ করে টিকায়েত বলেন — গুজরাটে যখন নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন মুখ্যমন্ত্রীর আর্থিক কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি নিজে। ঐ কমিটি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সরকারকে সুপারিশ করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টীর জন্য একটি আইন প্রবর্তন করা দরকার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ঐ কমিটির সুপারিশ এখনও ফাইলবন্দী রয়েছে। তাই নতুন কমিটির কোনোই প্রয়োজন নেই। বরং প্রধানমন্ত্রী মোদী সুস্পষ্টভাবে বলুন ঐ সুপারিশগুলি যেগুলির অংশীদার তিনি নিজে সেগুলি বাতিল করবেন না গ্রহণ করবেন। আমরা অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠিতে বিভিন্ন দাবি — যেমন ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, বিদ্যুৎ বিল, বীজ বিল, দুধ বিল, শহীদ কৃষক পরিবারদের ক্ষতিপূরণ এবং তাদের স্মারক নির্মাণের জন্য অবহিত করেছি। এটাও বলেছি, যদি উল্লেখিত বিলের মধ্যে কোনো বিল আমাদের সাথে বিনা আলোচনায় পাশ করানো হয় তাহলে আমরা তা নাকচ করবো। কৃষকদের থেকে বহু একর জমি বিনা ক্ষতিপূরণে জবরদস্তি নেওয়া হয়েছে। যদি ক্ষতিপূরণ না দেওয়া হয় তবে আমরা তা চষে ফেলব। চিনিকলগুলির মালিক আখচাষিদের বকেয়া মূল্য অবিলম্বে মিটিয়ে দিক। লখিমপুর খেরির সুগারমিল উদ্বোধন করবেন অভিযুক্ত মন্ত্রী অজয় টেনি। যদি তা করেন তবে সমস্ত আখচাষিরা তাদের আখ সুগারমিলের বদলে জেলা শাসকের অফিসে জমা করবেন। টিকায়ত স্পষ্টভাবে বলেন, সরকার কৃষকদের সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজিত করতে চাইছেন কিন্তু তারা যেন এই ফাঁদে পা না দেন বা ভেসে না যান।
এআইকেএম নেতা ঈশ্বরীপ্রসাদ কুশওয়াহা বলেন যতক্ষণ এমএসপি গ্যারান্টী আইন সহ সব দাবি পূরণ না হচ্ছে এবং টেনিকে বরখাস্ত করা হচ্ছে ততক্ষণ কৃষকদের জয় আসবেনা। কৃষক আন্দোলন থামবেনা যতক্ষণ না ২০২২ সালে ইউপি’র ক্ষমতা থেকে এবং কেন্দ্রে ২০২৪ সালে বিজেপি’কে মসনদচ্যুত করা হচ্ছে। এআইএআরএলএ নেতা শ্রীরাম চৌধরী বলেন, কৃষি শ্রমিকরা অভুক্ত হওয়ার কিনারায় রয়েছেন এবং আদানি আম্বানিরা বকলমে দেশ চালাচ্ছেন।
দেবারিয়া, বালিয়া, গাজীপুর, মৌ, চান্দৌলি, মির্জাপুর, বেনারস, জৌনপুর, আজমগড়, ভাদোহী, শোনভদ্র, এলাহাবাদ, রায়বেরিলি, ফৈজাবাদ, লক্ষ্মৌ, হরদৈ, জালায়ূঁ, লখিমপুর খেরি, পিলিভিট, বিজনৌর এবং মৈনপুরি থেকে হাজার হাজার কৃষক সমাবেশিত হয়েছিলেন মহাপঞ্চায়েতে।
২৮ নভেম্বর পার্টির উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্মেলনে নানাবিধ শ্রেণী-স্তরের এক ব্যপ্ত পরিসর থেকে প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। রেল, প্রতিরক্ষা প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের শ্রমিক-জুট মজদুর-রন্ধনকর্মী-নির্মাণ শ্রমিকের-গ্রামীণ শ্রমজীবী থেকে শুরু করে এক ঝাঁক ছাত্র-যুব, সাংস্কৃতিক কর্মী, মহিলা আন্দোলনের কর্মী ও নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে ১৫৫ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। যারমধ্যে মহিলা ৩২ জন, শ্রমিক ৬৪ জন (শহর ও গ্রাম মিলিয়ে), কৃষিফ্রন্টে ১৮ জন, ছাত্র ১৭ জন। বারাসাতের সুভাষ হলে আয়োজিত এই সম্মেলন নিশ্চিতভাবে সমগ্র পার্টি সংগঠনে এক নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা সঞ্চার করেছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও তার পাশাপাশি এরাজ্যের শাসকের বঞ্চনা প্রতারণা দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনগণকে বামপন্থী আন্দোলনে সামিল করার লক্ষ্য সম্মেলন তুলে ধরেছে। জেলার গ্রামীণ এলাকাগুলিতে গিয়ে কৃষিক্ষেত্রের কাজে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া, জুট শিল্প সহ শ্রমিকদের উপর শাসকদল ও মালিকপক্ষের মদতপুষ্ট সমাজবিরোধীদের হামলা মোকাবিলায় নতুন করে ঐক্যবদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন কাজের ধারা গড়ে তোলা, এপ্রশ্নে ধাপে ধাপে স্থিতাবস্থা কাটিয়ে ওঠা, নতুনভাবে এগিয়ে আসা ছাত্র যুবদের সংগঠনের সর্বস্তরে অগ্রণী দায়দায়িত্বে নিয়ে আসা, মহিলাদের আন্দোলনে তাঁদের কাজের দাবিকে গুরুত্বের সাথে সামনে আনা, ছাত্রফ্রন্টের সক্রিয়তাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়ার উপর জোর দেওয়া, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নানাবিধ শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ কাজের এক নতুন পরিসর গড়ে তোলা, এই সমস্ত দিকগুলি আলাপ আলোচনায় গুরুত্ব পায়। মোট ২৮ জন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন।
সম্মেলনে পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল বলেন, রাজ্যে আমাদের পার্টির প্রোফাইল বেড়েছে, কিন্তু গণভিত্তি বাড়ানোর কাজে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক পুনর্গঠন করতে হবো, নবীন শক্তিকে সাহসের সাথে দায়িত্বে নিয়ে আসতে হবে। রাজ্য পর্যবেক্ষক জয়তু দেশমুখ বলেন, রাজ্য পার্টির অগ্রগতিতে উত্তর ২৪ পরগণা জেলা অগ্রণী ভূমিকা নেবে, এই জেলায় শ্রমিক ফ্রন্টের কাজ নতুন রাস্তা দেখাবে, ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে কার্যকরি ভুমিকা গ্রহণ করবে এই বিশ্বাস রাজ্য কমিটির রয়েছে। জেলার গ্রামীণ এলাকাগুলিতে কৃষক ও কৃষি মজুররা নিশ্চিতভাবেই নানারকম ক্ষোভ বিক্ষোভের মধ্যে রয়েছেন, সেখানে আমাদের অংশ নেওয়া প্রয়োজন।
বিদায়ী জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত বলেন, নীচুতলায় পার্টি ব্রাঞ্চগুলিকে সক্রিয় না করতে পারলে সমস্ত পার্টি সদস্যদের পার্টি ও গণকাজে সামিল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এপ্রশ্নে আমাদের অগ্রাধিকার দিতেই হবে। সীমিত একটা শক্তিকে নিয়ে চলতে আমরা যেন অভ্যস্ত না হয়ে পড়ি এবিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। সমস্ত পার্টি সদস্যদের উপযোগী কাজের বৈচিত্র গড়ে তোলা — এটাও একটা সৃজন, দায়িত্বশীলদের এবিষয়ে সক্ষম হয়ে উঠতে হবে। সম্মেলনের শুরুতে জেলায় ’৭০ দশকের সমস্ত শহীদের তালিকা তৈরি করা, তাঁদের জীবনী ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রকাশনা করে নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি সম্পর্কে বলেন জেলা কমিটির সদস্য নবেন্দু দাশগুপ্ত। জেলা কমিটি সদস্য নির্মল ঘোষ আর্থিক বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করেন। ২৬ জনের জেলা কমিটি নির্বাচিত হয়। সুব্রত সেনগুপ্ত জেলা সম্পাদক রূপে পুর্ননির্বাচিত হন। তিনি বলেন, এই জেলায় তিতুমীরের সামন্তবাদ বিরোধী লড়াই, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, যাকে সিপাহী বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা হয় তার প্রথম শহীদ মঙ্গল পান্ডের আত্মবলিদানের ঐতিহ্য রয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনে সেই গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরা হবে৷ এ জেলার বরানগর, কাশীপুর, বারাসাতে গণহত্যা চালিয়ে একটা প্রজন্মকে শেষ করে দেওয়ার অপচেষ্টা হয়েছিল। বিপ্লবী যুব ছাত্রদের সেই বিপ্লবী ঐতিহ্যকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
গত সপ্তাহে সালকিয়া মালিপাঁচঘড়া থানার অধীনে একটি বেসরকারি হোমে ঘটে যাওয়া শিশু পাচার, শিশু নিগ্রহ সহ সেখানকার আবাসিকদের উপর যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদে ২৪ নভেম্বর সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হাওড়া জেলা কমিটির পক্ষ থেকে জেলা শাসকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, আইসা, এআইসিসিটিইউ’র উদ্যোগে হাওড়া ফ্লাইওভারের সামনে সংঘটিত হয় প্রতিবাদ সভা। বক্তব্য রাখেন নিলাশিস বসু, রতন দত্ত। জেলাশাসকের দপ্তরে স্মারকলিপি দেওয়ায় ছিলেন কল্যাণী গোস্বামী, অমিতাভ, অঙ্কিত এবং পার্টির জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত।
জেলাশাসকের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা শাসক (জেনারেল) স্মারকলিপি গ্রহণ করেন ও প্রত্যেকটি দাবি শোনেন। তিনি জানান ইতিমধ্যে সরকারের নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর এবং জেলা প্রশাসনের যৌথতায় একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যে কমিটি জেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি এবং মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে ভিজিট করবে।
প্রাথমিকভাবে যে অভিযুক্ত প্রশাসনিক কর্তা রয়েছেন তাকে ইতিমধ্যেই তদন্ত চলাকালীন প্রাথমিকভাবে সাসপেনশনে রাখা হয়েছে। ডেপুটেশনের প্রতিনিধিদল দাবি জানায় নিরপেক্ষ তদন্ত করে অবিলম্বে দোষীদের ‘পক্সো’ (২০১২) ধারায় পুলিশকে চার্জশিট দাখিল করতে হবে। এডিএম আশ্বাস দেন সাধ্যমতো দাবিসমূহ পূরণ করার চেষ্টা করবেন। তাঁকে পরিস্কারভাবে জানিয়ে আসা হয়েছে, কেবল কাগুজে কথায় বাস্তব পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয় না। এই ঘটনাপ্রবাহ থামাতে জেলা প্রশাসনের সৎ প্রচেষ্টা না থাকলে ভবিষ্যতে বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে যাওয়া হবে।
সমস্ত দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, পেট্রল, ডিজেল এবং রান্নার গ্যাসের দামের প্রতিবাদে, হাওড়ার সালকিয়া হোমকান্ডে শিশুদের যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ২৭ নভেম্বর। প্রতিবাদে মুখর হয়ে বক্তব্য রাখেন শুক্লা সেন, মমতা ঘোষ, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, শীলা দে সরকার, ইন্দ্রাণী দত্ত, সৌমী জানা ও স্নিগ্ধা বসু।
১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার বিএসএফের ৫০ কি.মি.পর্যন্ত ক্ষমতা বৃদ্ধি আদেশের বিরুদ্ধে সীমান্তবাসীদের পক্ষে বিভিন্ন গণসংগঠন, রাজনৈতিক দল ও ব্যাক্তিবর্গ রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় বিএসএফ দপ্তরে ৬ দফার দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি দেয়। এই পরিক্ষেতেই দক্ষিণেশ্বরের নিকট আলমবাজার (বরানগর) বিএসএফ দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। বিএসএফ আধিকারিক বলেন, নীতিনির্ধারণকারী কোন বিষয় তিনি ডেপুটেশন নিতে পারবেন না।
দাবি জানানো হয় —
১) চোরাচালান রোধে বিদেশি অনুপ্রবেশ আটকাতে বিএসএফ সীমান্তে (আইবি)-তে প্রহরা দিক, গ্রামের ভেতর ও জনপদে ও শিশুদের সামনে সশস্ত্র জওয়ানদের উপস্থিতি শোভন নয়।
২) বিএসএফ কর্তৃক নির্যাতন, বাধা, হত্যা-র অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত চাই।
৩) অনুরাধা ভাসিন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আদেশানুযায়ী একনাগাড়ে ১৪৪ ধারা প্রয়োগ রুজু করা চলবে না।
৪) কেন্দ্রীয় সরকারের ৫০ কি.মি. পর্যন্ত বিএসএফের ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রত্যাহার করা হোক।
৫) কাঁটাতারের ওপারে কৃষকের জমি বা জলাশয় আছে। সেখানে জমিতে চাষের জন্য চাষিদের বা মৎসচাষিদের সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত যাওয়া আসার অধিকার দিতে হবে।
৬) দেশের আইন, সাংবিধানিক অধিকার [(অনুচ্ছেদ ১৪ — সমানাধিকার), (অনুচ্ছেদ ২৯ — বিনা বাধায় ভারতীয় ভূখণ্ডে যাতায়াতের স্বাধীনতা) ও (অনুচ্ছেদ ২১ — জীবনের অধিকার)] সীমান্তবাসীদেরও আছে। আমরা সীমান্তবাসীর পক্ষে।
ডেপুটেশন কর্মসূচীতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সহ বেশ কিছু গণসংগঠন উপস্থিত ছিল। স্বাক্ষর করেছেন — রূপা চক্রবর্তী খান, নবেন্দু দাশগুপ্ত, প্রদীপ বসু, অভিজিৎ দে, মুজিবর রহমান, আশোক সাহা, শিবশঙ্কর গুহরায়, প্রীতম ধর সহ আরও অনেকে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার টিভি, রেডিও সহ সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ১,৯৪০ টাকা কুইন্টাল দামে সরকার সরাসরি কৃষকদের ধান কিনছে। প্রচার দেখে মনে হবে কৃষকদের চাহিদা মতো সমস্ত কৃষকই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারছেন। বাস্তবে পুর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদীয়া সহ বিভিন্ন জেলায় খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে কোথাও এখনও ধান কেনা শুরুই হয়নি। মোটামুটি ব্লক পিছু একটির বেশি ক্রয়কেন্দ্র নেই। এখন নাম রেজিষ্ট্রেশন চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথমে লাইন দিয়ে কুপন নিয়ে ২০ থেকে ৩০ দিন পর নির্দিষ্ট তারিখে জমির কাগজ পত্র, আধার কার্ড ও ব্যাংক একাউন্ট নং দেখিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করতে হচ্ছে। ধান বিক্রির সময়ও প্রথমে লাইন দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন কার্ড দেখিয়ে কুপন সংগ্রহ করে পরে নির্দিষ্ট তারিখেই ধান জমা দিতে হয়। কখনও কখনও ২-৩ মাস পর ধান জমা দেওয়ার তারিখ হতে পারে। দৈনিক ২০ জনের বেশি কৃষকের থেকে ধান সংগ্রহ হবেনা। তারপর আছে ধান পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার। টাকা ব্যাংক মারফত পেতে হবে। এত দীর্ঘ প্রক্রিয়া। দৈনিক ২০ জনের ধান কেনা হলে কতদিনে ব্লকের ধান কেনা সম্পূর্ণ হবে নিশ্চয়তা নেই! কৃষকদের অপেক্ষা করতে হবে। আবার জমির কাগজ না থাকলে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান নেওয়া হবে না। কাগজপত্রের অভাবে নিজের জমির ধানও কৃষক ক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি করতে সুযোগ পান না। নদীয়ার একটি ক্রয় কেন্দ্রের আধিকারিক বলেন, যদি মালিক তার জমির কাগজপত্র সহ আপনি চাষ করেছেন অনুমতি লিখিত দেন তাহলে ধান নেওয়া যাবে, নচেৎ নয়। পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদীয়া, হুগলি সহ বেশীরভাগ জেলাতেই নতুন ধান ওঠার পর থেকেই ১,২০০/১,৩০০ টাকা কুইন্টাল দামে গ্রামাঞ্চলের ফড়ে ব্যাপারীদের মাধ্যমেই গরিব প্রান্তিক কৃষকরা ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। উৎপাদন খরচ বিঘায় ১১,০০০/১২,০০০ টাকা। উৎপাদন হয় বিঘা পিছু ৬ থেকে ৮ কুইন্টাল। এলাকা ভিত্তিক উৎপাদন খরচ ও ফলন কিছু ফারাখ হতে পারে। মোটামুটি বিঘা পিছু ৪,০০০ টাকার কম-বেশি লোকসান হয়। একর পিছু ১২,০০০ টাকা লোকসান। বছরে দু’বার ধান চাষ করলে একর পিছু ২৪,০০০ টাকা লোকসান। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার কৃষকদের যথাক্রমে দ্বিগুণ ও তিনগুণ উন্নতি হয়েছে প্রচার করছে। ‘কৃষক সম্মান যোজনা’ ও ‘কৃষক বন্ধু প্রকল্পে’র মাধ্যমে বছরে একরে ৬,০০০ টাকা ও ১০,০০০ টাকা অনুদান দিয়েই ত্রাণকর্তা সাজার চেষ্টা করছে। সরকারি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার ব্যবস্থা করলে কৃষক একরে ৩,০০০ টাকার মতো লাভ করতে পারেন। স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই রাজ্যে ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত কুইন্টাল প্রতি ২,৭০০ টাকা।
এই রাজ্যের ঠিকাচাষি মানে মরসুমী লীজচাষি, অনতিভুক্ত ভাগচাষি ও পাট্টাহীন গরিব কৃষক যারা ব্যাপক সংখ্যায় ও প্রত্যক্ষভাবে কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়ে থাকেন। তারা না পায় সরকারি সহায়ক মূল্যের সুযোগ, না পায় ফসল নষ্টের ক্ষতিপূরণ, না পায় কৃষক সম্মাননিধি বা কৃষকবন্ধু প্রকল্পের সুযোগ। তাই এই ধরনের ক্ষুদ্র কৃষকদের দাবি আজকে গুরুত্বপূর্ণ। সরকারগুলোর এই শ্রেণীর কৃষকদের প্রতি কোন মাথা ব্যথা নেই। এই বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ব্যাপক ফসল। শস্যবীমার প্রচার করলেও সরকার কোনো এলাকাকে ক্ষতিগ্রস্থ ঘোষণা না করলে বীমা কোম্পানিগুলো কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে না। আলু, পেঁয়াজ ও অন্যান্য সব্জির সরকারি কোনো সহায়ক মূল্য নির্দিষ্ট করা হয় না। যদি কখনও এই সমস্ত ফসলের মুল্যবৃদ্ধি হয়, তখন সরকারি টাস্কফোর্স নামিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্ত কৃষকরা যখন ফসলের দাম না পেয়ে সব্জি গরুকে খাওয়াতে বাধ্য হন বা জমিতেই নষ্ট করতে বাধ্য হন এবং চাষের ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ নিতে বাধ্য হন তখনও সরকারের কোনো মাথাব্যথা থাকেনা। বরং অস্বীকার করার চেষ্টা করে থাকে। ধান কেনার ক্ষেত্রে দীর্ঘসুত্রিতার জন্য গরিব ও প্রান্তিক চাষিরা ধরেই নিয়েছেন তাদের পক্ষে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে ধান বিক্রি করা সম্ভব নয়। তাই অনেক ক্ষেত্রে এনিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা থাকে না। দেখা যায় তাদের জমির কাগজ বা রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে অন্য লোক মানে দালাল ব্যবসায়ীরা ধান বিক্রি করে। কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কার্যকরি হচ্ছে না। অথচ সারের দোকান ও সমবায়গুলো বুক ফুলিয়ে সারের বস্তায় থাকা দাম থেকে অনেক বেশি দামে সার বিক্রি করে যাচ্ছে।
ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়নের দাবি দেশজুড়ে বর্তমানে মুল দাবি হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করছে। অথচ নিজের রাজ্যে সহায়ক মূল্যের আইন প্রণয়ন করছেনা। তাই ধান কেনার ক্ষেত্রে দীর্ঘসুত্রিতার পরিবর্তে সরল পদ্ধতিতে গ্রাম পঞ্চায়েত ভিত্তিক একটি করে ধান ক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে পর্যাপ্ত ধান ক্রয় করতে হবে। ধান কেনার ক্ষেত্রে গরিব ও প্রান্তিক চাষিদের অগ্রাধিকার দিতে হবে, লীজ চাষি-অনতিভুক্ত ভাগচাষি ও পাট্টাহীন গরিব কৃষকদের থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। ধানের সহায়ক মূল্য ২,৭০০ টাকা কুইন্টাল করতে হবে। সমস্ত কৃষি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্দিষ্ট করতে হবে, এর আইন প্রণয়ন করতে হবে।
এই সমস্ত দাবিতে আন্দোলন জোরদার করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।
- সজল পাল
২০২০ সাল। মার্চ মাস। দায়িত্বজ্ঞানহীন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে চার ঘন্টার নোটিশে গোটা দেশকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ভারতবাসী প্রথম শুনেছিল দেশজোড়া লকডাউনের কথা। মালিক বা সংস্থার কর্তৃপক্ষের দ্বারা কারখানা বা সংস্থা লকডাউনের সাথে দেশের শ্রমজীবী মানুষ অতিপরিচিত হলেও দেশের সরকারের দ্বারা গোটা দেশ লকডাউন হয় এটা ছিল নতুন এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আজও সেই অভিজ্ঞতা এক দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে শ্রমজীবী মানুষের মনে। ২০২০ সালের জানুয়ারী মাস থেকেই ভয়াবহ করোনা রোগের প্রকোপ শুরু হলেও ‘অচ্ছে দিনের কান্ডারী’ মোদী-শাহ তখন ব্যস্ত মধ্যপ্রদেশে কি করে বিজেপি রাজ কায়েম করা যায়, আমেরিকার তৎকালীন প্রসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত সফর কত নির্বিঘ্নে করিয়ে দেওয়া যায়। সময় থাকতেও শ্রমজীবী মানুষের কথা ভাবা হয়নি। ভাবা হয়নি এই পর্যায়ে তারা দুবেলা খাওয়ার সংস্থান করবেন কীভাবে? পরিযায়ী শ্রমিকরা তাঁদের রাজ্যে কীভাবে ফিরবেন? মুহূর্তের মধ্যে বেকারে পরিণত হন দেশের লক্ষ কোটি মানুষ। একদিকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়, আক্রান্ত হলে সুচিকিৎসার অভাবে নিশ্চিত মৃত্যু, অন্যদিকে ভিনরাজ্য থেকে নিজের পরিবারের কাছে পৌঁছানোর আকুতি। সারা দেশ স্তম্ভিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ শিশু বৃদ্ধ মহিলা পুরুষ তথা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষের পায়ে হেঁটে হাজার হাজার মাইল অতিক্রমের হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে। কত মানুষ মারা গেলেন, কত মানুষ তার পরিবারের কাছে শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেন, কতজন পারলেনই না — তার হিসাব আজও অজানাই রয়ে গেছে।
এই দুর্বিষহ অবস্থার বিরুদ্ধে দেশের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর লাগাতার চাপ সৃষ্টি এবং বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টে এবং দেশের সুপ্রিম কোর্টে মামলা শুরু হয়। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যখন দেশের পরিযায়ী শ্রমিকসহ অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য জানতে চাইল তখন ৭৫ বছরের স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নির্লজ্জের মতো জানিয়ে দিল যে, তাদের কাছে কোনও তথ্যই নেই। যে দেশে শ্রমজীবী মানুষের ৯৩ শতাংশ মানুষ অসংগঠিত শ্রমিক, সে দেশের সরকারের কাছে তাঁদের কোনও তথ্যই নেই!
সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিল আগামী ৩১ ডিসেম্বরের ২০২১’র মধ্যে সমস্ত তথ্য জানাতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় গত ২৬ আগষ্ট ২০২১ এই ই-শ্রম পোর্টাল চালু করেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে যে, এর মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের অসংগঠিত শ্রমিকদের সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করা হবে। ভবিষ্যতে অসংগঠিত শ্রমিকদের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা যোজনা প্রদান করতে এই তথ্যভান্ডার কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে সহায়তা করবে।
গত ২৯-৩০ অক্টোবর ২০২১, দিল্লীতে এআইসিসিটিইউ’র কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে ই-শ্রম পোর্টাল বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এআইসিসিটিইউ মনে করে যে, এই ই-শ্রম পোর্টালের মধ্য দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক এবং অসংগঠিত শ্রমিক সম্পর্কিত একটি তথ্য ভান্ডার তৈরী করা হচ্ছে, কিন্তু আসলে মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আগামীদিনে দেশের বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক বোর্ডগুলিকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে ফেলবে — এটা হল তার প্রাথমিক পদক্ষেপ। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণ বোর্ডের কাছে বেশ কিছু অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের তথ্য থাকা সত্ত্বেও আবার এই পোর্টালে নথিভুক্ত করার যে কথা বলা হচ্ছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে বিগত দিনে ঐসব বোর্ডে যে শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করা হয়েছিল তা এবং বোর্ডগুলিকে আগামীদিনে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হবে। এটা জানানো হয়েছে যে ভবিষ্যতে সমস্ত রকমের বেনিফিট (মহামারী, প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ) এই পোর্টালের মাধ্যমেই দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কল্যাণ বোর্ডের কাছে দেশের শ্রমিকদের যে লক্ষ কোটি টাকা গচ্ছিত আছে সেই টাকার ভবিষ্যত কি হবে — এ প্রশ্নে একেবারেই নিশ্চুপ। বোঝাই যাচ্ছে এই কোটি কোটি টাকার তহবিল লুঠ চলবে। নির্বাচনের পূর্বে দেশের শাসকদলগুলি যে বেনিফিটের কথা ঘোষণা করে থাকে তা প্রদানের ক্ষেত্রে এই পোর্টাল ব্যবহার করা হবে কিনা সেটাও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বর্তমান বোর্ডগুলি যে বেনিফিট দিয়ে আসছে সেসব এই পোর্টালের মধ্য দিয়ে সংকুচিত করার আশংকা থাকছে। আমরা জানি বিভিন্ন কল্যাণমূলক বোর্ডের মধ্যে বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডে বেশি বেনিফিট দেওয়া হত (বাড়ি তৈরির সুবিধাসহ) — তা মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের জমানায় গত চারবছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। এই এসএসএস কোড সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে নতুন ধারণা হাজির করতে চলেছে যা মালিক বা সরকারকে শ্রমিকদের দায় থেকে মুক্ত করবে। যেমন স্বাস্থ্য বীমা (ইএসআই), অবসরকালীন বেনিফিট (পিএফ), গ্র্যাচুইটি, আবাসন, শিশুদের শিক্ষা, ইত্যাদির দায় শ্রমিকদের উপরেই বর্তাবে। এআইসিসিটিইউ মনে করে এই ই-শ্রম পোর্টালের সমালোচনা, বিরোধিতা আমরা চালিয়ে যাব, কিন্তু এসব সত্ত্বেও ই-শ্রম পোর্টালের বা অন্য কোনো কল্যাণমূলক বোর্ডের মাধ্যমে যে কমবেশি বেনিফিট শ্রমিকরা সরকারের কাছ থেকে পাবেন তাকে সুনিশ্চিত করা দরকার।
এই পোর্টাল আনুমানিক ৩৮ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকদের নথিভুক্ত করবে এবং ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক রেখে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকে প্রদান করার পরিকল্পনা করবে। শ্রম মন্ত্রক, ট্রেড ইউনিয়ন, রাজ্য সরকার ও কমন সার্ভিস সেন্টারগুলি (সিএসসি) দায়িত্ব সহকারে এই নতুন পোর্টালে শ্রমিকদের নথিভুক্ত করার দায়িত্ব নেবে।
(ক) ই-শ্রম কার্ড কি?
e-Shram’এ নথিভুক্ত করলে সরকার এই কার্ড দেবে। প্রতিটি e-Shram কার্ডে Unique Universal Account Number (UAN) থাকবে যার দ্বারা শ্রমিকরা যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময় সামাজিক সুরক্ষার বিভিন্ন সুবিধাগুলি পাবেন। বারো সংখ্যার এই কার্ড দেশের সর্বত্রই মান্যতা দেওয়া হবে।
(খ) কোন শ্রমিকেরা কি সুবিধা পাবেন?
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা একবার এই e-Shram’এ নথিভুক্ত হলে অন্য কোনো সামাজিক সুরক্ষা যোজনাতে আলাদাভাবে নথিভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন হবে না।
e-Shram যোজনা দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রায় সমস্ত শ্রমিকদের আওতাভুক্ত করছে। যেমন নির্মাণ শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক, গৃহ শ্রমিক, পথ হকার, ট্রাক ড্রাইভার, মৎসজীবী, কৃষি শ্রমিক, কুটির শিল্পের শ্রমিক, রিক্সা চালক, দুধ বিক্রেতা, গিগ শ্রমিক, প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক, অঙ্গনওয়াড়ী, আশাকর্মী, প্রকল্প কর্মী ইত্যাদি সব ধরনের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদেরকে আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বীমা যোজনার অধীনে ৩৬৫ দিন সকল নথিভুক্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের দুর্ঘটনাজনিত বীমার আওতায় আনা হবে। দুর্ঘটনায় মারা গেলে এবং সারা জীবনের মত অক্ষম হলে ২ লক্ষ টাকা পাবেন। আংশিক অক্ষম হলে ১ লক্ষ টাকা পাবেন।
এই পোর্টাল শুধুমাত্র সামাজিক সুরক্ষাই প্রদান করবেনা, মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অসংগঠিত শ্রমিকদের সাহায্য প্রদান করতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে সহায়তা করবে।
এই পোর্টালের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের রেকর্ড তৈরি করা হবে এবং তাদের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে আরো সুযোগ সৃষ্টি করবে।
(গ) নথিভুক্তকরণে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ কি লাগবে?
এই পোর্টালে নাম নথিভুক্তকরণ বিনামূল্যে হবে। বয়স ১৬ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে হতে হবে।
• আধার কার্ড এবং আধার কার্ডের সাথে লিংক আছে এমন ফোন নাম্বার।
• নমিনির আধার কার্ড।
• ব্যাঙ্কের পাশবই।
• যদি ইনকাম সার্টিফিকেট থাকে দিতে পারেন।
• যদি শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট থাকে দিতে পারেন।
• তপশিলি জাতি, জনজাতি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীভুক্ত হলে তার সার্টিফিকেট দিতে পারেন।
(ঘ) ই-শ্রম পোর্টালে নথিভুক্তিকরণের পদ্ধতি কি?
প্রথমত যাদের ফোনে (স্মার্ট ফোন) আধার কার্ড লিঙ্ক ফোন নাম্বার আছে তারা নিজেরাই নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাতে পারবেন।
ই-শ্রম সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত যতটুকু জানা বোঝা গেল তাতে এখনই দুর্ঘটনা জনিত অনুদান ছাড়া অন্য কোনো সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি নেই। কিন্তু, যে সকল শ্রমিকরা এতকাল শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি পেতেন না এবার তাঁদের নাম এই পোর্টালে নথিভুক্তকরণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ই-শ্রম কার্ড আইনগতভাবে শ্রমিক পরিচয়পত্র হিসেবে গণ্য হওয়ার একটা সুযোগ হয়ে গেল। আমরা জানি বেশিরভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কোনো পরিচয়পত্রই নেই। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বহুদিন ধরেই আমরা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের চারপাশে থাকা বিশাল সংখ্যার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পরিচয়পত্র হিসাবে এই কার্ডকে ব্যবহার করার সুযোগকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হওয়া দরকার। আপাতত দুর্ঘটনা জনিত আর্থিক সহায়তা শ্রমিকদের পাইয়ে দেওয়ার সাথে সাথে এই যোজনা বা পোর্টালের সমস্যা, অসম্পূর্ণতা, ঘাটতি বা নেতিবাচক দিকগুলিকে শ্রমিকদের মধ্যে প্রচারে নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবিসনদ আকারে তুলে ধরতে পারি।
- দিবাকর ভট্টাচার্য
কোভিড১৯ অতিমারীর আগেই ভারতীয় গৃহস্থরা ঋণ সংকটে জর্জরিত। এক কর্মসূচি গবেষণা সংস্থা ‘দ্বারা রিসার্চ’ তাদের সমীক্ষায় দেখিয়েছেন অতিমারী শুরুর অনেক আগের থেকে ভারতে গ্রামীণ এলাকায় ঋণ সংকট দ্রুতই বেড়ে হয়েছে ৮৪ শতাংশ এবং শহর এলাকায় হয়েছে ৪২ শতাংশ। গার্হস্থ্য ঋণ ২০২০-২১ সালে জিডিপি’র হারে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩৭.৩ শতাংশ যা ২০১৯-২০ সালে ছিল ৩২.৫ শতাংশ।
দেশীয় শ্রমিকদের ৬০ শতাংশ লকডাউনের সময় কোনো বেতন পাননি এবং ৩১ শতাংশ লকডাউনের ৬ মাস পরে কোনো কাজ পাননি। খুব কম শ্রমিকই তাদের মালিকের থেকে সাহায্য পেয়েছেন। পারিবারিক খরচ চালানোর জন্য তাঁরা আরও ঋণের ফাঁদে জড়িয়েছেন।
বিমুক্ত জাতি এবং যাযাবর উপজাতিদের জন্য ‘জাতীয় অ্যালায়েন্স গ্রুপ’ সহ অন্যান্য সামাজিক সংগঠন একটি সমীক্ষা করে — ৯৮,০০০ দলিত, মুসলিম, আদিবাসী এবং বিমুক্ত জাতির পরিবার যারা ৪৭৬টি ছোট ছোট গ্রামে এবং শহুরে মহল্লায় থাকেন তাদের নিয়ে। সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি ৪টি দলিত এবং বিমুক্ত জাতির পরিবারের মধ্যে ৩টি পরিবার ঋণের ফাঁদে পড়েছেন। কর্মহীন হয়ে তাঁরা চড়া সুদে মহাজনদের থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন।
সম্প্রতি নীতি আয়োগ একটি দারিদ্র সূচক প্রকাশ করেছে। সেই সূচক অনুযায়ী তৃতীয় স্থানে রয়েছে যোগীর রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। প্রথম স্থানে বিহার এবং দ্বিতীয় স্থানে ঝাড়খণ্ড।
নীতি আয়োগের প্রকাশিত বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক অনুযায়ী বিহারে মোট জনসংখ্যার ৫১.৯১ শতাংশ, ঝাড়খণ্ডে ৪২.১৬ শতাংশ এবং উত্তরপ্রদেশে ৩৭.৭৯ শতাংশ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করেছেন। বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশ রয়েছে চতুর্থ স্থানে। সেখানে মোট জনসংখ্যার ৩৬.৬৫ শতাংশ গরিব।
উল্লেখযোগ্য ভাবে কেরল (০.৭১ শতাংশ), গোয়া (৩.৭৬ শতাংশ), সিকিম (৩.৮২ শতাংশ), তামিলনাড়ু (৪.৮৯ শতাংশ) পঞ্জাব (৫.৫৯ শতাংশ) এবং ছত্তীসগঢ় (৫.৯৭ শতাংশ) তালিকার নীচের দিকে রয়েছে। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে দাদরা এবং নাগর হাভেলি (২৭.৩৬ শতাংশ), জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ (১২.৫৮ শতাংশ), দমন এবং দিউ (৬.৮২ শতাংশ)। তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে দিল্লী। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির তুলনায় সেখানে দারিদ্রের হার কিছুটা কম, ৪.৭৯ শতাংশ।
তবে, সূচকে বিহারের অবস্থা অন্য রাজ্যগুলির থেকে বেশ করুণ। এর কারণ হিসাবে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, জনসংখ্যার একটা বড় অংশ মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত। দীর্ঘ একবছরের বেশি সময় ধরে স্কুলে না যাওয়ার ফলে রান্না করা মিড-ডে-মিল পায়নি পড়ুয়ারা। এছাড়া রান্নার জন্য জ্বালানি এবং বিদ্যুতের অভাব এর বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ নভেম্বর ২০২১
এই প্রথম দেশের বিভিন্ন শহরাঞ্চলের উন্নতি মাপতে নেমেছিল সরকারের পরামর্শদাতা নীতি আয়োগ। সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরে দেখা গেল কিছুক্ষেত্রে ভরাডুবি হয়েছে কলকাতার। ভদ্রস্থ কাজের সুযোগ এবং আর্থিক বৃদ্ধির মাপকাঠিতে এই মহানগরী সূচকটির আওতাভুক্ত ৫৬টি শহরের মধ্যে সবথেকে পেছনে চলে গিয়েছে। ক্ষুধা, দারিদ্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, লিঙ্গ বৈষম্য, কেনাকাটা ও উৎপাদন, শিল্প-উদ্ভাবন-পরিকাঠামো, অসাম্য সহ মোট ১৫টি মাপকাঠির বিচারেও সার্বিকভাবে কলকাতা সূচকের একেবারে শেষ সারির ১০টি শহরের একটি।
এই মুহূর্তে কর্মসংস্থানকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছে রাজ্য। শিল্পে লগ্নি টানার বার্তা দিতে একাধিক পদক্ষেপও করছে। তবে নীতি আয়োগের সূচক বলছে, ভালো কাজের সুযোগ এবং আর্থিক উন্নতির নিরিখে কলকাতার বহু পথ হাঁটা বাকি। এই মাপকাঠিতে নম্বর দেওয়া হয়েছে বেকারত্ব হ্রাস, নতুন সংস্থায় কর্মসংস্থান, দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, এটিএম ও ব্যাঙ্ক শাখার সংখ্যা সহ ১২টি লক্ষ্যের ভিত্তিতে।
নীতি আয়োগের এই সূচকের নাম হল ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি), আর্বান ইন্ডিয়া ইনডেক্স’। মোট ৫৬টি শহরাঞ্চল এই সূচকের আওতায়, যার একটি কলকাতা। এই সূচকে, ১৫টি মাপকাঠিতে দেশের বিভিন্ন শহরের উন্নতি যাচাই করা হয়েছে। প্রতিটি মাপকাঠিতে নম্বর ১০০।
সার্বিকভাবে ‘এসডিজি আর্বান ইন্ডিয়া ইনডেক্স’এর আওতায় সবথেকে পিছিয়ে থাকা ১০টি শহরের মধ্যে একটি কলকাতা। সঙ্গী ধানবাদ, পটনা, ইটানগর, আগ্রা ইত্যাদি। সবার সেরা শিমলা।
নাগরিকদের মোটামুটি ভদ্র কাজ দিতে পারা এবং আর্থিক বৃদ্ধির মাপকাঠিতে ৫৬টি শহরের মধ্যে কলকাতা সকলের পেছনে। ১০০-তে নম্বর মাত্র ৩। এইক্ষেত্রে সেরা বেঙ্গালুরু।
অন্যান্য মাপকাঠির মধ্যে কলকাতা ক্ষুধায় ২৭ নম্বর পেয়ে ৫৪, দারিদ্রে ৪০ পেয়ে ৫৪, শিল্প-উদ্ভাবন-পরিকাঠামোয় ৪৮ পেয়ে ৩৭, কেনাকাটা ও উৎপাদনে ৬৪ পেয়ে ৪৭।
এক একটি মাপকাঠিতে র্যাঙ্কিং হয়েছে ১০০ নম্বরে। কেউ ১০০ পেলে বুঝতে হবে শহরটি ২০৩০ সালের লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলেছে। শূন্য (০) পাওয়ার মানে, ওই লক্ষ্যে পৌঁছনোর পথে সব থেকে দূরে। ০ থেকে ৪৯’র মধ্যে নম্বর পাওয়াদের এগিয়ে যেতে আগ্রহী তকমা দেওয়া হয়েছে। কাজ এবং আর্থিক উন্নতিতে কলকাতা এই সারিতেই। সেরা বেঙ্গালুরু। তারাই শুধু ৬৪’র বেশি নম্বর পেয়েছে। এমনকি এই মাপকাঠিতে ৫০’র বেশি জুটেছে মাত্র ১৩টি শহরের।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ নভেম্বর ২০২১
“আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলাদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরো বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ কিন্তুক আলেদা মানুষ।” – আগুনপাখি, হাসান আজিজুল হক।
হাসান আজিজুল হক বললেই মনে পড়ে আগুনপাখি।
তাঁর লেখা উপন্যাস। যদিও আদতে হাসান ছিলেন প্রধানত গল্পকার। তবু আগুনপাখি নিয়েই বলা যাক দু’চার কথা।
আগুনপাখি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ রাঢ় অঞ্চলের পটভূমিতে লেখা। এই অঞ্চলে হাসান জন্মেছিলেন, লেখাপড়াও শিখেছিলেন, প্রধানত বিদ্যালয়-পর্ব। এই উপন্যাসটি মূলত একটি গ্রামীণ পরিবারের উত্থান-পতনের অপ-রূপকথা। কাহিনীর, সুত্রধার একজন গৃহিণী, তিনিই বলেছেন কাহিনী। গল্পটি শুরু হচ্ছে দেশভাগের, মানে ভারতবর্ষ ভাগের কয়েক বছর আগে।
উপন্যাসের শুরুর দিকে, লেখক পরিবার-জীবনের কথা বলেছেন, বলেছেন জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ নিয়ে হরেক অপ-রূপকথা। লেখকরা তাঁদের এলাকার সবচেয়ে বড় জমির মালিক হওয়ায় তাঁদের ভাগ্য পীড়িত ছিল না বটে কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা কলেরা, অভাব, ফসল না হওয়া এবং হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের আতঙ্কে আক্রান্ত হন। এই ঘটনাগুলি যেন একটি অভ্যন্তরীণ গল্পকে তার ঘরোয়া চৌকাঠ পার করে রাস্তায় এনে উলঙ্গ করে দাঁড় করায় বা বলা ভাল উন্মুক্ত নগ্ন জগতের পরিসরে নিয়ে আসে।
উপন্যাসের শেষে, পরিবারের সন্তানরা পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং সেখানে গিয়ে তাঁরা তাঁদের বাবা-মাকেও তাঁদের কাছে যেতে বলে। গৃহিণীর স্বামী সম্মত হন, কিন্তু গৃহিণী গৃহ ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন। তাঁর একা থাকার সিদ্ধান্ত স্বামীকে হতবাক করে। স্বামী প্রশ্ন করেন, “তুমি এত কিছু কবে শিখলে?” তিনি জবাব দেন, “এই সমস্ত বছর আমি কেবল আপনি আমাকে যা শিখিয়েছেন তা শিখেছি এবং আপনি আমাকে যা বলেছিলেন তা আমি বলেছি। এখন আমি নিজে থেকে একটি-দুটি জিনিস শিখেছি।”
উপন্যাসের এই গৃহিণী, এই নারী চরিত্রটি দেশভাগের পর কী দেখলেন? অনেকে রাঢ়বঙ্গ ত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে গেল আবার অনেকে গেলনা। যেসব লোকজন দেশভাগ নিয়ে উদ্বেল ও উদ্বাহু ছিল তারা অনেকে থেকে গেল কিন্তু অন্যরা যারা চায়নি এই বিভাজন তারা চলে যেতে বাধ্য হল। ওই নারীচরিত্র বিভাজনের রাজনীতি বোঝেন না কিন্তু এটা জানেন যে একটা বড় বৃক্ষকে যদি তার ভূমি থেকে তুলে নিয়ে অন্যভূমিতে রোপন করা হয় তবে সে বৃক্ষ বাঁচবে না। তাঁকে পাকিস্তানে যেতে বাধ্য করলে তিনিও মারা যাবেন।
স্বাধীনতা দেশভাগ নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে আগুনপাখির স্রষ্টা বলেছিলেন, “হিন্দু মিথের একটা গল্প বলি। পার্বতীর সঙ্গে তাঁর শ্বশুরকুলের খুব গণ্ডগোল। শিবের পোশাক-আশাক, চলাফেরা এসবের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। প্রায়ই তাঁদের মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকে। একদিন শিব পার্বতীকে চক্র দিয়ে কেটে ৫০ টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দিলেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল, প্রত্যেকটি টুকরো এক-একটা ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেল। এই সব মিলে আলাদা একটা ইতিহাসও তৈরি করে ফেলল। আমাদের অবস্থা হচ্ছে এমন। দেশভাগ, স্বাধীনতা অঞ্চলভেদে এক-একটা ঐতিহ্য যেমন আছে, সব মিলিয়ে সম্মিলিত সংস্কৃতির ভেতরে আছি আমরা।”
ওপার বাংলায় ফেলে দেওয়ার আগের কথা বলা যাক। হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান জেলার যবগ্রামে এক অবস্থাপন্ন যৌথ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বার নাম মোহাম্মদ দোয়া বখশ্ আর মা হলেন জোহরা খাতুন। ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তিনি যখন কাশীশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন ঐ স্কুলে রাজা সৌমেন্দ্র চন্দ্র নন্দীর আগমন উপলক্ষ্যে একটি সম্বর্ধনাপত্র রচনার মধ্য দিয়ে তার লেখালেখি জীবনের শুরু। এছাড়া প্রবেশিকা পাশের পরপরই তিনি লেখেন ‘মাটি ও মানুষ’ শীর্ষক একটি উপন্যাস; যে রচনাটি আজও প্রকাশিত হয়নি। ১৯৫৬ সালে খুলনা শহরের অদূরে দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি দেশত্যাগ করেন। তাঁর দেশত্যাগ নিয়ে সরাসরি কথা না বললেও ছোটগল্পে তার ছাপ রেখে গেছেন। এ প্রসঙ্গে হাসান আজিজুলের দেশভাগ নিয়ে ‘খাঁচা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ স্মরণীয়, পরে যা সিনেমা হয়েছে। তাঁর আর একটি গল্প দেশ বিভাজনের যন্ত্রণা নিয়ে, যার নাম ‘উত্তর বসন্তে’। তাঁর ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘পরবাসী’, ‘আগুনপাখি’ এবং ‘ফিরে আসি ফিরে যাই’, ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ আত্মজীবনীমূলক লেখাগুলোয় দেশভাগের বেদনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। হাসান নিজেই দেশভাগের শিকার, তাঁকে দেশভাগের জন্য বাবা-মা, পরিজন, ভিটে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।
আমরা সাধারণত দেশভাগ নিয়ে যে সব লেখা পড়েছি তা মূলত পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া হিন্দুদের দুর্দশা ও বেদনা নিয়ে। হাসান আজিজুল হক মুদ্রার অন্য পিঠ। তাঁর লেখায় মুসলমান পরিবারের ওপারে চলে যাওয়ার বেদনাক্লিষ্ট আখ্যান চিত্রিত হয়েছে।
১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী সরকারি কলেজে থেকে দর্শন অনার্স নিয়ে তিনি বিএ পাশ করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন গবেষণার উদ্দেশে। কিন্তু বিদেশে মন টেকেনি তাঁর। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ এবং দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন। রাজশাহী ছিল মুর্শিদাবাদের সন্নিহিত জেলা, আমের জন্য বিখ্যাত। রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় কলেজের পত্রিকায় হাসানের প্রথম লেখা ছাপা হয়। লেখাটির বিষয় ছিল ‘রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য’। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় ১৯৬০ সালে ‘শকুন’ শীর্ষক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে হাসান আজিজুল হক বৃহত্তর সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত হন। ১৯৬০ সালে ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের সপক্ষে’ গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পরই তিনি এক বিশিষ্ট কথাশিল্পী হিসেবে খ্যাত হন।
হাসান আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে: সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), রোদে যাব (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭), বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)।
প্রবন্ধসাহিত্যেও তিনি উজ্জ্বল। তাঁর লেখা — কথাসাহিত্যের কথকতা (১৯৮১), চালচিত্রের খুঁটিনাটি (১৯৮৬), অপ্রকাশের ভার (১৯৮৮), সক্রেটিস (১৯৮৬), অতলের আধি (১৯৯৮), কথা লেখা কথা (২০০৩), লোকযাত্রা আধুনিক সাহিত্য (২০০৫), একাত্তরঃ করতলে ছিন্নমাথা (২০০৫), ছড়ানো ছিটানো (২০০৮), কে বাঁচে কে বাঁচায় (২০০৯), বাচনিক আত্মজৈবনিক (২০১১), চিন্তন-কণা (২০১৩), রবীন্দ্রনাথ ও ভাষাভাবনা (২০১৪)।
উপন্যাস কম লিখেছেন, মাত্র তিনটি — আগুনপাখি (২০০৬), সাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩), শামুক (২০১৫)।
তাঁর মৃত্যুতে একটি অধ্যায়ের সমাপন ঘটলো। কী সেই অধ্যায়? সেই অধ্যায় হল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার পক্ষে, বিভাজনের বিপক্ষে, সম্প্রীতির পক্ষে, ঘৃণা লালসার বিরুদ্ধে, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের পক্ষে সৎ লেখকদের যে সহজাত লড়াই সে এক অধ্যায় বটে, যখন দেখি কাকতাড়ুয়া-লেখকে বাজার ছেয়ে গেছে, বাজারকে তারা মহিয়ান করে তুলছে, ঘৃণাকে ও বিভাজনকে তারা পরিণত করছে পণ্যসাহিত্যে তখন হাসান আজিজুলের মতো এক মহান স্রষ্টার চলে যাওয়া অপূরণীয় ক্ষতি।
- শামিম আহমেদ
“তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি আসলে একটা গাছের মতন যে গাছ সবাইকেই ছায়া বিলিয়ে দেয়” — চন্দনা হোড়।
একটি ছবি, চিত্রিত ভাস্কর্য, মুহূর্তেই হয়ে ওঠে বাঙ্ময়, সজীব। সে ছবি কথা বলতে থাকে, বলতে থাকে তার ইতিহাস, তার অভীপ্সা, তার স্বপ্নের কথা। আমরা শুনতে পাই না, কিন্তু অনুভব করতে পারি। আর এখানেই রচিত হয়ে যায় শিল্প আর বাস্তব জগতের মেলবন্ধনের ইতিকথা, গাথা-সঙ্গীতের মর্মকথা। একটা গ্রিসীয় পানপাত্রের গায়ে আঁকা ছবি দেখে মোহিত হয়ে পড়েছিলেন কবি কিটস। সেই ছবি কবিকে এক বাঙ্ময় কথার সরব জগতে নিয়ে গিয়েছিল। কবি লিখেছিলেন যে সঙ্গীত আমরা অহরহ শুনি তা তো মধুর, কিন্তু যে সঙ্গীত শোনা যায় না তা মধুরতর। গ্রিসীয় পানপাত্রের গায়ে আঁকা ছবি তাঁকে এতটাই মোহিত করেছিল যে তিনি যেন সেই মধুরতম অশ্রুত সঙ্গীত শুনতে পাচ্ছিলেন। সামান্য ব্যবধান বিমোচনের জন্যে এক গূঢ় ইচ্ছার অপরিতৃপ্তির যন্ত্রণা এই ছবিতে মূর্ত হয়ে উঠেছিল।
একটি ছোট্ট ঘটনা শিল্পীর কাছে তুচ্ছ বিবেচিত হয় না। শিল্পী তো কবিই। তিনি সেই তুচ্ছ ঘটনার মধ্যেই খুঁজে পান এক অনন্য দর্শন। সোমনাথ হোড়’এর ছোট্ট মেয়ে চন্দনা পড়ে গিয়েছিল। তার হাঁটুতে আঘাত লাগে, সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্তক্ষরণ নিছক রক্তক্ষরণে থেমে থাকেনি। বরং এই রক্তক্ষরণ শিল্পী সোমনাথ হোড়’কে তাঁর ‘উন্ডস’ সিরিজের ছবি নির্মাণের কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কফি তৈরি করতে গিয়ে গরম দুধ পড়ে পুড়ে যায় তাঁর শরীরের একাংশ। এই দহন জন্ম দিয়েছিল তাঁর অসামান্য ভাস্করায়িত দ্রৌপদীর, যার শরীরের কটিদেশ থেকে নিম্নাঙ্গ দগ্ধে-যাওয়া দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অপমানাহতা, সম্মানহানির শিকার হওয়া এক নারীত্বের প্রতিমূর্তি। এখানেই শিল্পী সোমনাথ হোড়’এর বিশিষ্টতা, তাঁর স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত শিল্পকর্মের অনন্ত অনঙ্গ।
সোমনাথ হোড়ের জন্ম আজ থেকে শতবর্ষ আগে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার বরমা গ্রামে। সেখানকার স্কুলের শিক্ষক দেবেন্দ্র মজুমদার সোমনাথ সহ তাঁর সতীর্থদের ড্রইং শেখাতেন। এই ড্রয়িং ক্লাসে সোমনাথ মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, তাঁর ড্রয়িং ক্লাসে তিনি খুব মন দিয়ে কাজ করতেন। এই কাজ মানে “বাজারি কপিবুক থেকে চেয়ার, টেবিল, বাড়ির গেট, গোলাপফুল প্রভৃতি। এগুলি করতে গিয়ে সোজা করে লাইন টানা, বেঁকিয়ে টানা, গোল বৃত্ত আঁকা ইত্যাদিতে আমি মজা পেতাম। মাস্টারমশাই আমাকে আঁকায় খুব উৎসাহ দিতেন।” তাঁর প্রাথমিক শিক্ষালাভ এই গ্রামেই হয়েছিল। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে। এরপর তিনি কলকাতায় এসে রিপন কলেজে ভর্তি হন। এসময় প্রখ্যাত শিল্পী চিত্তপ্রসাদের সান্নিধ্যে আসেন তিনি।
বিশ শতকের চল্লিশের দশকের প্রত্যূষপর্বে সোমনাথ শিবু নামীয় তাঁর এক বন্ধুর মাধ্যমে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সান্নিধ্যে আসেন এবং পরবর্তীতে পার্টির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হন। পার্টির পত্রপত্রিকায় তাঁর আঁকা ছবি মুদ্রিত হতে থাকে। গত শতকের চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে পঞ্চাশের (১৩৫০/১৯৪৩) মন্বন্তরের সময় সমসময়ের মর্মান্তিক দৃশ্যপট তিনি তাঁর আঁকা ছবির পটচিত্রে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। পাশাপাশি তেভাগা আন্দোলনের পটপ্রেক্ষায় তাঁর আঁকা ছবিগুলিও তাঁর রাজনৈতিক দায়বদ্ধ মন-মনস্কতার পরিচয় বাহক।
উত্তরকালে শান্তিনিকেতনে থাকার সময় সোমনাথ রামকিঙ্কর এবং বিনোদবিহারীর সান্নিধ্যে এসে আরও সমৃদ্ধ হয়েছিলেন এবং এর প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর শিল্পীত চিত্র-ভাস্কর্যে। আসলে বিগত শতকের চল্লিশের দশকের জনসমাজে আলোড়ন তোলা ঘটনাবলি সোমনাথের চিন্তা-চৈতন্যে নিবিড় প্রভাব ফেলেছিল। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্কময় দিনগুলি এবং অন্যদিকে মন্বন্তরের মানবতা-বিপন্নকারী আবহ তাঁকে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখে এনে দাঁড় করিয়েছিল। ১৯৪২এ তিনি তাঁর স্বভূমি চট্টগ্রামে ফিরে যান। এর অব্যবহিত পরে চট্টগ্রামে শুরু হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এসময়ে তাঁর বয়স একুশ বছর। তাঁর পরিবারও এই দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। বাবা আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন। মা’ই তাঁদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এসময় সরাসরি ত্রাণের কাজে যুক্ত হন সোমনাথ। আর এই সূত্রেই তিনি আসেন কমিউনিস্ট পার্টির নিবিড় সান্নিধ্যে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সক্রিয় শরিক হন। এসময় তাঁর দিন অতিবাহিত হতো পার্টির কমিউনে। এই সময়েই তিনি প্রচুর ছবি এঁকেছেন, সেসব ছবির প্রদর্শনীও করেছেন। তাঁর আঁকা ছবির বেশ কিছু মুদ্রিত হয়েছিল পার্টির মুখপত্র ‘জনযুদ্ধ’ এবং ‘পিপলস ওয়ার’এ। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ভবানী সেন তাঁকে নিয়ে যান কলকাতায়। পরের বছর তিনি আসেন পার্টির সম্পাদক পূরণচাঁদ যোশীর সংসর্গে, পরিচিত হন পার্টি নেতা বঙ্কিম মুখার্জী এবং মুজাফ্ফর আহমেদ’এর সঙ্গেও। আর সমসময়ের পার্টি পরিচালিত আন্দোলনের আবহে তাঁর শিল্পীসত্তা নতুন এক দিগদর্শনের সন্ধান পায়। সমসময়ের প্রপীড়িত মানুষের লড়াই-সংগ্রাম আর ইতিহাস মূর্ত হতে থাকে তাঁর শিল্পকর্মের অবয়বে।
কিন্তু শুধুমাত্র প্রচার-শিল্পে সন্তুষ্ট হতে পারেননি সোমনাথ। তিনি সৃজনশীল চিত্রকর হয়ে ওঠার প্রত্যাশী হয়ে ওঠেন। আর এই কারণেই তিনি ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। এখানে অধ্যয়নকালে সোমনাথ শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সংসর্গে আসেন। তাঁর কাছ থেকে সোমনাথ শেখেন শিল্পের আঙ্গিকগত শিক্ষা। তিনি লিখেছিলেন, “আর্ট স্কুলে আবেদিন সাহেবের কাছে হাত মক্সো করার কাজ শুরু হল। প্রথম বার্ষিকে ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা খড়ি দিয়ে রেখাপ্রধান ছবি করতাম; খুব মনোযোগ সহকারে আঁকতাম; আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, ভালো ছবি করতে হলে করণকৌশল আয়ত্ত করতে হবে। আমাদের পূর্বসূরীদের কাজ দেখে নিজের অভাববোধ প্রকট হতো। কেবলই মনে হতো — অমন করে কবে আঁকব? আঁকতে পারব কি?” এই আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা তাঁকে তাঁর অভীষ্ট সাধনের লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিল। একজন সংবেদনশীল শিল্পী হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন প্রপীড়িত মানুষের অন্তরের যন্ত্রণাদগ্ধ অন্তঃস্থলকে। ‘লাঞ্ছিত মানবতা’ তাঁকে যন্ত্রণাহত করেছিল। তাঁর বিবেকি শিল্পী সত্তা মানবতার এই রক্তাক্ত ক্ষরণ তাঁকে সংগ্রামী মানবতার পক্ষে অবিচল অবস্থানে আসীন করেছিল। কোনোরকম প্রলোভনের কাছে তিনি তাঁর শত প্রয়োজন সত্ত্বেও মাথা নত করেননি। একবার জনৈক বিদেশী তাঁর সামনে তাঁর অ্যাটাচি খুলে থরে থরে সাজানো ডলার দেখিয়ে প্রলুব্ধ করলে সোমনাথ তাঁর পোশাকের নিচে আবৃত পেট উন্মুক্ত করে দেখিয়ে বলেছিলেন তাঁর তো এই ছোট্ট পেট! এরজন্যে ওসবের দরকার নেই।
জনৈক আলোচক তাঁর এক নিবন্ধে লিখেছেন, “আর্ট কলেজে ভর্তির আগে এক দায়বোধ থেকে তাঁর সৃজনে প্রচারধর্মিতা প্রাধান্য পেয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁর কাজে শিল্পমুক্তির আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। সেজন্য বোধকরি তিনি আর কোনোদিন কোনো একটি বিশেষ গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চাননি। দারিদ্র্য, ক্ষুধা দেখেছিলেন পঞ্চাশ বছর আগে; এই প্রত্যক্ষণই তাঁর সৃষ্টির বিষয় হয়ে থাকে আমৃত্যু। মানবের ট্র্যাজেডি এবং ক্ষত তাঁর অন্তরে এমনভাবে প্রবেশ করে যা তাঁর জীবন, মনন ও সৃষ্টিতে ছাপ ফেলে যায়।”
উত্তরকালে সোমনাথ শান্তিনিকেতনের কলাভবনে শিক্ষকতার দায়িত্বে আসীন হয়েছিলেন। আর এই সময়েই বেশকিছু অসাধারণ শিল্পের ‘ফসল’ ফলিয়েছিলেন তিনি। এই সময়েই তিনি তাঁর ‘ক্ষত’ অর্থাৎ ‘উন্ডস’ সিরিজের ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন যা তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। বিগত শতকের একাত্তরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতার দলন তাঁকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করেছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় তাঁর কিছু ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য এক অনুভূতিপ্রবণ আলেখ্য রচনা করেছিল।
কলকাতায় আর্ট কলেজে পড়ার সময় তিনি সমসময়ের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কুলদাচরণ দাশগুপ্তের কন্যা রেবার সঙ্গে পরিচিত হন। এই রেবাই সোমনাথের হাত ধরে তাঁর শিল্পীজীবনে পরিপূর্ণতা এনেছিলেন। রেবাও সোমনাথের পথের সওয়ারি হন কোনোরকম দ্বিধাকে প্রশ্রয় না দিয়েই। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে রেবা এবং সোমনাথ পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।
জীবনসঙ্গীনী রেবার বেশকিছু পেইন্টিং সম্পর্কে সোমনাথ নিজেই লিখেছিলেন, “রেবার কতগুলি পেইন্টিং এবং ড্রয়িং দেখে মনে হয় — এগুলি করা হয়নি — নিজের থেকে হয়ে গেছে। ছবিতে রংগুলি নিজেরাই যার যার জায়গা দখল করে নিয়েছে। কুকুরের ড্রয়িং দেখে মনে হয় জ্যান্ত কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করতে করতে কখন যেন কাগজে সেঁটে গিয়েছে…।’ আর এরই প্রসঙ্গে চলে আসে আমাদের আলোচনার প্রারম্ভকালীন কবি কিটসের কবিতাটির অনুষঙ্গ।
শান্তিনিকেতনে থাকার সময় সোমনাথ সপরিবারে থাকতেন লালবাঁধে। সেখানে তাঁর বাড়িতে উনুনের আগুনে একদিকে যেমন ভাস্কর্যের ব্রঞ্জগুলো পুড়তো তেমনই অন্যদিকে সন্ধ্যেবেলায় তাঁর বাড়ির আড্ডায় আসতেন সুচিত্রা মিত্র, শম্ভু মিত্রের মতো তাঁর একসময়ের ‘গণসংগ্রামের সহযোদ্ধা’রা।
কিন্তু শান্তিনিকেতনে কি এই শিল্পীকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল? ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রফেসর এমেরিটাস হিসেবে যোগ দেন। এখানে তাঁর চাকরির মেয়াদ প্রথাবিরুদ্ধভাবেই বাড়ানো হয়নি। এই অমর্যাদাকর পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে তিনি যন্ত্রণাদগ্ধ হয়েছিলেন। যন্ত্রণার মূক শাসন নীরবে সহ্য করেছিলেন। অসম্মানিত এই শিল্পী যখন নতমস্তকে তাঁর বাড়ির দরজায় ফিরে এসেছেন তখন তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা দুজনে এসে দুদিক দিয়ে তাঁর হাত শক্ত করে ধরেছিলেন। তাঁর ‘মাদার অ্যান্ড দ্য চাইলড’ শীর্ষক ভিয়েতনাম বিষয়ক ভাস্কর্যটি কলাভবন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল! যন্ত্রণাহত সোমনাথ একসময় তাঁর লালবাঁধের বাড়িটি বিশ্বভারতীকে দান করে দিয়েছিলেন। অথচ এমত একজন শিল্পীর বাড়িটিও বিশ্বভারতীতে যোগ্য সম্মান পায়নি।
পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন, “সোমনাথ হোরের সঙ্গে সাক্ষাৎ। ৮৪-তে পৌঁছে তিনি অশক্ত, কিন্তু মন ও কথাবার্তা স্বচ্ছ। পোখরান-২’র ঘটনাকে স্মরণ করে তাঁর করা কালো ব্রোঞ্জের একটি ভাস্কর্য দেখালেন। একটি মানুষ, একটি কুকুর, একটি গাছ ও একটি পাখি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে — সকলেই মৃত — আণবিক শৈত্যে মৃত্যু হয়েছে ওদের। অনির্বচনীয় এর শক্তি, একটি মাস্টারপিস!… আমার মনে হয় এই কাজটি পিকাসোর গ্যের্নিকার থেকেও এগিয়ে রয়েছে। আমি মনে করি এটি জাতিপুঞ্জের সংগ্রহ করা উচিত।”
এই হলেন শিল্পী সোমনাথ হোড়। তাঁর দীক্ষিত মার্কসবাদ তাঁকে কখনো আপসের পথানুসারী করেনি। মাথা উঁচু রেখে তিনি তাঁর শিল্পীসত্তাকে সদাজাগ্রত রেখেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি কার্যত অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। সেসময় তিনি একদিন তাঁর একমাত্র কন্যা চন্দনাকে বলেছিলেন যে তিনি দেখতে পাচ্ছেন আকাশ থেকে অজস্র চিল আর শকুন নেমে আসছে। এ যেন কবি সুকান্তর মৃত্যুর অব্যবহিত আগের আর্তনাদেরই প্রতিধ্বনি। সেদিন পার্টির প্রতি কবি সুকান্ত একরাশ অভিমান মনের নিভৃতে সাজিয়ে রেখে বিদায় নিয়েছিলেন। আর ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর যখন এমত পরিস্থিতিতে বিদায় নিলেন তখন এই রাজ্যের মসনদে ক্ষমতাসীন সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার। তাঁর এই দুঃসহ দুর্দিনে তাঁদের কী ভূমিকা ছিল এ প্রশ্ন অত্যন্ত সঙ্গত। তবে তাঁরা তেভাগা আন্দোলনের এই ‘লো প্রোফাইল জিনিয়াস’এর প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেই কর্তব্য সেরেছিলেন!
তবে তাঁর প্রয়াণের পরের বছর অর্থাৎ ২০০৭এ শিল্পীকে মরণোত্তর পদ্মভূষণ সম্মান দেওয়া হয়েছিল!
- অশোক চট্টোপাধ্যায়
২৬ নভেম্বর সকালে ঘুমের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন বালীর সাংস্কৃতিক কর্মী অমিতাভ দে (ফুচকন)। জন্ম ১৯৫৮ সালে। স্ত্রী মারা যাবার পর নিঃসন্তান অমিতাভ একা থাকতেন। মৃত্যুকালে রেখে গেলেন মা, দিদি, ভাই, ভাইপো, ভাগ্নীদের। ১৯৮০’র দশকে প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই পশ্চিমবঙ্গ গণশিল্পী পরিষদের রাজ্যস্তরের সংগঠক ছিলেন। পরবর্তীতে শিল্পী পরিষদের বিকশিত রূপ পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বিপ্লবী বাম সাংস্কৃতিক কাজকে গণচরিত্র দেওয়ার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। বালী-নিশ্চিন্দায় নবারুণ সাহিত্য গোষ্ঠীর গণসঙ্গীতের স্কোয়াডের মুখ্য সংগঠক ছিলেন। ‘ইঙ্গিত’ সাংস্কৃতিক সংস্থার জন্মকাল থেকেই মুখ্য সংগঠক ছিলেন। ইঙ্গিতের চিন্তার ফসল, বালী গ্রামাঞ্চল সাংস্কৃতিক মেলার মুখ্য স্থপতি ছিলেন।
১৯৭৮ সালের পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গার সঙ্গে বালীতেও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনকে পুনর্গঠিত করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছিল। সেই পরিকল্পনার অধীনে সর্বজন পরিচিত ‘ফুচকন’ নিশ্চিন্দায় কাজ শুরু করেন। পার্টি গোপন থাকাকালীন গণরাজনৈতিক সংগঠন আইপিএফ’এর মুখ্য ভৃমিকায় ছিলেন। দীর্ঘদিন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বালী-বেলুড় লোকাল সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন। দীর্ঘকাল হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন।
ছোটবেলা থেকে ফুটবলার হিসাবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। তাঁর সার্বিক পরিচয়ের আকর্ষণে বিভিন্ন স্তরের মানুষ মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছিলেন। বালীতে পার্টির হাওড়া জেলা অফিসে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সলিল দত্ত, প্রবীর হালদার; রাজ্য কমিটির সদস্য ও হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত; রাজ্য কমিটির সদস্য মীনা পাল, কল্যাণী গোস্বামী, পার্থ ব্যানার্জী, নিলাশিস বসু; জেলা কমিটির সদস্য অঙ্কিত মজুমদার, মাধব মুখার্জী; পঞ্চায়েত এলাকার সংগঠক বাবলু গুহ, দীপক চক্রবর্তী সহ পার্টির সহযোদ্ধারা; পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক নীতীশ রায়; ভাই অরুণাভ দে; গ্রামাঞ্চলের সাংস্কৃতিক সংগঠক তন্ময় কুশারী, সমীর দত্ত, শঙ্কর গাঙ্গুলী সহ বিভিন্ন ব্যক্তি। শেষ যাত্রায় ধ্বনিত হয় আন্তজার্তিক সঙ্গীত। কমরেড অমিতাভ দে অমর রহে।