বাংলার তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তিনটিতেই হারল বিজেপি। এই হারকে এখনই রাজনৈতিক ভরাডুবির সংকেত হিসেবে ধরা ঠিক হবে না। তবে বিজেপির জন্য অবশ্যই একটা জোর ধাক্কা। এরাজ্যে বিশেষত গত তিনবছর যাবত যেভাবে টগবগিয়ে এগোচ্ছিল, ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ মনোভাব নিয়ে চলছিল, তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেসের ছুট কিছু কিছু নেতা-হাফ নেতা সমেত ভোট ভান্ডার পেতে থাকার জমি তৈরি করতে পারছিল, সেখানে এই পরাজয় গেরুয়া পার্টির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। নেতারা একে ‘উপনির্বাচনের ফলাফল সচরাচর শাসকদলের পক্ষে যায়’ বলে হারার গুরুত্বকে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। তার কারণ, বিজেপি ঝাঁপিয়েছিল ২০২১-এ এখানে ক্ষমতায় আসছে হাওয়া তুলে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা খারিজ করে দেওয়া, অসমে এন আর সি চাপিয়ে দেওয়া, উত্তরপ্রদেশে সপক্ষে অযোধ্যা রায় পেয়ে যাওয়া, আর এই সবকিছুকেই দ্বিতীয়বার মোদী জমানা ফিরে আসার পর কেন্দ্রে এবং উপরোক্ত তিন রাজ্যে ক্ষমতার মুকুটে একেকটা পালক হিসেব দেখিয়ে খোয়াবে মশগুল ছিল মহারাষ্ট্র থেকে বাংলা যেখানে যত বিধানসভা নির্বাচন, উপনির্বাচন, পৌর নির্বাচন, সবেতেই বিরাট দাঁও মারতে পারবে। বাংলার উপনির্বাচন কেন্দ্রের তিনটিতেই টেক্কা দেবে। কিন্তু সেই আশায় ছাই পড়ল। মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায় ফেরার সুখস্বপ্ন পরিত্যক্ত হল মাঝদরিয়ায়। এমনকি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির অনৈতিক যোগসাজশে পেছনের দরজা দিয়ে মসনদে ফেরা সম্ভব হল না। আর বাংলায়ও তিনটি কেন্দ্রেই হতে হল হেরো। তাই দেখে অপ্রস্তুত দলের রাজ্য নেতারা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় স্বীকার করেছেন, এনআরসি-র মাশুল গুণতে হল। তবে মনে করছেন না এনআরসি জনবিরোধী-দেশবিরোধী-বহুত্ববিরোধী। বরং তাদের ধারণাত্মক দিক থেকে তারা অনড়। ধরে নিচ্ছেন এনআরসি অভিযানের অবতারণায় এতো বিরূপতা-বিরোধিতার মুখে পড়তে হোত না, যদি আগাম ‘ক্যাব’ পাশ করিয়ে প্রচারে নামানো যেত। নিজেদের জালে জড়িয়েছে নিজেরা। আর ধরে নিচ্ছে ‘ক্যাব’ না থাকার সুযোগ নিচ্ছে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। তাছাড়া ধাক্কা খাওয়ার পেছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। কি কি থেকেছে তার কারণ বুঝতে বিজেপির নেতারা ছুটছেন তিনটি কেন্দ্রে।
এটা ঘটনা যে, এই বাংলার এ যাত্রার উপনির্বাচনে এনআরসি ব্যুমেরাং হয়েছে বিজেপির হারে। অমিত শাহ বলে আসছেন সারা দেশজুড়ে হবে এনআরসি। তবে অসমের পর ওদের প্রাধান্য দেওয়ার চাঁদমারিতে রয়েছে বাংলা, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের লক্ষ্যে। স্বভাবতই হয়ে যাওয়া উপনির্বাচনে জুজুটি দেখিয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু তা ব্যুমেরাং হল। তবে বিজেপির হারের পেছনে কারণটি ছিল কেবল এই একমাত্রিক, তা বললে সঠিক হবে না। অর্থনৈতিক নীতিও মতদানে প্রতিক্রিয়ার ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলার দুটি নির্বাচনী কেন্দ্র কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুরে ‘ব্যাপক বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’দের চিহ্নিত করা ও বিতাড়ন করার জিগির তুলে প্রচার করার ‘সুযোগ’ অনেক বেশি এবং সেই সুযোগ বিজেপি ‘কাজে লাগানোর’ ধূর্ত চেষ্টা চালিয়েছে যথেচ্ছ। অন্যদিকে, খড়গপুর সদর কেন্দ্রটি এক শিল্প ও ব্যবসা কেন্দ্রের মিশ্র এবং বহু জাতি-বহু ভাষাভাষী বিশিষ্ট বহুত্বের অঞ্চলও বটে। সেখানে হারের পেছনে এক বড় কারণ নিশ্চয়ই থেকেছে মোদী জমানায় গৃহীত শিল্প-পরিষেবা ক্ষেত্রের ব্যাপক বেসরকারিকরণ নীতি। এই কেন্দ্রের নব্বই হাজার সংখ্যাধিক ভোটারদের জীবন-জীবিকার ভাগ্য রেল শিল্পের সঙ্গে জড়িত। দেড়শোর মতো ট্রেন আর পঞ্চাশেক স্টেশন বেসরকারীকরণের প্রাথমিক পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছে মোদী সরকার। এটা ভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে গেছে। যে সদর কেন্দ্রে বিজেপির খোদ রাজ্য সভাপতি ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে, ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে জিতেছেন, সেই কেন্দ্রে এবার উপনির্বাচনে জয়ের হ্যাট্রিক মুখ দেখা হল না। ভোটের দিন নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়াই অ-অনুমোদিত জায়গায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন দলবল সহ বিজেপির রাজ্য সভাপতি। আশংকা ছিল বলেই নিয়মরীতি না মানার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন। তবু, পরাজয় ঘটেছে শোচনীয়। ভোট ও ভোট শতাংশের ব্যবধানের বিচারে উভয়তই। উপনির্বাচন এই উচিত শিক্ষাটি পাইয়ে দিল।
তিনটি কেন্দ্রেই জয়লাভ গেছে তৃণমূলের ঝোলায়। তৃণমূলের ভোট শতাংশ কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুর কেন্দ্র দুটিতে ২০১৬-র বিধান সভা নির্বাচনের তুলনায় ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সামান্য হ্রাস পায়, এবার উপনির্বাচনে তা আবার অনেকটাই বেড়েছে। আর খড়গপুর সদরে তার ভোট শতাংশ বেড়েছে উত্তরোত্তর। তুলনায় বামেদের ও কংগ্রেসের প্রাপ্তিযোগ উপর্যুপরি হ্রাসমান।
ফলাফলের নিরীখে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তৃণমূল শাসন ফের জনবাদী হচ্ছে, তৃণমূলের ভাগ্যের চাকা আবার গড়াতে শুরু করেছে। কারণ এ রাজ্যে গণতন্ত্র, জীবনজীবিকা ইত্যাদি জনস্বার্থের মূল মূল বিষয়গুলি যথেষ্ট নিষ্পেষিত, অবহেলিত। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী একমুখে বলছেন এখানে এনআরসি হবে না, অন্যদিকে ‘জনগণনা’র নামে এনপিআর প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন, যা কিনা সন্দেহাতীতভাবে এনআরসি-র প্রাক পর্বের পঞ্জিকরণ। তাই এবারের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য হল তৃণমূল যত না জিতেছে, তার চেয়ে এটাই নির্যাস যে বিজেপি হেরেছে।
বিজেপি হেরেছে, এটা প্রমাণ করছে মানুষ সুবিধাবাদী বাম ধারার ছড়ানো বিভ্রান্তির বাতাবরণ থেকে মুক্ত হওয়ার একটা নতুন বিকাশমান চেতনার সফল পরিচয় দিলেন। বিজেপি-ই যে বাংলা তথা দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ, প্রকাশ ঘটাচ্ছেন এই অনুভবের, মননের।