‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দিতে কাউকে জোর করা যায় না। স্কুলে চলতে দেওয়া যায় না। এটা শুধু বলে নয়, করে দেখালো স্কুলের ছাত্ররা। দেখালো মানে অনেক কিছু শেখালো। কথায় মানলে ভালো, না হলে রুখে দাঁড়াতে হবে। ঘটনাস্থল এই বাংলারই এক সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলা মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ অন্তর্গত শ্রীকান্তবাটি হাই স্কুল। ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সম্প্রতি ঘটেছে ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান তোলা ও তোলানোর জন্য চাপ সৃষ্টির ঘটনা। মহড়া শুরু করা হয় একদিন। শ্রেণী শিক্ষকের সাময়িক অনুপস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে। দ্বাদশ শ্রেণীর কিছু ছাত্র ধ্বনি দেয় ‘জয় শ্রীরাম’, বাকি ছাত্রদেরও বলে প্রতিধ্বনি তুলতে। সবার আগে প্রতিবাদ করে একটি মুসলিম ছাত্র, দ্বন্দ্বটা সেখানেই সীমিত থাকেনি, মুসলিম প্রতিবাদী ছাত্রটির পাশে এককাট্টা হয়ে দাঁড়ায় শ্রেণীকক্ষের বাকি সমস্ত প্রতিবাদী ছাত্ররা। ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধর্মাচরণের ক্ষেত্র বানাতে না দেওয়ার সহজাত জেদ থেকে, বিদ্বেষ-বিভাজন সৃষ্টির অঙ্কুরেই বিরোধিতা বুঝিয়ে দিতে, সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখতে চেয়ে। এক সরল-সুন্দর-সাহসী চাওয়া। জল গড়ায় অনেক দূর। যে ছাত্ররা দাপট দেখানোর সোরগোল তুলছিল তারা বাধ্য হয় থামতে, ভাগ্য ভালো তারা আক্রমণ করতে বা পিটিয়ে মারতে প্রবৃত্ত হয়নি। কিন্তু কিছু সময় পরেই উপস্থিত হয় একদল যুবক। তারা স্কুলে ঢোকে জোর জবরদস্তি, খুঁজে বার করে প্রথম প্রতিবাদী ছাত্রটিকে, আর তাকে একচোট মেরে স্কুল চত্বর ছেড়ে চলে যায়। ঘটনার সিরিয়াল বুঝিয়ে দেয় ঘটনা ঘটেছে পুরোপুরি পরিকল্পনা মাফিক। নেপথ্যে নিশ্চিত রয়েছে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর গেরুয়া হাত। জানাজানি হতে অভিভাবকরা এসেছেন দলে দলে, পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেছেন, বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, বিদ্বেষ-বিভাজনের ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কলুষিত করতে না পারে তার জন্য। তাঁরা স্কুল শিক্ষক-পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সম্প্রীতি রক্ষার প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন, নিজেরাও দিয়েছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে দিয়েছেন একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর পঠন এক সপ্তাহ বন্ধ থাকবে। কোনো ধর্মীয় ধ্বনি স্কুলে বরদাস্ত করা যায় না মানে, অন্য কোনও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও এরকম চলতে দেওয়া যায় না। ধর্মীয় বর্হিভূত প্রতিষ্ঠানসমূহে যে কোনো মূল্যে বজায় রাখতে হবে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির পরিবেশ। এটা সাংবিধানিক অধিকার ও নৈতিকতাকে মান্যতা দেওয়ার বিষয়। এই রীতিনীতির লঙ্ঘন হতে দেওয়া যায় না। এপ্রশ্নে কোনো গরিষ্ঠতার লীলা বা ক্ষমতার জোর খাটাতে দেওয়া যায় না।
কিন্তু ধর্মান্ধ ফ্যাসিবাদীরা না শোনে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সম্প্রীতির কাহিনী। বিজেপি ও তার স্বয়ং সেবক সংঘ শক্তি সব ক্ষেত্রেই মানুষের মগজ ধোলাইয়ে নেমেছে। ওদের নিশানায় রয়েছে স্কুল ছাত্ররাও। কেন্দ্রের মোদী জমানার জোরে ওরা স্কুল শিক্ষার সিলেবাসের একেবারে ওলোট-পালোট করে দিতে শুরু করেছে। চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা চালাচ্ছে। বিশেষত ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্য, দর্শন, সংস্কৃতি ও ইতিহাস পুনরুদ্ধার-পুনঃপ্রতিষ্ঠার নামে সঙ্ঘবাদী গেরুয়ার দল আমাদের দেশের যুক্তিবাদী ও বিবিধের মাঝে মিলনের যা পরম্পরা রয়েছে তার সর্বনাশ করতে চায়, সেই সমস্ত কিছু মুছে দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিকৃতি ও দূরাচার দিয়ে সন্ত্রাসের পরিবেশকে প্রতিস্থাপিত করতে চাইছে। তারই অঙ্গস্বরূপ হাতিয়ার করতে তুলছে ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান, আর ভিড় ঘটিয়ে পিটিয়ে মারার কৌশলকে। ওরা লোকসভা নির্বাচনের আগে দাড়িভিটেও সন্ত্রাস সৃষ্টির এক সুপরিকল্পিত মহড়া দিয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনে এরাজ্যে শক্তি বাড়িয়ে বিপজ্জনক মহড়াগুলো আরও বাড়িয়েই তুলছে। তারই ছাপ রঘুনাথগঞ্জ স্কুলের ঘটনায়। তবু সেখানে বিজেপির বদ পরিকল্পনা এখনও একতরফা বাজিমাৎ করে উঠতে পারেনি। ওপথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন ছাত্রদের প্রতিবাদ দেখে এগিয়ে আসা অভিভাবকরাও। এইসমস্ত উপাদান ও শিক্ষাই তৈরি করে আশা-ভরসার জায়গা।