অভাব অভিযোগ দারিদ্র্য বেকারি ক্ষুধা — এ তো ফুল্লরার বারোমাস্যা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সমাজের চেহারায় দ্রুত একটা পরিবর্তন ঘটে চলেছে। একটা ভয়ের বিদ্বেষের চাদর যেন সমাজটাকে মুড়ে ফেলছে। কে যে কখন কী অজুহাতে তথাকথিত ‘জনরোষের’ শিকার হয়ে লাঞ্ছিত হবে আহত হবে প্রাণ খোয়াবে কেউ জানে না। বিশেষ করে সংখ্যালঘু দলিত মানুষ,দরিদ্র অসহায় মানুষ। সমাজের দেহে ঘৃণা বিদ্বেষ অবিশ্বাসের এক ভয়ঙ্কর জীবাণুর সংক্রমণ ঘটানো হয়েছে। সেই সংক্রমণের জেরে ন্যায় নীতি মূল্যবোধ যুক্তি সবকিছু তাৎক্ষণিকভাবে ভেসে যায়। অনায়াসে একটা তরতাজা যুবককে নির্মমভাবে মারতে মারতে একতাল রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড বানিয়ে ফেলা যায়!
কখনও আবার ভারতীয়দের একাংশের আরাধ্য পুরুষ ‘রামের’ নামে এই সম্মিলিত খুন, হিংস্রতা, জিঘাংসাকে, খুনের রাজনীতিকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এইভাবে হিংসার সামাজিকীকরণ ঘটছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা সমাজের বিশিষ্ট নাগরিক যারা নিজের বিবেককে কারও কাছে বন্ধক রাখেননি, যারা নিজেদের সৃজনসংসারে একান্ত মগ্ন থেকেও সমাজ পরিবেশ প্রতিবেশকে ভুলে যাননি —তারা অত্যন্ত বিচলিত,উদ্বিগ্ন। শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশার ঊনপঞ্চাশ জন বিশিষ্ট মানুষ ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সম্প্রতি একটি খোলা চিঠিতে তাদের ক্ষোভ ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
এই চিঠির জেরে দু’জন স্বাক্ষরকারী (অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক কৌশিক সেন এবং চলচ্চিত্র পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণনকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। যারা একদিন কাপুরুষের মত কুলবর্গী, গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর, গৌরী লঙ্কেশকে হত্যা করেছিল সেইসব চরম দক্ষিণপন্থী সংগঠন তাদের হিংস্র দাঁত, নখ নিয়ে প্রকাশ্যে আসছে। আমরা তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানাই এই অন্ধকারের ষড়যন্ত্রীদের, এই হত্যার কারবারীদের। এদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে প্রশাসনিক পদক্ষেপ চাই।
২৩ জুলাই ২০১৯
শ্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী মহোদয়েষু
মাননীয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী
সম্প্রতি বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে যে মর্মান্তিক ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে, শান্তিপ্রিয় ও গর্বিত ভারতবাসী হিসেবে আমরা তাতে গভীর উদ্বিগ্ন।
আমাদের সংবিধানে ভারতকে বলা হয়েছে একটি ধর্মনিরপক্ষ সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র যেখানে সকল ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ এবং বর্ণের নাগরিকরা সমান। তাই, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি নাগরিক যাতে সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলি ভোগ করতে পারে তা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে, আমাদের নিবেদন :
(১) মুসলিম,দলিত এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর গণপীড়ন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। গত ২০১৬-তে কম করে ৮৪০টি দলিত নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে এবং শাস্তিদানের শতকরা হার নিশ্চিতভাবেই কমেছে — এনসিআরবি (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো)-র এই রিপোর্ট দেখে আমরা মর্মাহত।
তাছাড়া, গত ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ২৯ অক্টোবর ২০১৮ পর্যন্ত ২৫৪টি ধর্মীয় পরিচয়-ভিত্তিক বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে, যাতে অন্তত ৯১জন নিহত এবং ৫৭৯ জন আহত হয়েছেন (তথ্য-চেক-এর ইনডাটাবেস অক্টোবর ৩০,২০১৮)। দি সিটিজেন’স রিলিজিয়াস হেট ক্রাইম ওয়াচ-এর নথি অনুযায়ী ৬২% ঘটনায় মুসলিমরা (যারা ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার ১৪%) আর ১৪% ক্ষেত্রে খ্রিস্টানরা (যারা জনসংখ্যার ২%) এর শিকার। এই আক্রমণের প্রায় ৯০% ঘটেছে মে, ২০১৪-র পরে, যখন আপনার সরকার জাতীয় স্তরে ক্ষমতায় এসেছিল।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি সংসদে এই ভীড়-হিংসার ঘটনাগুলির সমালোচনা করেছেন, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়! এই ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলো যারা ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি এই অপরাধগুলিকে জামিন-অযোগ্য বলে ঘোষণা করা উচিত এবং দ্রুততার সঙ্গে ও নিশ্চিতভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। হত্যার ক্ষেত্রে যদি শর্তাধীন মুক্তি বা প্যারোল বিহীন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি হয়, তবে গণপীড়নের ক্ষেত্রে তা হবে না কেন, যা আরও নৃশংস, বর্বরোচিত? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনো নাগরিককেই যেন নিজের দেশে ভয়ের মধ্যে না বাস করতে হয়!
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি আজ একটা প্ররোচনামূলক ‘রণ-হুঙ্কারে’ পরিণত হয়েছে যা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমস্যা সৃষ্টি করছে। আর অনেক গণপ্রহারের ঘটনা ঘটছে এর নামে। ধর্মের নামে এত হিংসার ঘটনা সত্যিই হতবাক করে দেয়! এটা মধ্যযুগ নয়! ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেকের কাছে ‘রাম’ একটি পবিত্র নাম। দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসক হিসেবে আপনার উচিত রামের নাম এইভাবে কলঙ্কিত হওয়াকে বন্ধ করা।
(২) মতবিরোধ ছাড়া গণতন্ত্র অস্তিত্বহীন। সরকারের বিরুদ্ধ মত পোষণ করলেই জনসাধারণকে ‘দেশ-দ্রোহী’ বা ‘শহুরে নকশাল’ তকমা দেওয়া ও জেলে পুরে দেওয়া উচিত নয়। ভারতীয় সংবিধানের ১৯নং ধারায় বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে,মতবিরোধ হচ্ছে তার একটি অচ্ছেদ্য অংশ।
শাসক দলের সমালোচনা মানে দেশের সমালোচনা নয়। কোনো শাসক দল তাদের শাসনাধীন কোনো দেশের সমার্থক নয়। এটি সেই দেশের অনেকগুলি রাজনৈতিক দলের একটি মাত্র। সুতরাং সরকার বিরোধী অবস্থানকে দেশ বিরোধী মনোভাবের সঙ্গে এক করে ফেলা উচিত নয়। যেখানে বিরোধী মতকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় না, এমন একটি পরিবেশেই দেশ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
আশা করছি আমাদের প্রস্তাবগুলি সঠিক অর্থেই বিবেচনার জন্য গৃহীত হবে, যেহেতু ভারতবাসী আজ আমাদের দেশের ভাগ্য নিয়ে সত্যিই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন।
শ্রদ্ধাসহ
অদিতি বসু (সমাজ কর্মী), আদুর গোপালকৃষ্ণন (চলচ্চিত্র নির্মাতা), অমিত চৌধুরী (লেখক), অঞ্জন দত্ত (চলচ্চিত্রনির্মাতা-অভিনেতা), অনুপম রায় (গায়ক-গীতিকার, সংগীত পরিচালক), অনুরাধা কাপুর (সমাজ কর্মী), অনুরাগ কাশ্যপ (চলচ্চিত্র নির্মাতা), অপর্ণা সেন (চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেত্রী), আশা আচে জোসেফ (শিক্ষাবিদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা), আশিস নন্দী (শিক্ষাবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ), বৈশাখী ঘোষ (পুষ্পসজ্জা বিশেষজ্ঞ, শিল্পী), বিনায়ক সেন (চিকিৎসক, সমাজকর্মী), বোলান গঙ্গোপাধ্যায় (সমাজকর্মী, সাংবাদিক), বনানী কাক্কর (পরিবেশবিদ, ‘পাবলিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা), চিত্রা সরকার (ডিজাইনার), দর্শন শাহ (উইভার্স স্টুডিও-র প্রতিষ্ঠাতা), দেবল সেন (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ), গৌতম ঘোষ (চলচ্চিত্র নির্মাতা), ইফতেখার আহসান (ক্যালকাটা ওয়াকস/ক্যালকাটা বাংলো-র প্রতিষ্ঠাতা, সি ই ও), জয়শ্রী বর্মন (শিল্পী), জয়া মিত্র (পরিবেশকর্মী, লেখক), কনি কুস্রুতি (অভিনেতা), কৌশিক সেন (চলচ্চিত্র এবং নাট্যব্যক্তিত্ব), কেতন মেহতা (চলচ্চিত্র নির্মাতা), কঙ্কনা সেনশর্মা (চলচ্চিত্র নির্মাতা. অভিনেত্রী), মণি রত্নম (চলচ্চিত্র নির্মাতা), মুদার পাথেরিয়া (নাগরিক), নারায়ণ সিনহা (ভাস্কর), নবীন কিশোর (প্রকাশক, সীগাল পাবলিকেশন), পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় (অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা), পূর্বা চ্যাটার্জি (ইতিহাসবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী), পিয়া চক্রবর্তী (গবেষক), প্রদীপ কাক্কর (পাবলিক-এর প্রতিষ্ঠাতা), রামচন্দ্র গুহ (ঐতিহাসিক), রত্নাবলী রায় (মানসিক স্বাস্থ্য কর্মী), রেবতী আশা (চলচ্চিত্র নির্মাতা,অভিনেতা), ঋদ্ধি সেন (অভিনেতা), রূপম ইসলাম (গায়ক, গীতিকার, যন্ত্রশিল্পী), রূপসা দাশগুপ্ত (পরিচালক, কলকাতা সুকৃতি ফাউন্ডেশন), শুক্তি রায় চৌধুরী (সংস্কৃতের অধ্যাপক, নাট্যব্যক্তিত্ব), শমীক ব্যানার্জি (শিক্ষাবিদ, চলচ্চিত্র ও নাট্য সমালোচক), শিবাজী বসু (সার্জন, ইউরোলজিস্ট), শুভা মুদ্গল (গায়িকা, যন্ত্রশিল্পী), শ্যাম বেনেগল (চলচ্চিত্র নির্মাতা), সৌমিত্র চ্যাটার্জি (অভিনেতা), সুমন ঘোষ (চলচ্চিত্র নির্মাতা), সুমিত সরকার (ইতিহাসবিদ), তনিকা সরকার (ইতিহাসবিদ), তাপস রায় চৌধুরী (শল্যচিকিৎসক, হৃদরোগ)।