চলো ঘর না জ্বালিয়ে ঘরে আলো জ্বালাই

দেশলাই কাঠি জ্বলবেই, এবার সেটা কে কীভাবে ব্যবহার করছে তার উপর নির্ভর করছে যে, সেটা শুকনো জঞ্জাল জ্বালাবে নাকি কারোর ঘর জ্বালাবে। তেজ, জোশ, উত্তাপ এসব তো ছাত্র-যুবদেরই পরিচিতি চিহ্ন, অনেকটা জন্মদাগের মত। হাঁটার কোন রাস্তাটা তাদের দেখানো হচ্ছে তার উপর নির্ভর করছে যে তারা কলেজে/বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পেটাবে, তোলাবাজি করবে বা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙবে নাকি নিজের শিক্ষার অধিকার বিক্রি হয়ে গেলে, কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেলে, ফসল বেচে দাম না পেয়ে চাষীরা বিষ খেলে বা গলায় দড়ি দিলে ঝাঁঝিয়ে উঠে সমাজের হদ্দমুদ্দ লোকেদের কাঁদিয়ে ছাড়বে। দেশলাই কাঠিকে জলে ভিজিয়ে মিইয়ে দিলে তার জ্বলার ক্ষমতা থাকেনা সুতরাং শুকনো আবর্জনা ঘরে জমতে থাকলে সেই নোংরার মধ্যেই বাস করতে হয় কারণ তাকে পোড়ানো যাচ্ছেনা যে -- এটা সেইসব অভিভাবকরা মাথায় রাখুন যাঁরা সন্তানকে রাজনীতি করতে বারণ করেন। চলতি সময়ের ক্যালেন্ডারে এক একটা দিন দাগী হয়ে থাকছে ‘ছাত্র’দের করা প্রথমোক্ত (কু)কাজগুলোর অভিযোগেই। আর সবকটা ক্ষেত্রেই তাদের চালনা করছে কারা? বড়বাড়ি (সংসদ) আর ছোটবাড়ির (বিধানসভা) মুরুব্বিরা অর্থাৎ বিজেপি ও তৃণমূল, যে দলগুলোই কিনা বিভিন্ন সময়ে ‘ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতি করা উচিত নয়’ বলে হৈ চৈ করেছে, স্বাভাবিক – কারণ ছাত্রসমাজ যদি রাজনীতি বিশেষত প্রতিষ্ঠান বিরোধী রাজনীতিটাই করে তাহলে বিনা প্রশ্নে ভয়ে বা অন্ধ ভক্তিতে কেনই বা ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘মমতা ব্যানার্জী জিন্দাবাদ’ বলবে? রাজনীতি করতে গেলেই যে তারা সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল সহ বহু কিছু পড়ে ফেলবে, শুধু মার্কসের নেশায় সিলেবাসে বন্দী করে রাখা যাবেনা, মার্ক্সের চর্চাও করে বসবে তারা যা কালক্রমে চারু মজুমদার, দ্রোণাচার্যঘোষদের দিনবদলের ডাকেও সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাহলে আর ভিনধর্মের মানুষকে ‘শায়েস্তা’ করতে বা ভোটের দিন বুথ দখল করতে পাঠানো যাবে কাকে?

শাসক দলগুলোর কাজের প্যাটার্নে যা রাজনৈতিক ফারাক আছে তার ছাপ অনিবার্য ভাবেই তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর কাজেও পড়ছে – যেমন আরএসএস, বিজেপির মতো দল ও তাদের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি রক্তমাংসের মানুষকে মারা বা কাটার আগেও চায় তার চিন্তাভাবনার ও জ্ঞানচর্চার উৎস, বিষয়, মাধ্যম, পদ্ধতি-প্রকরণটাই পাল্টে তাকে ভেতর থেকেই নিজেদের গেরুয়া উগ্র হিন্দুত্ববাদী, জাতপাত ভেদাভেদ, জমিদারতন্ত্র, পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে ঢালা মানসিকতার জীব তৈরি করতে, যারা তাতে অবাধ্য হয় তাদেরকে খুন, গুম করা বা মিথ্যা মামলা দেওয়ার দিকে এগোয়; উদাহরণ – রোহিত ভেমুলা, নাজীব আহমেদ। আর তৃণমূলের মতো দল বা তাদের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি যাদের নির্দিষ্ট মতাদর্শগত ভিত্তিটা ঠিক কী তা নিয়ে নিজেরাই বেশ ঘেঁটে থাকে তারা নিতান্তই মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের দিকগুলো শর্টকাটে বা অন্যকে বঞ্চিত করে পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বা পেতে না দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নিজেদের হয়ে কাজ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করে। সাম্প্রতিক সময়ের দু/ তিনটে ঘটনাই এই প্রবণতাগুলো বুঝে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট —

(১) বিজেপি-আরএসএসের উন্মত্ত বাহিনীর হাতে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে ফেলা — ঘটনার মধ্যেই বাংলার নবজাগরণের চেতনা, যুক্তিবাদী শিক্ষার প্রসারের আকাঙ্ক্ষা, কুসংস্কার নির্মূল করার ও বিধবা বিবাহ শুরু করার মতো দুঃসাহসী প্রগতিশীল মানসিকতা ও আইকনকে ধ্বংস করে নিজেদের পিছিয়ে থাকা মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণাকে সেই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার ভাবনা স্পষ্ট। যদিও তারপরে নরেন্দ্র মোদী অন্যান্য আরো পাঁচটা জুমলার মতই ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দেন যে এক সপ্তাহের মধ্যে ওখানে পঞ্চধাতুর বিদ্যাসাগর মূর্তি বসাবেন — যেন শিশুকে আরো দামী খেলনা কিনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তার চোখ থেকে নিজের অপদার্থতা বা দুষ্কর্মের প্রভাব হালকা করার চেষ্টা

(২) হুগলীর কোন্নগরে হীরালাল পাল কলেজে টিএমসিপি লুম্পেনদের দ্বারা অধ্যাপক সুব্রত চ্যাটার্জীকে সর্বসমক্ষে নিগ্রহ করা — তাঁর ‘অপরাধ’ যে তিনি একদল সাধারণ ছাত্রছাত্রীকে ক্যাম্পাসে তাদের স্বাধীন গতিবিধিতে বাধা দিয়ে টিএমসিপি কর্মীদের দ্বারা জোর করে ‘মমতা ব্যানার্জী জিন্দাবাদ’ বলানোর চেষ্টার প্রতিবাদ করেন। এমনিতেই কলেজে কলেজে ছাত্রভর্তিতে যেমন খুশি অবৈধ টাকা খাওয়ার বা তাদের দলের হয়ে মিছিলে না গেলে বা তাদের হয়ে ভোটে দাঁড়াতে না চাইলে ছাত্রছাত্রীদের আই কার্ড, বিলবই আটকে রাখার একচেটিয়া তৃণমূলী দাপট এখন বেশ ধাক্কার মুখে, তার উপর মমতা ব্যানার্জীর জয়ধ্বনিটাও নতুন নতুন ছেলেমেয়েগুলো করতে চাইছে না – আধিপত্যের সামনে এত বড় প্রশ্নচিহ্নকে কি রেয়াত করা সম্ভব তৃণমূলের পক্ষে! তাই তো অধ্যাপকের গায়ে হাত তোলা ঐ কর্মীকে লোকদেখানো গ্রেফতার করলেও পাশাপাশি সংগঠিত ভাবে ঐ অধ্যাপকের নামে নেগেটিভ প্রচারের ফুলঝুরিও চালাচ্ছে তারা।

(৩) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুল কাফির উপর এক প্রাক্তন ছাত্রের অতর্কিত আক্রমণ — যদিও এই ঘটনায় ঐ ছাত্রের মোটিভটা এখনও পরিষ্কার নয় — কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিদ্বেষ নাকি নিতান্তই তার ব্যক্তিগত মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে এইরকম কাজ — কাজটার নিন্দা করতে যদিও তার রাজনৈতিক পরিচয় জানা মোটেই আবশ্যক নয় কিন্তু ঘটনা পরম্পরার সাথে তার সূত্র খুঁজতে বা বুঝতে কিম্বা ভবিষ্যতে ফের আশঙ্কা আছে কিনা অনুমান করতে সেটা জানার চেষ্টা করাই দরকার মনে হয়। সুতরাং গেরুয়া ফ্যাসিবাদী শাসকের কাছে মানুষের মগজ দখলের মাধ্যমে আর স্বৈরাচারী তৃণমূলের মত শক্তিগুলোর কাছে গায়ের জোরে এলাকা দখলের অগ্রাধিকার ক্যাম্পাসেও স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আশার কথা এবং দমের উদাহরণও আছে — প্রথম ঘটনায় রাজ্যজুড়ে জায়গায় জায়গায় তীব্র ধিক্কার আর জ্বলে ওঠা রাগ নিয়ে পথে নেমে পড়েছে অধিকাংশ সাধারণ ছাত্রছাত্রী যাদের অনেকেই দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকে সচরাচর আর বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো তো আছেই — তাদের সাথে খোলামেলা আলোচনা আর বন্ধুত্বের পরিসরটাও বাড়লো শিক্ষার্থী সমাজের আর দ্বিতীয় ঘটনায় আক্রান্ত অধ্যাপককে গুণ্ডাদের হাত থেকে প্রাণপণে বাঁচানোর চেষ্টা করতে এবং প্রতিবাদে প্রকাশ্যে চেঁচিয়ে উঠতেও তাদের বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা গেল। রোগ আছে, চিকিৎসাও আছে, থাকবেই।

 

খণ্ড-26
সংখ্যা-23