খবরা-খবর
‘মব লিঞ্চিং’-এর বিরুদ্ধে কামারহাটিতে নাগরিক কনভেনশন

৬ জুলাই ‘কামারহাটি আইডিয়াল এডুকেশনাল সোসাইটি’-র উদ্যোগে ‘মব লিঞ্চিং’-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এই সংগঠনের প্রধান কাজ হল পিছিয়ে থাকা সংখ্যালঘু অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজকর্ম সংগঠিত করা। কামারহাটির আলোকপ্রাপ্ত মুসলমান সম্প্রদায় এই এনজিও সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন। এরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনায় আলোচনা, সেমিনার, পথসভা করে থাকে। এই দিনের আলোচনা সভায় অধ্যাপক, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশার মানুষরা উপস্থিত ছিলেন। শুরুতে চিত্রশিল্পী পার্থ রায় ঝরঝরে উর্দুতে আজকের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। নাট্যকার সৈয়দ নোমানি বলেন, আমরা যদি কথা না বলি, চুপ করে থাকি তবে এঘটনা বাড়তেই থাকবে। ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী সাগ্নিক চক্রবর্তী শুদ্ধ হিন্দিতে বলেন ২০১৪ সালের আগেও আমরা ‘মব লিঞ্চিং’ দেখেছি। বিভিন্ন কারণে দলগতভাবে নৃশংসভাবে মানুষকে হত্যা করা হোত, অবশ্যই তা অন্যায় ছিল। কিন্তু এখনকার ‘মব লিঞ্চিং’ রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় হচ্ছে। আমাদের সহনাগরিক মুসলমান ও দলিতদের মধ্যে ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে দিয়েছে। এই ভয় সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস না পায়।

স্থানীয় বুদ্ধিজীবী অবোধ পান্ডে বলেন, আমি গর্বিত, আমি মুসলমানদের সঙ্গেই এই পাড়ায় বড় হয়ে উঠেছি। জেএনইউ-র উদাহরণ দিয়ে বলেন, এবিভিপি’র বিরোধিতা করার জন্য নাজীবকে হত্যা করা হয়। তিনি সম্প্রীতির উদাহরণ দিয়ে বলেন – ছেলেকে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করার সময় অনেকেই বারণ করেছিলেন। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা খুঁজে পেলাম। ছেলে যখন ইউনিভার্সিটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে প্রত্যক্ষ করলাম ওদের সহমর্মিতা। এটাই আমার দেশ।

শ্রমিক নেতা বাসুদেব বসু বলেন, মব লিঞ্চারদের গ্রেপ্তার বা শাস্তি প্রদান দূরের কথা, যারা নিহত হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। মুমতাজ আলম বলেন, বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতের রাজনীতি ছিল না। বামেরা দীর্ঘদিন এই সবের বিরুদ্ধে লড়েছেন। দু:খের কথা বামেরা এখন ‘রাম’ হয়েছে, আর বিপজ্জনক রাজনীতির সওয়ারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গারুলিয়া মিল হাইস্কুলে তিনি পড়াশুনা করেছেন। সেখানে বাংলা, হিন্দি ও উর্দু মাধ্যমে পড়াশুনো করানো হয়। স্কুলে কোনো দিন ভাষা বা ধর্মীয় বিভাজন বুঝতে পারিনি।

ইরফান বলেন, নিরাপদ বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। দরজা বা জানালা দিয়ে দেখা বন্ধ করুন, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করুন। দলিত নেতা রামবচন বলেন সংবিধান আক্রান্ত, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এইসব ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতিতে জনতা ফেঁসে যাচ্ছেন। অধ্যাপক জাফর আহমেদ বলেন — ‘মব লিঞ্চিং’ হল রাজনৈতিক হত্যা, এর নাম হল ‘ভয়ের রাজনীতি’। সবাইকে চুপ করিয়ে দাও। আজ বাজেট নিয়ে আমরা কথা বলছি না, বলছি অন্য কিছু বিষয় নিয়ে। আর্যরা যেমন এখানে এসেছিল, মুসলমানরাও তেমনি এসেছিল। উভয়ই এখানে থেকে যায়। এই দেশ আমাদেরও। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে ছুৎ, অচ্ছুৎ, ডাইন, বাচ্চা চুরি, মুসলমানদের হেয় করা, কখনো গোপনে বা প্রকাশ্যে অতি সন্তর্পণে করছিল। এখন ক্ষমতায় এসে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশ্যে আক্রমণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এসসি এবং এসটি-দেরকেও ঘৃণা করতে শেখানো হচ্ছে। কমন্ডলুর বিরুদ্ধে মন্ডলও পিছু হটেছে। বামেরাই পারত কিন্তু তারাও ‘রাম’ হয়ে গেছে। টিএমসি মুসলমানদের ব্যবহার করেছে মাত্র, যখন তারা বিপদে পড়লো তখন তাদের পিঠ থেকে হাত তুলে নিল। সব ধর্ম, ভাষা ও জাতিদের নিশ্চিত আশ্রয় ছিল বাংলা, এখন আর তা নেই। বামেরা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাংলায়ও ‘ভয়’ জাঁকিয়ে বসেছে। কাঁকিনাড়ার সাম্প্রতিক ঘটনা তার উদাহরণ। তিনি সবার কাছে আবেদন করেন, সম্প্রীতির মাধ্যমে নিজেদের পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিজেদেরই ঠিক করতে হবে।

আর যারা বক্তব্য রাখেন তাঁরা হলেন রাজেন্দ্র সিং, আসগর, আরশাদ আনসারি, মুস্তাক আহমেদ। সঞ্চালক ছিলেন সেরাজ নোমানি। সভাপতিত্ব করেন নবেন্দু দাশগুপ্ত।

খণ্ড-26
সংখ্যা-20