তার প্রথম দফায় মোদী সরকার প্লানিং কমিশনকে ভেঙ্গে দিয়ে অর্থনৈতিক ফ্রন্টে তার যাত্রা শুরু করে। তার পর থেকে এই ভাঙ্গা ও ভাংচুরের অভিযান অব্যাহত ভাবে চলতে থাকে — বিমুদ্রাকরণ ঘটানো হল এবং এটা তার মূল্যও উশুল করল, রিজার্ভ ব্যাংকের স্বায়ত্ততা খর্ব করা হল, একতরফাভাবে অপরিণত চিন্তা প্রসূত জিএসটি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হল, মূল মূল অর্থনৈতিক তথ্যগুলিকে চেপে গিয়ে ত্রুটি যুক্ত ও নিজেদের সুবিধা জনক তথ্য গুলি পরিবেশিত হল এবং সরকার খামখেয়ালীভাবে ও বাছবিচারহীনভাবে সবকিছুই আধারের সঙ্গে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে গরীব মানুষদের ত্রাণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হল। এখন দ্বিতীয় দফা শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে বাজেটের আগে পেশ হওয়া অর্থ বিষয়ক মন্ত্রকের পেশ করা আর্থিক সমীক্ষা সহ বাৎসরিক বাজেট বরাদ্দকে লক্ষ্যে রেখে দ্বিতীয় দফা শুরু হয়েছে।
প্রচলিত ভাবে চলে আসা ব্রিফকেসের বদলে বাজেট পেপার এক লাল ফাইলে রেখে অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের মধ্য দিয়ে সরকার বাজেট পেশের ধরনকে পাল্টে দিতে চেয়েছে। মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এটাকে পশ্চিমী ভাবনার দাসত্ব থেকে বেরিয়ে এসে ভারতীয় ঐতিহ্যর প্রত্যাবর্তন বলেও বর্ণনা করেন। কেউ ভাবতেই পারেন যে পশ্চিমী ধারণা থেকে এই ধরনের মুক্তি কি কোনো একদিন সংবিধান ও সংসদীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে! সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে যে, যাকে ভারতীয় ধরনের হিসাবের খাতায় ফিরে আসা বলা হচ্ছে তা বাস্তব জীবনে সাধারণ দোকানদাররা যে আয়ব্যয়ের খাতা ব্যবহার করেন তার এক অনোপকারি (ক্ষতিহীন) প্রতীক নয়, বরং এমন কিছু যাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দুর্দশাগ্রস্ত ও ঋণগ্রস্ত ভারতীয়রা নির্দয় কুসিদজীবীদের এক ভয়ংকর হাতিয়ার হিসেবে প্রত্যক্ষ করে এসেছেন।
এখন অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও বাজেটের বিষয় বস্তুতে আসা যাক। অর্থনৈতিক সমীক্ষাটি ততটুকু তাৎপর্যপূর্ণ যতটুকু তা কিছু মূল দিককে তুলে ধরে — ভারতীয় অর্থনীতিতে এক মন্দা চলছে, বৃদ্ধির হ্রাস ঘটছে, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ কমেছে, কর্মসংস্থানের অভাব, ভোগ্যপণ্যের বিক্রি কমেছে, ব্যাঙ্কের গভীরতর সংকট, ব্যবসা-বাণিজ্যে ঘাটতি ইত্যাদি। এ সব কিছুই সংকটের আবর্তচক্রে যুক্ত হয়ে চলেছে। কিন্তু সমীক্ষা আশা করছে যে অর্থনীতি হঠাৎই সংকট থেকে মুক্ত হবে ও বৃদ্ধির পথে ফিরে আসবে এবং ২০২৪-২০২৫ সালে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি অর্জন করবে। এখন মোদী ও তার টিম এমনভাবে এই লক্ষ্যের কথা বার বার বলছে যেন লক্ষ্য ইতিমধ্যেই অর্জন হয়ে গেছে।
আগামী বছরগুলিতে ৮ শতাংশ বৃদ্ধির হার, এর সাথে বেসরকারি বিনিয়োগের বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা — এগুলির উপর ভিত্তি করে তাদের এই আশা দাঁড়িয়ে আছে। গত ৫ বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কম কিছু ছিল না। মোদীর প্রথম দফাতেও বিজেপি’র নিজেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। যদি মোদী সরকারের প্রথম দফায় বিনিয়োগের বৃদ্ধির বদলে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হ্রাস ঘটে, তাহলে মোদী শাসনের আরো ৫ বছরে কেন ভিন্ন ফলাফল আসবে? সমীক্ষা কোনো ধরনের সূত্র দেখায়নি। সমীক্ষা বাচালের মতো অর্থনীতিতে তেজ সৃষ্টির কথা বলেন, আমরা কি ইতিমধ্যেই কর্মসংস্থান ও জীবনজীবিকার ধ্বংস করতে এই তেজ যথেষ্ট দেখিনি?
বড় বড় ঋণখেলাপী কর্পোরেট সংস্থাগুলো যখন অনাদায়ী ঋণের পাহাড় সৃষ্টি করছে, সরকার তখন বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণ মকুব করতে এবং ব্যাঙ্কগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে সময়ান্তরে ব্যাঙ্কে পুঁজি ঢালতেই ব্যস্ত। সমীক্ষা কট্টর ঋণখেলাপীদের অর্থনীতিগত আচরণ শেখাতে ধর্মের বাণী শুনিয়েছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা আমাদের এটাই বোঝাতে চায় যে সময়মতো ঋণ মেটাবার জন্য একবার ধর্মীয় নৈতিকতার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে নীরব মোদী ও বিজয় মাল্যরা তৎক্ষনাৎ ঋণ মিটিয়ে দেবে। সমীক্ষা অর্থনীতিগত আচরণের সফল উদাহরণ হিসেবে ‘স্বচ্ছ ভারত’ ও বেটি বাঁচাও’-এর উল্লেখ করে। অবশ্য এ সম্পর্কে নীচেরতলার রিপোর্ট ও সমীক্ষা এই আত্মসন্তুষ্ট বড় বড় দাবিকে সমর্থন করে না। অর্থনৈতিক ফ্রন্টে মোদী সরকার চীন দেশ সম্পর্কে আবিষ্ট হয়ে আছে। কখনো সে চীন থেকে শেখার কথা বলে, কখনো চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কথা বলে। কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক সাফল্য যেখানে ভূমি সংস্কার ও কৃষির আধুনিকীকরণ, বিপুল পরিমানে সরকারী পুঁজি নিয়োগ ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিপুল জাল-এর উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে, মোদী অর্থনীতি সেখানে কেবল কয়েকটি বৃহৎ বেসরকারি ঘরানার ওপর ভিত্তি করেছে এবং এ বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষা আবারও অল্প কিছু বৃহৎ কর্পোরেটের উপরেই নির্ভর করেছে।
নির্মলা সীতারমনের প্রথম বাজেটেও বৃহৎ কর্পোরেটদের সবেতেই তোয়াজ করা হয়েছে এবং বিনিয়োগ বাড়াতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য মিনতি করা হয়েছে। একক ব্রান্ডের খুচরো ব্যবসা, ইনসিওরেন্স, বিমান শিল্প, প্রচার মাধ্যম, এ্যানিমেশন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের যে নিয়ম-কানুন আছে তা শিথিল করা হয়েছে (অবশ্য দামী পুস্তক আমদানির উঁচু আমদানি কর লাগবে) এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে বেসরকারি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হল এই যে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলি থেকে অর্থ ধার করে এই ধরনের অধিকরণ হচ্ছে। এবং যখন ব্যাঙ্কগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়বে সরকার তখন পুঁজি ঢেলে ব্যাঙ্কগুলোকে চাঙ্গা করবে। ২০১৯ এর বাজেট সদ্য সদ্য আবার ভারতীয় কর দাতাদের কষ্টার্জিত ৭৫০০০ কোটি টাকা ব্যাঙ্কগুলিকে চাঙ্গা করতে বরাদ্দ করেছে। নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, নির্বাচনী বন্ডগুলি ভাঙ্গানো হয়েছে, টাকা ফেরানোর সময় সম্ভবত শুরু হয়েছে।
বেসরকারিকরণ কেবলমাত্র পরিকাঠামো ক্ষেত্রেই ঘটছে না, রাষ্ট্রায়ত্ত পরিষেবার সমস্ত ক্ষেত্রকেই ক্রমান্বয়ে লক্ষ্য বস্তু বানানো হচ্ছে। যানবাহন, শক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিষেবা — এই সমস্ত মূল ক্ষেত্রগুলো থেকে সরকার তার দায়িত্ব গুটিয়ে নিচ্ছে। রেলওয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলো, রেলওয়ে রুট ও উৎপাদনের ইউনিটগুলো বেসরকারি কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দিতে চায়, বিমান বন্দরগুলো আদানিকে লিজ দেয়া হচ্ছে এবং শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বড় পরিমানে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। বিমা-ভিত্তিক ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প এবং বুনিয়াদি স্বাস্থ্য পরিষেবার লভ্যতার এত নিষ্ঠুর ধরনের তফাৎ রয়েছে যা মুজফ্ফরপুরে এনসেফালাইটিসে মৃত্যুর মর্মান্তিক সংখ্যার মধ্যে দেখা গেল। কিন্তু বাজার চিকিৎসা প্রদান করাকে ব্যবসা হিসেবে দেখে এবং মানুষদের ঘাড় ভেঙ্গে মুনাফা উশুল করে। বাজেটে ভয়ংকর দিক বিস্তারিত ভাবে আছে। ২০১৯ সালের বাজেটে সদ্য সদ্য এসসি ও এসটি’-দের জন্য ডক্টোরাল ও পোস্ট ডক্টোরাল ফেলোশিপের বরাদ্দ ৬০২ কোটি টাকা থেকে ২৮৩ কোটি টাকা এবং ৪৩৯ কোটি টাকা থেকে ১৩৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
সরকার জনগণের প্রাথমিক প্রয়োজন ও আকাংখা মেটাতে নিজের দায়িত্ব কে পরিত্যাগ করেছে, রাজস্ব বাড়াতে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম আবারো বাড়ানো ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবতে পারে না এবং এইভাবে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে জনগনের ঘাড়ে বোঝা চাপাচ্ছে। এই সরকার ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে ভারতকে উন্নত করার বড় বড় কথার পিছনে নিজের আসল মুখকে ঢেকে রাখতে চায়। কিন্তু দেশে যখন চলছে খরা, অনাহার ও কর্মহীনতা, তখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মোদী সরকারের ক্রমবর্ধমান ব্যর্থতাকে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়। তথ্য নিয়ে সরকারের নোংরা খেলা — সরকারের দ্বারা সংগৃহীত ম্যাক্রোস্তরের অর্থনৈতিক তথ্যবলীর আর কোনো ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই আর জনগণকে নিয়ে মাইক্রো স্তরের তথ্য প্রতিদিনই রাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বেসরকারি কোম্পানিগুলো চুরি করছে — এই বিস্ফোরক অর্থনৈতিক সংকটকে বেশিদিন চেপে রাখতে পারবে না।
-- (এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ৯ জুলাই, ২০১৯)