মুসলমান জনসংখ্যা ও অনুপ্রবেশের সাম্প্রদায়িক অতিকথনকে উন্মোচিত করুন

ভারতের শাসক দল বিজেপির নির্বাচিত সাংসদরা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদির মন্ত্রীসভার সদস্যরা ভারতের মুসলমান জনসংখ্যা সম্পর্কে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক অতিকথন ছড়ানোর মাধ্যমে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদযাপন করেছে।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ যন্তর মন্তরে এক সমাবেশে তার কথা অনুযায়ী ‘ক্রমহাসমান হিন্দু ও ক্রমবর্ধমান অহিন্দু জনসংখ্যার সমস্যা’ নিরসনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করার দাবি করেন। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা খোলাখুলিভাবে হিংস্র গণহত্যায় প্ররোচনাদায়ক বক্তৃতা দেন। একজন মুসলমাদের মানবিক অধিকার ছাঁটাই করার দাবি করেন। অন্যজন তার ইচ্ছে মতো সমস্ত মুসলমানের শিরোচ্ছেদ করার অনুমোদন ভারতীয় সংবিধান কেন দিচ্ছে না বলে আক্ষেপ করেন। সমাবেশ বিষময় ও মিথ্যে প্রচার করে যে বহুবিবাহ অনুমোদনকারি মুসলমান ব্যক্তিগত আইনের জন্য বর্তমান মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধি বজায় থাকলে ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা অচিরেই হিন্দু জনসংখ্যাকে অতিক্রম করে যাবে।


কয়েক দিন আগেই উত্তর প্রদেশের বালিয়ার বিজেপি বিধায়ক সুরেন্দ্র সিং বলেছিলেন যে, মুসলমানরা জানোয়ারের মতন, “৫০ জন স্ত্রী রাখে ও ১০৫০ জন সন্তানের জন্ম দেয়”। গত বছরেও তিনি অনুরূপ বক্তব্য রাখেন ও প্রত্যেক হিন্দু দম্পতিকে অন্তত ৫ জন সন্তানের জন্ম দিতে বলেন

 বহুবিবাহ, লাভ জিহাদ (হিন্দুনারীর সঙ্গে মুসলমান পুরুষের বিবাহ) এবং “বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ”-এর মাধ্যমে মুসলমান জনসংখ্যার হিন্দুদের অতিক্রম করে যাওয়ার সাম্প্রদায়িক প্রচার আরএসএস-বিজেপির একটি পরিচিত বয়ান। ২০০২ সালে গুজরাটে সংগঠিত মুসলমান হত্যার পরে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাঙ্গা বিধ্বস্ত মুসলমানদের ত্রাণ শিবিরগুলিকে সন্তান উৎপাদনের কারখানা বলে অভিহিত করেন। ২০১৫ সালে বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজ হিন্দু দম্পতিদের ৪টি করে সন্তান জন্মদানের আহ্বান করেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধ্বী প্রাচী পুনরায় ওই পরামর্শদেওয়ার প্রক্রিয়ায় সমকামি সম্পর্কের বিরুদ্ধে ঘৃণা উদ্গার করেন। তার বক্তব্যের সপক্ষে তিনি মন্তব্য করেন যে তিনি চান হিন্দুরা ৪টি সন্তানের জন্ম দেবে, ৪০টি কুকুরের নয় — অর্থাৎ তিনি মুসলমানদের কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেন।

এই প্রচার জনগণনার তথ্য দ্বারা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিরক্ষরতা, অপ্রাপ্তি ও দারিদ্রের সঙ্গে যুক্ত। মুসলমান নারীদের সাক্ষরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দুদের থেকে দ্রুততর গতিতে কমছে। ১৯৯১- ২০০১ সাল পর্যন্ত হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে ৩.১৬%, যেখানে মুসলমাদের অনুরূপ বৃদ্ধির হার কমেছে ৪.৯২%। গত দুদশকের মধ্যে সাম্প্রতিককালে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন।

একইভাবে, ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্য মুসলমান নারীদের সাক্ষরতা হারের বৃদ্ধির সঙ্গে গর্ভধারণ হারে যথেষ্ট হ্রাস দেখাচ্ছে। ২০০৫-০৬ এর সমীক্ষায় হিন্দু নারীদের মোট গর্ভধারণ হার ছিল ২.৬ যা ২০১৫-১৬র সমীক্ষায় কমে ২.১ হয়েছে, যেখানে মুসলমান নারীদের ক্ষেত্রের অনুরূপ হার ৩.৪ থেকে কমে ২.৬ হয়েছে। অধিক গুরুত্বপূর্ণবিষয় হল যে ওই সমীক্ষা অনুযায়ী হিন্দু ও মুসলমানদের গর্ভধারণ হারের পার্থক্য ২০০৫-০৬-এ ৩০.৮% থেকে কমে ২০১৫-১৬-তে ২৩.৮% হয়েছে।

মুসলমান গর্ভধারণ হারকে যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতে পেশ করতে গেলে জানা দরকার যে, তফসিলি জাতির ক্ষেত্রে অনুরূপ হার ২.৫, তফসিলি উপজাতি ও ওবিসিদের ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে ২.৩ ও ২.২, যেখানে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, এবং মধ্যপ্রদেশের ক্ষেত্রে তা ৩। অন্য কথায়, শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ এবং প্রান্তিক জনজাতি ও রাজ্যগুলিতে গর্ভধারণ হার বেশি, যেখানে তুলনামূলকভাবে উন্নত স্বাস্থ্যসুবিধা ও অধিক নারী-সাক্ষরতা সম্পন্ন গোষ্ঠি ও রাজ্যে গর্ভধারণ হার কম। কেরালার মতো অধিক সাক্ষরতা বিশেষত অধিক নারী সাক্ষরতাসম্পন্ন রাজ্যে মুসলমানদের গর্ভধারণ হার উত্তরপ্রদেশের (যেখানে সাক্ষরতা ও নারী সাক্ষরতার হার কম) হিন্দুদের গর্ভধারণ হারের থেকে কম।

আরএসএস ও বিজেপির সাম্প্রদায়িক প্রচার দাবি করে যে, বাংলাদেশ থেকে বেআইনি অনুপ্রবেশের ফলে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রচার মুলত: বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্য, বিশেষত, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে করা হয়ে থাকে। আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি), যার শেষ দিন ৩১ জুলাই, ২০১৯, অন্তর্ভুক্তিকরণের সঙ্গে বিজেপি নেতাদের সাম্প্রদায়িক অত্যুক্তি জড়িত ছিল। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময়ে অমিত শাহের বক্তব্যগুলিতে বাংলাদেশী মুসলমানদের উইপোকাদের সঙ্গে তুলনা করে তাদের বাংলাদেশে তাড়ানোর মতন অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার করা হত।

কিন্তু তথ্য সমস্ত ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ থেকে বেআইনি অনুপ্রবেশের দাবিকে খারিজ করেছে। জনগণনার তথ্য অনুসারে ১৯৯১ থেকে ২০০১ এর মধ্যে আসামের মুসলমান জনসংখ্যা সারা দেশের মুসলমান জনসংখ্যার সমহারে বেড়েছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সারা দেশের মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। আসামের তপসিলি জাতি ও উপজাতির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি।

এমনকি উচ্চতম আদালতও, আসামের এনআরসি দেখভাল করার সময়ে, আসামে ৫০ লক্ষ বেআইনি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী আছে বলে ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রচারিত দাবি মেনে নিয়েছে। বাস্তবে, একটি সাম্প্রতিক তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে যে, “ওই সংখ্যা কোনো সমীক্ষার উপরে ভিত্তি করে নয়, স্বার্থ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে শোনা কথার ভিত্তিতে বলা হয়েছে। সুতরাং, বেআইনি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ সম্পর্কে কোনো বাস্তব তথ্য বা সংখ্যা দেওয়া যাবে না। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও সংখ্যাগুলি অবিশ্বস্ত অনুমানের উপর ভিত্তিশীল ও বেঠিক।”

এটি বিপজ্জনক যে, ঐ ধরনের “শোনা কথা” ও “অবিশ্বস্ত অনুমান” একটি কর্মসূচীর ভিত্তি হয়ে উঠল, যা আসামের কয়েক লক্ষ ভারতীয়কে ৩১ জুলাই, ২০১৯ এ নাগরিকত্ব থেকে বহিস্কার করবে।

তথ্য অনুসারে বন্যা বিধ্বস্ত আসামের বাংলাভাষী মুসলমানরা তাদের বন্যা আক্রান্ত বাসস্থান ছেড়ে যেতে অস্বীকার করছে এই আশঙ্কায় যে বাসস্থান ত্যাগ করলে এনআরসি নাগরিকের তালিকায় নাম থাকার দাবি দুর্বল হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে, এনআরসি তালিকা প্রকাশের প্রাক্কালে বাংলাভাষী মুসলমান কবিদের প্রতিবাদী কবিতার বিরুদ্ধে এফআইআর করে কিছু দল আসামে সাম্প্রদায়িক বাতাসে ধুয়ো দিতে চাইছে। তাদের উপহাস করে “মিয়া” বলে অভিহিত করার স্থানীয় ডাককে আত্মিকরণ ও পুনর্ব্যবহার করে ওই কবিতা সাম্প্রদায়িক ও ভাষাগত অসহিষ্ণুতাকে অস্বীকার করে এবং “মিয়া” অস্তিত্বের প্রতি গর্বের প্রকাশ করে।

বিজেপি এবং আরএসএস এর মুসলমান জনসংখ্যা ও অনুপ্রবেশ সম্পর্কে মিথ্যাচার ও ভীতি সঞ্চারকারী সাম্প্রদায়িক প্রচার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্টতাবাদ ও গণহত্যার সপক্ষে সমর্থন সৃষ্টির উদ্দেশ্য প্রণোদিত। মোদী সরকার কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে সংগঠিত এই অপপ্রচারকে জরুরি ভিত্তিতে উন্মোচিত করতে ও রুখতে হবে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৬ জুলাই, ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-22