এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই, নাগরিক পঞ্জি বা নিবন্ধন (এনআরসি) করে আসামের ৪১ লক্ষ মানুষকে বে-নাগরিক ঘোষণা করে ভারতের নব্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পয়লা নম্বর বংশবদ অমিত শাহ দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে সুপরিকল্পিতভাবে ঠেলে দিতে চাইছেন। রাজ্যসভায় তাঁর হুংকার তার ভয়ংকর ইঙ্গিত। সমাজবাদী সদস্য জাভেদ আলিকে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, শুধু আসাম নয়, নাগরিক পঞ্জি তথা এনআরসি গোটা দেশে প্রযোজ্য হবে। “এনআরসি অসম ক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য। আমাদের নির্বাচনী ইস্তাহারেও-এর প্রসঙ্গ ছিল এবং সেই প্রতিশ্রুতিতেই ক্ষমতায় এসেছি। দেশের প্রতিটি ইঞ্চিতে খুঁজে খুঁজে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করবে সরকার। তার পর আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাঁদের নিজের নিজের দেশে ফেরত পাঠানো হবে।”
অমিত শাহ অবশ্য শপথ গ্রহণের দিনই তাঁর মন্ত্রণালয়ের আমলাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর দল বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে তিনি পালন করবেন। বেঠকে তিনি বলেন, দেশের নিরাপত্তা ও স্বার্থের সঙ্গে তাঁদের সরকার কোনো রকম আপস করবে না। তার মধ্যে আছে আসামের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যত্র এনআরসি রূপায়ন ও নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাশ করা।
এর আগে পশ্চিমবঙ্গে আলিপুরদুয়ারে নির্বাচনী জনসভায় অমিত শাহ বলেই ছিলেন, ‘ক্ষমতায় এলে আমরা পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি চালু করব। সব অনুপ্রবেশকারীকে তাড়িয়ে বিদায় করব। তবে আমরা দেখব, হিন্দু শরণার্থীরা যেন নিরাপদ থাকেন।’ জনসভায় প্রকাশ্যে তিনি ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ তুলনা করেছিলেন ‘উইপোকা’র সঙ্গে এবং বলেছিলেন, ‘সবাইকে আমরা দেশ থেকে তাড়াব, কেননা, এদের জন্য প্রকৃত নাগরিকদের ভোগান্তির শেষ নেই।’
আসামে এনআরসি তৈরি করা হচ্ছে ভারতের সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে। আসাম চুক্তিতে (১৯৮৫) এই নাগরিক নিবন্ধন তৈরির কথা ছিল। মুসলিম মুক্ত ভারত গড়ার চক্রান্তের আরেক নাম এনআরসি -- তা সে সুপ্রীম কোর্ট-নির্দেশিত হলেও। এই নাগরিক পঞ্জি ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই প্রকাশিত হয়েছে এবং হওয়া মাত্র আসামে এক জলিট পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, কারণ আসামের মোট জনসংখ্যার ৩.২৯ কোটির মধ্যে ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষ দেশহীন বে-নাগরিক হয়ে সেদিন থেকে ভীত, সন্ত্রস্ত বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন।
কিছু মানুষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা রটিয়ে উচ্চ ও নিম্ন আসামে ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষদের মধ্য চিড় ধরাতে চাইছেন। এরা যে সঙ্ঘ পরিবারের বাসনানুসারে এনআরসি রূপায়ন-সমর্থক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মোদী-শাহ (অপশাসনে) বিজেপি যে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে, এইসব কার্যকলাপে তা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
আসামে যেমন বাঙালি খেদাও হচ্ছে, ২০০২ সালে গুজরাটে নরেন্দ্র মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে বিভীষিকাময় দাঙ্গার সময় যেমন মুসলমান বিতাড়ন হয়েছিল। এখন শুরু হয়েছে বিহারি বিতাড়ন।
আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের সময়সীমা সুপ্রীম কোর্ট আরও একমাস পিছিয়ে ৩১ আগস্ট নির্ধারিত করেছে। আগামী ৭ আগস্টের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সুপ্রীম কোর্টে হাজির হয়ে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর বেঞ্চ। তবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং বাদ পড়াদের মধ্যে ২০ শতাংশ নাগরিকের তথ্যপঞ্জি নতুন করে খতিয়ে দেখার যে আর্জি করেছিল কেন্দ্র ও অসম সরকার, সেই আর্জি খারিজ করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে নাগরিকপঞ্জিতে এমন অনেকেই বাদ পড়েছেন, যাঁরা প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় নাগরিক। আবার অনেক প্রবাসীও তালিকায় ঢুকে পড়েছেন। বিশেষত অসম-বাংলাদেশ সীমান্তের কিছু এলাকায় স্থানীয় আধিকারিকদের যোগসাজশে এমনটা হয়েছে। তাই আরও অন্তত ২০ শতাংশ নাগরিকের নথিপত্র খতিয়ে দেখে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা প্রয়োজন। সেই জন্যই অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন।
কিন্তু এনআরসি সমস্যা বাড়াবে বৈ কমাবে না, আর এর ফলে সামাজিক ও জনজাতিগত সংঘাত সৃষ্টি হবে না, তা আগাম বলা যায় না। আসামের কথাই ধরা যাক। সেখানকার মুলবাসীরা তো অহম-রা না। আদি বাসিন্দারা খাসিয়া জয়ন্তিয়ারা, যারা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো। এতে চীনের মদদ আছে কি নেই, সে বিতর্কিত প্রশ্নে যাচ্ছি না। কিন্তু কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনই নিরালম্ব বায়ুভুক হতে পারে না। শতাব্দীব্যাপী বঞ্চনা বিচ্ছিন্নতাবাদের অঙ্কুরোদ্গম সূচিত করে। তাই প্রবলোৎসাহে এনআরসি রূপায়ন বিচ্ছিন্নতাবাদকে আরও উস্কে দেবে না, এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।