মোদী সরকার বার বার “এক দেশ এক ভাষার” নামে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ‘হিন্দি-হিন্দু- হিন্দুস্থানের’ পুরোনো এজেন্ডা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরে মোদী সরকারের অন্যতম প্রথম পদক্ষেপ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের আধিকারিক, বিভিন্ন দপ্তর, পুরসভা এবং ব্যাংকগুলিকে আদেশ দেওয়া যাতে তারা তাদের সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে হিন্দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এরপর সরকার মন্ত্রী, রাজ্যপাল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদাধিকারীদের হিন্দিতে বক্তৃতা দিতে বলে। বিজেপি নেতা তথা মন্ত্রী শ্রী বেঙ্কাইয়া নাইডু নিজে একজন তেলেগুভাষী হয়েও হিন্দিতেই জানান – “হিন্দি হামারি রাষ্ট্রভাষা হ্যায়” অর্থাৎ “হিন্দি হোলো আমাদের রাষ্ট্রভাষা” (‘রাষ্ট্রভাষা’ ইংরাজিতে ‘ন্যাশনাল ল্যাংগুয়েজ’ অর্থাৎ ‘জাতীয় ভাষা’র সমার্থকরূপে দেখা হয়)। কথাটি সর্বৈব মিথ্যা। ভারতের কোনো একটি নির্দিষ্ট ‘রাষ্ট্রভাষা’ নেই। মোদী ১.০ সরকারের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ জানিয়েছিলেন যে তাঁদের সরকার রাষ্ট্রসংঘে হিন্দিকে ভারতের আধিকারিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী। এহেন উদ্যোগের অস্যার্থই দাঁড়ায় হিন্দি এদেশের ‘রাষ্ট্রভাষা’। মোদী ১.০ সরকার তামিলনাড়ুর মতো অ-হিন্দিভাষী রাজ্যে জাতীয় সড়কের মাইলফলকেও ইংরাজির পরিবর্তে হিন্দি ব্যবহারের চেষ্টা করে। এবার মোদী ২.০ আবার নতুন করে হিন্দি চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে তার নতুন শিক্ষানীতির মাধ্যমে। বর্তমানে ভারতের সমস্ত স্কুল যে ‘দুই-ভাষা’ নীতি মেনে চলে তার বদলে এই নতুন শিক্ষানীতির খসড়ায় ‘তিন ভাষা নীতি’ প্রণয়নের সুপারিশ রাখা হয়েছে। দেশব্যাপী প্রবল প্রতিবাদের মুখে মোদী সরকার আপাতত এই প্রস্তাব ফিরিয়ে নিলেও নিঃশব্দে, নানা চোরাপথে অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলির উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছেই।
আসলে হিন্দি, অন্তত যে হিন্দি নানা সরকারি কাজকর্মে ব্যবহৃত হয়, তা তথাকথিত হিন্দি-ভাষী অঞ্চলেরও স্বাভাবিক মুখের ভাষা নয়। এটি কথ্য হিন্দি-উর্দু বা ‘হিন্দুস্তানি’ ভাষার সংস্কৃতায়িত বিকৃতি। এই সংস্কৃত-কন্টকিত, আরবি-ফার্সিমূলের শব্দাবলী-বিযুক্ত ‘সরকারি’ হিন্দির জন্মবৃত্তান্ত বুঝতে গেলে আমাদের একদিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস, অন্যদিকে হিন্দি ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের ইতিহাসকে জানতে হবে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা হিন্দিকে হিন্দুধর্মের সঙ্গে আর উর্দুকে ইসলামের সঙ্গে জুড়ে দুটি ভাষার মধ্যে মেরুকরণের চেষ্টা করেছিল। অথচ এই দুটি ভাষাই কৃত্রিমভাবে তৈরি – প্রথমটিতে সংস্কৃতের আধিক্য, দ্বিতীয়টিতে ফার্সির বাড়াবাড়ি। হিন্দি বা উর্দুনয়, হিন্দুস্তানিই ছিল একটি জীবন্ত ভাষা এবং ব্রিটিশদের মেরুকরণের চেষ্টা সত্ত্বেও তা বেঁচে থেকেছে এবং বিকশিত হয়েছে। ১৯২০ এবং ৩০ এর দশকে হিন্দি ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ভারতীয় জাতীয়তায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়। ১৯০৫ সালে বাল গঙ্গাধর তিলক দেবনাগরি (নাগরি) লিপিতে লিখিত হিন্দিকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আধিকারিক ভাষা করার চেষ্টা চালান। ১৯৩৯ সালে হিন্দু মহাসভা দাবি জানায় যাতে হিন্দুস্তানি নয় হিন্দি ভাষাই ভারতের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। এই বিতর্ক সংবিধান সভাতেও উঠে আসে। ইতিহাস বলে নেহেরু এবং গান্ধি দুজনেই নাগরি ও ফার্সি উভয় লিপিতে লিখিত হিন্দুস্তানিকেই ইংরাজির পাশাপাশি আর একটি সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। পরিবর্তে নাগরি লিপিতে লিখিত হিন্দি ভারতের একটি সরকারি ভাষা নির্বাচিত হয়। সে যাত্রা এই যুদ্ধে হিন্দি-হিন্দু জাতিয়তাবাদী লবির জয় হয়।
১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো আচমকাই হিন্দুস্তানি ভাষায় পঠিত খবরকে হিন্দি খবরে পরিবর্তিত করে। সাধারণ সম্প্রচারের ভাষাও ততদিনে এতটাই বদলে ফেলা হয়েছে যে ১৯৪৮ সালে খোদ নেহেরু অনুযোগ জানান যে তিনি নিজেই নিজের ইংরাজি ভাষণের হিন্দিতে অনুদিত সম্প্রচার বুঝতে পারছেন না!
হিন্দি লেখক প্রেমচন্দ, যিনি হিন্দি এবং উর্দু উভয় ভাষাতেই সাহিত্যচর্চা করতেন তাঁর পৌত্র অলোক রাইয়ের মতে এই সরকারি এবং সংস্কৃতায়িত হিন্দি একদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু-জাতিয়তাবাদী রাজনীতির ফসল আবার একই সঙ্গে সেই রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম। রাই ‘ট্র্যাক্টস ফর দ্য টাইম’ সিরিজের (ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোওয়ান, ২০০০) অন্তর্গত একটি ছোটো বই লেখেন। নাম ‘হিন্দি ন্যাশন্যালিজম’। এই বইতে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষের মুখের হিন্দি ভাষাকে দমন করা হয়েছে এক বিশুদ্ধ, সংস্কৃত-ভেকধারী হিন্দির নামে। এই বই খোঁজ করে কীভাবে “ভারতীয় এবং হিন্দু জাতিয়তাবাদ ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে পরস্পর মিলে অতি- সংস্কৃতায়িত ‘শুদ্ধ হিন্দির’ জন্ম দেয়, যা এখন ভারতের একটি সরকারি ভাষা এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রস্বরূপ”।
রাই এটাও দেখান যে নাগরি লিপির (যে লিপিতে এখন হিন্দি লেখা হয়) পুরোনো নাম বাভানি, অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের লিপি। ফার্সির পরিবর্তে হিন্দুস্তানি ভাষার জন্য একটি ‘ভারতীয়’ লিপি হয়ে ওঠার প্রাথমিক যুদ্ধ ছিল কৈথি আর বাভানির মধ্যে। এই যুদ্ধে বাভানি অর্থাৎ নাগরি জয়লাভ করে (‘এ ডিবেট বিটুইন অলোক রাই অ্যান্ড শাহিদ আমিন রিগার্ডিং হিন্দি’, তহেলকার ইন্টারনেট সংখ্যা, অ্যানাল অফ উর্দু স্টাডিজে সম্পাদিত ও পুনঃপ্রকাশিত, ২০০৫)
১৯৬০ এর দশকে একদিকে উত্তর ভারতে হিন্দিভাষীদের উপর ইংরাজি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে লোহিয়াপন্থী-সমাজবাদী প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত হয়,অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত তামিল নাড়ুতে একই রকম আন্দোলন দানা বাঁধে হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।
হিন্দি-ইংরাজি-তামিল ভাষা আন্দোলনের মাঝখানেই ভাষা সংক্রান্ত আরো নানারকম বিচিত্র সমস্যা উঠে আসে। ১৯৬৯ সালে যখন পাঞ্জাব থেকে আলাদা হয়ে হরিয়ানা রাজ্যটি তৈরি হয় তখন এই নবগঠিত রাজ্য তার সরকারি ভাষা হিসেবে হরিয়ানভির সঙ্গে পাঞ্জাবি রাখতে চায়নি, তাই তার দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হয় তামিল! ফলত হরিয়ানার সরকারি স্কুলে তামিল ভাষা শেখানো হয়।
অলোক রাই হিন্দি (জীবন্ত, প্রাণবন্ত, শৈল্পিক যে ভাষা সমগ্র উত্তর ভারতের কথ্য ভাষা এবং যোগাযোগের মাধ্যম) এবং ‘হিন্দি’র (বন্ধ্যা, সংস্কৃতায়িত, ফার্সি-বিবর্জিত যে ভাষা উত্তর ভারতীয় উচ্চবর্গ নিজস্বার্থে, নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখতে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করেছে) মধ্যে তফাৎ করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দ্বিতীয় ‘হিন্দি’ ই স্কুলে পড়ানো হয়ে থাকে।
‘হিন্দি’র এই আগ্রাসন কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরালা বা কর্ণাটকের পক্ষেই চিন্তার বিষয় নয়। এই সংস্কৃতায়িত, সরকারি ‘হিন্দি’ উত্তর ভারতের পড়ুয়াদের কাছেও ইংরাজির মতই এক অচেনা, বিদেশি ভাষা। অলোক রাই তাঁর ‘হিন্দি ন্যাশন্যালিজম’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন ‘স্কুলের হিন্দি’ উত্তর ভারতেও কতটা ভীতিকর। তিনি লিখছেন, “হিন্দি বলয়ে হিন্দিতে ফেল করা ছাত্র-ছাত্রীদের বিপুল সংখ্যাই এই সত্যের ভয়াবহ সাক্ষ্য বহন করে যে ‘হিন্দি’ তাঁদের থেকে তাঁদের মাতৃভাষা কেড়ে নিয়েছে”।
একটি প্রবাদ আছে, “কোস কোস পর বদলে পানি, অউর চার কোস পর বাণী” (অর্থাৎ প্রতি ক্রোশে জল বদলায়, আর চার ক্রোশে বদলায় ভাষা”। চীনের ফুজিয়ান প্রদেশে একই রকম একটি প্রবাদ প্রচলিত, “যদি তুমি ফুজিয়ানে পাঁচ মাইল গাড়ি চালিয়ে যাও, দেখবে সংস্কৃতি বদলাচ্ছে, আর দশ মাইল গেলে ভাষা যাবে বদলে”।
সরকারি ‘হিন্দি’ ভোজপুরি, মৈথিলী, মাগহি, আঙ্গিকা, বজ্জিকা, বুন্দেলি, অওয়ধি, সাঁওতালি, গোন্ডি ইত্যাদি ভাষাকে ‘উপভাষা’ হিসেবে নীচু চোখে দেখে এবং এই ভাষাগুলি যেসব ছাত্রছাত্রীর মাতৃভাষা তাঁদের অপমান করে। রাই বলেন এইসব ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘হিন্দি’ একরকমভাবে গরিব মানুষের ইংরেজির কাজ করে – ‘হিন্দি’ এক্ষেত্রে ক্ষমতা এবং সামাজিকভাবে উপরে ওঠার ভাষা।
রাই লক্ষ্য করেন যখন মৈথিলী সাহিত্য একাডেমী যেসব ভাষায় রচিত সাহিত্যকে পুরস্কার দেয় সেই তালিকায় সামিল হওয়ার দাবি জানায় তখন “হিন্দিওয়ালারা সাংঘাতিক বিচলিত হয়ে পড়েন কারণ মৈথিলী হিন্দির একটি উপভাষামাত্র এই গল্পটি বহু দশক ধরে মেনে চলা হয়েছে। কীভাবে এইসব উপভাষারা ‘মানক’ অর্থাৎ ‘মান্য’ হিন্দির গ্রাসে আসে সেই ইতিহাস যে মুহূর্তে খুলে যাবে তখনই এই সংক্রান্ত বিবাদের ইতিহাসও বাইরে বেরিয়ে আসবে। এবং এই ইতিহাসের বেরিয়ে আসা তাঁদের একেবারেই অনভিপ্রেত, তাই তো এত সাবধানে একে ঢাকা দিয়ে রাখা হয়েছিল” (‘এ ডিবেট বিটুইন অলোক রাই অ্যান্ড শাহিদ আমিন রিগার্ডিং হিন্দি’)।
রাইয়ের মতে ‘হিন্দি’ হল হিন্দির সবচেয়ে বড় শত্রু। তিনি বলেন প্রকৃত অর্থে হিন্দি পুনরুজ্জীবিত তখনই হতে পারবে যখন উত্তর ভারতের অন্যান্য ভাষা, বা তথাকথিত উপভাষাগুলির (ইংরেজিতে ‘ডায়ালেক্ট’। তবে জি এন দেবী ইংরেজিতে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ আর ‘ডায়ালেক্ট’ এর ভেদাভেদের বদলে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন বিচিত্র ভাষাকে ইংরেজিতে ‘ভাষা’ নামেই অভিহিত করেন। এই নামটি অনেক বেশি সুপ্রযুক্ত) সঙ্গে তার যোগাযোগ নতুন করে স্থাপিত হবে। এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত ঐশ্বর্যশালী, বিপুল শৈল্পিক সম্ভাবনাময়, জীবন্ত ভাষা।
অলোক রাই তাঁর বইয়ের শেষে নকশালপন্থী হিন্দিভাষী কবি ধুমিলের কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করেন। ধুমিল ১৯৬৫ সালে ‘ভাষা কি রাত’ (ভাষার রাত্রি) নামে একটি কবিতা লেখেন। রাই লক্ষ্য করেন কীভাবে ১৯৬৫ সালে উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতে যথাক্রমে ইংরেজি-বিরোধী আর হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের প্রবল মেরুকরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধুমিল এই লাইনগুলি লেখার মতো সংবেদনশীলতা খুঁজে পেয়েছিলেন –
তোমার তামিল ব্যথা
সহোদর আমার ভোজপুরী বেদনার
ভাষা সেই ফন্দিবাজ দানবের
এক গ্রাসমাত্র ...
ভাষা সংশোধনের আগে
সংশোধন করো মানুষের ...
এসো! এসো, কথা বলো তোমার চতুর্দশ মুখে!
কোন পথে এগোবো?
রাই লিখছেন “হিন্দির পক্ষে ‘রাষ্ট্র’ ভাষার মর্যাদা আলংকারিক থাকতেই বাধ্য। এক যদি না হিন্দি তার সঙ্গে মানানসই এক ‘রাষ্ট্র’ তৈরি করে নিতে পারে – যে রাষ্ট্র হিন্দু, সাবর্ণ, ব্রাহ্মণ্যবাদী, বিশুদ্ধ...” (‘হিন্দি ন্যাশন্যালিজম’)। মোদী সরকারের ছত্রছায়ায় সংঘ যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারতকে তাদের স্বপ্নের হিন্দু, সাবর্ণ, ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে। সেই কারণেই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি হিন্দি চাপাতে চাক বা না চাক, মোদী সরকার সবসময়ই চেষ্টা করবে সারা দেশে হিন্দি চালানোর তাদের পুরোনো এজেন্ডায় ঢুকে পড়ার। এই এজেন্ডা প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন অহিন্দি ভাষার নিজস্ব সত্ত্বা এবং তৎসংক্রান্ত গর্বকে তুলে ধরা অবশ্যই দরকার। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। হিন্দি আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলন যাতে তামিলনাড়ু, কেরালা বা পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামেই সীমাবদ্ধ না থাকে সেটাও জরুরী।এই আন্দোলনকে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ সংগ্রামের রূপ দিয়ে সারা ভারতে ছড়াতে হবে।একই সঙ্গে এই আন্দোলনকে পরিযায়ী শ্রমিকদের মাধ্যমে ভাষার স্বাভাবিক প্রবাহকেও স্বীকার করতে হবে (তা সে উত্তর পূর্ব বা জম্মু কাশ্মীরে বসবাসকারী বাংলা বা হিন্দিভাষী শ্রমিকরাই হোন, তামিল নাড়ু বা কর্নাটকে বসবাসকারী হিন্দিভাষী শ্রমিকরাই হোন অথবা মুম্বাই বা দিল্লি নিবাসী তামিল বা ভোজপুরিভাষী শ্রমিকরাই হোন)। এই আন্দোলনকে প্রতিটি শিশুর নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষিত হওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। দাবি জানাতে হবে যাতে উত্তর ভারতের সব স্কুলে ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে তামিল, কন্নড়, মালয়ালাম, তেলুগু বা উর্দুর মতো ভাষাগুলি থাকে। এমন একটি সংগ্রামের উচিত সমগ্র ভারতে এবং ভারতের প্রত্যেক রাজ্যে, প্রত্যেক অঞ্চলে ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, খাদ্য ইত্যাদি সবরকমের বিভিন্নতাকে আপন করে নেওয়া। হিন্দি আগ্রাসনের বিরোধিতার সঙ্গেই এই আন্দোলনের উচিত প্রবাসী শ্রমিকদের উপর হওয়া অত্যাচার বা গরুর মাংসের নামে মুসলমানদের উপর হওয়া হিংসার প্রতিরোধ করা।
-- ভাষান্তর : সিঞ্জিনী লিবারেশন জুলাই ২০১৯ সংখ্যা থেকে
- ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন
অন্তত প্রাক-প্রাথমিক স্কুলে দেশীয় ভাষায় শিক্ষার অধিকারের বিষয়ে উদারপন্থীরা প্রতিক্রিয়াশীলদের থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। কিন্তু একটি বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁদের আর প্রতিক্রিয়াশীলদের অবস্থান একেবারেই এক।
একটি বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষার মানে কী? ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর মানে দাঁড়ায় মহান রাশিয়ান, যারা সমগ্র রাশিয়ার জনসংখ্যার বিচারে সংখ্যালঘু তাদের ভাষাকে রাশিয়ার বাকি জনসংখ্যার উপর চাপিয়ে দেওয়া। প্রতিটি স্কুলে সরকারি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক হতে হবে। সমস্ত সরকারি কাজকর্ম সরকারি ভাষাতেই হতে হবে, অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ভাষায় নয়।
যারা একটি বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষার হয়ে কথা বলে তারা কীসের ভিত্তিতে এর প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে যুক্তি সাজায়?
ব্ল্যাক হান্ড্রেডদের ‘যুক্তি’ অবশ্যই সোজাসাপ্টা। তারা বলে রাশিয়ান নয় এমন সমস্ত জনগোষ্ঠিকেই লৌহশাসনে রাখতে হবে যাতে তারা “হাতের বাইরে বেরিয়ে না যায়”। রাশিয়া অবিভাজ্য আর সকলকেই মহান রাশিয়ানদের শাসনই মেনে চলতে হবে কারণ মহান রাশিয়ানরাই রাশিয়াভূমিকে গঠন করেছে এবং ঐক্যবদ্ধ করেছে। তাই শাসকশ্রেণির ভাষাকেই হতে হবে বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষা। সমস্ত ‘আঞ্চলিক ভাষাকে’ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতেও পুরিস্কেভিচদের আপত্তি নেই, যদিও রাশিয়ার সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ৬০% এই ভাষাগুলিতেই কথা বলে।
লিবারালদের আচরণ এর চেয়ে বেশি ‘সুসংস্কৃত’ এবং ‘পরিশীলিত’। তারা একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে দেশীয় ভাষার ব্যবহারের অনুমতি দেয় (যেমন প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে)। আবার একই সঙ্গে তারা বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষাকে সমর্থন করে। তা নাকি ‘সংস্কৃতি’র স্বার্থে, ‘ঐক্যবদ্ধ’ এবং ‘অবিভাজ্য’ রাশিয়ার স্বার্থে প্রয়োজন।
“রাষ্ট্রীয়তা সাংস্কৃতিক ঐক্যের স্বীকৃতি। একটি সরকারি ভাষা রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ ... রাষ্ট্রক্ষমতা প্রভুত্বকারী শক্তির ঐক্যের উপর নির্ভরশীল, সরকারি ভাষা সেই ঐক্য সাধনের অন্যতম যন্ত্র। রাষ্ট্রক্ষমতার অন্যান্য রূপের মতোই সরকারি ভাষাও একইরকম বাধ্যতামূলক তথা সর্বজনীন দমনমূলক ক্ষমতার অধিকারী...।
“রাশিয়াকে যদি ঐক্যবদ্ধ এবং অবিভাজ্য থাকতে হয় তাহলে সাহিত্যিক রাশিয়ান ভাষার রাজনৈতিক উপযোগিতার উপর আমাদের দৃঢ়তার সঙ্গে জোর দিতে হবে”।
সরকারি ভাষার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে এটাই একজন উদারপন্থীর চিরাচরিত দর্শন।
উপরের অনুচ্ছেদটি আমরা উদারপন্থী সংবাদপত্র ‘ডায়েন’ (সংখ্যা ৭)-এ প্রকাশিত শ্রীযুক্ত এস পেট্রাশকিনের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করলাম। নেহাতই সহজবোধ্য কারণে ব্ল্যাক হান্ড্রেড ‘নোভো ভ্রেমিয়া’ সংবাদপত্র এইজাতীয় মতাবলীর লেখককে অত্যন্ত পছন্দ করেছে। মেনশিকভের সংবাদপত্র (সংখ্যা ১৩৫৮৮) জানিয়েছে শ্রীযুক্ত পেট্রাশকিনের “মতামত অত্যন্ত বলিষ্ঠ”। এইরকমই ‘বলিষ্ঠ’ মতামতের জন্য আর যে সংবাদপত্রটিকে ব্ল্যাক হান্ড্রেডের দল সমানে প্রশংসা করে তা হল ন্যাশনাল-লিবারাল কাগজ ‘রাস্কায়া মিসল’। আর উদারপন্থীরা যখন তাঁদের নানান ‘সুসংস্কৃত’ তর্কের সাহায্যে ঠিক সেই জিনিসগুলির সপক্ষেই কথা বলেন যেগুলি ‘নোভো ভ্রেমিয়া’র লোকেদের অত্যন্ত প্রিয় তখন তাঁরা প্রশংসা না করে কোথায়ই বা যান?
উদারপন্থীরা আমাদের বলেন রাশিয়ান একটি মহৎ ও শক্তিশালী ভাষা। তোমরা কি চাওনা রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষরাও এই মহৎ ও শক্তিশালী ভাষা জানুক? তোমরা দেখতে পাওনা রাশিয়ান ভাষা অ-রাশিয়ানদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সম্পদ নিয়ে আসবে তাদের হাতের মুঠোয়? এমনই কত কিছু।
উত্তরে আমরা এইসব উদারপন্থীদের বলি, ভদ্রমহোদয়রা, এ সবই ঠিক কথা। তুর্গেনিভ, টলস্টয়, দোব্রোল্যুবভ আর চেরনিশেভস্কির ভাষা যে মহৎ ও শক্তিশালী তা আমরা আপনাদের চেয়ে ভালো জানি। রাশিয়ায় বসবাসকারী সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর নিপীড়িত শ্রেণির মধ্যে কোনোরকম ভেদাভেদ ছাড়াই নিকটতম যোগাযোগ আর সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হোক এই আশা আপনাদের চেয়েও বেশি করে রাখি আমরা। এবং আমরা অবশ্যই চাই রাশিয়ায় বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ এই মহান রাশিয়ান ভাষা শেখার সুযোগ পাক।
আমরা যা চাই না তা হোলো জবরদস্তি। আমরা চাই না কোদালের গুঁতোয় মানুষকে স্বর্গে পাঠানো হোক। ‘সংস্কৃতি’ সম্পর্কিত যত ভালো ভালো বুলিই আওড়ান না কেন একটা বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষার মধ্যে জবরদস্তি লুকিয়ে আছে, লুকিয়ে আছে কোদালের গুঁতো। আমরা মনে করি না মহৎ ও শক্তিশালী রাশিয়ান ভাষার প্রয়োজন আছে জোর করে কাউকে এই ভাষা শেখানোর। আমরা বিশ্বাস করি রাশিয়ায় ধনতন্ত্রের বিকাশ এবং সাধারণভাবে তার সমাজ জীবনের ধারা সমস্ত জাতিগোষ্ঠীকে কাছাকাছি আনছে। হাজার হাজার মানুষ রাশিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত করছেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করছে। নিজেকে বিশিষ্ট ভাবার প্রবণতা এবং জাতীয় গোঁড়ামি নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য। যেসব মানুষের পক্ষে জীবনযাপন বা পেশাগত কারণে রাশিয়ান শেখা প্রয়োজন তাঁদের বাধ্য না করা হলেও তাঁরা রাশিয়ান শিখবেন। কিন্তু জোর (অর্থাৎ সেই কোদাল) করার একমাত্র পরিণাম — তা মহৎ ও শক্তিশালী রাশিয়ান ভাষাকে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়াতে বাধা দেবে। সবচেয়ে বড় কথা হোলো এর ফলে বিরুদ্ধতা তীক্ষ্ণ হবে, নতুন নতুন সংঘাত তৈরি হবে, বিদ্বেষ বাড়বে, পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি বাড়বে।
কারা এমন চায়? রাশিয়ার মানুষ চাননা, রাশিয়ার গণতান্ত্রিকরা চাননা। তার জাতিগত নিপীড়নকে কোনো রূপেই স্বীকার করেন না, এমনকি “রাশিয়ার সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রের স্বার্থেও” নয়।
সেই কারণেই রাশিয়ান মার্ক্সবাদীরা বলেন কোনো বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষাই চলবে না। জনগণকে এমন স্কুল দিতে হবে যেখানে সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় পঠনপাঠন চলবে। সংবিধানে এমন মৌলিক আইন আনতে হবে যাতে কোনো নির্দিষ্ট জাতির সমস্ত বিশেষ সুযোগসুবিধা এবং দেশের অল্পসংখ্যকদের অধিকার লঙ্ঘন বেআইনি ঘোষিত হবে।