২০২৪ এর মধ্যে ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে ৫ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ফেরি করে দেশের প্রায় ৪০ কোটি শ্রমজীবী, সম্পদসৃষ্টিকারী মানুষের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করল মোদী-২ সরকার। গত ১০ জুলাই, কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রী সন্তোষ কুমার গাঙ্গওয়ার এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করলেন যে, সারা দেশের জন্য নতুন ফ্লোর লেভেল ন্যুনতম মজুরির হার হবে দৈনিক ১৭৮.০০ টাকা — যা সারা মাসে দাঁড়ায় ৪,৬২৮.০০ টাকা।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে অনুপ সথপতির নেতৃত্বে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে এই শ্রমমন্ত্রীই গঠন করেন এক বিশেষজ্ঞ কমিটি, যার দায়িত্ব ছিল জাতীয় স্তরে ন্যুনতম মজুরির হার নির্ধারণ করা। ২০১৯-এর জানুয়ারি মাসে, ওই কমিটি তার সুপারিশ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জমা দেয়। সমস্ত প্রচলিত মানদন্ড, যেমন, দৈনিক ২,৭০০ কিলো ক্যালোরির ন্যুনতম খাদ্যগ্রহণের মাপকাঠিকে কমিয়ে ২,৪০০ কিলো ক্যালোরির ভিত্তিতে এবং তার সাথে নানা কারসাজি করে ওই কমিটি জাতীয় ন্যুনতম মজুরির হার স্থির করে দৈনিক ৩৭৫-৪৪৭ টাকা অর্থাৎ, মাসিক ৯,৭৫০- ১১,৬২২ টাকা। কিন্তু নিজেরই তৈরি করা কমিটির রিপোর্টথেকেও মোদী সরকার জাতীয় স্তরে ন্যুনতম মজুরির হার নির্ধারণ করল অনেকটা নীচে নেমে।
শুধু তাই নয়, দু বছর আগে যে মজুরির হার ঘোষিত হয়, বর্তমানের হার তার থেকে মাত্র দু-টাকা বেশি। অর্থাৎ, দু-বছরে মাত্র এক শতাংশ বৃদ্ধি! গত দু বছরে মূল্যস্ফীতির হার থেকেও কম। আসলে, এটা প্রকৃত মজুরির হারে অবক্ষয় ঘটানো ছাড়া আর কিছুই নয়।
মনে রাখা দরকার, জাতীয় স্তরে ফ্লোর লেভেল ন্যুনতম মজুরি ঘোষিত হয় বিধিবদ্ধ যে স্ট্যাটুটারি মিনিমাম ওয়েজ অ্যাডভাইজারী বোর্ড রয়েছে, তার বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। কিন্তু, এবারে কোনো ধরনের বৈঠক ছাড়াই শ্রমমন্ত্রী তার মর্জিমাফিক এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ২০১৬ সালে সপ্তম বেতন কমিশন ন্যুনতম মজুরির যে হার ঘোষণা করে, মাননীয় শ্রমমন্ত্রীর ঘোষিত হার তার থেকে এক চতুর্থাংশ কম। ১৫তম জাতীয় শ্রম সম্মেলন ১৮,০০০টাকা ন্যুনতম মজুরির হার ঘোষণা করে, এবং পরবর্তীতে, ৪৪-৪৫-৪৬তম জাতীয় শ্রম সম্মেলনগুলি ও সেটাকেই মান্যতা দেয়। ১৯৯২ সালে, সুপ্রিম কোর্টতার বিখ্যাত রেপ্টাকস এণ্ড ব্রেট মামলায় যে রায় দেয় তার উপর ন্যুনতম মজুরি হয় ১৮,০০০ টাকা। এ সবই বহু আলোচিত, প্রতিষ্ঠিত তথ্য। কিন্তু, সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান, শীর্ষ আদালতের রায়কে অগ্রাহ্য করে শ্রমমন্ত্রী তা ঘোষণা করলেন তা নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানে ৩১টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ন্যুনতম মজুরির যে হার চালু রয়েছে, তা শ্রমমন্ত্রীর ঘোষিত হার থেকে অনেকটাই বেশি।
জাতীয় স্তরের ফ্লোর লেভেল ন্যুনতম মজুরি সর্বত্র রূপায়ণ করা কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়। এটা হল একটা ঘোষিত স্তর, যার নীচে কোনো রাজ্যে মজুরির হার বজায় রাখাটা কাম্য নয়। সংবিধানে শ্রম বিষয়ক ক্ষেত্রটি রয়েছে যুগ্ম তালিকায়, তাই প্রধানত রাজ্যগুলিই ন্যুনতম মজুরি নির্দ্ধারণ করে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকার তার কর্মীবাহিনীর জন্য বিভিন্ন স্তরের মজুরি স্থির করে থাকে। আইন অনুযায়ী সরকারগুলো বিধিবদ্ধ পেশা বা এমপ্লয়মেন্টের জন্য ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ করে থাকে আর তালিকাভুক্ত বিধিবদ্ধ পেশাগুলোর সংখ্যা কমপক্ষে ১,৬০০।
ইতিমধ্যে, গত ৩ জুলাই, মোদী-২ ক্যাবিনেট মজুরি কোডকে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করে সংসদে পেশ করল। মোট চারটি কোড এর মধ্যে এটাই প্রথম যা এখন সংসদের অধিবেশনে আলাপ আলোচনার জন্য অপেক্ষারত। বর্তমানের চারটি আইন — পেমেন্ট অফ ওয়েজেস অ্যাক্ট, ১৯৩৬-মিনিমাম ওয়েজেস অ্যাক্ট, ১৯৪৮, পেমেন্ট অফ বোনাস অ্যাক্ট, ১৯৬৫, আর সম মজুরি আইন, ১৯৭৬ — এগুলোকে একত্র করে তৈরি করা হল “লেবার কোড অফ ওয়েজেস’’। এই নতুন কোড “বিধিবদ্ধ” পেশার এতদিনকার ধারণাটিকে পুরোপুরি বাতিল করল। এতদিন পর্যন্ত বিধিবদ্ধ পেশাগুলো শ্রম কানুনের আওতায় থাকতো। কিন্তু নতুন কোডে বিধিবদ্ধ পেশার জন্য ন্যুনতম মজুরি নয়, সমস্ত সংগঠিত অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য মজুরি নির্দ্ধারিত হবে। আর পাশাপাশি, জাতীয় স্তরে একই ফ্লোর লেভেল ন্যুনতম মজুরি নয়, কয়েকটি স্তরে মজুরিকে নির্ধারণ করবে এই ওয়েজ কোড। মূলত তিনটি স্তরে মজুরি থাকবে — জাতীয় ন্যুনতম মজুরি, বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলগুলোর জন্য আলাদা আলাদা ন্যুনতম মজুরি, আর, রাজ্যস্তরে ন্যুনতম মজুরি। এইভাবে জাতীয় স্তরে ন্যুনতম মজুরির ধারণাটিকেই এক তামাশায় পরিণত করা হল। কোড এর মতে, এ সব ক্ষেত্রে একটা নীতি মেনে চলতে হবে, আর তা হল, কোনো অবস্থাতেই রাজ্য স্তরের ন্যুনতম মজুরি কেন্দ্রের স্থির করা জাতীয় ন্যুনতম মজুরির কম হবে না। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে অ্যাডভাইজরি বোর্ডথাকলেও ন্যুনতম মজুরি নির্দ্ধারণের ক্ষেত্রে এই বোর্ডের সুপারিশ কখনোই বাধ্যতামূলক থাকবে না। বিভিন্ন রাজ্য তার নিজের মতন করে ন্যুনতম মজুরি স্থির করার স্বাধীনতা পাবে, আর এর ফলে, শিল্পকে নিজ রাজ্যে টানতে, পুঁজিকে আকর্ষণ করতে ন্যুনতম মজুরির হার কম রাখার এক অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। আরেকটা বিষয় হল, ন্যুনতম মজুরির হার নির্ধারণ করার কোনো নীতিগত অবস্থান এই কোড ঘোষণা করল না — জাতীয় শ্রম কমিশন,সপ্তম বেতন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টযা বারংবার প্রতিষ্ঠা করেছে। কোড শুধুমাত্র জানিয়েছে যে, বেসিক ও মহার্ঘ ভাতার নিরীখে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। আর এটা নির্ধারিত হবে, দক্ষতা-কর্মক্ষেত্র কতটা শ্রমসাধ্য আর ভৌগলিক বিশিষ্টতা অনুযায়ী। মজুরির পরিমাণ এক এবং একমাত্র সরকারের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিতে হবে। আর এ প্রশ্নে, ওয়েজ কোড সরকারের মনোনীত প্রশাসক বা আমলাকুলের উপর ঢালাও অধিকার দিয়েছে।
সমমজুরি আইন বা ইকুয়্যাল রেমুনারেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৬, এর মাত্র একটা ধারাকে যুক্ত করা হয়েছে, যে ধারাটি “বেতনের প্রশ্নে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যকে নিষিদ্ধ’’ করেছে। কিন্তু, সেই ধারাটি লঙ্ঘিত হলে জরিমানা সহ যে সমস্ত শাস্তি বিধৃত ছিল তা বাতিল করেছে নতুন এই কোড। আগে ন্যুনতম মজুরির অ্যাডভাইজরি বোর্ডে ৫০% মহিলা রাখার সুযোগ ছিল। এখন তা কমিয়ে এক তৃতীয়াংশ করা হয়েছে। এই বিলে এমন মারাত্বক শর্ত রয়েছে যে একদিনের ধর্মঘট বে আইনি ঘোষিত হলে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী শ্রমিকের ৮ দিনের বেতন কেটে নেওয়া হবে।
২০১৭ জুলাই থেকে ২০১৮-এর জুনের মাঝখানে এনএসএসও এক লক্ষ পরিবারের মধ্যে একটা সমীক্ষা চালায় যার শিরোনাম “পিরিওডিক লেবার ফোর্স” সার্ভে। এই রিপোর্টে উঠে এসেছে, কী নিদারুণ আর্থিক অনটনের মধ্যে বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ দিন গুজরান করছেন। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের ও বেশি নির্ধারিত মজুরি তুলনায় অনেক কম পাচ্ছেন, ৭১% এর নেই কোনো কাগজে-কলমে কাজের শর্তাবলী, ৫৪% পান না কোনো ছুটি। এবারের আর্থিক সমীক্ষাও দেখাতে বাধ্য হয়েছে যে বিগত দিনের আর্থিক বৃদ্ধি দেশের শ্রমজীবী মানুষের আয় বাড়াতে পারেনি। ক্রমাগত বেড়ে চলা আর্থিক বৈষম্য ঠেকাতে, ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে আর্থিক সমীক্ষা ন্যুনতম মজুরি বৃদ্ধির দিকে সরকারকে নজর ফেরাতে বলেছে।
কিন্তু মোদী সরকার সবকিছুকেই দু পায়ে মাড়িয়ে কর্পোরেটদের স্বার্থে নামিয়েছে নজীরবিহীন আক্রমণ। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশের সর্বস্তরের নাগরিক আজ ফ্যাসিবাদি স্টীম রোলারের চাকায় পিষ্ট হচ্ছেন। এর বিরুদ্ধে, আবার নতুন করে প্রত্যাঘাত হানার সময় এসেছে।