ওরা পারবে কি ভোলাতে কৃষকের জীবন-জীবিকার প্রশ্নগুলি?

সব জিনিসের দাম বাড়ে, কিন্তু কৃষকের ফসলের দাম বাড়ে না। ভোটের আগে শাসকেরা নতুন নতুন লম্বা চওড়া বুলি আউড়ে যান। মোদী সরকার “কিষাণ সন্মান নিধি”-র মধ্য দিয়ে চাষিদের উন্নতির স্বপ্ন ফেরি করেন। রাজ্যের তৃণমূল সরকার “কৃষক বন্ধু” প্রকল্পে চাষির প্রভূত সহায়তা হবে বলে ঢাক পেটায়, কিন্তু কৃষি ও কৃষকের সংকট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত মূল্যবৃদ্ধির এক সরকারী তথ্যে এ সত্য উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে শহরাঞ্চলে মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া, বৃদ্ধির হার ৫.৬ শতাংশ। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের ছবিটা একটু ভিন্ন। সেখানে মূল্যবৃদ্ধির হার ০.৩০ শতাংশ। এতেই প্রমাণিত হয় যে, গ্রামে চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, অথচ শহরে সেই শস্য বিক্রি হচ্ছে বহুগুন দামে। মুনাফা লুঠছে মধ্যসত্বভোগীরা। কেউ কেউ বলবেন এটাই নাকি বাজারের নিয়ম! সেটা না হয় বোঝা গেলো, কিন্তু চাষিদের স্বার্থরক্ষায় সরকারের ভূমিকা কি? সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করবে, এবং সেটা করার সময় উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দাম কড়ায় গন্ডায় হিসেব করবে — বড় গলা করে মোদীবাবু এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটলো কি? এ বছর ধানের সহায়ক মূল্য বাড়ানো হলো কুইন্টালে মাত্র ৬৫ টাকা। অথচ কৃষিবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সমস্ত মহল থেকেই চাষের খরচের হিসেব কষে দাবি জানানো হয়েছিল, ধানের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দেড়গুণ সহায়ক মূল্য হয় কুইন্টাল প্রতি ২৩৫০ টাকা। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণায় সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি করা হলো যৎসামান্য! গত বছর ধানের সরকারী সংগ্রহ মূল্য ছিলো ১৭৫০ টাকা। এ বছর হলো ১৮৫০ টাকা।

এদিকে বর্তমানে পাট চাষিরা চরম আশংকার মধ্যে রয়েছেন। প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে পাটের ফলন এ বছর ভালো পরিমানে কমে যাবে! সরকারী ঘোষণায় পাটের সরকারী সহায়ক মূল্য কুইন্টাল পিছু ৩৭০০ টাকা থেকে বেড়ে হলো ৩৯৫০ টাকা। অথচ ১ কুইন্টাল পাট উৎপাদনের খরচ কমপক্ষে ৪২০০-৪৫০০ টাকা। তাই দাবি উঠেছে সরকারকে ৬০০০ টাকা কুইন্টাল দরে পাট কিনতে হবে। এরকম পরিস্থিতিতে মোদী সরকারের তথাকথিত সহায়ক মূল্যের বৃদ্ধিকে “কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে” ছাড়া আর কিইবা বলা যায়! আজ দিকে দিকে বিজেপি সরকারের কাছে এর জবাব চাইছে গ্রামের ব্যাপক কৃষক জনগণ। প্রবল খরা জনিত আবহাওয়া, চাষের খরচ বেড়ে যাওয়া এবং পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ বছর কৃষিতে চাষাবাদের জমির পরিমাণ কমে গেছে। সরকারী তথ্য জানাচ্ছে, বিগত মরসুমে ১৬২.০৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছিল এ বছর সেটা কমে হয়েছে ১৪৬.৬১ লক্ষ হেক্টর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকারী ঘোষণা যাই হোক না কেন, চাষিরা সেই দাম আদৌ পায় না। সরকারী উদ্যোগে ধান পাট কেনার যে ব্যাবসা করা হয়ে থাকে সেখানেও আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে সরকারের মদতপুষ্ট “ফড়ে-দালাল রাজ”। নানান আইন কানুন-নিয়ম বিধির বেড়া ডিঙ্গিয়ে ব্লকের কিষাণ মান্ডিতে পৌছে সরকারের ঘরে ফসল বিক্রি করছে হাতে গোনা খুবই স্বল্পসংখ্যক চাষি। ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিরা, বাবুদের জমি ভাগে করা ব্যাপক পরিমাণ চাষিরা—যাদের শ্রমে-ঘামে আজকাল গ্রামাঞ্চলের অর্ধেকের বেশি পরিমাণ জমিতে চাষাবাদ চলছে, তাঁরা থেকে যাচ্ছেন চরম বঞ্চিত শোষিত। মহাজনী ঋণের ফাঁদে আষ্টেপিষ্টে বাঁধা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুক্তি চাষের মধ্য দিয়ে বিশাল পরিমান সংখ্যায় এরা হয়ে উঠেছে এক ধরনের মরশুমী ভিত্তিক বাঁধা কিষাণ। এদের জন্য কোনো আইন নেই, সরকারের কোনো প্রকল্প নেই। এই পরিপ্রক্ষিতে দাবি উঠেছে, যারা প্রকৃত চাষ করে এমন ধরনের সমস্ত কৃষকদের থেকে সরকারী দরে ফসল কিনতে হবে। এ জন্য গ্রামে ক্যাম্প করতে হবে। ফড়ে দালালদের থেকে ফসল কেনার সরকারী বন্দোবস্ত বন্ধ করতে হবে। ফসল কেনার সঙ্গে সঙ্গে দাম দিতে হবে।

ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে, ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ঠিক কতজন কৃষক আত্মহত্যা করছে? মোদী সরকারের কাছ থেকে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আজ আর পাওয়া যাবে না। এ জাতীয় “অস্বস্তিকর” তথ্য এখন সরকার বেমালুম চেপে দিতে চাইছে। কারণ কৃষকের লং মার্চ, রক্ত ঝড়ছে পা থেকে — তবুও লক্ষ লক্ষ কৃষক সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করছে — নাগরিক সমাজ তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে — এ ছবি ওদের কাছে চরম দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়েছে। কিন্তু জাতীয়তাবাদের শাক দিয়ে কৃষি ও কৃষক সংকটের মাছ কতদিন আর ঢেকে রাখা যাবে! ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী কৃষক আত্মহত্যার কোনে সরকারী তথ্য এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা প্রকাশ করা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও সংবাদ মাধ্যমে এই খবর লাগাতার উঠে আসছে। মোদী সরকারের তথাকথিত “কৃষক সম্মান নিধি” আইনী কাগজপত্র না থাকায় সিংহভাগ কৃষকের নাগালের বাইরেই থেকে যাচ্ছে, তা কৃষকের প্রতি চরম অসম্মান বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। রাজ্য সরকারের বহুল বিজ্ঞাপিত “কৃষক বন্ধু-র গালভরা প্রতিশ্রুতি বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিদের জন্য খুবই যৎসামান্য আর্থিক সহায়তা! একরে মাত্র আড়াই হাজার টাকা। সেই অনুপাতে স্বল্প পরিমান জমিতে চাষ করা ব্যাপক কৃষকের ভাগে জুটবে কতটুকু, সহজেই অনুমেয়। ফলে এটা ছুঁড়ে দেওয়া রুটির টুকরো বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে। তাই জমে উঠছে গণক্ষোভ, মুখোশ খসে পড়ছে শাসকের। কৃষকের অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের জমি তৈরি হয়ে চলেছে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, বিভাজন আর বিভেদের ছলনায় ওরা পারবে না ভোলাতে কৃষকের জীবন-জীবিকার প্রশ্নগুলিকে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-22