২০১৯ লোকসভা নির্বাচন : বিত্ত, বৈভব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক জগৎ

একটার পর একটা নির্বাচন যাচ্ছে আর ক্রমশ তা কোটিপতি কেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। সাধারণ মানুষ বা ছোট দলগুলির নির্বাচন লড়া প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়ছে । আর লড়লেও জেতার কোনো সম্ভাবনা থাকছে না, হারজিত কয়েকটি অর্থবান ও কর্পোরেট অনুদান প্রাপ্ত দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে । মিলিওনার, বিলিওনার প্রাথী বা পার্টিগুলির সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতাতেই সাধারণ প্রার্থী বা দলগুলির এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। একজন প্রার্থীর পয়সা খরচের সীমা নামেই দেওয়া আছে, প্রচারে তারা খরচ করে অনেক বেশি। সাধারণ ছোট দলের প্রার্থীরা সংবাদ মাধ্যমে প্রচারও পায় না, আবার পয়সা খরচ করে টিভি বা খবরের কাগজেও বিজ্ঞাপন দিতে পারে না। তাই ভারতবর্ষের নির্বাচনে যোগ্য জনপ্রতিনিধি জেতে না। জেতে অর্থ, বৈভব, প্রচারের জাঁকজমক। নরেন্দ্র মোদী শুধু রোড শো-তে হাঁটবেন বলে ১.৪ লক্ষ লিটার জল দিয়ে রাস্তা ধোয়া হয়, আর সিপিআই(এমএল)-এর রাজু যাদবের প্রচারের জন্যে হন্যে হয়ে অর্থের খোঁজ করতে হয়। ২০১৯ লোকসভা ভোটে এই বিষয়টির গুরুতর প্রতিফলন হয়েছে।

India Today Data Intelligence Unit-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী প্রার্থীদের পেশ করা হলফনামা থেকে দেখা যাচ্ছে ২০১৯ লোকসভা ভোটে শতকরা ৩০% প্রার্থী এক কোটি টাকার বেশি সম্পদের অধিকারী । বিজেপি সবচেয়ে বেশি কোটিপতি প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। তার সংখ্যা ৩৬৩ জন। তারপর কংগ্রেস, ৩৪৯ জন কোটিপতি তাদের প্রার্থী । মায়াবতীর বিএসপিএর কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা ১২৯। এই দলটি যে অভিজাত দলিত শ্রেণীর প্রতিনিধি, এখান থেকেই তা স্পষ্ট। বিহারের পাটলিপুত্র কেন্দ্র থেকে মনোনীত নির্দল প্রার্থী রমেশ কুমার শর্মা এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে ধনী, তার সম্পত্তির পরিমান ১১০৭ কোটি টাকা।

ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকা থালা রাজা গোপালাচারীর প্রতিষ্ঠিত স্বতন্ত্র পার্টিকে অর্থনৈতিক ভাবে শুকিয়ে দিতে ১৯৬৯ সালে কর্পোরেট ফান্ডিং-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল তৎকালীন ইন্দিরা সরকার। ১৯৮৫ সালে রাজীব সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তারপর থেকে ক্রমশ ভারতবর্ষের সমগ্র রাজনীতিকে কর্পোরেটরা কব্জা করে ফেলে। ২০১৩ সালে আইন বদল করা হয়। বিগত তিন বছরের নীট লাভের ৫% ছিল কর্পোরেট অনুদানের সর্বোচ্চ সীমা, তাকে বাড়িয়ে ৭.৫% করা হয়। ২০১৭ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার “কোম্পানি এক্ট ২০১৩ সেকশন ১৮২’’-কে সংশোধন করে সেই সীমাটাও তুলে দেয়। তারা আরো যেটা করে বিদেশী কোম্পানিগুলি যাতে রাজনৈতিক দলগুলিকে অনুদান দিতে পারে সেই জন্যে ২০১৮ সালের ফিনান্স বিলের মাধ্যমে “ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেগুলেশন এক্ট, ২০১০”-এর সংশোধন করে বিদেশী কোম্পানিগুলিকে ভারতে রেজিস্ট্রি করতে অনুমোদন করে।

২০১৭-১৮ অর্থবর্ষেবিজেপি অজানা উৎস থেকে আয় হিসাবে ৫৫৩.৩৮ কোটি টাকা ঘোষণা করেছে, যা জাতীয় দলগুলির মোট আয় ৬৮৯.৪৪ কোটি টাকার ৮০ শতাংশ। সবচেয়ে বড়ো ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট প্রুডেন্ট ইলেক্টোরাল ট্রাস্টে ২০১৪ এর তৈরি হওয়া থেকে এ পর্যন্ত বিজেপি একাউন্টে অজানা দাতাদের মাধ্যমে ৭২৬.১৭ কোটি টাকা জমা পড়েছে।

২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের খরচ ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ এই অংককে অনায়াসে টপকে যাবে। নির্বাচনের সময় প্রচার অর্থায়ন বা campaign funding ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে নগদ অর্থের এক বৃহৎ কিন্তু ঝাপসা প্রবাহ, যা দেশের বিস্ময়কর দুর্নীতির উৎস, কিন্তু এই উৎসে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব। ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট ও সাম্প্রতিক প্রবর্তিত ইলেক্টোরাল বন্ড শাসক রাজনৈতিক দলগুলির সম্পত্তি যত বাড়িয়েছে, ছোট দলগুলি লড়াই থেকে তত পেছনে সরে গেছে । ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন সর্বকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং কর্পোরেট প্রভাবাধীন নির্বাচন। এই কর্পোরেট অনুদান শাসক দলগুলির সঙ্গে অন্যদলগুলির লড়াইতে এক অলঙ্ঘ্য অসমতা তৈরি করেছে।

সৌজন্যে : ইন্ডিয়া টুডে, এসোসিয়েশন অফ ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম, স্ক্রল.ইন, অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বিজনেস টুডে

খণ্ড-26
সংখ্যা-14