তৃণমূল স্তরে জনগণের মোহভঙ্গ, ক্রোধ এবং পরিবর্তনের যে আকাঙ্খা তীব্রতর হচ্ছিল, কিছুদিন আগে ২০১৮-র শেষ দিকে অনুষ্ঠিত প্রথাগতভাবে বিজেপির শক্তিশালী রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনে যা সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছিল, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল তাকে সম্পূর্ণরূপে খারিজ করে দিয়েছে। মোদী সরকার ২০১৪-র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে, প্রশাসনিকতার প্রতিটি ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয়কর ফলাফল নিয়ে আসে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং নীতিমালাকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং এই জমানার নিত্যদিনের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে হিংসা, ঘৃণা এবং মিথ্যাচার। গোটা দেশ এটাই ধরে নিয়েছিল যে, এই সমস্ত কিছুর জন্য মোদী সরকার কঠিন নির্বাচনী পরীক্ষার মুখে পড়বে। কিন্তু পুলওয়ামায় ঘটল সিআরপিএফ জওয়ানদের উপর আত্মঘাতী বোমার হামলা এবং তার পরপরই নির্বাচনের ঠিক আগে বালাকোটে চালানো হল বিমান আক্রমণ। ফলে মোদী সরকার পাকিস্তানকে তার নিজের মাটিতেই শিক্ষা দেওয়ার মত উগ্র-জাতীয়তাবাদী সংলাপ শুরুর সুযোগ পেয়ে গেল এবং মূল ধারার প্রচার মাধ্যমগুলির যে সিংহভাগই নিজেদের মোদী জমানার প্রচার যন্ত্রে পর্যবসিত করেছিল, তারা উগ্র-জাতীয়তাবাদী প্রচারের বন্যা বওয়াতে লাগল।
অপদার্থ এবং বিপর্যয়কর এক জমানার বিচারের যথার্থ প্রতিফলন হওয়ার পরিবর্তে এই নির্বাচন দেখিয়ে দিল, মোদী জমানায় ভারতের নির্বাচনী রাজনীতির বুনিয়াদি বিষয়গুলোতে কতটা পরিবর্তন ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে। মোদী সরকার ব্যাপকতম স্তরে অঘোষিত জরুরী অবস্থার জমানা রূপেই স্বীকৃত হয়েছে। অতএব মনে করা হয়েছিল যে, ২০১৯-এর নির্বাচনও ১৯৭৭-র জলবিভাজিকা নির্বাচনেরই সমগোত্রীয় হবে, যে নির্বাচনে বলতে গেলে গোটা অ-বাম কংগ্রেস-বিরোধী বিরোধী পক্ষ ইন্দিরা গান্ধির স্বৈরাচারী জমানার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং দক্ষিণের রাজ্যগুলো ছাড়া অন্য সব রাজ্যে কংগ্রেসের বিপুল পরাজয় ঘটেছিল। কিন্তু আমরা যেটা প্রায়শই ভুলে ছিলাম তা হল, ১৯৭৭-র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল জরুরী অবস্থা তুলে নেওয়ার পর আর ২০১৯-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল স্বৈরাচারের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতির ছায়াতেই। ভারতের নির্বাচন কমিশন যেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করল তা বুনিয়াদি এই পরিস্থিতিটাকেই নির্মমভাবে মনে পড়িয়ে দিল, প্রতিদিনই যার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়েছিল।
মোদী নিজে এবং বিজেপির অন্যান্য বরিষ্ঠ নেতারা আদর্শ নির্বাচনী বিধিকে ছিন্নভিন্ন করেন এবং প্রতিটি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তাদের ক্লিন চিট দিতে থাকে। বেশ কিছু লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে অভিযোগগুলিকে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ফেলে রাখা হয় এবং নির্বাচন শেষ হওয়ার পরই বিধিভঙ্গকারী নেতাদের কাছে নোটিশ পাঠানো হয়। তাঁর বিরোধী মতকে নথিবদ্ধ করার গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি অবিচল থেকে এক নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন কমিশনের বৈঠকগুলি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন। সন্দেহজনক নির্বাচনী বণ্ড প্রকল্প থেকে শুরু করে ইভিএম সম্পর্কেক্রমবর্ধমান সংশয় এবং ভিভি প্যাটগুলি গুণতে অনমনীয়ভাবে অস্বীকার করে চলা এবং নির্বাচনের অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া সম্পর্কে জনগণকে আশ্বস্ত করার ব্যাপারে ভারতের নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা, এ সবকিছু নিয়ে গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং ন্যায্যতা সম্পর্কেও গুরুতর প্রশ্ন রয়ে গেছে।
মোদী ২০১৯-এর নির্বাচনে যে প্রচার চালান তা ছিল ২০১৪-র নির্বাচনী প্রচারের সম্পূর্ণবিপরীত। ২০১৪-র নির্বাচনে মোদী নিজেকে উন্নয়ন গুরু হিসেবে বিকিয়ে ছিলেন, বিদেশী ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকা ফিরিয়ে আনা এবং মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে ‘আচ্ছে দিন’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কালো টাকা খর্ব করার নামে সরকার বিমুদ্রাকরণের মত বিপর্যয়কর পদক্ষেপই নিতে পেরেছিল, যেটা ছিল ভারতে স্বেচ্ছাচারীভাবে গৃহীত অবিমৃষ্যকারী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলির অন্যতম, যা অর্থনীতিতে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটিয়ে সর্বস্তরে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান ও জীবিকা ধ্বংস করেছিল। পেটোয়া পুঁজিবাদ অভূতপূর্বমাত্রা অর্জন করে এবং আম্বানি ভাইয়েরা ও আদানি গোষ্ঠী একের পর এক লোভনীয় বরাত হাতাতে থাকে। কৃষি সংকট গভীরতর হয়ে উঠে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং কৃষকদের উপর বিক্ষোভকারী বিজেপি সরকারগুলির গুলিচালনার ফলে কৃষক সংগঠনগুলি দেশব্যাপী এক ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তুলে ঋণ মুকুব এবং ফসলের লাভজনক দামের দাবিতে শক্তিশালী আন্দোলনের বিকাশ ঘটায়। বেকারি পাঁচ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোয় কর্মহীন যুবকরা এবং তার সাথে নিরাপত্তাহীন ও নগণ্য মজুরির শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে মোটামুটি ভালো কাজ ও জীবনধারণের পক্ষে ন্যূনতম মজুরির জন্য লড়াই করতে থাকেন। ২০১৯-এর নির্বাচনে তাঁর প্রচারে মোদী লক্ষণীয়ভাবে এই সমস্ত ইস্যুতে নীরব থাকেন এবং তাঁর প্রচার সাম্প্রদায়িক ঘৃণাবাজি এবং যুদ্ধবাজ উগ্র-জাতীয়তাবাদ সর্বস্ব হয়ে ওঠে। সন্ত্রাসে অভিযুক্ত বিচারাধীন প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে ভুপাল কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী করা এবং হেমন্ত কারকারে সম্পর্কে অপমানজনক এবং নাথুরাম গডসের মহিমা কীর্তন করা তাঁর মন্তব্যের মধ্যে এই নির্লজ্জ ঘৃণা-চালিত প্রচার মূর্ত হয়ে ওঠে।
প্রদত্ত ভোটের আরো বেশি অংশ এবং আরো বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় নরেন্দ্র মোদীর প্রত্যাবর্তন ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের কাছে অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ খাড়া করছে। তাদের জমানার প্রথম পর্বে মোদী সরকার সংবিধান এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের বুনিয়াদ স্বরূপ বিদ্যমান সমস্ত ধরনের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং গণতান্ত্রিক নীতিমালার ওপর প্রণালীবদ্ধ আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। সি বি আই থেকে আর বি আই থেকে সুপ্রিম কোর্ট এবং ভারতের নির্বাচন কমিশন— হেন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ভিন্ন মত পোষণকে স্তব্ধ করা এবং যৌথ ও গণতান্ত্রিক কার্যধারাকে বরবাদ করা হয়নি। মোদীর এই দ্বিতীয় পর্বে এই ধারায় রাষ্ট্রকে নতুন করে ফ্যাসিবাদী ছাঁচে ঢালা থেকে আটকানোটা এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। তথাকথিত প্রান্তিক শক্তিগুলো দীর্ঘদীন ধরেই সংঘ-বিেজপির নকশার কেন্দ্রে রয়েছে। মোদী সরকারের দ্বিতীয় পর্ব এই শক্তিগুলোকে চূড়ান্ত রূপে স্পর্ধিত করে তুলবে। সংসদে বিরোধী পরিসর প্রধানত রয়েছে আঞ্চলিক দলগুলোর দখলে, এদের অধিকাংশের উপরই এখন প্রবল চাপ দেওয়া হবে মোদী সরকারের পশ্চাদমুখী নীতিসমূহ এবং স্বৈরাচারী পদক্ষেপগুলোকে মেনে নেওয়ার জন্য। বিরোধী- পরিচালিত কয়েকটি রাজ্য সরকার অবিলম্বে অবধারতিভাবেই পতনের বিপদের মুখোমুখি হবে। তামিলনাড়ু, কেরল এবং অন্ধ্রপ্রদেশ — দক্ষিণের এই রাজ্যগুলো এখনও পর্যন্ত বিজেপির সর্বগামী উপস্থিতি থেকে তুলনামূলকভাবে মুক্ত এবং সংসদে বামেদের উপস্থিতি — যা সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে কম — এখন থাকছে শুধু তামিলনাড়ু ও কেরল থেকে। তবে বিজেপির মতাদর্শযে এই রাজ্যগুলোতেও ক্রমেই বেশি-বেশি করে ঢুকছে সে সম্পর্কে আমরা বিস্মৃত থাকতে পারি না।
এই পৃষ্ঠভূমিতে বাম এবং অন্যান্য ফ্যাসি- বিরোধী শক্তিগুলোকে তৃণমূল স্তরে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের এই ভয়াবহ বিস্তার ও ভেদশক্তির গভীরতা একইসাথে অবিচলভাবে জনগণকে তাদের বুনিয়াদি ইস্যুগুলো ও অধিকারের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা, ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের পশ্চাদমুখী প্রভাবের প্রতিরোধে প্রগতিশীল যুক্তিবাদী চিন্তাধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ফ্যাসিবাদী হিংসার মোকাবিলায় জনগণের প্রতিরোধের বিকাশ ঘটানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। মোদী যুগের আবির্ভাবের সাথে সাথেই যে সমস্ত সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক সম্প্রদায় এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রবক্তা যে নাগরিকগণ প্রণালীবদ্ধ নিপীড়ন ও হিংসার মুখোমুখি হচ্ছেন, আমাদের সমস্ত সমর্থন ও সংহতি তাঁদের প্রয়োজন। সিপিআই(এমএল) গঠনের এই পঞ্চাশতম বার্ষিকীতে এবং তার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কমরেড চারু মজুমদারের জন্ম শতবার্ষিকীতে আমাদের সমস্ত শক্তি ও সাহসকে সংহত করে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে এবং বর্তমান সন্ধিক্ষণের কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় হিম্মত দেখাতে হবে।