সিঙ্গুর আজও সোচ্চার ‘চাষযোগ্য করে জমি ফেরত’ দাও

হুগলি লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের রত্না দে নাগকে প্রায় তিয়াত্তর হাজার ভোটে পরাজিত করে এবারের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বিজেপির শ্রীমতী লকেট চট্টোপাধ্যায়। সিঙ্গুর বিধানসভা ক্ষেত্রে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীর থেকে এগিয়ে, প্রায় সাড়ে দশ হাজার ভোটে। নির্বাচনের দিন তিনি ধনেখালি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, এখন নির্বাচনে জিতেই ঘোষনা করলেন, সিঙ্গুরের জমিতে ফের কারখানা নির্মাণ করতে চান! কারখানা গড়ার সপক্ষে সেখানে বিজেপির পতাকা কাঁধে মিছিলও হয়। উল্লেখ্য, নির্বাচনের কয়েকমাস আগে, যখন দিল্লিতে কৃষকদের পার্লামেন্ট অভিযান চলছে, ঠিক সে সময়ে সিঙ্গুর থেকে রাজভবন ‘সফল’ কৃষক পদযাত্রা সংগঠিত করে সিপিএম, অন্যতম দাবি ছিল, সিঙ্গুরের জমিতে কারখানা স্থাপন। এই লোকসভা নির্বাচনে সিঙ্গুরে সিপিএম পেয়েছে প্রায় সতের হাজার সাতশো ভোট। বিপরীতে ‘কৃষকদের জমি চাষযোগ্য করে ফেরত দাও’ এই দাবিতে সরব সিপিআই(এমএল) পেয়েছে সাতশো ভোট এবং এসইউসি পেয়েছে নশো বারো ভোট !

মাননীয়া লকেট চ্যাটার্জির দল এক দশক আগের উত্তাল সিঙ্গুর আন্দোলনে সামিল ছিলেন না। সেদিন, তাঁদের অবস্থান স্পষ্টতই ছিল টাটার পক্ষে। বিপরীতে যে সামাজিক শক্তি সেদিন সিঙ্গুরের মাটিতে ‘কৃষকদের বলিদানে, বহুজাতিকের কারখানা’ স্থাপনের পক্ষে সোচ্চার ছিল, তারা এবার স্পষ্টতই বিজেপিকে ভোটে জেতায়। জিতেই এই শক্তি আবার কারখানার পক্ষে সক্রিয় হয়। এই সক্রিয়তা আরো বাড়বে। এক দশক আগে সেদিন সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ি, গোপালনগর, বাজিমোল্লা, খাসের ভেড়ির কৃষকদের জীবনে আক্ষরিক অর্থেই ঘটেছিল বর্গীহানা। তারা অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলেন, তাদের প্রতিটা গ্রাম, তাদের বাস্তু সহ কৃষিজমি, গোচারণভূমি ইত্যাদি সবটুকু দখল করে ন্যানো নামক মোটরগাড়ি কারখানা গড়তে সরকারের লোক নিয়ে সার্ভে করতে এসেছে টাটা গোষ্ঠীর লোকজন। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ঝাঁটা হাতে টাটাদের প্রতিরোধ করতে নামে হাজারো কৃষক রমণী ও গ্রামবাসীরা। পরেরটুকু ইতিহাস। তেভাগা, নক্সালবাড়ির বাংলায় কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে যুক্ত হল নতুন নাম ‘সিঙ্গুর’।

সেদিন সিঙ্গুরের কৃষকদের প্রতিবাদে মূল বিষয় ছিল (১) এই হাজার একর জমি উর্বর কৃষিজমি; দু/তিন ফসলি। (২) একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে ও বন্দুকের ডগায় সব প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে জমি কাড়তে চাইছে সরকার। (৩) এই উর্বর জমি থেকে সরে গিয়ে সরকার টাটাদের কারখানা গড়তে অনুর্বর, অনাবাদী জমি অথবা বন্ধ কারখানার জমি দিতে পারে। (৫) জনগণের ট্যাক্সের পয়সা নষ্ট করে টাটাদের প্রায় বিনা পয়সায় এই বিরাট পরিমাণ জমি, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া চলবে না। মাননীয়া এম পি ইতিহাসকেই অস্বীকার করতে চান। অস্বীকার করতে চান দেশ-দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেওয়া এই গণআন্দোলনের উত্তরাধিকারকে। সেদিন আন্দোলন শুরু করেন সিঙ্গুরের কৃষক। এই আন্দোলনে ক্রমে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় সারা বাংলা সহ গোটা দেশ। বিরোধী প্রধান নেত্রী হওয়ায় মমতা এই আন্দোলনকে ‘হাইজ্যাক’ করেন।আন্দোলনের ধাক্কাতে রাজ্যে সরকার বদল ঘটে। টাটারা প্রজেক্ট সরিয়ে নিয়ে যায় সানন্দে। দীর্ঘ আইনী লড়াই শেষে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আসে ‘চাষযোগ্য অবস্থায় কৃষকদের হাতে ফেরত দিতে হবে ওই জমি।’

মমতা সরকার এই কাজটিতে আন্তরিকতা দেখায় না । জমি চাষযোগ্য করার নামে ওই জমিকে কেন্দ্র করে চলে সরকারি অর্থের বেলাগাম, বে শরম তছরুপ। বেনাবন পরিষ্কারের নামে প্রত্যেক বছরে দুতিনবার এসব চলছে। এ সত্বেও সমস্ত জমিখন্ডগুলির এমনকি সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজটাও সুসম্পন্ন হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী সরষে বীজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলেন; মূল কারখানা থেকে দূরে,প্রান্তে অবস্থিত গোপালনগর মৌজা লাগোয়া কিছু জমিতে আলু ফলানো দেখিয়ে বলা হল জমি চাষযোগ্য হয়েছে!! খাসের ভেড়ি, বেড়াবেড়ি, বাজিমেলিয়া — কৃষকদের মধ্যে এই নিয়ে সর্বত্র তীব্র অসন্তোষ। এ সত্বেও এই গ্রামগুলির কৃষকরা এখানে কারখানা চান না, তাঁরা জমি চাষযোগ্য অবস্থায় ফিরে পেতে চান। কারখানা হোক, কিন্তু সেটা হোক অন্য কোন যোগ্য স্থানে, এই তাঁদের অভিমত, আজও। এই বাস্তবতা সত্ত্বেও লকেট চ্যাটার্জিরা কৃষকদের দাবী আদায়ের পক্ষে না দাঁড়িয়ে ওই জমিতে কারখানাই গড়তে চান কেন? উত্তরটা পরিষ্কার। সিঙ্গুরের মাটিতে টাটারা যে ধাক্কা খেয়েছিল, বহুজাতিক দূনিয়ার কাছে সেটা ছিল মোক্ষম আঘাত। সিঙ্গুর বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলের নিরিখে বিজেপি এখানে নিজের অনুকূলে ভোট টানতে সক্ষম হয়েছে। তাকে এই অনুকূল পরিবেশ অনেকটাই উপহার দিয়েছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। কর্পোরেট-সরকার অশুভ আঁতাত বনাম কৃষিজীবী জনগণের যে তীব্র সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল যে অশুভ সামাজিক শক্তি, পরবর্তীতে শাসক দলের সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, সিন্ডিকেটরাজ, সরকারি তহবিলের দখলদারি নিয়ে বেলাগাম গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, এসবের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূণ্যতাকে কাজে লাগিয়ে এরা নতুন করে প্রাণ পেয়েছে। বিশেষ করে কোর্টের রায়ের বহু মাস পরও যখন সরকারি আন্তরিক উদ্যোগ, পরিকল্পনা, যথেষ্ট বরাদ্দ অর্থের অভাবে জমি পরিত্যক্ত থেকে যায়, সেই পরিস্থিতিকে কর্পোরেট স্বার্থে কাজে লাগাতে চাইছে বিজেপি। রাজ্য ও জেলা জুড়ে চরম বেকারত্বের প্রেক্ষাপটে বিজেপি আওয়াজ তুলতে চাইছে, ‘কারখানা হলে কত বেকারকে কাজ দেওয়া যেত’!

ওরা জানে সিঙ্গুরের জমিতে কারখানা করতে পারলে, শেষ হাসি হাসবে কর্পোরেট দুনিয়া! আপাদমস্তক জনবিরোধী, কর্পোরেট মুখি বিজেপির সিঙ্গুর পরিকল্পনা নিয়ে তাই এই জটিল সময়ে সতর্ক থাকতে হবে আমাদের।

খণ্ড-26
সংখ্যা-14