মোদী সরকারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি কী রূপ পেতে চলেছে, প্রথম দু-সপ্তাহ আমাদের তা দেখিয়ে দিচ্ছে : সামাজিক মাধ্যমে নজরদারি, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারি, অপরাধের সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং মুসলিমদের দানবীয়করণ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, আসাম সীমান্তরক্ষী পুলিশ বাহিনীর দেওয়া বানানো রিপোর্টের ভিত্তিতে সেনা বাহিনীর প্রাক্তন এক সদস্যকে ‘‘বিদেশী’’ বলে ঘোষণা করে বন্দী শিবিরে আটক করা, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী বুদ্ধিজীবী এবং কর্মীবৃন্দকে হত্যার হুমকি এবং বেকারি ও জিডিপি-র পরিসংখ্যান সম্পর্কে গত মোদী সরকারের মিথ্যাচার উন্মোচিত হওয়া।
প্রশান্ত কানোজিয়া নামে এক সাংবাদিককে উত্তরপ্রদেশের সাদা পোশাকের পুলিশ নয়ডায় তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরে দেয়। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি টুইট করে একটা ভিডিওকে শেয়ার করেন, যে ভিডিওটি নাকি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর ‘‘মর্যাদাহানি ঘটিয়েছিল’’। সংবাদ চ্যানেল ন্যাশন লাইভ-এর প্রধান ইশিতা সিং ও তার সম্পাদক অনুজ শুক্লাকেও ঐ ভিডিওটি প্রচার করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট কানোজিয়াকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করে এবং তা করতে গিয়ে বলে যে, ‘‘এক নাগরিকের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।’’ একটা টুইট-এর জন্য গ্রেপ্তারির মধ্যে নিহিত স্বেচ্ছাচার ও জুলুমবাজি সামাজিক মাধ্যমে নজরদারিকে বাড়িয়ে তোলা এবং সাংবাদিক ও বিরোধী কন্ঠস্বরগুলোকে হুমকি দেওয়ার বিজেপির অভিসন্ধিকে দেখিয়ে দেয়।
এর মধ্যে আবার জনগণের বুদ্ধজীবী এবং মুম্বইয়ে বসবাস করা ফ্যাসি-বিরোধী প্রচারক রাম পুনিয়ানি মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন। বোম্বে আইআইটি-র প্রাক্তন অধ্যাপক পুনিয়ানি ইউ টিউবে যে জনপ্রিয় ভিডিওগুলি দিয়েছেন, যে ভিডিওগুলি হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে দর্শকদের শিক্ষিত করে, তার জন্যই তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। মহারাষ্ট্রে নরেন্দ্র ধাবোলকার ও গোবিন্দ পানসারে এবং কর্ণাটকে এম এম কালবুর্গি ও গৌরি লঙ্কেশের মতো যুক্তিবাদী ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকে মাথায় রাখলে পুনিয়ানির প্রতি এই হুমকি ভীতিপ্রদ ও আশঙ্কাজনক হয়ে দেখা দেয়।
পশ্চিমবাংলা এবং ত্রিপুরায় অ-বিজেপি ভোটার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর সমর্থকদের বিরুদ্ধে বিজেপি সন্ত্রাস চালাচ্ছে। বিজেপি পশ্চিমবাংলায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও হিংসা উস্কিয়ে তোলারও চেষ্টা করছে।
কাঠুয়ায় যাযাবর মুসলিম বকরওয়াল সম্প্রদায়ের ছোট একটি মেয়ের গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটিতে কিছু মাত্রায় ন্যায়বিচার পাওয়া গেছে। এই মামলায় অপরাধের সংঘটক তিন ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে এবং তথ্যপ্রমাণ নষ্টের জন্য তিন পুলিশ কর্মীও অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছে। ‘হিন্দু ঐক্যর’ নামে বিজেপি মন্ত্রী ও বিধায়করা এই ঘৃণ্য ধর্ষণ-হত্যা এবং ঘৃণাজাত অপরাধের ঘটনায় অভিযুক্তদের সমর্থনে জনসমাবেশ সংগঠিত করলে সারা দেশই প্রতিবাদে গর্জে ওঠে।
সংঘ পরিবারের শক্তিগুলো যেমন কাঠুয়ার ঘৃণাজাত অপরাধের সংঘটকদের সমর্থনে হিন্দুদের সমর্থন সমাবেশিত করার চেষ্টা করেছিল, ঐ শক্তিগুলোই এখন আবার উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে টাপ্পাল গ্রামে এক বালিকার হত্যাকে সাম্প্রদায়িক প্রচারের খোরাক হিসাবে কাজে লাগিয়ে মুসলিমদের দানব সদৃশ করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। আলিগড়ের ঘটনায় দুই অভিযুক্ত যেহেতু মুসলিম, বাইরে থেকে আসা সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো ঐ গ্রামকে অবরুদ্ধ করে রাখছে, মুসলিমদের বাড়ির বাইরে চিৎকার করে সাম্প্রদায়িক শ্লোগান ও বক্তৃতা দিচ্ছে। হিংসার শিকার ঐ বালিকার বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বলেছেন যে ঐ হত্যার পিছনে কোনো সাম্প্রদায়িক অভিপ্রায় ছিল না আর তাই তাঁরা বারবারই ঐ ধরনের সাম্প্রদায়িক প্রচারের অবসানের আবেদন জানিয়েছেন — কিন্তু ঐ অপরাধে সাম্প্রদায়িক রং চড়ানো অব্যাহত রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের পুলিশও এই ঘটনায় দানবীয় জাতীয় নিরাপত্তা আইন (এনএসএ) প্রয়োগ করে ঐ সাম্প্রদায়িক চাপকে তুষ্ট করেছে, যদিও রাজ্যে শিশুদের বিরুদ্ধে চালিত হিংসার অন্যান্য ঘটনায় এন এস এ প্রয়োগ করা হয়নি। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ উত্তরপ্রদেশের কুশিনগরে সম্প্রতি ১২ বছরের দলিত বালিকার উপর ছয় ব্যক্তির গণধর্ষণের ঘটনায় এনএসএ প্রয়োগ করা হয়নি। উত্তরপ্রদেশের পুলিশ যে বেছে বেছে, মূলত মুসলিমদের বিরুদ্ধে, এন এস এ প্রয়োগ করছে তার মধ্যে দিয়ে একটা সাম্প্রদায়িক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, আর তা হল — হত্যার মতো অপরাধ মুসলিমদের দ্বারা সংঘটিত হলে তা জাতির বিরুদ্ধেই অপরাধ বলে গণ্য হবে।
আসামে বিদেশী সনাক্তকরণের ট্রাইব্যুনাল সেনা বাহিনীর প্রাক্তন সুবেদার এবং যুদ্ধে অংশ নেওয়া মহম্মদ সানায়ুল্লাকে অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করে আসামের এক আটক শিবিরে পাঠায়। এই ঘটনাটা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি এবং বিদেশী সনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার স্বেচ্ছাচারী এবং প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক চরিত্রকেই তুলে ধরে। আসাম সীমান্ত পুলিশের তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতেই এই আটক চলে এবং ঐ রিপোর্ট বানানো কথা এবং প্রকট মিথ্যাচারে ভর্তি। সানায়ুল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় ২০০৮ সালে এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির খসড়ায় তাঁর নাম ছিল না। সানায়ুল্লা এখন জামিনে মুক্তি পেলেও গোটা ঘটনাটা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি এবং বিদেশী সনাক্তকরণ ট্রাইব্যুনালের অন্যায্য এবং স্বেচ্ছাচারী চরিত্রকেই উন্মোচিত করে, ধর্মীয় এবং ভাষাভাষী সংখ্যালঘুদের হেনস্থা ঘটাতে যেগুলোকে অবলীলায় ব্যবহার করা যাবে। সারা দেশে এনআরসি চালু করার (এর সাথে যুক্ত হবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন যা নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় থেকে হিন্দুদের অব্যাহতি দেবে) বিজেপির পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরনের ঘটনা আমাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে জানাচ্ছে যে, মুসলিমরা কি ধরনের হেনস্থা ও অবমাননার শিকার হয়ে উঠতে পারে।
নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ায় সরকার অবশেষে বেকারি সম্পর্কিত পরিসংখ্যানকে প্রকাশ হতে দিল — ঐ পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে ভারতে বেকারির হার ৪৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। মোদীর প্রথম পর্বের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্ম্যনিয়নের এক গবেষণা পত্র এই তথ্যকে উন্মোচিত করেছে যে, সরকার ২০১১ থেকে ২০১৭ বর্ষের মধ্যে জিডিপি বৃদ্ধির যে হারকে ৭ শতাংশ বলে দাবি করেছিল তা অনেক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল, বৃদ্ধির প্রকৃত হার মাত্র ৪.৫ শতাংশ। ভারত ‘‘সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধির অর্থনীতি’’, সরকারের এই দাবি মেকি তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।
গোড়ার দিকের সতর্ককারী এই সংকেতগুলো মোদীর নিজের ‘‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’’-এর দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে এবং দ্বিতীয় পর্বের মোদী জমানার প্রকৃতি ও অভিপ্রায় কি হতে চলেছে তাকে দেখিয়ে দিচ্ছে।
— (এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১১ জুন ২০১৯)