ভারতীয় চলচ্চিত্রে নব্য বাস্তববাদের ধারাই প্রধান

বাংলা তো বটেই সারা ভারতবর্ষেও এখনও চলচ্চিত্রে নব্য বাস্তববাদের ধারাটাই চলছে। বক্তা চলচ্চিত্র পরিচালক অশোক বিশ্বনাথন। অশোক বক্তৃতা করলেন, ‘চলচ্চিত্র ও সমাজ’-এর উপর, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দশম স্মারক সভায়। শিয়ালদহে ডেন্টাল কলেজ সংলগ্ন জর্জ ভবনে, ২২ জুন সন্ধ্যায়। কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত মোদী সরকার ও রাজ্যে তৃণমূল সরকারের কাজকর্মর উপর তিনি শুরুতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

অশোক তাঁর বক্তৃতায় জানান, ১৯৪০-এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে পৃথিবীজুড়ে চলচ্চিত্রে নব্য বাস্তববাদের ধারা চালু হয়। সেখানে গল্প বলাটাই প্রধান হয়ে ওঠে। এই পর্বেই ভেত্তোরি ডি সিকা, রোজেলিনি, আইজেনস্টাইনের মত পরিচালকেরা নব্য বাস্তববাদের ধারাতে ছবি তৈরি করতে শুরু করেন যেখানে সমাজের নানান ঘটনা ধরা পড়তে থাকে। তিনি জানান, ডি সিকার দ্য বাইসাইকেল থিফ এই ধারার চলচ্চিত্র হিসাবে ব্যাপক পরিচিত লাভ করে। কমিউনিস্ট মতাদর্শেবিশ্বাসী সোভিয়েত রাশিয়ার পরিচালক আইনজেনস্টাইন তৈরি করে ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন। সেটিও নব্য বাস্তববাদের ধারায় তৈরি। ইতালির পরিচালকেরাও নব্য বাস্তববাদের ধারাতে ছবি তৈরি করলেন। ভারতবর্ষেও নব্য বাস্তববাদের ঢেউ আছড়ে পড়ে। বিমল রায়, কে আব্বাস আলি থেকে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন সকলে নব্য বাস্তবাদের ধারাতেই ছবি তৈরি করলেন। তিনি জানান ১৯৪০- এর দশক থেকে ১৯৬০, ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত বাংলা তো বটেই সমগ্র ভারতবর্ষেও নব্য বাস্তববাদের ঢেউয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হল। যদিও ১৯৬০-এর দশকের শেষে সারা পৃথিবীর নানান দেশে নতুন আন্দোলনের ঢেউ তৈরি হল। ফ্রান্সে, জার্মানিতে ছাত্র আন্দোলন, ভারতবর্ষের বাংলায় নকশালবাড়ীর কৃষক অভ্যুত্থান, লাতিন আমেরিকায় সামরিক জুনটার বিরুদ্ধে আন্দোলন সহ বহু দেশের মার্কিন আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলন। এই সময়েই ফ্রান্সে চলচ্চিত্রে এল নব তরঙ্গ আন্দোলন। যদিও সেই নব তরঙ্গ আন্দোলনের ঢেউয়ের অাঁচ এই বাংলায় বা ভারতবর্ষের অন্যত্র লাগেনি। নব তরঙ্গ চলচ্চিত্র আন্দোলনে নব্য বাস্তববাদের মতেো গল্প বলাটা প্রধান নয়। এখানে নানা টুকরো টুকরো ঘটনার কোলাজ। নব তরঙ্গ চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রভাব যখন সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে অদ্ভুতভাবে ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র আন্দোলন সেই প্রভাব মুক্ত। এখানে নব্য বাস্তববাদের ধারাই প্রধান হয়ে উঠল। ভারতবর্ষের বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ মুক্তি পাচ্ছে পঞ্চাশের দশকে অথচ ঋত্বিক ঘটক ‘নাগরিক’ তৈরি করেছিলেন ‘পথের পাঁচালি’র বহু আগে কিন্তু সেটি তখনও মুক্তি পায়নি। ঋত্বিক ঘটকের প্রায় প্রতিটি ছবিই সমাজের বাস্তবের প্রতিফলন। সমসাময়িক সময়ে মৃণাল সেনের প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ খুব বেশি পরিচিত ছিল না যতদিন পর্যন্ত ‘নীল আকাশের নীচে’ তিনি তৈরি করলেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’ অনেক পরে তৈরি করেছেন কিন্তু মৃণাল সেনের তৈরি এই ছবিটি সর্বাধিক পরিচিত।

নকশালবাড়ি আন্দোলনের উপর বহু ছবি তৈরি হয়েছে, এখনও তৈরি হয়েছে, এখনও তৈরি হচ্ছে। সত্যজিৎ রায় তৈরি করলেন প্রতিদ্বন্দ্বি মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ। এই সময়েই তিনি আরও দুটি ছবি— ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’ ও ‘জন অরণ্য’ তৈরি করলেন। সমসাময়িক রাজনীতি, সমাজ বাস্তবতা ধরা পড়ছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বি’ও ‘ইন্টারভিউ’’ চলচ্চিত্রে। ‘জন অরণ্যে’ও মানুষ মুখ খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা কিন্তু অরণ্যের দিন রাত্রিতে যৌনতার অল্পসল্প সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা যা সমাজ বাস্তবতারই অঙ্গ বলে অশোক বক্তব্যে জানান। মৃণাল সেন এই সময় তৈরি করছেন ‘একদিন প্রতিদিন’ ‘আকালের সন্ধানে’, ‘খণ্ডহর’ — এ সবই সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। চল্লিশ দশক থেকে হালসময়ের ‘নগরকীর্তন’ পর্যন্ত সব ছবিই নব্য বাস্তবতার উপর তৈরি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনদের বেশ কিছু ছবির মুহূর্ত তুলে ধরে বক্তা নব্য বাস্তববাদ তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করার সঙ্গে এদিনের বক্তব্যের বিষয়বস্তু ‘চলচ্চিত্র ও সমাজ’-এর সমর্থনে সাবলীল ভঙ্গিমায় বক্তব্য পেশ করেন।

বক্তব্য শেষ হওয়ার পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে শ্রোতাদের নানান প্রশ্নের উত্তর দেন এবং কৌতুহল নিরসন করেন। শ্রোতাদের মধ্যে সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী, পোদ্দার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সল্টলেক ক্যাম্পাসের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক সন্দীপ ঘোষ, সাতদিন ডট ইন ওয়েব পোর্টালের অন্যতম কর্ণধার অনুপম কাঞ্জিলাল, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন রাজ্য অফিস সম্পাদক ধীরেশ গোস্বামী প্রমুখ্য বক্তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। সন্দীপ প্রশ্ন করেন মৃণাল সেনের জেনেসিস ও খণ্ডহর বক্তার আলোচনায় উল্লেখ কেন হল না। ওই দুটি ছবি মধ্যেই সমাজ বাস্তবতা আছে। চিত্র পরিচালক মণিকলল-এর একটি ছবির অনুপ্রেরণায় খণ্ডহর তৈরি বলেও জানান তিনি। স্বপ্নময় প্রশ্ন করেন ছবিতে গল্প না থাকলে কি তা সমাজ বাস্তব হয়ে ওঠে না। যে সমস্ত ছবি গল্প ছাড়া তৈরি হয় সেগুলি কি সমাজ বাস্তব হয়ে ওঠে না? অশোক উত্তরে জানান নিটোল গল্প ছাড়াও টুকরো টুকরো ঘটনার উপর কোলাজ করেও যে ছবি তৈরি হয় তাও সমাজকে প্রতিফলিত করে। একই ধরনের প্রশ্ন করেন অনুপম। ধীরেশ গোস্বামী প্রশ্ন করেন বক্তা চার্লিচ্যাপলিনের ছবি নয়ে কোনো আলোচনা করলেন না কেন? স্বপ্নময় প্রশ্নকর্তার উত্তরে জানান সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় যেমন রবীন্দ্রনাথ আছেন ধরে নিয়েই সাহিত্য আলোচনা করা হয় সেইরকম চলচ্চিত্রেও চার্লিকে বাদ দিয়ে আলোচনা মানে তিনি আলোচনার ঊর্ধ্বে। অশোক বলেন চার্লির সব ছবিতেই সমাজের যে চালচিত্র ফুটে উঠেছে এবং তা সময়ের দলিল হয়ে উঠছে। উদাহরণ হিসাবে ‘মঁসিয়ে ভর্দো’র কথা তিনি তুলে ধরেন। অনুষ্ঠান শুরুতে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক নীতীশ রায় শ্রোতাদের গণসঙ্গীত গেয়ে শোনান। তারপর যাঁর স্মৃতিতে এদিনের সভা সেই দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমন্ত্রিত বক্তা অশোক বিশ্বনাথন সম্পর্কেকিছু কথা বলেন সভা সঞ্চালক নিত্যানন্দ ঘোষ। এরপর প্রয়াত দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের নানান দিক ও তাঁর উপর দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পেশ করেন বাসুদেব বসু। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিপি আই(এমএল) পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য কল্যাণ গোস্বামী, অ্যাডভোকেট সৌমিত্র সাহা, নাট্যশিল্পী শেখর সরকার, সমাজকর্মী অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী, চিত্রচেতনার কর্ণধার তপন সেন, অভিজিৎ গুপ্ত, দিগন্ত বলয় পত্রিকার সম্পাদক বরুণ দাস প্রমুখ। অনুষ্ঠান শেষ হয় নীতীশ রায়ের ‘‘যত হামলা কর সব সামলে নেব/চ্যালেঞ্জ তোমায় যদি মারতে পারো ...’’ গানের মধ্যে দিয়ে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-18