নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই বিজেপি বুঝে গেছিল সরকারের কাজের উপর নির্ভর করে ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। তাই ‘দেশপ্রেম’ এর নামে, সরাসরি ধর্মের দোহাই দিয়ে তাকে নির্বাচনে লড়তে হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার প্রশ্নে কোন রকম সম্পর্কছিল না এবং যে অভাবনীয়ভাবে তারা আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে তা যে কোনো সচেতন মানুষের কাছে শিউরে ওঠার মতো। অথচ, খুব সাধারণ মানুষের কাছে যারা সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয় তাদের অধিকাংশই বিষয়টিকে বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন। মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে যেটুকু বোঝার চেষ্টা করেছি তা ভয়ঙ্কর। তাদের অনেকের মধ্যে বক্তব্যের ফারাক থাকলেও মূলগত কোন পার্থক্য পাইনি। ধর্মতাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
কিছুদিন আগেও বোঝা যায়নি, বর্তমান শাসক দলের প্রতি মানুষের এত ক্ষোভ-বিক্ষোভ জমে আছে। কিছুটা বোঝা যাচ্ছিল যে, একটা উল্টো হাওয়া বইতে শুরু করেছে কিন্তু সেটা যে কোন ঝড়ের পূর্বাভাস তা হয়তো খোদ ‘দিদি’ও ভাবেন নি।
৩৪ বছরের বাম জমানা থেকে তৃণমূল জমানায় দুটো নতুন বিষয় সংযোজন হয়েছিল। এক, বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে তাতেও কাজ না হলে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে যেনতেন প্রকারে বিরোধীদলের এমপি, এমএলএ থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মীদেরকে নিজেদের দলে নাম লিখতে বাধ্য করা। যারা নিজেদের আখের গোছাতে সব সময় ‘সেফ’ জায়গায় থাকতে ভালোবাসেন, তারা তো এমনি এমনিই রং বদলে ফেলেছিলেন। প্রথম প্রথম অনেকেরই ভাবনার মধ্যেই আসেনি যে, বিগত শাসক বামপন্থী দলগুলি থেকে কাতারে কাতারে মানুষ একটি চরম দক্ষিণপন্থী দলে ভিড়তে পারে। আস্তে আস্তে এটা গা সওয়া হয়ে গেছিলো। আর যারা নিজের থেকে যায়নি, তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল ‘উন্নয়নে’ সামিল হতে। আর দ্বিতীয় যে বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ানক হয়ে উঠেছিল তা’হল বিরোধী পরিসরটাকে ক্রমাগত মুছে দেওয়ার অপচেষ্টা। আর তারই ফলস্বরূপ বিরোধীদের আন্দোলনগুলোকে নানা কায়দায় টুটি টিপে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগানো হয়েছে যাতে কোনো রকম মিছিল-মিটিং এর অনুমতি না দেওয়া হয়। বিভিন্ন জায়গায় যেখানে যেখানে মিটিং বা আলোচনা করার মত ব্যবস্থা ছিল সেই জায়গাগুলোকে কুক্ষিগত করা, যাতে বিরোধীরা বিশেষ করে বামপন্থীরা মানুষকে ওদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে না পারেন। তারই ফলস্বরূপ গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সারা রাজ্যে যে প্রহসন দেখা গেছিল তা অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে।
প্রমোটার রাজ থেকে সিন্ডিকেট, তোলাবাজি, দলবাজি, দুর্নীতি, স্বজন-পোষণ, বিরোধী পক্ষের ওপর হামলা করা, প্রশাসনকে ন্যক্কারজনকভাবে নিজেদের তল্পি বাহিনীতে পরিণত করা, এসব কিছুর সঙ্গেই ২০১১-র অনেক আগে থাকতেই সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটেছিল। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল, পরিবর্তন হয়েছিল। সেটা একটা ইতিহাস। কিন্তু তার পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেভাবে চলতে শুরু করল, ছাত্র ভর্তির নামে কলেজে কলেজে হাজার হাজার টাকার তোলাবাজি মানুষকে যেভাবে মানতে বাধ্য করা হয়েছিল, তার ক্ষোভের আগুন ধিক-ধিক করে জ্বলতে শুরু করেছিল।
এগুলোর পাশাপাশি রাজ্যে শুরু হলো মোচ্ছবের রাজনীতি। বাম রাজত্বেই আরএসএস-র বাহিনী রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে অসংখ্য স্কুল পরিচালনার মধ্যে দিয়ে এবং অন্যান্য কিছু সামাজিক বিষয়কে সামনে রেখে তাদের জাল বিস্তার করছিল। কেন্দ্রে মোদি সরকার আসার পর আরএসএস বাহিনী সরাসরি পশ্চিমবাংলার মাটিতে ধর্মকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করল। কখনো রামনবমীর নামে, কখনো অন্য কিছু ধর্মীয় বিষয়কে সামনে রেখে তারা একটা উত্তেজনার পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করলো, কোথাও কোথাও সাফল্যও পেল। যার ফলস্বরূপ, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এ রাজ্যে বেশ কয়েকটি দাঙ্গার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যাতে শুধু সম্পত্তির ক্ষতি নয় মানুষের প্রাণহানিও ঘটেছে। একে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে শাসক শ্রেণী পাল্টা ধর্মীয় খেলায় মেতে উঠলো। হিন্দুদের কাছে দেখাতে চাইলো তারা কম হিন্দুনয়, আর সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের কাছে নিজেকে মসিহা করে তোলার চেষ্টা করলো। পরিণতি হল ভয়ঙ্কর।
নির্বাচনের কিছুদিন আগে, কয়েকজনের সাথে রকের আড্ডায় চমকে উঠেছিলাম। মুসলিম তোষণের কথা ওঠায় প্রশ্ন করেছিলাম কিসের মুসলিম তোষণ? ইমাম ভাতার কথা উঠেছিল। বোঝাতে পারিনি যে, ইমাম ভাতা’টা মুসলিম তোষণ নয়। আসলে তোষণের ভণ্ডামি। তৃণমূল সরকার এই টাকা দেয়না, অর্থটি আসে মুসলিমদের নিজস্ব ফান্ড ওয়াকফ থেকে। কথাটা কেউ শুনতে চায়নি। একজন তো বলেই বসলো, এটা ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ না হলে ওদের ‘টাইট’ দেওয়া যাবে না। যখন এই ধরনের উক্তির তীব্র প্রতিবাদ করি, ওখানে উপস্থিত অন্যরা কিন্তু আমাকে সাথ দেয়নি। অনেকটা “ম ৌন সম্মতি লক্ষণম” গোছের। যে কথাটা বলেছিল, সে যুবক থাকাকালীন সি পি এমের ঝান্ডা নিয়ে বেশ কিছুদিন মাতব্বরি করেছিল। তারপর নিজের আখের গোছাতে না পেরে কিনা জানিনা, সেই যে অনেকদিন আগে সরাসরি রাজনীতি থেকে সরে এসেছিল তার আজকের মধ্য বয়স পর্যন্ত সে আর অন্য কোন দলে ভেড়েনি। এমনকি পরিবর্তনের পরও তৃণমূুল বিরোধী থেকে গেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বুঝলাম ধর্মতাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
সকালবেলায় একটা জায়গায় যাই একটু শারীর চর্চা করতে। বেশ কয়েকজন সেখানে আসেন, নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। পুলওয়ামার ঘটনা তখনো ঘটেনি। কোন একটা বিষয় নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে কথা চলছিল, হঠাৎ একজন বলে বসলো “মুসলিমরা ভীষণ দেশ বিদ্বেষী। ওরা মাদ্রাসাগুলোতে দেশের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টি করার শিক্ষা দেয়।” কথাটা শুনে আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। তাকে প্রশ্ন করলাম “আপনি মাদ্রাসায় পড়েছেন না পড়ান”। আর যায় কোথায়, যেন আগুনে ঘি দেওয়া হলো। সবাই মিলে যেন আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে ওরা মজা পেত। তাও আমি বললাম, “আপনারা কি জানেন যে মাদ্রাসা গুলোতে এই রাজ্যের গ্রামের বহু গরীব ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করে, তা প্রায় ১০ শতাংশ”। মানতেই চাইলো না। বেশ কিছুক্ষণ তর্কাতর্কিই সার হল। বুঝলাম, ধর্ম ওদেরকে ভাসিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচনের দিন ঘোষণার পর থেকেই বুঝতে পারছিলাম, আকাশে-বাতাসে কান পাতলেই যেন শোনা যাচ্ছিল ধর্মীয় মেরুকরণের কথা। সুচতুরভাবে চারিদিকেই যেন রব তোলা হয়েছিল “.... গুলোকে বড্ড মাথায় তুলেছে”। অথচ হিন্দুতোষণের তো কিছু খামতি ছিল না। সাগর মেলায় ১০০ কোটি খরচ। দূর্গা পূজার কার্নিভালে প্রায় ৫০ কোটি খরচ। ভারত সেবাশ্রমে অর্থদান। দূর্গা পূজায় প্রতিটি ক্লাবকে ১০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান। ছট ও গনেশ পূজা, রামনবমী এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে হনুমান পূজো, সরকারি অর্থেহিন্দু পুরোহিত ভাতার ঘোষণা, অলিতে গলিতে শনি থেকে ইট পূজোর প্রমোট করা ইত্যাদি। কিন্তু শুনছে কে ? ধর্ম ওদেরকে ভাসিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরের দিন তো দুজনের কথপোকথনের মধ্যে একজন অন্যকে বলছেন :
- আরে একটুর জন্য মনে দু:খ থেকে গেল।
- কেন কি হল আবার ?
- ভারতী ঘোষটা জিততে পারলো না, আক্ষেপ থেকে গেল।
- ঠিক আছে, অর্জুন তো বুঝিয়ে দিয়েছে না !
- হ্যাঁ, ঐ আর কি। নে এবার বোঝ। তোর দিন শেষ। নে এবার মোল্লাগুলোকে মাথায় নিয়ে ঘোর।
কথাগুলো কানে আসছিল, ওখান থেকে সরে যাওয়ারও উপায় ছিল না। কান থেকে যেন গরম হাওয়া বেরাচ্ছিল। ভাবছিলাম এ কোন সমাজ ! কোথায় যাচ্ছি আমরা? যেখানে বাস্তব বোধ মানুষ হারিয়ে ফেলে, যেখানে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো ভাবতে ভুলে যায়! এই কিছুদিন আগেও তো ভারতী ঘোষ, অর্জুন সিং-রা এদের কাছে অত্যাচারী, তোলাবাজ, সন্ত্রাসবাদী আরও অনেককিছু ছিল, আর আজ দলবদল করেই ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে গেল ! সেদিন প্রায় সারাদিন অন্য কোন কাজে মন:সংযোগ করতে পারিনি, শুধু ভেবেছি আসলে ওই মানুষগুলো কি সত্যিই অন্যায়ের প্রতিকার চায়, সত্যিই কি ওরা একটা সুস্থ সমাজ চায় ? উত্তর পাইনি। মনে হয়েছে, ধর্ম ওদেরকে ভাসিয়ে দিয়েছে। যে মুসলিম তোষণের কথা বলা হচ্ছে তার ভিত্তি কি, ওরা কেউ নির্দিষ্টভাবে বলতে পারবে না। বাম আমলে সাচার কমিটির যে সুপারিশগুলি ছিল তা কোনো সরকারই প্রয়োগের রাস্তায় হাঁটেনি। গত আট বছরে বাংলার মুসলমানরা কত সরকারি চাকরি পেয়েছে, আর্থিক ভাবে কতটা অগ্রগতি হলো ? এ প্রশ্ন তাদের কাছে করা যাবে না। আমাদের চারপাশে যেসব মুসলিম মহল্লাগুলি আছে, তারা যেমন ছিল তেমনিই আছে। সরকারি চাকরিতে মুসলিমরা বরং ৮% থেকে পিছিয়ে কমবেশি ৩% হয়েছে। অথচ মুসলিম তোষণ হচ্ছে বলে বিজেপি-সংঘবাহিনী সংখ্যাগুরু মেরুকরণে পুরোপুরি সফল হয়েছে। সাধারণ মানুষকে যা ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। কারণ ধর্মের অন্তর্গত থাকার প্রাথমিক শর্ত–অন্ধ আনুগত্য ও প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণ। বিজ্ঞান ও ধর্ম দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। অলৌকিকতা ও বিশ্বাস যেখানে ধর্মের প্রাণ, বাস্তবতা ও প্রমাণ সেখানে বিজ্ঞানের অবলম্বন। এখন মানুষ ধর্ম চর্চা করে শুধুমাত্র তার নিজের স্বার্থের কথা ভেবে। এখান থেকেই একটা মানুষ একটু একটু করে যখন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে তখন তার মধ্যে ভালমন্দের বোধ কাজ করে না। তার উদাহরণ আমাদের দেখার আর বাকি আছে কি ? ধর্ম ওদের ভাসিয়ে দিয়েছে।
সিপিএমের নেতৃত্বও এটা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের কর্মী-সমর্থকরাও তলে তলে মেরুকরণের রাজনীতির শিকার। আর তাই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে নির্বাচনের কিছুদিন আগে তাদের দলের কর্মী- সমর্থকদের উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী শোনাতে হয়। পরিকল্পনা মাফিক ‘বাম রামে গেছে’ না কি তাদের দেউলিয়া ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতি তাদেরকে রামে পরিণত করেছে তা আগামী দিনই বলবে। একজন তথাকথিত সি পি এম সমর্থক বন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মানুষ এটা কি করলো? চোরের থেকে বাঁচতে ডাকাতের খপ্পরে পড়লো ? তার উত্তর, কি করবে মানুষ বর্তমান অবস্থা থেকে বেরোতে চাইছে। আগামীদিনে সে বুঝবে তার খারাপ হলো কি ভালো হলো। মনে হলো সবাই যেন কেমন একটা ‘হিস্টিরিয়ার’ মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মনে আশংকা জাগে আজ যদি কাজী নজরুল ইসলাম বেঁচে থাকতেন তার পরিণতি দাভোলকার,পানসারে বা গৌরী লঙ্কেশের মতো হতো কিনা !
তবু লড়াই ছেড়ে দিলে চলবে না। এই বাংলার বহু মনীষীরা জাত-পাত-ধর্ম-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন তা বিফলে যেতে পারে না। এই দেশ দেখেছে, একদা ‘এশিয়ার মুক্তি সূর্য’কে কিভাবে মাটিতে আছড়ে ফেলতে। তাই রুটি-রুজির প্রশ্ন, মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্নগুলো যতই সামনে আসবে, দেশপ্রেম-ধর্মদিয়ে তাকে ঠেকানো যাবেনা। আর এ প্রশ্নে প্রকৃত বামপন্থীরাই পারে মানুষকে লড়াইয়ের রাস্তা দেখাতে। আমাদের হারতে নেই, জনগণের জীবন-জীবিকার লড়াইটা শুধু বামপন্থীরাই করতে পারে, এই বিশ্বাসটা জনগণের মধ্যে জাগাতে হবে। আজ তাই একটাই শ্লোগান “জোট বাঁধো, তৈরি হও। সামনে লড়াই, তৈরি হও”।
- শ্রীকান্ত লাহা