কাঠুয়া রায়ের রুপোলি রেখা ও শঙ্কার কালো মেঘ

কাঠুয়া মামলার ১০ জুনের রায়ে ধর্ষিতা এবং পৈশাচিকতার শিকার যাযাবর মুসলিম বকরওয়াল সম্প্রদায়ের ৮ বছরের নাবালিকা আসিফা বানো আপাতত ন্যায়বিচার পেল এবং অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে অভিযুক্তদের দণ্ডপ্রাপ্তি ঘটল। এই মামলায় সাত অভিযুক্তর মধ্যে সাঞ্জী রাম, দীপক খাজুরিয়া ও পরভেশ কুমারকে গণধর্ষণ, খুন ও অন্যান্য অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে পাঠানকোটের বিশেষ দায়রা আদালত। আর ঘুষ নিয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপের জন্য পুলিশের তিন কর্মী সাব-ইন্সপেক্টর আনন্দ দত্ত, হেড কনস্টেবল তিলক রাজ এবং স্পেশ্যাল পুলিশ অফিসার সুরেন্দ্র বর্মার পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। আর এক অভিযুক্ত সাঞ্জী রামের ছেলে বিশাল জনগোত্রকে আদালত সন্দেহের অবকাশ থাকায় (নাবালিকার ধর্ষণ ও হত্যার সময় কাঠুয়ায় তার উপস্থিতি সম্পর্কে) দণ্ডপ্রাপ্তি থেকে রেহাই দিয়েছে। অষ্টম অভিযুক্ত সাঞ্জী রামের ভাইপো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময় নাবালক ছিল কিনা তার বিচার আদালত এখনও শেষ করেনি।

কাঠুয়া ঘটনায় কি হয়েছিল তা সংক্ষেপে বিবৃত করা যাক। ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি নিখোঁজ হল আসিফা বানো। প্রসঙ্গত, এই বকরওয়ালরা পশুপালক যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষ। শীতকালে ওরা জম্মুতে এসে থাকে এবং গরম পড়লে আবার পশুর দল নিয়ে চলে যায় উপত্যকা কাশ্মীরের দিকে। পাঠানকোট আদালতের রায় ঘোষণার দিনও আসিফার পরিবারের সদস্যরা কাঠুয়ায় ছিল না, ঘোড়া, ভেড়া নিয়ে রওনা দিয়েছে কাশ্মীরের দিকে। মেয়েটি নিখোঁজ হওয়ার দুদিন পর তার পালক পিতা স্থানীয় হিরানগর থানায় এফআইআর করেন। এক সপ্তাহ পর ১৭ জানুয়ারি মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত মাথা থেঁতলানো দেহ মেলে তাদের গ্রাম রসানা থেকে ১ কিলোমিটার দূরে। কেন নাবালিকার ওপর এমন নির্মমতা চালানো হল আর যারা এই বর্বরোচিত হিংসা চালাতে একটুও কুন্ঠিত হল না তাদের উদ্দেশ্যই বা কী ছিল? পুলিশের তদন্তকারী দল তাদের পেশ করা চার্জশিটে বলেছে — বকেরওয়াল সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টিই ছিল এই ধর্ষণ ও হত্যার মূল উদ্দেশ্য। বকেরওয়াল ও গুজ্জরদের মত মুসলিমদের সংখ্যা যাতে হিন্দু সংখ্যাধিক্যের জম্মুতে বেড়ে না যায়, সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যেই তার বাবা-মা ও সম্প্রদায়কে বার্তা দিতে ঐ পৈশাচিকতা চালানো হয়। তদন্ত চালানো থেকে আদালতে অভিযোগ প্রমাণ — এই গোটা প্রক্রিয়াটায় প্রচুর প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে হয় তদন্তকারী অফিসার এবং সরকারি আইনজীবীদের। সাম্প্রদায়িক চাপ, ব্ল্যাক মেইলিং, হুমকি, ঘুষের প্রস্তাব, হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোর ‘‘ধর্ষক বাঁচাও আন্দোলন’’ — এতসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তদন্তকারী এবং সরকার পক্ষের আইনজীবীরা তাঁদের কর্তব্যের প্রতি প্রশংসনীয় নিষ্ঠা দেখিয়েছেন।

এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে কোন প্রত্যক্ষ্যদর্শীর সাক্ষ্য মেলেনি। তিন পুলিশ কর্মীর সাজাপ্রাপ্তি থেকে জানা যাচ্ছে —অকুস্থলের সাক্ষ্যপ্রমাণগুলি লোপের চেষ্টায় পুলিশেরই কয়েকজন সদস্য সক্রিয় ছিল। এ সত্ত্বেও বিশেষ তদন্তকারী দল (তদন্তের ভার তুলে দেওয়া হয় জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের অপরাধ দমন শাখার হাতে) পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে নাছোড় মনোভাব দেখান। তাঁরা সাক্ষ্যপ্রমাণের ১৪টি প্যাকেট ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠান। ময়না তদন্তের রিপোর্ট জানায় — হত্যার আগে নাবালিকার ওপর গণধর্ষণ চালানো হয়েছিল। আর ধর্ষণের আগে তার শরীরে মাদক ঢুকিয়ে তাকে আচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছিল (তার পাকস্থলিতে ক্লোনাজেশাম মাদকের চিহ্ন মেলে)। যে মন্দিরে মেয়েটিকে ৭ দিন আটকে রেখে তার ওপর পাশবিকতা চালানো হয়েছিল, সেখান থেকে সংগ্রহ করা চুলের গুচ্ছ ফরেন্সিক পরীক্ষায় মেয়েটির চুল বলেই প্রমাণিত হয়। সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপে মেয়েটির পরনের জামাকাপড় ধুয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু সেই ধোয়া জামাকাপড়েও থেকে যাওয়া প্রায় অদৃশ্য রক্তচিহ্ন মেয়েটির ডিএনএ-র সঙ্গে মিলে যায়। এই সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আদালতের বিচারপতিরাও অভিযুক্তদের অপরাধ সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে কোন‍ো দ্বিধা দেখাননি।

তদন্তের শুরু থেকেই এই হত্যাকাণ্ডকে ধরে বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণে মেতে ওঠে। ন্যায়বিচারকে বানচাল করা এবং ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িতদের বাঁচানোর উদ্যোগ সচল হয়। জম্মুর হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোকে এক ছাতার তলায় এনে গঠন করা হয় ‘‘হিন্দু একতা মঞ্চ’’। এই মঞ্চ থেকে বিজেপি নেতা, মন্ত্রী, বিধায়করা মুসলিম বিদ্বেষী কুকথার ফোয়ারা ছোটাতে থাকেন। হিন্দু একতা মঞ্চ মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্তদের ফাঁসানোর ওজর তুলে তাদের সমর্থনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। যেদিন অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হয়, সেই ২০১৮-র ১ মার্চহিন্দু একতা মঞ্চ সংগঠিত বিক্ষোভে রাজ্যের বিজেপি মন্ত্রী চৌধুরী লাল সিং (জম্মু ও কাশ্মীরে তখন পিডিপি-বিজেপি জোট সরকার চলছে) বলেন, ‘‘এই মেয়েটা মারা গেছে তো কি হয়েছে, প্রতিদিন অনেক মেয়েই তো মারা যায়।’’ তাঁর কথার মর্মার্থ, এক মুসলিম নাবালিকার ধর্ষণ ও হত্যা গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়। বকরওয়াল ও গুজ্জরদের বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। কাঠুয়া জেলা বিজেপি সভাপতি হিন্দু একতা মঞ্চর আন্দোলনের মধ্যে তাঁদের অর্থাৎ হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদ এবং ‘‘বকরওয়ালাদের জাতীয়তাবাদ বৈরিতা’’র মধ্যে লড়াইকে চিহ্নিত করলেন। কাঠুয়ায় উস্কিয়ে তোলা মুসলিম বিদ্বেষ জম্মুতেই সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়ল অন্যান্য রাজ্যে। কেরলের আরএসএস নেতা ই এন নন্দকুমারের ছেলে বিষ্ণু নন্দকুমার ফেসবুকে লেখেন, ‘‘ও যে আগে মারা গেছে তাতে ভালো হয়েছে, তা না হলে ভবিষ্যতে ও দেশের কাছেই একটা বোমা হয়ে উঠত।’’ তদন্তকারী দলের সদস্যরা ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল চার্জশিট পেশ করতে গেলে কাঠুয়ার হিন্দুত্ববাদী আইনজীবীরা তাতে বাধা দেন। পরে আরো পুলিশ পৌঁছানোর পরই চার্জশিট পেশ সম্ভব হয়। হিন্দুত্ববাদী আইনজীবীদের আধিপত্যে চালিত জম্মু হাইকোর্টের বার এ্যাসোসিয়েশন কিছু দাবিকে অজুহাত করে ১১ এপ্রিল জম্মু বন‌ধের ডাক দেয়, যার পিছনে অভিযুক্তদের সমর্থনে চাপ সৃষ্টির কৌশল তেমন প্রচ্ছন্ন ছিল না। ন্যায়বিচারকে ভেস্তে দিতে হিন্দুত্ববাদীরা আর একটা কৌশলেরও আশ্রয় নেয়। আইনজীবীরা ‘নিরপেক্ষ’ সিবিআই তদন্তের দাবি তোলে, এই দাবিতে ধর্ণায় বসানো হয় অভিযুক্তদের পরিবারের মহিলাদেরও। সিবিআই তদন্তের দাবির পিছনে এই অভিপ্রায় কাজ করে থাকবে যে, সিবিআই যেহেতু নরেন্দ্র মোদীর পরিচালনাধীন একটি সংস্থা তাই মোদীর মাধ্যমে সিবিআই-এর হস্তক্ষেপে অভিযুক্তরা নির্দোষ প্রতিপন্ন হয়ে শাস্তি থেকে রেহাই পাবে। সুপ্রিম কোর্ট কাঠুয়া ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবিকে খারিজ করে দেয় এবং কাঠুয়ায় পরিস্থিতি বিচারের অনুকূল নয় জ্ঞান করে মামলাটাকে স্থানান্তরিত করে পাঞ্জাবের পাঠানকোটের দায়রা আদালতে। বিজেপি এমন একটা দল নয় যে তার কদর্য কাজের জন্য অনুতাপ প্রকাশ বা ভুল স্বীকার করবে। কাঠুয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডকে ধরে তারা অত্যন্ত সচেতনভাবেই মেরুকরণের রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছিল এবং তার ফলও তারা পেয়েছে। কাঠুয়া যে লোকসভা ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে, সেই উধমপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি সহজ জয় পেয়েছে এবং বিজেপির যে নেতারা অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরা আজ সম্ভবত তাঁদের কৌশলের সাফল্যে উল্লসিত হয়ে আড়ালে মুচকি হাসি হাসছেন।

কাঠুয়া কাণ্ডে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ হয় ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল, আর ঐ একই সময়ে ৮ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির সামনে আত্মাহুতি দেওয়ার চেষ্টা করেন উন্নাওতে ধর্ষিতা ১৭ বছরের এক তরুণী। ২০১৭ সালের ৪ জুন তিনি বিজেপি বিধায়ক কূলদীপ সিং সেঙ্গার-এর হাতে ধর্ষণের শিকার হন। উভয় ঘটনাতেই ধর্ষিতা হয় নাবালিকা এবং সেগুলিতে জড়িত থাকে বিজেপি ও হিন্দুত্বের সমর্থক লোকজন। কাঠুয়া কাণ্ডে তাঁর দলের লোকজন অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং তাদের বাঁচাতে উঠেপড়ে লেগেছে, একথা জেনেও মোদী প্রায় তিন মাস মুখ বুজে থাকেন। অবশেষ দুটি ঘটনা নিয়ে দেশ তোলপাড় হলে তিনি নীরবতা ভাঙ্গেন ২০১৮-র ১৩ এপ্রিল এবং টুইট করে ‘‘লজ্জাজনক ঘটনা’’, ‘‘ন্যায় বিচার হবে’’র মতো সাধারণ দু-একটা কথা বলেন। তাঁর দলের লোকজনের কলঙ্কজনক ভূমিকা নিয়ে তাঁর টুইটার হ্যাণ্ডেল থেকে একটি শব্দও বেরোয় না। নারীর শরীর যুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার যে প্রবচন আছে, কাঠুয়া কাণ্ডে তার সত্যতা প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হল। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আট বছরের এক মুসলিম নাবালিকার ধর্ষণ ও হত্যাকে সংকোচহীনভাবে কাজে লাগানোর ধৃষ্টতা জাহির করা হল। চরমতম পাশবিকতার সংঘটনে যারা একটুও কুন্ঠিত হল না, জাতীয় পতাকায় শরীর মুড়ে তারা জাতীয়তাবাদের বাহক হয়ে উঠল। এই শক্তিগুলোই আজ রাষ্ট্রের মদতে পুষ্ট হচ্ছে। ‘হিন্দু একতা’ যে কোনো অনাচারের, সমস্ত ধরনের নৈতিকতা বর্জনের ন্যায্যতা প্রতিপন্নে মতাদর্শগত ভিত্তি হয়ে উঠছে। আজকের রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কাছ থেকে কাঠুয়া কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার প্রত্যাশা নিরর্থক। কাঠুয়া কাণ্ডের রায়ের রুপোলি রেখার পাশাপাশি শঙ্কার কালো মেঘও তাই এক সংশয়হীন বাস্তবতা।

খণ্ড-26