ভারতের নির্বাচন কমিশন অবশেষে ২০১৯- এর লোকসভা নির্বাচন এবং কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা করল। এই ঘোষণায় যে বিলম্ব হয়েছে এবং নির্বাচনী নির্ঘন্টকে যেভাবে বহু দফায় ভাগ করা হয়েছে তার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তা যথার্থভাবেই কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যাতে ঝড়ের গতিতে প্রকল্প উদ্বোধনের (এবং কিছু ক্ষেত্রে আগে উদ্বোধন করা প্রকল্পের নতুন করে উদ্বোধন) সফর শেষ করতে পারেন, তার জন্যই কি ঘোষণায় দেরি করা হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী যাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জনসভায় ভাষণ দিতে পারেন আর শাসক দল যাতে তার ক্যাডারদের যথাসম্ভব কার্যকরীভাবে নিয়োগ করেত পারে তার জন্যই কি এত দফা ধরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়েছে? এই প্রশ্নগুলো অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবাংলায় ২০১৪ সালে যেখানে পাঁচ দফায় ভোট সম্পন্ন হয়েছিল, ২০১৯ সালে সেখানে এই রাজ্যে ভোট অনুষ্ঠানের দফাকে বাড়িয়ে করা হয়েছে সাতে। বিজেপি দাবি করেছে যে এই রাজ্যের নির্বাচনে টি এম সি চালিত হিংসার ইতিহাস থাকার কারণে বাড়তি দফার প্রয়োজন হচ্ছে, তা হলে মহারাষ্ট্রে নির্বাচনী দফাকে বাড়িয়ে চার করা হল কেন, যে রাজ্যে নির্বাচনী হিংসার কোন ইতিহাস নেই? মাওবাদী হিংসার সম্ভাবনার কথা ভেবে উড়িষ্যায় নির্বাচনকে চার দফায় ভাগ করা হল, অথচ অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় ঐ ধরনের ঘটনার ইতিহাস অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও ঐ দুটি রাজ্যে নির্বাচনকে মাত্র এক দফায় সীমিত করা হল কেন? মাত্র কয়েক মাস আগে মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন একটি মাত্র দিনে অনুষ্ঠিত হলেও লোকসভা নির্বাচনকে চার দফায় অনুষ্ঠিত করা হচ্ছে কেন? পার্বত্য রাজ্য উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশের নির্বাচন আলাদা আলাদা পর্বে অনুষ্ঠিত করা হচ্ছে কেন? জম্মু ও কাশ্মীরে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিধানসভা নির্বাচন করা হচ্ছে না কেন? দিল্লী, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের নির্বাচনের জন্য মে মাসের শেষের দিকের পর্বগুলি নির্ধারিত হয়েছে কেন? শাসক দল বিজেপির সুবিধা করে দিতেই যে সাধারণ রীতি থেকে সরে আসা হয়েছে, এই সিদ্ধান্তকে এড়ানো এক রকম অসম্ভব। একটা হাওয়া ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেছিল : এই হাওয়া অংশত তৈরি করেছিল প্রচার মাধ্যমের চ্যানেলগুলো মোদীর ‘উন্নয়ন’-এর মসীহা হওয়ার ভাবমূর্তিনির্মাণ করে; অংশত তৈরি হয়েছিল পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মত সংবেদনশীল অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে, সুনিয়ন্ত্রিত ঢঙে সাম্প্রদায়িক বার্তা ছড়ানোর মাধ্যমে; আর অংশত তৈরি হয়েছিল কংগ্রেস ও ইউ পি এ-র বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মনোভাব তৈরি হওয়ার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ২০১৯-এর নির্বাচন একটা সম্পূর্ণভিন্ন ধরনের নির্বাচন, আর বিজেপি খুব ভালো করেই তা জানে। এবার দুর্নীতি, বেকারি, কৃষকদের দুর্দশা, অর্থনৈতিক সর্বনাশের ইস্যুগুলোতে ক্রোধ ও বিক্ষোভ সরাসরি চালিত হচ্ছে সাধারণভাবে বিজেপি এবং বিশেষভাবে মোদীর বিরুদ্ধে। মিডিয়ার বড় অংশ এখনও মোদীর প্রচার যন্ত্র রূপে কাজ করে চললেও তার প্রত্যাশিত ফল দ্রুতই কমে আসায় ক্ষতিকে পোষাতে ওদের এখন অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। প্রচারযন্ত্র পুলওয়ামা ও বালাকোটের ঘটনাকে দু-হাতে আঁকড়ে ধরে উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে সমস্ত ধরনের অনুসন্ধান ও গণতান্ত্রিক জিজ্ঞাসাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছে। এই মরিয়া প্রচেষ্টাও কিন্তু প্রভাব সৃষ্টিতে তেমন সফল হচ্ছে না। প্রচার যন্ত্ররূপে কাজ করেচলা টিভি চ্যানেলগুলো দাবি করছে, জনমত সমীক্ষাগুলো দেখাচ্ছে যে পুলওয়ামা ও বালাকোট পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিজেপি এবং এন ডি এ যথেষ্ট এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করলে এক ভিন্ন বাস্তব অবস্থা দেখা দিচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ, ইণ্ডিয়া টিভি-সি এন এক্স জনমত সমীক্ষা প্রকৃতই যা দেখাচ্ছে তা হল, ডিসেম্বরে করা তাদের শেষ জনমত সমীক্ষার পর থেকে বিজেপির আসন অল্পমাত্রায় কমছে, যে কমার পরিমার হল ৯টি আসন—যা দেখাচ্ছে যে, পুলওয়ামা ও বালাকোটের ঘটনা সত্ত্বেও বিজেপি খুব স্বস্তিকর অবস্থায় নেই। এবিপি নিউজ-সি ভোটার- এর জনমত সমীক্ষা দেখাচ্ছে, জানুয়ারি মাসে করা তাদের শেষ জনমত সমীক্ষার পর থেকে বিজেপির আসন সংখ্যা এবং প্রাপ্ত ভোটের হার ভালো মাত্রায় বাড়ছে : কিন্তু ঐ সমীক্ষা অনুযায়ী অধিকাংশ আসনে লাভ অল্পই হচ্ছে, আর যে লাভ দেখানো হচ্ছে তার সিংহভাগই মহারাষ্ট্রের আসনগুলোতে সীমাবদ্ধ যে রাজ্যে বিজেপি শিবসেনার সঙ্গে জোট পাকা করে ফেলেছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, জনমত সমীক্ষায় দেখতে পাওয়া উন্নত ফলাফলের পিছনে আসল কারণ হল জোট, তাতে পুলওয়ামা বা বালাকোটের ঘটনা তেমন কোন প্রভাব ফেলছে না। ইণ্ডিয়া টুডে-র করা জনমত সমীক্ষায় মতদাতাদের ৩৬ শতাংশ জানিয়েছে এবারের নির্বাচনে বেকারিই হবে মূল ইস্যু, ২২ শতাংশের মতে কৃষকের দুর্দশা হবে মূল ইস্যু, আর ২৩ শতাংশের মতে সন্ত্রাসবাদ মূল ইস্যু হবে। স্পষ্টতই, পুলওয়ামা এবং বালাকোটের ঘটনাকে ধরে মিডিয়ার শোরগোল, যুদ্ধ জিগির এবং ঘৃণার কটূক্তিও বেকারি, কৃষকের দুর্দশা এবং অন্যান্য রুটি-রুজি, জীবনমরণের ইস্যুগুলোকে নির্বাচনী এজেণ্ডা থেকে হঠিয়ে দিতে পারেনি—যে ইস্যুগুলোতে মোদী সরকার সুনিশ্চিতভাবেই কাঠগড়ায়। ২০১৯-এর নির্বাচন এগিয়ে আসায় মিডিয়ায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় চলা প্রচারের কীর্তনকে বর্জন করা, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে ইন্ধন জোগানোর প্রতিটি প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করাটা ভারতীয় জনগণের কাছে একান্তই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাছে আরো গুরুত্বপূর্ণ হল, যে সমস্ত ইস্যু ও প্রশ্ন থেকে বিজেপি জনগণের মনোযোগকে বিক্ষিপ্ত করতে চায় সেগুলোর ওপর তাদের দৃষ্টিকে দৃঢ়ভাবে নিবদ্ধ রাখা। (এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১২ মার্চ ২০১৯)