নতুন বছর নতুন লড়াইয়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। ১৮০ মিলিয়নের (১৮ কোটি) বেশি শ্রমিক ও মেহনতী মানুষ ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘটে সামিল হবেন। পথে নামবেন, প্রত্যাঘাত করবেন এক স্বৈরাচারী তানাশাহিকে। যে আর্থিক, সামাজিক ও শিল্পনীতি কর্মসংস্থানকে শেষ করে দেয়, বেকারির সর্বশেষ হার ৬.৯ শতাংশ (এ বছরের অক্টোবরের), শ্রমজীবী মানুষকে কর্মচ্যুত করে, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয় তাকে চরম প্রত্যাঘাত হানতে এই ধর্মঘট। ৮-৯ জানুয়ারীর ধর্মঘটের সংগঠক কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি (কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলি) সমাজের অন্যান্য অংশের, ছাত্র-যুব-মহিলাদের কাছে এই ধর্মঘটকে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতার আবেদন/আহ্বান রেখেছে। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রে আসীন ফ্যাসিস্ট সরকারের দেশবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী, জনবিরোধী নীতির ফলে যারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন—দলিত হোন, সংখ্যালঘু হোন, আদিবাসী হোন এই তানাশাহির (নোয়াম চমস্কির ভাষায়, ফ্রেন্ডলি ফ্যাসিজিমে'র) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে সামিল হবার জন্য। এ এক সর্বাত্মক লড়াই। এরা প্রচার করেছিল "পরিবর্তন আনার, স্বপ্ন দেখিয়েছিল নতুন ভারত গড়ার। এখন বলছে, সবই "জুমলা"। বুর্জোয়া ও তাদের প্রচার মাধ্যমগুলি ধারাবাহিকভাবে প্রচার চালাচ্ছিল কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি সব "দালাল হয়ে গেছে, আন্দোলন ভুলে গেছে", যে প্রচারে আমাদের বন্ধুদেরও কেউ কেউ প্রভাবিত হয়েছেন, তারাই আজ তারস্বরে বলতে শুরু করেছে, "রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের ক্ষেপানো হচ্ছে"। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আর এস এস) মদতপুষ্ট বি এম এস এই অজুহাতে ধর্মঘটের বিরোধী। আমাদের রাজ্যের ক্ষমতাসীন শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও তার শাখা-প্রশাখা "উন্নয়নের স্বার্থে" এই ধর্মঘটের বিরুদ্ধে। কথা আলাদা, সুর ও স্বর এক। শ্রমজীবী জনগণের আন্দোলনের বিরোধিতা,কর্পোরেটের দালালি এদের মূল লক্ষ্য।
কি আছে ১২ দফা দাবিগুলিতে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমাও। পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, কেরোসিনের দাম কমাও। একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবথেকে বড় লুঠ হয় নিঃশব্দে, মূল্যবৃদ্ধির ফলে। প্রায় ১২ থেকে ১৪ লক্ষ কোটি টাকা "জনগণের পকেট" থেকে "বড় বড় ব্যবসায়ী ও কর্পোরেটদের পকেটে" ঢোকে। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, এর ফলে প্রাথমিক উৎপাদকরা অর্থাৎ কৃষকরা, বর্গাদার, ভাগচাষীরা লাভবান হয়। মোটেই না। মূল্যবৃদ্ধি রোধ করার অজস্র পন্থার মধ্যে গণবন্টন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা একটা পথ। কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে ফসল ক্রয় করে গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিলি করার দাবি কি অন্যায্য, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ? কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষমতায় আসীন শাসকদল তো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বছরে দু'কোটি কর্মসংস্থান করবে। সরকারের প্রতিশ্রুতি মত অন্ততঃ দশ কোটি বেকারের কর্মসংস্থান হবার কথা। কালো টাকা উদ্ধারের নামে যে নাটক হল তাতে কত লোক নতুনভাবে কর্মচ্যুত হল (প্রাথমিক হিসাবে ৯০ লক্ষ থেকে এক কোটি ২০ লক্ষ), এ কথা যদি সরিয়েও রাখি, শ্রমের বাজারকে প্রসারিত করার একটা পথ তো বন্ধ ও রুগ্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি খোলা বা তার পুনরুজ্জীবন করা। এ দাবিটা কি অন্যায্য নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? ভারতের সংবিধান তো লিখেছে, জাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিককে সমানভাবে দেখা হবে, কোন বৈষম্য করা হবে না। তাহলে সমকাজে নারী-পুরুষের সমান মজুরী হবে না কেন? অথচ একজন নারী শ্রমিক একই কাজ করে প্রায় ৩৮.২ শতাংশ কম মজুরী পায়। এমনকি আধুনিক আই টি সেক্টরে এই বৈষম্য আরও বেশি। এই বৈষম্যের অবসান ঘটানোর দাবি কি অন্যায্য ? স্থায়ি কাজে একই কাজ, কখনও কখনও ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ, বছরের পর বছর করে কেজুয়াল বা ঠিকা শ্রমিকরা একই মজুরী পায়না। অথচ শ্রমিকদের কত রকমের পদবী? কেজুয়াল, ঠিকা, জিরো নাম্বার, 'ফ্লেক্সি', 'ফিক্সড টার্ম', স্কিম ওয়ার্কার। উদ্দেশ্য একটাই। শ্রমিকদের মজুরী চুরি করা, বিধিবদ্ধ পাওনা লুঠ করা। ৪৫-৪৬ শ্রম কমিশন সুপারিশ করল, স্কিম ওয়ার্কারদের সরকারী শ্রমিকের মান্যতা দিতে হবে। সরকার কমিশন বানায়, অথচ তার সুপারিশও কার্যকর করেনা। এ কথাটা বলা কি অন্যায্য? গড়পড়তা একটা ভাতা বা ফ্লোর ওয়েজ (৪-৫ হাজার টাকা) দিয়ে দাও, কোন স্থায়িত্ব নেই, কোন সামাজিক নিরাপত্তা নেই। শ্রমের বাজারে পুঁজির এই হামলাকে শ্রমিকশ্রেণী নীরবে মেনে নেবে?
শুধু শ্রমিকদেরই নয়, বঞ্চনা চলছে কৃষক, বর্গাদার, ভাগচাষী, কৃষি মজুর বা গ্রামীণ অন্যান্য শ্রমিকদের সঙ্গেও। ফসলের ন্যায্য মূল্যের দাবি কিংবা ঋণ থেকে মুক্তির দাবি আজ দেশজুড়ে। অন্নদাতারা আজ বেঁচে থাকার দাবিতে রাজপথে। ২৯-৩০ নভেম্বর রাজধানীর রাজপথে কৃষকদের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়লো। এই দেশজোড়া ধর্মঘটে কৃষকরাও সামিল। মেদিনী তাই কেঁপে উঠেছে। ছাত্র-যুবরা তাই পিছিয়ে থাকতে পারে না। আজ প্রকৃত দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হবে। দেশকে ভালবাসার অর্থ দেশের শ্রমিক কৃষককে ভালবাসা। তাদের লড়াইয়ে সাথে থাকা, সংগ্রামের বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া। এপথেই মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। এ লড়াই তাই রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করেছে। ফ্যাসিবাদী শাসককে সবক শেখানো।
কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের করণীয় কি? লেনিনের কথা মনে পড়ে গেল। পেট্রোগ্রাডে শ্রমিকরা তখন পরিখা খুঁড়ছে। মেনশেভিকদের সঙ্গে বলশেভিকদের তুমুল বিতর্ক চলছে, "করণীয় কি" ? লেনিন বিতর্ক থামিয়ে বললেন, "চলুন, আমরা রাস্তায় শ্রমিকদের পাশে যাই"। আজ ১৮ কোটি শ্রমিক ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্ররা পথে নেমেছে। সমাজের অগ্রণী অংশ নিশ্চুপ থাকতে পারেনা। সমস্ত কমিউনিস্ট ও বামপন্থী কর্মীকে আজ পথে নামতে হবে। নীরবতা, নিস্ক্রিয়তা রাজনৈতিক অপরাধ। আসুন, আমরা ৮-৯ জানুয়ারীর শ্রমিক ধর্মঘটকে সফল করতে পথে নামি। প্রস্তুতি কাজ সেরে ফেলি। পাড়ায় পাড়ায়, কারখানায় কারখানায় স্ট্রাইক কমিটি গড়ে তুলি। সমাজের সমস্ত মেহনতীদের এই কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করি। স্ট্রাইক ব্রেকারদের সতর্ক করি। শ্রমিক কৃষকদের দাবিগুলিকে জনগণের সর্বস্তরে পৌঁছে দিই। এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াই জিততে হবে।