কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী আর্থিক নীতি এবং শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দেশের ১৫ কোটির বেশী শ্রমজীবী জনতা ৮-৯ জানুয়ারী দু-দিনব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটে সামিল হবেন। দেশের দশ লক্ষ ব্যাঙ্ক কর্মচারীও এই ধর্মঘটে যোগ দেবেন। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং ফেডারেশনের আহ্বানে এই ধর্মঘটের সিদ্ধান্তকে ব্যাঙ্ক শিল্পের সর্ববৃহৎ সংগঠন সারা ভারত ব্যাঙ্ক কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন (এ আই বি ই এ)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি গত নভেম্বর মাসেই সমর্থন জানায় এবং বিবৃতি জারি করে। ব্যাঙ্ক এবং বীমা শিল্পের পাঁচটি বড় সংগঠন—সারা ভারত ব্যাঙ্ক কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন (এ আই বি ই এ), সারা ভারত জীবন বীমা কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন (এ আই এল আই সি ই এ), সাধারণ বীমা কর্মচারী সর্বভারতীয় সমিতি (জি আই ই এ আই এ), ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন (বি ই এফ আই) এবং অল ইণ্ডিয়া লাইফ ইন্সিওরেন্স এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন (এ আই এল আই সি এফ) ইতিমধ্যে স্ট্রাইক নোটিশ জারি করেছে এবং ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে দেশব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের অভিন্নতা ঘোষণা করেছে। বর্তমান সময়ে ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা ভারত সরকারের জনবিরোধী শিল্প নীতির প্রত্যক্ষ শিকার এবং কর্মচারীরাও তার প্রত্যুত্তরে ধর্মঘটে সামিল হচ্ছেন। ২০১৮ সালের শেষ দশ দিনের মধ্যে ১০ লক্ষ ব্যাঙ্ক কর্মচারী দু-দিন ধর্মঘটে সামিল হয়েছেন। ২১ এবং ২৬ ডিসেম্বর। এই রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিকে পরিকল্পিতভাবে ভেঙ্গে দিয়ে ব্যক্তি মালিকানাকে অবাধ সুযোগ করে দেওয়ার এবং এরফলে শোষণ-বঞ্চনা ও দারিদ্র বাড়বে জানা সত্ত্বেও ভারত সরকারের অনমনীয় নীতির বিরোধিতা ৮-৯ ধর্মঘটের অন্যতম লক্ষ্য যার সঙ্গে ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শ্রমকানুনের সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মঘট সহ যৌথ দরকষাকষির অর্জিত অধিকারও কেন্দ্রীয় সরকার রদ করে দিতে চাইছে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরিবর্তে সরকারের একতরফা সিদ্ধান্ত ঘোষণা এবং স্বীকৃত সামাজিক সুরক্ষাগুলিকে বাতিল করার চেষ্টা মোদী সরকারের অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য শিল্পের মতন ব্যাঙ্ক শিল্পেও নিয়মিত এবং স্থায়ী কাজগুলি অস্থায়ী, অনিয়মিত এবং ঠিকা কর্মচারীদের দিয়ে করানো হচ্ছে। ব্যাঙ্ক, বীমা সহ সমগ্র আর্থিক ক্ষেত্র, যা আমাদের জাতীয় সঞ্চয়ের সিংহভাগ, সংস্কারের নামে প্রত্যক্ষ আক্রমণের ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা দাবি তুলেছে জনগণের সঞ্চিত অর্থ জনস্বার্থে কাজে লাগাতে হবে আর ভারত সরকার এই টাকা কর্পোরেট লুঠের জন্যেই ব্যবহার করতে বদ্ধপরিকর। অতি সম্প্রতি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধের অন্যতম বিষয়ই ছিল সঞ্চিত অর্থে ভাগ বসানো নিয়ে। সাধারণ মানুষ যেমন ব্যাঙ্কে তাদের সঞ্চয় জমা রাখেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হল ব্যাঙ্কগুলির সঞ্চয় জমা রাখার ক্ষেত্র। ২০১৮ মার্চ অর্থ বছর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে মোট নগদ জমা রাশির পরিমাণ একশত চোদ্দ লক্ষ পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকা যার একটি অংশ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তহবিলে রাখতে হয়। দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের স্বার্থে ভারত সরকার ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণের মাধ্যমে শুধু এই নগদ রাশিকেই হস্তগত করতে চাইছে না, রিজার্ভ ব্যাঙ্কে সঞ্চিত রাশির ওপরও থাবা বসাতে চায়।
ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণের লক্ষ্যে মোদী সরকারের অন্যতম এক পদক্ষেপ হল ব্যাঙ্কগুলিকে রুগ্ন করা এবং একটির সঙ্গে অন্যটির সংযুক্তি বা মার্জ করে দেওয়া। ৩২ কোটি মানুষের আবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন শতাধিক ব্যাঙ্ক কাজ করতে পারে সেখানে আমাদের দেশে ২১টি সরকারি ব্যাঙ্কে ৯০,০০০ শাখা, গড়ে শাখা পিছু ১৫,০০০ মানুষকে পরিষেবা দেয়। তা সত্ত্বেও ভারত সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সম্প্রসারণের বিপরীতে সংকোচনের নীতি গ্রহণ করেছে। ২০০৮ সালে দুনিয়াব্যাপী মহামন্দার অাঁচে আমাদের দেশের আর্থিক ব্যবস্থা ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল। ব্যাঙ্ক বড় হলে হঠাৎ লোকসানের ধাক্কা সহ্য করতে পারবে বা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বড় মাপের ব্যাঙ্ক লাগবে, অর্থমন্ত্রীর এই ধরনের বক্তব্যের পিছনে আসল উদ্দেশ্য হল এক সাথে বড় লুঠের ক্ষেত্র তৈরী করে দেওয়া। বিজয় মালিয়া, ললিত মোদী, নীরব মোদী, মেহুল চৌক্সিরা তার বড় উদাহরণ।
২০১৭ এপ্রিল মাসে স্টেট ব্যাঙ্কের সঙ্গে ৬টি অ্যাসোসিয়েট ব্যাঙ্কের সংযুক্তি ঘটানো হয়। অ্যাসোসিয়েট ব্যাঙ্কগুলি বিভিন্ন রাজ্য ভিত্তিক গড়ে উঠেছিল যেমন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ মাইশোর বা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ পাতিয়ালা ইত্যাদি। এই ব্যাঙ্কগুলি সেই সেই রাজ্যে স্টেট ব্যাঙ্কের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী ছিল। সংযুক্তির ফলে স্টেট ব্যাঙ্কের আয়তন বিশ্ব ক্রমপর্যায়ে ৫৩তম স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু স্টেট ব্যাঙ্কের অনাদায়ী, প্রথমবারের মত বিপুল পরিমাণে লোকসান এবং ৬৯৫০টি শাখা বন্ধ করে দিয়ে কর্মচারীদের স্বেচ্ছা অবসরে বাধ্য করা হচ্ছে। ভারত সরকার এখন ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, দেনা ব্যাঙ্ক এবং বিজয়া ব্যাঙ্কের সংযুক্তির পদক্ষেপ নিয়েছে। এই তিনটি ব্যাঙ্কের ৯০০০ শাখা আছে এবং সংযুক্তির ফলে ব্যবসার আয়তন হবে ১৪ লক্ষ কোটি টাকা। এরই বিরোধিতায় ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা ২৬ ডিসেম্বর ২৪ ঘন্টার ধর্মঘটে সামিল হয়েছিলেন। আমাদের দেশে মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা বেশী এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য তা অনেকটাই বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের উপস্থিতি সাধারণ মানুষের সঞ্চয় পরিকল্পনা সহজ করে দিয়েছে। ব্যাঙ্ক কর্মচারী সংগঠনগুলি এবং অর্থনীতিবিদরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সম্প্রসারণের পক্ষেই লাগাতার সওয়াল করছেন। মোদী সরকারের উল্টো পথে হাঁটার উদ্দেশ্য তাই সহজেই অনুমান করা যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক লোকসানে চলার গল্পটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়ে কর্মচারীদের নায্য বেতন চুক্তি পিছিয়ে দেওয়া এবং তাদের অধিকারগুলিকে সঙ্কুচিত করার প্রয়াস চলছে। ২০১৮ মার্চ অর্থ বছর শেষে সরকারি ব্যাঙ্কগুলির মোট মুনাফার পরিমাণ ১,৫৫,০০০ কোটি টাকা কিন্তু অনাদায়ী ৩০,০০০ কোটি টাকা প্রভিসন করার জন্য নীট লোকসান ৮৫,০০০ কোটি টাকায় পৌছাল, যা এক রেকর্ড। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ১০টি বৃহৎ শিল্পপতি গোষ্ঠী ৯,১৬,০০০ কোটি টাকা ঋণ হিসাবে গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে আম্বানীদের ৩,০০,০০০ কোটি টাকা এবং আদানিদের ২,০০,০০০ কোটি টাকা যারা মোদী সরকারের অত্যন্ত কাছের মানুষ। অন্যদিকে ঘোষিত বা লুঠ হয়ে যাওয়া ১০ লক্ষ কোটি টাকা প্রায় ২৫ শতাংশ ১২টি বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠীর কাছেই অনাদায়ী এবং এর পরিমাণ ২,৫৩,৭২৯ কোটি টাকা। বলাবাহুল্য এরাঁও মোদী সরকারের প্রিয়জন।
সরকারের মদতে যখন ১ শতাংশ লোকের হাতে দেশের ৭৩ ভাগ সম্পদ কুক্ষিগত হয়, গরীব মানুষ এবং শ্রমজীবী জনতা দারিদ্রের চরম সীমায় পৌঁছাতে থাকে, দ্রব্যমূল্য হয় আকাশ ছোঁয়া, শ্রমিক শ্রেণীর বেঁচে থাকা আরও কঠিন হয়ে পড়ে তখন ব্যাঙ্ক, বীমা ক্ষেত্রের কর্মচারীরা সেই সংগ্রাম থেকে দূরে থাকতে পারে না। ঐক্যবদ্ধ লড়াই এই পরিস্থিতি মোকাবিলার অন্যতম শর্ত।