মনে পড়ছে এক যুগ অর্থাৎ ১২ বছর আগের সময়কে। সিঙ্গরের জমি জোর করে পুলিশ পাঠিয়ে লাঠি চালিয়ে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে দখল করা শেষ হয়েছে, অন্তত শেষ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছিল। শাসক শিল্পপতির পুঁজিবৃদ্ধির আকাঙ্খাকে কৃষকের জীবন-জীবিকার আর্তির থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে জমি দখল করে ধনিকের হাতে তুলে দেওয়ার সব ব্যবস্থা নিয়ে তৃপ্ত। পরবর্তিতে, সিঙ্গুরে জবরদস্তি জমি দখলের ‘সাফল্যে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাবের জন্য কৃষি জমি দখলের বিজ্ঞপ্তি জারি হল। গুলি চলল, মানুষ মরল, পুলিশের জীপ পুড়ল, নন্দিগ্রাম অবরুদ্ধ হল, অপারেশন সানরাইজ হল। তারপরে সেই সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নামল, দলে দলে, প্রায় নিত্যদিন। পশ্চিমবঙ্গ দেখেছিল সত্তরের দশকের পরে সব থেকে উত্তাল সময়। গত দশকের সেই গণ আন্দোলনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিল্পী সাহিত্যিক নাট্যকর্মী সাংস্কৃতিক কর্মীরা। শাসকের বশম্বদ থাকার দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে বেরোতে চাইছিলেন অনেকেই। তাঁরা এসে দাঁড়ালেন সামনের সারিতে, সারিটা বাড়তে বাড়তে মিছিলে পরিণত হল। সুমিত সরকার, তণিকা সরকার, অমিত ভাদুড়ি প্রমূখ, যদিও বামপন্থী ও বহুলাংশে বাম সরকারের সমর্থক, শাণিত যুক্তি ও বিদগ্ধ কলমে কৃষি জমি দখল করে উন্নয়নের মডেলটিকে তুলোধোনা করলেন। অন্যদিকে মহাশ্বেতা দেবী, সুকুমারী ভট্টাচার্য, শঙ্খ ঘোষ, তরুণ সান্যাল, নবনীতা দেবসেন, নবারুণ ভট্টাচার্য, জয গোস্বামী, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণঘোষ, অঞ্জন দত্ত, পরমব্রত, গৌতম ঘোষ, শাঁওলি মিত্র, কৌশিক সেন, বিভাস চক্রবর্তি, ব্রাত্য বসু, অর্পিতা ঘোষ, শক্তিনাথ ঝা, কবীর সুমন, নচিকেতা, প্রতুল মুখার্জী, পল্লব কীর্তনিয়া, বিপুল চক্রবর্তী, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, মধুময় পাল, সব্যসাচী দেব প্রমূখ লেখায়, রেখায়, মিছিলে, মিটিঙে মধ্যবিত্ত বিবেককে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন। নকশালবাড়ির আন্দোলনের পরে সেই প্রথম সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কৃষকদের আন্দোলন নিয়ে কবিতা লেখা হল, কবিতার সংকলন বেরোলো কয়েক ডজন, লিটল ম্যাগাজিনের উপজীব্য বিষয় হল সেই কৃষকদের জমি রক্ষার আন্দোলন, ছবি আঁকা হল, পথনাটক, অঙ্গনমঞ্চ নাটক, প্রসেনিয়াম নাটক সবেতেই ঢুকে পড়ল সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রাম, গানে ছবিতে, প্রচ্ছদে প্রবন্ধে সর্বত্র চলতে লাগল শাসকের জোর করে জমি দখলের বিরুদ্ধে লড়াই।২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-গায়ক-নাটককার-চলচিত্র পরিচালক-চিত্রকর সকলের নেতৃত্বে মুখর হয়েছিল কলকাতার রাজপথ। সেদিন তৎকালিন বামফ্রন্ট সরকারের পতনের সূত্রপাত ঘটেছিল।
একযুগ পরে দেশ তো মুখোমুখি হয়েছে আরেক অন্ধত্বের, শাসকের দম্ভের, স্পর্ধার। এ রাজ্যও সেই মুর্খের ঔদ্ধত্যের মুখোমুখি। মনে পড়ে যাচ্ছে ছাত্রদের সেই শ্লোগানের, উদ্ধত মূর্খের অসহ্য দম্ভ, শাসকের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামব। আজও তো দুই অসত্যবাদী দাম্ভিক একনায়কের স্পর্ধিত শাসনের পাল্লায় পড়েছে আমাদের দেশ ও রাজ্য। সেই স্লোগান নিয়ে রাজপথ উত্তাল করার সময় তো এসে গিয়েছে।
সারা দেশ জুড়ে ফ্যাসিবাদ থাবা বাড়িয়েছে, ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে খেপিয়ে তোলা হচ্ছে মানুষজনকে। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা চলছে দেশ জুড়ে। খুন করা হচ্ছে পিটিয়ে। জল জমি জঙ্গল থেকে উৎখাত করা হচ্ছে মূলবাসীদের। দলিতদের উপরে অত্যাচার করছে মনুবাদিরা। যারা ওই নিপীড়িত মূলবাসী বা দলিতদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন বা তাদের অধিকারের লড়াই-এ আইনী সাহায্য দিচ্ছেন তাদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে গৌরী লঙ্কেশ, দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, কালবুর্গিদের মত মুক্তমনা সাংবাদিক, যুক্তিবাদি, বিজ্ঞান মনস্ক ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার অগ্রণীদের। দেশের প্রধানমন্ত্রী ক্রমাগত ঘৃণা ও হিংসার রাজনীতি ফেরি করে চলেছেন। ধর্মের সুড়সুড়ির উপর ভিত্তি করেই ক্ষমতা বজায় রাখতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি। অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা উচ্চারণ করলেই তাঁকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানে রফতানি করার হুমকি দেওয়াটা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মান্ধ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ। এরকম পরিস্থিতিতেই তো শিল্পী-সাহিত্যিকদের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে আওযাজ উঠছে ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকারকে পরাস্ত করার। কৃষকেরা বারম্বার দাবি তুলছে মুম্বাই কলকাতা দিল্লির রাজপথে। শ্রমিকরা ধর্মঘট করে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। ৮-৯ জানুযারী, ২০১৯ আবার তারা সাধারণ ধর্মঘটে রাস্তায় নামছে। সাংস্কৃতিক জগতের সংবেদনশীল মানুষজন শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুবদের দাবিকে সাবলীলভাবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে দেশের এই ভয়াবহ সময়কে অতিক্রম করতে সক্রিয় হবেন এটাই সময়ের দাবি।
এরাজ্যেও রয়েছে এক দাম্ভিক শাসক। তাঁর তাঁবেদার অনুগামীরা মনে করেন যে তাঁর অনুপ্রেরণা ব্যতিরেকে রাজ্যে কিচ্ছুটি হয় না, এমনকি শৌচাগারের উদ্বোধনও নয়। রাজ্যে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, ব্লকে ব্লকে নিজেদের মধ্যে মারামারি, রাজ্য জোড়া সিন্ডিকেট রাজ, শাসক দলের সর্বস্তরে দুর্নীতির স্রোত বইছে, কৃষক তাদের ফসলের দাম পাচ্ছে না, ভাঙর বা ভাবাদীঘিতে কৃষি জমি বা মাছ চাষের জলাশয় দখল চলছে, হাজার হাজার কলকারখানা বন্ধ কিন্তু উৎসবের আধিক্যে সব ঢাকার প্রচেষ্টা; যাকে বলে বাইরে কোঁচার পত্তন ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন। কেন্দ্রের মেগালোম্যানিয়াক নেতা, যার নিজের পরীক্ষা পাসের শংসাপত্র খুঁজে পাওযা যায় না তিনি পরীক্ষার আগে পরীক্ষার্থীদের টেনশন কাটানোর উপদেশ দেন; অন্যদিকে ডক্টরেট নিয়ে অনৃতভাষিণী রাজ্যের নেত্রী নিজের কবিতাকে ছাত্রীছাত্রদের পাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন। সারা রাজ্য জুড়ে তাঁবেদারির সংস্কৃতিকে নৈতিক বৈধতা দিচ্ছেন শাসক নেত্রীর অনুগামীরা যার মধ্যে রয়েছেন, সুবোধ সরকার, অরিন্দম শীল, রুদ্রনীল ঘোষ, ইন্দ্রনীল সেন, অনীশ ঘোষ, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মত বামফ্রন্টের শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত সরকারের তোষামোদ করা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। কিন্তু এই সরকারভজা শিল্পী-সাহিত্যিকদের বাইরে রয়েছে এক বিপুল সাংস্কৃতিক কর্মী ও ব্যক্তিবর্গ। সময়ে অসময়ে তাঁরা বিভিন্নভাবে একক অথবা কয়েকজন একত্রে সোচ্চার হচ্ছেন রাজ্য জোড়া অনাচারের বিরুদ্ধে। তাঁদের সামগ্রিক ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগই পারে রাজ্যের মনন চিন্তন সমেত শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুব নারীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের এই ক্রম অবনমন রোখার ক্ষেত্রে পথিকৃত ভূমিকা গ্রহণে। ১২ বছর আগে কৃষকদের জমি রক্ষার লড়াইকে যে নৈতিক শক্তি প্রদান করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক জগৎ, আজ ফ্যাসিবাদকে রুখতে ও পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলকে পুনরুজ্জীবিত করতে সেই ভূমিকার পুনরাবৃত্তির প্রত্যাশায় রয়েছে এ রাজ্যের গণতন্ত্র অভীপ্সু জনতা।