সম্পাদকীয়
ফ্যাসিবাদের থাবা ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর

নরেন্দ্র মোদী সরকার এবার থাবা বসানোর পলিসি নিল ব্যক্তি স্বাধীনতার আরও একটি ক্ষেত্রে। কেন্দ্রের সরকার বাহাদুর সম্প্রতি নজরদারী চালানোর এক নয়া বিজ্ঞপ্তি জারী করল। তার মধ্য দিয়ে জনগণের  গণতন্ত্রকে শাসকের তালুবন্দী করার পলিসিকে আরও সম্প্রসারিত করা হল। 'বিজ্ঞপ্তি'র বহিরাবরণে এ আসলে আরেকটি ফতোয়া। তার মোদ্দা কথা হল,  দিল্লী পুলিশ সহ আারও নয়টি গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে যে কোন সংস্থা বা ব্যক্তির কম্পিউটার চালিত তথ্যের আদান-প্রদান তথা সংরক্ষিত তথ্যভান্ডার তল্লাশী চালানো থেকে শুরু করে বাজেয়াপ্ত পর্যন্ত করতে পারবে। অজুহাত অতি চেনা ও চর্চিত। 'জাতীয় নিরাপত্তা'র সুরক্ষা ও 'আইন শৃংখলার শাসন'কে মজবুত করার ' প্রয়োজনেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ! 'যুক্তি' জাহির করা হচ্ছে ২০০০ সালে তৈরী তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৯(১) ধারা অনুসারে এই পদক্ষেপ করা হল। এটাও দাবি করা হচ্ছে যে ৬৯(১) ধারার এক সংশোধনী এনে লোকসভার উভয় কক্ষে পাশ করিয়েছিল বিগত ইউ পি এ সরকার ২০০৮ সালে। যে সংশোধনীর জোরে কেন্দ্র তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থাক্ষেত্রে নজরদারী চালানোর  নিরঙ্কুশ ক্ষমতাশালী থাকবে, আর রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রকে সেই অনুমতি দিতে বাধ্য থাকবে। এই যুক্তিজাল বিছিয়ে মোদী সরকার নিজেকে নির্বিবাদী সাব্যস্ত করতে চাইছে। এর ফলে সবচেয়ে বিপাকে পড়ছে কংগ্রেস, কারণ থাবা বাড়াতে মোদী জমানা ব্ল্যাকমেইল করছে বিশেষত মনমোহন আমলকে, আর সাধারণভাবে তদানীন্তন ঐকমত্যে সামিল হয়ে যাওয়া সংসদীয় দলগুলোকে। মোদীর দলের হুল খেয়ে রাহুল গান্ধীর দল ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে এই সাফাই গেয়ে যে, সংশ্লিষ্ট সংশোধনীটা ইউ পি এ আমল লাগু করেছিল কেস বুঝে পদক্ষেপ করার জন্য এবং রাজ্যস্তরের সরকারের সম্মতি সাপেক্ষে । সে যাই হোক, কংগ্রেসের পেছনের কৃত সমস্যা কংগ্রেস সামলাক। কারণ, গণতন্ত্র হরণ ও নিধনে শুধু বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসকবর্গ কেন, ফ্যসিবাদী বিজেপির উত্থান-পুনরুত্থানের পেছনেও কংগ্রেসের বহু অপরাধের 'অবদান' রয়েছে।

কিন্তু প্রাক্তন মনমোহন আমলের মাশুল, আর বর্তমান মোদী জমানার আগ্রাসন আমজনতা সহ্য করবে কেন? মোদীরাজের চাপিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক আধার নথিভুক্তকরণের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে জনস্বার্থের দাবিতে চ্যালেঞ্জ সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সেখানে নয় সদস্যের বিচারকমন্ডলী সংবিধানের ২১ ধারা উল্লেখ করে মামলার রায় দেন 'আধার' ব্যক্তি পরিসরের গোপনীয়তা রক্ষার মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী, অতএব আধার নথিভুক্তকরণ কিছুতেই পালনীয় গণ্য হওয়ার নয়। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও মোদী সরকারের সদ্য জারী করা নিয়ন্ত্রণ বিজ্ঞপ্তিতে সংবিধানে প্রণীত ২১ নং ধারায় মানবাধিকার বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অথচ তারপরেও, অর্থাৎ সংবিধানের ২১ নং ধারা এবং আধার বিরোধী সর্বোচ্চ আদালতের বিচারের রায়, ব্যক্তি পরিসরের গোপনতা বজায় রাখার এই দ্বিবিধ রক্ষাকবচ থাকা সত্ত্বেও মোদীতন্ত্র বেপরোয়া। তারা এই পলিসি-পদক্ষেপটি চাপিয়ে দিচ্ছে চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা চালানোরই উদ্দেশ্যে। এ যদি ইউ পি এ আমলের মতোই ব্যবস্থা গ্রহণ হবে, তবে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারীর প্রয়োজন হয়ে পড়ল কেন ? ভারতীয় সাধারণতন্ত্রে দূরভাষে আড়িপাতার শাসক ক্ষমতা হাসিল করতে আইনী প্রবর্তনের গোড়াপত্তন হয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলের ধাঁচা অনুসরণ করে। তারপর তথ্যপ্রযুক্তি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও সেই একই ধারা চলে আসছে। আর বিজেপি জমানা এই ব্যক্তি স্বাধীনতার মূলোচ্ছেদ করতে আরও যা সব সংবিধানসম্মত গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার ধ্বংসের পন্থা নিয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ জারী সেই ধারাতেই এক মারাত্মক সংযোজন। অনুমান হচ্ছিল, তিন রাজ্যের নির্বাচনে ধরাশায়ী হয়ে বিজেপি আরও উন্মত্ত হবে, কোন বিরোধিতাকে সহ্য না করতে আরও নিপীড়নমূলক পন্থা নেবে। সেইমতোই নির্মমভাবে নামিয়ে নিয়ে আসা হল বল্গাহীন গোয়েন্দা নজরদারীর নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ। এ ফ্যাসিবাদেরই পদক্ষেপ।

খণ্ড-25
সংখ্যা-39