বিশ্বে দারিদ্র্য প্রশমনের লক্ষ্যে কাজ করে চলা সংস্থা, এন জি ও জোট অক্সফ্যাম বিশ্ব অর্থনীতির হাল-হকিকত নিয়ে প্রতি বছরই একটা রিপোর্ট তৈরি করে। সেই রিপোর্টে বিশ্বে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের আর্থিক বৈষম্যের একটা চেহারার প্রতিফলনও থাকে। এবারেও তাদের প্রকাশ করা রিপোর্টে সন্নিবিষ্ট পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, চরম আর্থিক বৈষম্যের যে ধারা নয়া-উদারবাদী জমানার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে তার কোন পরিবর্তন মোদী জমানায় তো হয়নি, উল্টে তা আরো বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান এই ধারা প্রকট করছে—জিডিপি বৃদ্ধির ভালো হারের সঙ্গে আর্থিক বৈষম্যের হ্রাসের কোন সম্পর্কনেই, বরং তা সম্পদের কেন্দ্রীভবনকেই আরো এগিয়ে নিয়ে যায়। সম্পদের কেন্দ্রীভবনের ছবিটা কি রকম? ভারতের সবচেয়ে ধনীদের ১ শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৫১.৫৩ শতাংশ, আর তাদের ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের ৭৭.৪ শতাংশ। অক্সফ্যামের গত বছরের সমীক্ষা জানিয়েছিল—সবচেয়ে ধনী ১০ শতাঠের হাতে ছিল মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ। সবচেয়ে ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ এক বছরে ৭৩ শতাংশ থেকে ৭৭.৪ শতাংশ হতে পারে একমাত্র তাদের আয় বাড়লেই। সেই বৃদ্ধিটা কি রকম? রিপোর্ট জানাচ্ছে— একেবারে ওপরের ১ শতাংশের আয় গত এক বছরে বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। আর যারা বিলিয়োনেয়ার, যাদের সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি, তাদের সম্মিলিত আয় প্রতিদিন বেড়েছে ২২০০ কোটি টাকা, শতাংশের হিসাবে যেটা ৩৫! এর বিপরীতে দরিদ্রদের আয় বৃদ্ধি হয়েছে টাকায় মাত্র ৩ পয়সা বা ৩ শতাংশ। দরিদ্রদের হাতে সম্পদ কতটা? একেবারে নীচের ৬০ শতাংশের হাতে রয়েছে জাতীয় সম্পদের মাত্র ৪.৮ শতাংশ। রিপোর্ট আরো জানিয়েছে, ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ দরিদ্র, যারা জনসংখ্যার ১০ শতাংশ তারা ঋণের শৃঙ্খলে বাঁধা, ২০০৪ সাল থেকে আজও তাদের ঋণ মুক্তি ঘটেনি। ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্যকে আরো প্রকট করে তুলছে এই পরিসংখ্যান—দরিদ্রের মধ্যে ৫০ শতাংশ বা মোটামুটি ৬৫ কোটি মানুষের যা সম্পদ, সেই সম্পদ রয়েছে মাত্র ৯ জন ধনীর হাতে!
উদারিকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়নের জমানা ভারতীয় বিলিয়োনেয়ারদের সংখ্যাকে ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। ভারতীয় বিলিয়োনারদের সংখ্যা ২০০০ সালে ছিল ৯, যা বেড়ে ২০১৭ সালে দাঁড়ায় ১০১। এবং গত এক বছরে এই শতকোটি ডলার ক্লাবের সদস্য আরো ১৮ জন বেড়ে ভারতীয় বিলিয়োনেয়ারদের সংখ্যাকে নিয়ে গেছে ১১৯-এ। এই বিলিয়োনেয়ারদের সম্পদের মোট পরিমাণও এই প্রথম ৪০০ বিলিয়নের গণ্ডি পেরিয়ে গেল। ২০১৭-এর ৩২৫.৫ বিলিয়েন ডলার থেকে ২০১৮-তে তা গিয়ে দাঁড়াল ৪৪০.১ বিলিয়ন ডলারে, ভারতীয় মুদ্রায় যা ৩১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি! অক্সফ্যাম আরো জানাচ্ছে—২০১৮ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ভারতে প্রতিদিন ৭০ জন নতুন মিলিয়োনেয়ারের (যাদের প্রত্যেকের সম্পদের পরিমাণ ১০ লক্ষ ডলারের বেশি) জন্ম হবে। অর্থাৎ, ধনীদের আরো ধনী হওয়ার ধারায় কোন যতি পড়বে না।
জনসাধারণের জন্য পরিষেবা খাতে সরকারগুলো কতটা ব্যয় করে? রিপোর্ট বলেছে, চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও জল সরবরাহে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো যে টাকা বরাদ্দ করেছে (২০৮১৬৬ কোটি, আর বরাদ্দ মানেই ব্যয় নয়), ভারতের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি, একা মুকেশ আম্বানির সম্পদের পরিমাণ তার থেকে বেশি (২ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা)। অক্সফ্যামের ইন্টারন্যাশনাল এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর উইনি বায়ানিমা ভারতীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে এই অভিমত পোষণ করেছেন যে, ‘‘গুটি কয়েক ধনী ব্যক্তি ভারতীয় সম্পদের ক্রমেই আরো বেশি অংশ সঞ্চয় করছেন আর দরিদ্ররা তাদের পরবর্তী আহার জোগাড়ের জন্য বা সন্তানদের ওষুধের দাম মেটানোর জন্য লড়াই করছেন, এটা নৈতিকভাবে অত্যন্ত আপত্তিকর।
‘‘ধনীদের ওপরতলার ১ শতাংশের সঙ্গে বাকি ভারতের এই অশ্লীল অসাম্য যদি চলতে থাকে তবে তা দেশের সামাজিক ও গণতান্ত্রিক কাঠামোটাই পুরোপুরি ধসিয়ে দেবে।’’ অক্সফ্যামের ভারতীয় সিইও অমিতাভ বেহারও প্রশাসনকে ভর্ৎসনা করে বলেছেন, ‘‘সরকার এক দিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমাচ্ছে। অন্যদিকে ধনীদের কর ছাড় দিয়ে বৈষম্য বাড়াচ্ছে। আর সেই বোঝা চাপছে গরিব এবং মধ্যবিত্তদের ঘাড়েই।’’ বেহার আরো বলেছেন, ‘‘অতি-ধনী এবং কর্পোরেশনগুলো যেন দেয় করের ন্যায্য অংশ জমা করে এবং সেই টাকা দিয়ে জন স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষা ক্ষেত্রকে শক্তিশালী করাটাকে সুনিশ্চিত করে সরকারকে যথার্থ পরিবর্তন আনতে হবে।’’
দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের পাঁচদিনব্যাপী বৈঠকের আগে অক্সফ্যামের এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির হর্তাকর্তাদের কানে এই রিপোর্টের কথা নিশ্চয়ই পৌঁছাবে। কিন্তু অর্থনীতির যে ধারাকে তাঁরা বিশ্বে চালাচ্ছেন তার অভিমুখ কি পাল্টাবে? অর্থনীতির যে ধারায় একদিকে ধনীদের সম্পদ ক্রমেই আরো স্ফীত হওয়া এবং অন্যদিকে প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল বৃদ্ধি আর স্বাস্থ্য, শিক্ষার মত জন পরিষেবা ক্ষেত্রে বরাদ্দ ক্রমেই হ্রাস পাওয়ার পরিঘটনার অবসান কি ঘটবে? অর্থনীতির ‘‘কর্মহীন বৃদ্ধি থেকে কর্মহারা বৃদ্ধির’’ গতিধারা কি পাল্টাবে? ‘‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’’ যে একটা মেকি প্রতিশ্রুতি ছিল, নোটবন্দি যে জনগণের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছিল, মোদী সরকার কি সে কথা স্বীকার করে যথার্থ জনকল্যাণের পথের কথা ভাবতে পারবে? ব্যাঙ্কে থাকা জনগণের টাকা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না করা তথা আত্মসাৎ করার কর্পোরেট সংস্কৃতিকে মদত দেওয়া তথা নির্লজ্জ কর্পোরেট তোষণ কি বন্ধ হবে? ব্যবসা-কর্পোরেট ও রাজনীতির বিপর্যয়কর গাঁটছড়া কি ছিন্ন হবে? অক্সফ্যামের রিপোর্টের শিরোনাম ছিল—‘‘জনকল্যাণ নাকি ব্যক্তিগত সম্পদ’’। এর মধ্যে প্রথমটিকে বেছে নিয়ে দ্বিতীয়টিকে খর্ব করার পথের বিবেচনা কি করা হবে? প্রশ্নগুলো তুললেও উত্তর আমরা দিচ্ছি না। কেননা, সেগুলো সবারই জানা।