বহু দিন যাবত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি সমস্ত শ্রমিকদের জন্য মাসিক ১৮,০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরীর দাবী জানিয়ে আসছে। সমস্ত শ্রমজীবী মানুষ, তাঁরা যেখানেই কাজ করুক না কেন, মাঠে-ঘাটে-খনিতে বা বনাঞ্চলে, সর্বত্রই ন্যূনতম এই হারে মজুরী দেওয়ার দাবিটা অন্যান্য বারের মতো এবারের ৮-৯ জানুয়ারি, ২০১৯-র সাধারণ ধর্মঘটে ও অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ দাবী হিসাবে সামনে এসেছে।
ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানী, যার বার্ষিক আয় ১৭ দেশের জাতীয় আয়ের থেকে বেশী, তিনি তার কন্যার বিবাহে এক রাতেই খরচ করলেন ৭০০ কোটি টাকা। আর, সেই প্রাচূর্যের কদর্য উৎকট প্রদর্শনীতে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন সেই চোখ ধাঁধানো বাহুল্যের অংশীদার হতে। এদিকে, আমাদের দেশে ঋণ জর্জর কৃষকেরা আত্মহত্যা করেন, আজও জাতীয় স্তরে ন্যূনতম মজুরীর দাবীতে শ্রমজীবী মানুষেরা পথে নামেন।
কিন্তু, এই ১৮,০০০ টাকার হিসাব কোন যুক্তিতে?
কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের গঠন করা সপ্তম বেতন কমিশন তাদের চূড়ান্ত সুপারিশে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মীদের জন্য ওই ১৮,০০০টাকা ন্যূনতম মজুরীর সুপারিশ করে। ১৫ তম ভারতীয় শ্রম সম্মেলন (ভারতীয় শ্রম সম্মেলন বা আই এল সি হচ্ছে মালিকপক্ষ-শ্রমিক ইউনিয়ন-সরকারের সর্বোচ্চ ত্রিপাক্ষিক মঞ্চ) এবং রপ্টাকস—ব্রেট মামলায় ১৯৯২ সালে সুপ্রিম কোর্ট যে নির্দেশিকা দেয় তার ওপর ৭ম বেতন কমিশন ওই ১৮,০০০ টাকা নির্ধারণ করে। তারপর, ২০১২ ও ২০১৫ সালে যথাক্রমে ৪৪ তম এবং ৪৬ তম আই এল সি ওটাকেই ন্যূনতম মাসিক মজুরী হিসাবে পুনর্ঘোষণা করে।
কেন্দ্রীয় সরকারী শ্রমিক-কর্মচারীদের সর্বভারতীয় কনফেডারেশন উপরোক্ত সুপারিশকে চ্যালেঞ্জ করে বলে যে, বর্তমানে ন্যূনতম মাসিক মজুরী ২৬,০০০ টাকা হওয়া উচিত, কারণ, আই এল সি ও সুপ্রিমকোর্ট ১৮,০০০ টাকার যে হিসাব নির্ধারণ করে তা ২০১৫ এর ভোগ্যপণ্য মূল্য সুচকের ভিত্তিতে। আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হল, ট্রেড ইউনিয়নগুলো কিন্তু ১৮,০০০ টাকা থোক বা কন্সলিডেটেড মজুরীর বদলে তা মূল্যসুচকের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি তুলেছে।
আই এল সি এবং সুপ্রিমকোর্টের সুপারিশ সমস্ত শ্রমিক- কর্মচারীদের জন্য একই হারে প্রযোজ্য। যেহেতু সকলকেই এক ই দাম দিয়ে বাজার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র কিনতে হয়, আর, ২০১৫-র পর থেকে খাদ্যসামগ্রী, পরিবহন, ওষুধপত্র জামাকাপড় সহ বিভিন্ন পরিষেবা উর্দ্ধমুখী তাই ভোগ্য পণ্য সূচকের সঙ্গেই ন্যূনতম মজুরীকে যুক্ত করার দাবী উঠেছে। ১৫ তম আই এল সি এবং সুপ্রিমকোর্ট ( র্যাপ্টাকস-ব্রেট মামলার সুপারিশ) যে ফর্মুলা নির্ধারণ করে তা নিম্নরূপ;
(১) তিন ইউনিট (২ জন প্রাপ্ত বয়স্ক ও দুই সন্তান) এর একটি শ্রমিক পরিবারের দৈনিক মাথা পিছু ন্যূনতম ২৭০০ কেলরি খাদ্য। (২) বছরে মাথা পিছু অন্তত ১৮ গজ কাপড়। (৩) নিম্ন আয়ের জন্য সরকারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউসিং প্রকল্পে নিম্নতম ঘর ভাড়া, (৩) জ্বালানি –বিদ্যুৎ অন্যান্য বিবিধ ব্যয় সমূহকে ন্যূনতম মজুরীর মধ্যে ২০ শতাংশ ধরতে হবে। (৫) শিক্ষা-চিকিৎসা-আমোদপ্রমোদ-বার্দ্ধক্যকালীন ও বিবাহ খাতের জন্য আরও ২৫ শতাংশ ধরে মোট ন্যূনতম মজুরীর হিসাব করার আদেশ সুপ্রিমকোর্ট দেয়।
বিজেপি শাসিত সরকারগুলো কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের ন্যূনতম মজুরী ১৮,০০০টাকা হিসাবে মান্যতা দিয়েছে। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে তা কার্যকরী করার প্রশ্নে এখনো এক পাও এগলো না।
মজুরীর উপর কী ধরণের আক্রমণ নামিয়ে আনছে মোদী সরকার?
ন্যূনতম মজুরী আইন, মজুরী প্রদান আইন (পেমেন্ট অফ ওয়েজেস অ্যাক্ট), বোনাস আইন, এবং সম মজুরী আইন—এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ আইনকে সংযুক্ত করে মোদী সরকার লোক সভায় ইতিমধ্যেই পেশ করেছে কোড অন ওয়েজেস বিল। ফলে, মজুরী নির্দ্ধারণের বিষয়টা এরপর থেকে শ্রম আইনের আওতার বাইরেই চলে এল।
ওয়েজ কোড বিল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর ওপরই ন্যূনতম মজুরী নির্দ্ধারণের ক্ষেত্রটাকে ছেড়ে দিল। উক্ত কোড বিল ন্যূনতম মজুরী নির্দ্ধারণের জন্য এক পর্ষদ বানাবে, কিন্তু তাদের সুপারিশ সরকারগুলো মানতে বাধ্য নয়। ইতিমধ্যে আইএলসি ও সুপ্রিমকোর্ট ন্যূনতম মজুরী নির্দ্ধারণের যে ফর্মূলা হাজির করেছে, ওয়েজ কোড সেই সমস্ত সর্বসম্মত সিদ্ধান্তগুলোকে খারিজ করে দিয়েছে। ওই মারাত্মক বিলে এমন শর্ত রয়েছে যে 'এক দিনের ধর্মঘট বেআইনী হলে অংশগ্রহণরত প্রতিটা শ্রমিকের ৮ দিনের মজুরী কেটে নেওয়া হবে। আরও একটা চরম শ্রমিক বিরোধী বিল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড বিল আইনে পরিণত হলে যে কোন ধর্মঘটই বেআইনি হিসাবে বিবেচিত হবে।
নিয়মিত বেতন প্রদানের যে বিধিসম্মত আইন রয়েছে তা ওয়েজ কোড বিল একেবারেই শিথিল করে দিয়েছে। যে আপাত কঠোর ধারাগুলো উল্লিখিত চারটে আইনে ছিল, ওয়েজ কোড তা বাতিল করেছে। নিজেদের মর্জ্জিমাফিক আইন কে ছেঁড়া কাগজে পরিনত করার অবাধ স্বাধীনতা দেবে ওই শ্রম আইন সংশোধনী।
এর বিরুদ্ধে আজ ভারতবর্ষের শ্রমিক শ্রেণি জোট বেঁধেছে। মোদী সরকারের চূড়ান্ত পতন ঘটাতে ৮-৯ জানুয়ারির ধর্মঘট এক বিরাট রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করছে।