(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮)
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলকে যেভাবেই ভাগ করুন না কেন দেখা যাবে যে তা ভারতে ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধ এবং জনগণের আন্দোলনে আত্মবিশ্বাস এবং নতুন প্রেরণা যোগাচ্ছে।
বিশেষভাবে, হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানে বিজেপির পরাজয় কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলো গৃহীত নীতি এবং তারা যে কাজ করেছে তার বিরুদ্ধেই রায়। এই রায় আবার বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী মোদীর অভেদ্য এবং অপরাজেয় হওয়ার দাবিকেও নস্যাৎ করে। ছত্তিশগড়ে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে এবং রাজস্থান তারা হারিয়েছে। যেখানে লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হয় সেই মধ্যপ্রদেশেও কংগ্রেস একক বৃহত্তম দল হিসাবে উঠে এসেছে এবং তারা সরকার গড়ার মত অবস্থায় রয়েছে।
বিজেপি অবশ্য এই নির্বাচনী পরাজয়গুলোর দায়বদ্ধতা থেকে মোদীকে আড়াল করতে চাইছে, তারা বলছে যে, সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলো এবং রাজ্য স্তরের বিজেপি নেতারা যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তার পরিণতিতেই এই ফলাফল ঘটেছে। পাঁচ মাস পরে ২০১৯-এর মে মাসে যে সংসদীয় নির্বাচন হতে চলেছে, বিধানসভা নির্বাচনগুলোর এই ফলাফলে প্রভাব ঐ নির্বাচনে পড়ার কথা অস্বীকার করতে বিজেপি বিশেষভাবে ব্যগ্র। বেশ কয়েকটা কারণেই এই দাবিগুলো শূন্যগর্ভ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
এ কথা ভোলা যাবে না যে, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলকে মোদী সরকার সম্পর্কে গণভোটের রায় বলে অমিত শাহ এবং বিজেপি বিজয়োল্লাসের সঙ্গে দাবি করেছিলেন; সেই বিজেপিই এখন কিভাবে দাবি করতে পারে যে এবারের বিধানসভা নির্বাচনগুলোর মোদী সরকারের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই? মোদী সরকারের দরিদ্রদের উপর বিপর্যয় সৃষ্টি থেকে নজর ঘুরিয়ে আলোচনা ধারাকে রাম মন্দির-মুখী করে তোলার চেষ্টা, ব্যাপক দুর্নীতির সঙ্গে তার যোগসাজশ, গণতন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর তার ধ্বংসসাধন এবং উর্জিত প্যাটেলের মত তার নিজের পছন্দের লোকজনদের কাছ থেকেই তার প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত হওয়া—এ সবই ভোটারদের কাছে সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়েছিল।
এছাড়া, মোদী নিজে এবং তার সঙ্গে অমিত শাহ ও যোগী আদিত্যনাথের মত তাঁর সাথী তারকা প্রচারকরা বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারকে রাজ্য স্তরের শাসনকার্যের বদলে জাতীয় রাজনীতি সর্বস্ব করে তুলেছিলেন (রাম মন্দির; মুসলিমদের অপদস্থ করার মত স্থানসমূহের নাম পরিবর্তন; মুসলিমদের 'অবৈধ অভিবাসী' এবং 'বিরিয়ানি-ভক্ষক সন্ত্রাসবাদী' বলে অভিহিত করা; 'আলি'র বিরুদ্ধে 'বজরংবলি'কে লড়িয়ে দেওয়া; 'শহুরে নকশাল', প্যাটেল মূর্তি এবং নেহরুকে হেয় করা)।
ছত্তিশগড়ের রায়ের মধ্যে সম্ভবত বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের রাজনৈতিক এজেণ্ডার চূড়ান্ত এবং তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্যাখ্যান রয়েছে। বুথ ফেরৎ সমীক্ষাগুলোতে ছত্তিশগড়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত ছিল, আর তাই এই রাজ্যে কংগ্রেসের বিপুল বিজয়কে একেবারেই আন্দাজ করা হয়নি। এমনকি ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী কোনক্রমে নিজের আসনটি ধরে রাখতে পেরেছেন। বস্তারে তাঁর প্রচারে মোদী নিজে 'শহুরে নকশালদের' দানব সদৃশ করে তোলেন—যা দিয়ে তিনি সুধা ভরদ্বাজ এবং অন্যান্য মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের বোঝান যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা ছত্তিশগড় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বস্তার এবং ছত্তিশগড়ের ভোটাররা প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বশংবদ সংবাদ গোষ্ঠীগুলোর প্রচার করা 'শহুরে নকশাল'-এর জুজুকে ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ছত্তিশগড়ে আদিত্যনাথ রাজ্যের খ্রিষ্টান জনগণকেও দানব রূপে তুলে ধরেন, তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন যে তারা 'রাক্ষসী রাজ' আনার জন্য আদিবাসীদের 'জোরজবরদস্তি ধর্মান্তকরণ' ঘটাচ্ছে, যে রাজকে রাম পরাস্ত করেছিলেন। ছত্তিশগড় এবং অন্যান্য রাজ্যের আদিবাসীদের হিন্দুকরণ এবং সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটিয়েছে বলে আরএসএস বড়াই করে থাকে এবং আদিত্যনাথ যখন ঘোষণা করেন যে বাঁদর দেবতা হনুমান বনবাসী আদিবাসী ছিল, তখন তিনি আরএসএস-এর এই দম্ভের ইঙ্গিত করেন। এরই সাথে ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড এবং অন্যান্য রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলো আদিবাসীদের উপর নির্মম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং লুন্ঠন চালিয়েছে। ছত্তিশগড়ের ফলাফল সংঘ ও বিজেপির সাম্প্রদায়িক-কর্পোরেট এজেণ্ডার বিরুদ্ধে আদিবাসী জনগণের সুস্পষ্ট রায়কেই দেখিয়ে দিচ্ছে।
মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান এবং তেলেঙ্গানায় আদিত্যনাথ ৭৪টি, অমিত শাহ ৫৬টি এবং মোদী ৩১টি জনসভায় ভাষণ দেন। প্রশ্নাতীতভাবে এই ৩ জনই ছিলেন এমন ব্যক্তি যাদের পার্টি নির্বাচনের কেন্দ্রীয় বার্তা প্রচারের জন্য বেছে নিয়েছিল। আদিত্যনাথ তাঁর ভাষণগুলোতে 'রাম', মন্দির এবং মুসলিমদের অপদস্থ করার ওপরই জোর দেন। আদিত্যনাথ এবং অমিত শাহ উভয়েই এই ইঙ্গিত করেন যে, কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধি হিন্দু-বিরোধী এবং মুসলিমপন্থী। অমিত শাহ যাদের 'অবৈধ অভিবাসী' (মুসলিমদের বোঝানোর সংকেতলিপি) বলেন তাদের 'কংগ্রেস সভাপতির জ্ঞাতিভাই' রূপে অভিহিত করে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উসকিয়ে তোলেন এবং তাদের ''ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বহিষ্কার করা''র প্রতিশ্রুতি দেন। মোদীর বক্তৃতাগুলোর মূল বিষয় ছিল কংগ্রেস সরকারগুলোকে এবং নেহরু থেকে রাহুল গান্ধি পর্যন্ত নেতৃবৃন্দকে আক্রমণ করা, যদিও বিমুদ্রাকরণ এবং জিএসটি-কে বিপর্যয় বলে অথবা তাঁর নিজের এবং তাঁর সচিবালয়ের ব্যাপক দুর্নীতিতে মদত দানের ক্রমেই বেড়ে চলা সাক্ষ্যপ্রমাণগুলোকে স্বীকার করতে অস্বীকার করেন।
মিজোরামে কংগ্রেসের ব্যাপক পরাজয় ঘটে এবং তেলেঙ্গানায় 'মহাকুটামি' জোট টিআরএস-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি, যে টিআরএস নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করেন। কংগ্রেস হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোতে পুনরুজ্জীবনকে তার 'হিন্দু ধর্ম বনাম হিন্দুত্ব'র রাজনীতির যাথার্থের প্রতিপন্নতা বলে ব্যাখ্যা করছে, যে রাজনীতির মধ্যে রয়েছে মন্দির পরিদর্শন এবং তাঁর হিন্দুয়ানাকে প্রমাণ করার জন্য কংগ্রেস সভাপতির ব্রাহ্মণদের 'পবিত্র সূত্র' এবং নিজের 'গোত্র'-কে জাহির করা। ঘটনা হল, গণপ্রহারে মত্ত জনতা, সংবাদ মাধ্যমের বড় অংশ এবং তার সাথে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে তার সোশ্যাল মিডিয়ার বাহিনী যে কদর্য সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে, এই সমস্ত রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনগুলো তাকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এর জন্য কৃতিত্বের বড় অংশ কৃষক আন্দোলনগুলোর প্রাপ্য, যা কৃষকদের ক্রোধ প্রকাশের এবং বিভেদমূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, দলিত-বিরোধী ও নারী-বিরোধী হিংসা এবং সামাজিক আন্দোলনের কর্মীদের 'শহুরে নকশাল' রূপে চিত্রিত করার বিরুদ্ধে লাগাতার কর্মসূচী গ্রহণের দৃঢ় এবং ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ হয়ে ওঠে।
সিপিআই(এম)-এর রাজস্থানে ২টি আসনে জয়লাভ প্রতিপন্ন করছে যে ফ্যাসিস্ট বিজেপির বিরুদ্ধে রায়ে বামেদের এবং কৃষক আন্দোলনেরও একটা অংশ রয়েছ এবং তা প্রেরণাদায়ী ও তাকে স্বাগত জানাতে হবে। রাজস্থানে নতুন গঠিত দল ভারতীয় উপজাতি পার্টির ২টি আসনে জয়লাভও উল্লেখযোগ্য এবং অভিপ্রেত ঘটনা।
এই পরাজয়ের পরিণতিতে মোদী-শাহ জুটি আরো মরিয়া হয়ে উঠবে বলেই মনে হয়—এবং সংসদীয় নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, ভারতীয় জনগণকেও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও হিংসা এবং ভুয়ো সংবাদ প্রচারের তীব্রতর অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকেও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। তবে বিধানসভা নির্বাচনগুলো মোদীর অপরাজেয়তার কল্পকথার গুঁড়িয়ে যাওয়ার এক সময়োচিত দৃষ্টান্ত—এবং তা আমাদের এই কথাও মনে পড়িয়ে দিচ্ছে যে, জনগণ লড়াই করতে পারেন এবং তাঁদের অবশ্যই তা করতে এবং জয় ছিনিয়ে আনতে হবে!